হাসান আজিজুল হক, খালাম্মা, পাখি শিকারের বন্দুক

শ্যামল— শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় কলকাতার অতিবিখ্যাত গ্রামোফোন রেকর্ড সংগ্রাহক হারুবাবুকে নিয়ে একটা গল্প লিখেছিলেন ‘গানের বাগান’ নামে। সেই গল্পে ‘আজকাল’-এর সাংবাদিক অলোক চট্টোপাধ্যায়ও ছিলেন। শ্যামল আমাকে শিখিয়েছেন কীভাবে কীভাবে পুরনো রেকর্ড সংগ্রহ করতে হয় কলকাতার চোর বাজার বা চোরা বাজার থেকে। হারুবাবুর রেকর্ড সংগ্রহও বি-ই-শা-ল। গানের রেকর্ডের বিপুল সংগ্রহ ছিল সাংবাদিক-কথাকার গৌরকিশোর ঘোষের কাছে। সেই রেকর্ডের সংগ্রহ কোথায় আছে বা কোথায় গেছে জানি না। হারুবাবুর রেকর্ড সংগ্রহও যথেষ্ট নামকরা। এছাড়া কল্যাণীর জয়দেববাবু— জয়দেব মুখোপাধ্যায়, তাঁর রেকর্ডের সংকলনও ছিল বিপুল। সেই পুরনো দিনের গালার রেকর্ড থেকে সব, বন্ধ হওয়ার আগে একেবারে শেষ দিকের ছোটো সাইজের লংপ্লেয়িং।

তুলসী লাহিড়ী— প্রখ্যাত অভিনেতা ও গাইয়ে তাঁর পুত্র হাবু লাহিড়ী এক অদ্ভুত মানুষ। হাবুবাবু মোহনবাগান ক্লাব, মোহনবাগান অ্যাথলেটিক ক্লাব-এর ফুটবল, ওস্তাদি বা কালোয়াতি গান— সবেতেই বেশ দড়। হাবু লাহিড়ী সেই অর্থে কোনো কাজ-কর্ম, চাকরি-বাকরি করেন না। ঘুরে বেড়ান যত্রতত্র। যেখানে যেখানে যান, সকলেই তাঁকে মর্যাদা দিয়ে থাকেন। কখনও কখনও কিঞ্চিৎ অর্থ সহায়তাও। হাবুবাবুর খালি পা। পায়জামা, পায়ের পাতার গাঁটের ওপর সামান্য উঁচু করে পরা। পায়জামা কখনও সুতির আবার কখনও বা টেরিকটের। পাঞ্জাবি হ্যান্ডলুমের, দুটোই বেশ কাচা, পরিচ্ছন্ন। তবে কেন যে খালি পায়ে থাকতেন হাবুবাবু, তার কোনো উত্তর পাইনি। কলকাতা শহরে এই ধরনের মানুষ যে কত কত ছিলেন, বলা মুশকিল। এঁরা ভবঘুরে ধরনের, পরাশ্রয়ী, তবে ভিক্ষুক নন কোনোমতেই। নিজের নিজের আত্মমর্যাদা সম্পর্কে তাঁরা অতিশয় সচেতন। দক্ষিণ কলকাতায় কালীঘাটে প্রায় কেওড়াতলা শ্মশানের কাছাকাছি মেজোখোকন-বড়োখোকনদের লাল নীল মাছের দোকানের সামনে, পাশে যে আড্ডা বসত, সেখানে ধুতি-শার্ট পরা একজন আসতেন। তাঁর নাম নিতাই। প্রায় সবাই তাঁকে নিতাইদা-ই বলে ডাকতেন। সেটা সত্তর দশকের প্রায় শেষ, আশির দশকের শুরু শুরু। নিতাইদার পদবি কী, জানতে পারিনি। মেজোখোকন-বড়োখোকনদের লাল-নীল-রঙিন মাছ, অ্যাকোয়ারিয়াম, মাছের খাবার— কেঁচো, ড্রাইফুড, শ্যাওলা, সাইফন পাইপ, অ্যানজেল, ফাইটার, গোরামি, সোর্ডটেল, ব্ল্যাকমলি, রেডমলি, সোর্ডটেল গোল্ড ফিশ, অ্যালবিনো গোল্ডফিশ, ল্যাকটেল, লোচ— এইসবের কেনাবেচা, তার বাইরেও এক বি-ই-রা-ট আড্ডা। মানে সন্ধেবেলায় বারো/তেরো জন তো নিয়মিত গুলতানিতে। তা নিতাইদা সেখানে আসতেন প্রায় নিয়মিত। আর এসেই কুস্তি নিয়ে আলোচনা। ফ্রি স্টাইল, গ্রেকো রোমান, গোবর গুহ— গোবরবাবু, গামা পালোয়ান, ভীমভবানী। নিতাইদাকে দেখে একেবারেই বোঝার উপায় নেই যে, তিনি কুস্তি লড়েন বা লড়তেন নিয়মিত। কারণে, অকারণে অন্যরা পেছনে লাগত তাঁর। কাঁচি প্যাঁচ, ল্যাং, ঘনাদা— ঘনশ্যাম দাস কর্তৃক কথিত ধোবিকা পাট বা ধোবি কা পাট্টা। 

নিতাইদাকে ল্যাং মারার কায়দাও দেখাতেন মেজোখোকন-বড়োখোকনদের রঙিন মাছের দোকান ঘিরে সকাল বিকেল গুলতানি করা আড্ডাধারীরা। তাঁদের মধ্যে বাপ্পাদা, বুবুদা, বিশুদা, কেদারদা, তরুণদা— এরকম আরও কেউ কেউ আছেন, ছিলেন। তরুণদা মারা গেছেন বহু বছর। বাপ্পাদা— হিরন্ময় ভট্টাচার্য আমার বড়ো মাসিমা ঊষারানি ভট্টাচার্যের মেজো ছেলে। আমাদের সবার আদরের বাবুলি— বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য, একই সঙ্গে ভারতবিখ্যাত ফুটবলার ও কোচ, সেই বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য— বাবুলির মেজদা বাপ্পাদা। আমরাও, মানে আমি অন্তত মেজদাই বলি। তো এই আড্ডায় দু-এক বার গেছি, দেখেছি দূর থেকে। নিতাইদা তাঁর বাড়ি থেকে স্ত্রী, সন্তানেরা চলে গেলে আনন্দে থাকতেন। আর সেই উচ্ছ্বাস প্রকাশ পেত মুখে। —শালারা নেই বুঝলি বাড়িতে…। এই বলে শুরু করে বাড়িতে নেমন্তন্ন করতেন কাউকে কাউকে এই মাছের দোকানের ‘ঠেক’— ‘আড্ডা ঠেক’ থেকে। ভাত, মাংস, দই। বেশ জমিয়ে পিকনিক নিতাইদার বাড়ি, ভালো মতো খ্যাটন। আর এই খ্যাট বা খ্যাটনের জন্য কোনো প্রস্তুতি লাগত না। খালি বাড়িতে বৌ, ছেলে-মেয়েরা না থাকলেই হল। তাতেই নিতাইদার মনের শান্তি। এসব কথা উঠে এল ১৯৯৮ সালে বর্ধমানের কাটোয়া থেকে যবগ্রামে এই উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আখ্যানকার হাসান আজিজুল হকের বাড়ি যাওয়ার প্রসঙ্গে। হাসান আজিজুল হক— হাসানদা রসগোল্লার হাঁড়ি হাতে ঝুলিয়ে গ্রামে ঢুকলেন। গ্রামের রাস্তায় কেউ কেউ তাঁকে চেনেন, অনেকেই চেনেন না-ও। কিন্তু পুরনো— বয়স হয়ে যাওয়া লোকজন, তাঁকে তো চেনেনই। হাসানদা গ্রামের মানুষদের— যবগ্রামের মানুষদের সঙ্গে কথা বলছেন। এঁদের মধ্যে কেউ কেউ তাঁর গ্রাম সম্পর্কে কুটুম্ব, আবার নিজের আত্মীয়স্বজন— হিন্দুরা যাঁদের জ্ঞাতি ইত্যাদি বলে থাকেন, তেমন সম্পর্কের শিকড় ও সুতো অনেক, অনেক দূর ছড়ানো।

হাসানদা বহু বাড়ির দাওয়াতেই বসলেন। কথা বললেন বুক খুলে। বাড়ির বাইরের সরু দাওয়ায় মাদুর, নয়তো খেজুর পাতায় বোনা খোলপে নয়তো তালপাতার পাটিতে বসে মুড়ি, চা। গপ্পোগাছা, কেমন আছো গো— ইত্যাদি। 

আরও পড়ুন
হাসান আজিজুল হক, গান ও গানের বাগান

এক বাড়ি তো নয়। অনেক অনেক বাড়ি। কেউ গুড় আনছে আখের, কেউ কাপে কাপে চা, কেউ বা ঘরে খোলায় ভাজা মুড়ি। সেসব মিটতে মিটতে খানিকক্ষণ সময় তো লাগলই। ইদিক ওদিক ঘুরে— বেশ অনেকের সঙ্গে কথাটথা বলে হাসানদা চললেন তাঁর বাল্য শিক্ষা যেখানে হয়েছিল, সেই কাশীশ্বরী বিদ্যালয়-এর দিকে। মহারাজা মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দীর পরিবারেরই মহারানি কাশ্বীশ্বরীর নামেই এই বিদ্যালয়। সম্ভবত কো-এড। স্কুল গেটের বাইরেও তো ছোটোখাটো ভিড়, জটলা। বেলা তখন অনেকটাই বেড়েছে, যবগ্রামের আকাশে ফট ফট করছে আলো। রোদ বেশ জোরালো। সেখান থেকে আবার হাসানদার ভিটে। তাঁদের পৈতৃক ভিটে তো আর নেই। খানিকটা ধ্বংসস্তূপ যেন, ফাঁকা উঠোন। হাসানদা আমাদের সকলকে একটু যেন চমকে দিয়েই বলে উঠলেন, ঐখানে, ঐখানে পড়েছিল শকুনটা।

আরও পড়ুন
নুসকা-টোটকা-মুষ্টিযোগ

সঙ্গে সঙ্গে আমার মনে পড়ল তাঁর লেখা অসামান্য সব গল্প— শকুন, পাতালে হাসপাতালে, আত্মজা ও একটি করবী গাছ। সব গল্পের পাতা সাজানো যেন, পর পর এসে যায় চোখের সামনে। তখনও ‘আগুনপাখি’ লেখা বাকি। ‘ঘের’ নামে একটি বেশ বড়ো গল্প তিনি লিখেছেন এর আগে। হাসানদা বরাবরই কেমন যেন বিষাদাতুর। মনখারাপের মাউথ অরগ্যান সবসময়ই যেন বাজতে থাকে তাঁকে ঘিরে। সে এক ভয়ানক বিষাদ। ডিপ্রেশন, তারপর নিজের স্ত্রী মাটির নিচে চলে গেলে এই মানুষটি যেন আরও অনেক অনেক বেশি নির্জন হয়ে গেলেন। একা। একা। ২০০০ সালে আমরা সাতজন কথাকার যখন বাংলাদেশ যাই যশোরের ফুলতলায় রবীন্দ্রনাথের শ্বশুরবাড়িতে রবীন্দ্রজয়ন্তী পালনের সময়, যার মূল উদ্যোক্তা ছিলেন— মানে আমাদের বাংলাদেশে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন তিনি হলেন ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে অদৃশ্য সাংস্কৃতিক সেতু হিসাবে দাঁড়িয়ে থাকা সুশীল সাহা। সুশীল সাহাকে সুশীলদা-ই বলি, এই সুশীলদাই উদ্যোগ নিয়ে আমাদের যাওয়ার ব্যবস্থা করেন বাংলাদেশে। আমরা যশোরের ফুলতলা থেকে রাজশাহী, তারপর ঢাকা যাই। ঢাকাতে এক রাত থাকা। সেখানে ‘শৈলী’ পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলীয় সদস্য কুয়াত সাহেব, প্রখ্যাত নাট্যকার সেলিম আলদীন, আখ্যানকার ভাস্কর চৌধুরী, এঁদের সকলের সঙ্গে ক্রমশ আলাপ জমে ওঠে। ভাস্করের সঙ্গে আমার আগে আলাপ ছিল না। অন্যদের সঙ্গে আলাপ তো ছিল নাই। ‘আজকের কাগজ’ নামের দৈনিকে তখন সাংবাদিকতার চাকরি করেন কবি ও ভাবুক শামীম রেজা। শামীম এখন জাগাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনে করে। থাকে জাহাঙ্গীরনগরেই। 

আরও পড়ুন
কালী, মহালক্ষ্মী, দীপাবলি, দিওয়ালি

আবার যবগ্রামে ফিরে আসি ২০০০ সাল থেকে ১৯৯৮ সালে। ১৯৯৮ সালের গরমে যবগ্রামে আমরা বসে আছি হাসানদার বাড়ি। মাটির দোতলা। বাঁশের সিঁড়ি নয়। মাটির সিঁড়ি। খুব নিকোনো ঝকঝকে, তকতকে। লাতা বা ন্যাতা বোলানো যাকে বলে। হাসানদার খালা— মাসি— মাসিমা— খালাম্মা রঙিন সুতির ছাপার শাড়িতে নিজের মাথা ঢেকেছেন। হাসানদার খালুর ফাটা গোড়ালি দেখে গত সংখ্যাতেই লিখেছিলেন আমার মনে পড়ে গেছিল আমার বন্ধু শ্যামল— শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের একটি অমোঘ বাক্য। শ্যামল বলেছিলেন, মোরারজি দেশাই আর কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত এবং সঙ্গীতশিল্পী রাজেশ্বরী দত্ত, এঁদের গোড়ালি খুব কাছ থেকে দেখেছি। একদম খোসা ছাড়ানো নৈনিতাল আলু যেন। তারপর তিনি শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের সমসাময়িক এক বিশিষ্ট বাংলা লেখকের— মানে বাংলা সাহিত্যের এক বিশিষ্ট লেখকের নাম করে বলেছিলেন, তোমরা বলো, অমুক কৃষক আন্দোলন করেছেন ভাগচাষি আধিয়ার, ভূমিহীন ক্ষেতমজুর— এঁদের নিয়ে। বঙ্গীয় কৃষকসভার সঙ্গেও নাকি তাঁর যোগাযোগ ছিল তোমরা বলো, তো সেই লেখকের গোড়ালিও কিন্তু খোসা ছাড়ানো গোল নৈনিতাল আলুই যেন, যেমন মোরারজি ভাই দেশাই, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত আর সুধীন্দ্রনাথের রূপময়ী স্ত্রী, অসামান্য রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী, পাঞ্জাব তনয়া রাজেশ্বরী দত্ত। শ্যামল— আমার বন্ধু শ্যামল, সেই কৃষক আন্দোলন করেছেন, ভাগচাষি, গরীব কৃষক, ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে সংগঠন করেছেন, এমন দাবি তোলা লেখকটি সম্বন্ধে বলেছিলেন, ওর গোড়ালি দেখেছ? একদম খোসা ছাড়ানো নৈনিতাল আলু যেমন, তেমনই। শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের সেই মূল্যবান কথাটি আজও মনে আছে। ভূমিহীন, গরিব চাষিদের নিয়ে সংগঠন করতে গেলে, তখন তো তাঁর গোড়ালিটি— মানে বাঁ ও ডান পায়ের গোড়ালি ফাটা-চটা, হাঁ মুখঅলাও কখনও, ফেটে গিয়ে আর সেই হাঁ করা মুখের ভেতর মাঠের জল-কাদা, কালিধূলি।

আরও পড়ুন
লক্ষ্মীর পাঁচালি, তারকেশ্বর…

হাসানদার খালাম্মা— মাসি সেদিন হাসানদাকে দেখেই মুখে ছাপা শাড়ির আঁচল চাপা দিয়ে আনু, আনুরে-বলে ফুঁপিয়ে উঠলেন। আনু হাসানদার ডাক নাম। আজ থেকে কমবেশি তেইশ বছর আগের বর্ধমান, কাতোয়া, যবগ্রাম। হাসানদার খালাম্মা— মাসিবাড়িতে দুপুরে আমরা মুড়ি খেলাম। ঘরে খোলায় ভাজা মুড়ি। ইউরিয়া ছাড়া। মুড়ির চাল, লোহার কড়াই, বালি, মুড়ো খ্যাংরা বা ঝাঁটা। উনোনের ওপর বসিয়ে নাড়াচাড়া। গত তিন দশকে বহু গ্রামে মুড়ি তৈরির মেশিন— কল বসেছে। ছোটো ছোটো জায়গাতেই হয়ে যায় এই মুড়ি ভাজা কল। তারকেশ্বর লাইনের হরিপালে ১৯৯০ সালে আমি এই মুড়ির তৈরি কল দেখি। হাসানদার খালাম্মা আমাদের ঘরে ভাজা মুড়ি দিলেন। সঙ্গে ঘুগনি, পেঁয়াজ কুচো, কাঁচা লঙ্কা, গুড়। একটু ঝোলা ধরনের এখো— আখের গুড়। খালাম্মা এবার লোহার ভারি ট্রাঙ্কের পেতের ভেতর থেকে বার করে আনলেন একখানা ভাঁজ করা সাদা কাগজ। একটু মোটা, চার ভাঁজ, তাতে পায়ের ছাপ। কচি পা— খালাম্মার অতি আদরের আনুর পায়ের ছাপ এই কাগজের ওপর।

মাসি কাঁদছেন। হাসানদার চোখে জল। দু চোখে জল আমাদেরও। আমরা জমিয়ে মুড়ি, ঘুগনি, পেঁয়াজ কুচো, লঙ্কা কুচি দিয়ে খাই। ঝালে উসআস করি। তারপর কলাইয়ের বাটিতে এখো— আখি বা আখের গুড়। একটু ঝোলা টাইপ ছিল, ফলে চুমুক দিয়ে দিয়ে, তারিয়ে তারিয়ে খাই। হাসানদা সেই কাগজের ওপর যে পা ছাপ, তার দিকে তাকিয়ে থাকেন। তাকিয়েই থাকেন।

এর পর তো আরও এক ইন্দ্রজাল শো। তোরঙ্গ, ট্রাঙ্ক বা প্যাঁটরার ভেতর থেকে একটি ফোটোগ্রাফ বার করলেন তিনি, সাদা-কালো কিন্তু বেশ উজ্জ্বল। দাগদাগ, পোকায় কাটা— এমন কোনো সমস্যাই নেই। সেই ফোটোগ্রাফে হাসানদা— হাসান আজিজুল হক সকেশ। হ্যাঁ, মাথা ভর্তি কালো চুল। ঢিলে— বড়ো ঘেরের সাদা পায়জামা আর সেইসঙ্গে সাদা আদ্দির পাঞ্জাবি। হাতে বন্দুক। বন্দুক হাতে পাখি শিকারে গেছেন তিনি। সঙ্গে অনেক দলবল। হাসানদা সেই ছবিটা হাতে নিলেন। কবে যেন বিল বা জলায় গেছিলেন পাখি মারতে, বন্দুক হাতে। শীতে যেই জলাভূমিতে নেমে আসে বলি হাঁস অনন্তের পথ ধরে। তার দিক— তাদের দিকে ঝাঁকে বন্দুক তাগ করে ছররা দেগে দেওয়া। ঝাঁকের পাখি গুলি লাগলে পড়ে আর মরে। সেই পাখির মাংস খালপোষ করে— পালক ফেলে ছাড়িয়ে, আধমরা পাখি হলে চাকু দিয়ে ঠিকঠাক হালাল করে নেওয়া। হাসানদা এই ছবির মধ্যে বসে। গ্রাম সমাজের অনেকেই ছেলেপিলেরা দাঁড়িয়ে। হাসানদার পাশে, পেছনে। হাসানদা কেমন যেন বিহ্বল হয়ে তাকিয়ে ছিলেন। হয়তো একটু বিহ্বলও তিনি ছবি দেখার পর। খানিকটা কিংকর্তব্যবিমূঢ় যাকে বলে। আমাদের সঙ্গে অ্যামবাসাডারে একটি গডরজব্দ পত্রিকা সম্পাদক, তিনি আবার তাঁর সেই পত্রিকাকে লিটল ম্যাগাজিন বলেন, আসলে তা তাঁর রোজগারের রাস্তা। তো সেই অসৎ সম্পাদক সঙ্গে সঙ্গে সেই ছবিটা প্রায় ছোঁ মেরে, তুলে নিয়ে বললেন, এটা আমার কাছে থাক। আমি হাসানদার ওপর একটা সংখ্যা করব। হাসানদাও চোখ ইশারায় তাঁর খালাম্মাকে বললেন, থাক, নিক। খালাম্মা তাঁর আদর-পেয়ারের আনুর কথার আর প্রতিবাদ করতে পারলেন না। করলেন না-ও। মসজিদে আজান হয়ে গেছে নামাজের জন্য। নামাজ আদায়ের ডাক। জোহরের নামাজ। দূরে কোথাও মোরগ বাং দিল কী? ডেকে উঠল মোরগ? নাকি এসবই আমার বিভ্রম? খালু মাটির দোতলা— মাঠখোঠার দোতলা থেকে আরও খানিকটা ওপরে ওঠার জন্য বাঁশের মই ব্যবহার করলেন। আরও ওপরে হয়তো আরও কিছু আছে। আমরা দেখছি দূরে রোদ নামছে নিজের স্টাইলে। চারপাশে তেমন কোনো শব্দ নেই। খালাম্মা আবার তাঁর মুখে ছাপা শাড়ির আঁচলটি চাপা দিয়ে কেন যেন ফুঁপিয়ে উঠলেন।

Powered by Froala Editor