মার্কনি সেট, রঘুবাবু ও মহালয়া

মুছে যায়? — ৬৩
আগের পর্বে

ইলাহাবাদের লোকজন সম্পর্কে কহাবত— ‘প্রচলিত কথা ইলাহাব্দী/ বড়ি ফাসাদি’। লাঠি, ছুরা— পিস্তলের ব্যাপার আছে, ছিল। ইলাহাবাদে প্রবল দাপট ছিল পুলিশেরও। কারণে, অকারণে রিক্সাওয়ালা, টাঙ্গাওয়ালাদের নিগৃহীত করতেন তাঁরা। ইয়ারদোস্তকে 'বে' সম্বোধনের প্রচলন ইলাহাবাদেই। কথাটা খুব একটা শোভন নয় একেবারেই। ষাট-সত্তর দশকে সেখানে ঘরে ঘরে ভাঙের নেশা। ভাঙ কা গোলা নিয়ে ‘বুত্’ হয়ে ঝিমিয়ে থাকে গোটা শহর। তবে এসবের মধ্যেও ইলাহাবাদে একছত্র প্রভাব ছিল বাঙালিদের। তারপর...

আমার বাবা অমরনাথ রায় ১৯৫৩ সালে রঘুবাবু নামের এক রেডিও বানিয়েকে দিয়ে একটি অলওয়েভ মার্কনি সেট বানিয়েছিলেন দুশো টাকা খরচ করে। সেই রেডিওর ভেতর কাঁটা, দুপাশে দু দুটো আলো, চমৎকার পালিশ করা কাঠের ক্যাবিনেট। বাইরে দু দুটো নয়, চার চারটে নব, সেই নব ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কাঁটা চালিয়ে চালিয়ে সেন্টার ধরা। রঘুবাবু ছিলেন বেশ কালো, সামান্য ভুঁড়িদার, কিন্তু বাকিটা স্টাউট, ব্যাকব্রাশ করা কালো চুল, নারকেল তেল দিয়ে পাট পাট করে বসানো, তাঁর চোখে চশমা, নাকের নিচে সরু গোঁফ। আমার পিসিমার বাড়ি চেতলার ৪০/১ জয়নুদ্দিন মিস্ত্রি লেন, আসলে সাধারণ জনের মুখে মুখে জয়নুদ্দিন, প্রকৃত উচ্চারণ জৈনুদ্দিন, সেই বাড়ির একতলায় তিনটে ঘর আর একটা চানঘর, পায়খানা নিয়ে ভাড়া থেকতেন দু ভাই— সুধা ও সুফল। সুধা বড়ো, সুফল ছোটো। সুধাকে বড়ো কাকাবাবু বলে ডাকত আমার পিসতুতো ভাই-বোনেরা। সুফলকে ছোটো কাকাবাবু। সুধার সঙ্গে মানে তাঁর প[অরিবারে স্ত্রী আর তিন কন্যা— সুর্গা, অণু, ছানু। এক পুত্র বাহুবিকাশ সেইসঙ্গে সুধার মা এবং মাসি। এই মাসিকে সবাই ‘দিদো’ বলে ডাকেন। সুফলের তিন ছেল, দুই মেয়ে। প্রথম পক্ষে তপন, বুলা বা বুলে, শিবানী। বুলা ব্যায়াম করে। দ্বিতীয় পক্ষে নাড়ু, পুণ্যি— পূর্ণিমা। এই নিয়ে গিজগিজে সংসার। বড়ো কাকাবাবু— সুধা চাকরি করতেন সেইসঙ্গে রেডিও মেকানিক। সারানো, তৈরি করা। তাঁদের এজমালি ঘরের ভেতর বড়ো চৌকিতে সাজানো প্লাস, ফিউজের তামার তার, তাঁতাল, ছুরি। বাড়িতে থাকলে দিন রাত কাজ করতেন সুধা দাস— বড়ো কাকাবাবু। তিনি চমৎকার তরমুজ দিয়ে শরবত তৈরি করতে পারতেন। বড়দি— দীপালিদির বিয়ের পাকা দেখা হয়েছিল গরমে। সেই অনুষ্ঠান উপলক্ষে তারকেশ্বরের পাকা তরমুজ দিয়ে শরবত বানিয়েছিলেন বড়ো কাকাবাবু। তরমুজের রসের সঙ্গে চিনি আর বরফ। বরফ তখন এক টাকা সের বা কিলো। কাঠের গুঁড়ো জড়ানো বরফ পাওয়া যায় কালীঘাট বাজারের কাছে। ব্যাগে করে নিয়ে আসতে হয়। থাক সে সব কথা। এই সুধা দাস— বড়ো কাকাবাবুর ঘরে ঢুকলে আঠা— সলিউশানের মিষ্টি মিষ্টি গন্ধ। রেডিওর বিভিন্ন পার্টস ইত্যাদি জোড়াতাড়া দেওয়ার কাজে ব্যবহার করা আঠা ঘ্রাণ। সেই ঝিমঝিমে গন্ধটা বেশ লাগত আমার। এখনও লাগে। ছেলেবেলার ফড়িং-স্মৃতি ফিরে ফিরে আসে। ন্যাপথলিন, কাঁচা পেট্রল, র কেরোসিন— সবার গন্ধই বড়ো প্রিয়, এখনও। কেরোসিনের গন্ধ অবশ্য এখন আর পাওয়া যায় না। ব্যবহারই তো নেই প্রায়। রান্নাঘর বা মডিউলার কিচেনের চিমনি পরিষ্কার করা ছাড়া। রঘুবাবু ছিলেন বড়ো কাকাবাবুর ‘গুরু’ রেডিও লাইনে। বড়ো কাকাবাবুই পার্টস অ্যাসেম্বল করিয়ে আমাদের বাড়ির বড়ো মার্কনি সেট— অলওয়েভ সেটটি তৈরি করাতে বলেন, রঘুবাবুকে দিয়ে। বাবা তা করিয়েও ছিলেন। বড়ো কাকাবাবু অমরনাথ রায়কে বলেছিলেন, মামাবাবু, তুমি এই রেডিও ওখান থেকে বানিয়ে নাও, রঘুদা সব করে দেবে। হাওড়ার কদমতলায় ছিল রঘুবাবুর কারখানা। সেই সেট বাবা কীভাবে এনেছিলেন, আমার জানার কথা নয়। কারণ, আমার জন্ম ১৯৫৩ সালে ৬ নভেম্বর। সে বছরই বাবা বালি শান্তিরাম রাস্তায় জমি কিনেছিলেন ছশো টাকা কাঠায়। হ্যাঁ, পিচ রাস্তার ওপর, কর্নার প্লটের জমি। মায়ের লক্ষ্মীর ভাণ্ডারে— মাটির ব্যাঙ্কে জমানো শ দুই টাকা দিয়ে এই জমি বায়না করা হয়েছিল। কমবেশি সোয়া দু কাঠা জমি। এক কাঠার দাম ছশো টাকা। ছশো। সব মিলিয়ে হাজার দেড়েক টাকা হয়তো ১৯৫৩ সালে। জমি রেজিস্ট্রি হয় আমার জন্মের পর। খুব ছোটো আমি তখন। হাওড়া কোর্ট, হলদেটে দেওয়ালঅলা একটা বাড়ি। কাচের শো কেসের ভেতর বড়ো বড়ো সাদা রসগোল্লা। সেই রসে মাছি। বাবা বোধ হয় দলিল তুলতে গেছিলেন জমির, মা আর আমাকে নিয়ে। সে ছিল কোনো এক গ্রীষ্মদিন। রঘুবাবুর তৈরি মার্কনি সেট রেডিওতে দারুণ সাউন্ড। মনে হয় বক্স বাজছে। ফুল ভলিউমে দিলে গমগম করে ওঠে সমস্ত পাড়া প্রায়। ভেতরে বাঘের মাথার সাইজের স্পিকার। একবার তো নেংটি ইঁদুর ঢুকে, ভেতরে বাসা করে, কেটেকুটে তছনছ করে দিল রেডিও। মানে রেডিওর ভেতরকার কাঁটা ঘোরাবার মুগার মোটা সুতো। তখন তো রেডিও রিপেলার করতে রঘুবাবু। কদমতলায় তাঁর রিপেয়ারিং সেন্টার। বাবা শিবপুর বেতাইতলা থেকে নীলসাদা বিছানার চাদরে বড়োসড় মার্কনি সেটটিকে, অন্তত দু হাত লম্বা, দেড় হাত উঁচু সেই সেট। তার সামনে বাহারি সিল্কের কাপড়, হালকা ঘিয়ে রঙের। 

তখন তো বাজারে অনেক অনেক রেডিও। ফিলিপস, জিইসি, এইচএমভি, নেলকো, মারফি। ব্যাটারির রেডিও— ট্রানজিস্টার আসব আসব সময় সেটা। আসলে আমরা আমাদের রেডিওটাকে বিছানার চাদর মোড়া না রেখে এমনি রেখেছিলাম ভাড়া বাড়ি পাল্টে— মানে পাল্টাবার পর, নতুন ভাড়া ঘরের কোণে। আসলে তখনও ইলেকট্রিক বিল ব্যাপারে কথা হয়নি। তখন সেখানে ইঁদুর— ইঁদুরের বাসা। সাধারণত ‘ধোপার কাপড়’ যেভাবে নিয়ে যান বোঁচকা বেঁধে রজকেরা, বাবা প্রায় সেই ভাবে মার্কনি সেটটিকে নিয়ে এলেন রঘুবাবুর কদমতলার রিপেয়ারিং সেন্টারে। আমিও তো গেছি বাবার সঙ্গে। রঘুবাবু ঠিকঠাক সারিয়ে দিলেন রেডিও সেটটি। তাঁর বেশ বড়ো, ঢেউ টিন ঘেরা রেডিও রিপেয়ারিং হাউসেও পেয়েছি ৪০/১ জয়নুদ্দিন বা জৈনুদ্দিন মিস্ত্রি লেনে পিসিমার বাড়ির একতলায় সুধা দাস— বড়ো কাকাবাবুর একমাত্র ঘরে ভেসে থাকা আঠা বা সলিউশানের ঝিমঝিমে ঘ্রাণ। ‘ফেভিকল’, ‘ডেনড্রাইট’, ‘কুইক ফিক্স’ ইত্যাদি স্বপ্নের বাইরে। সলিউশানই তখন সব। বেশ ঘোর ঘোর অন্ধকার সেই রিপেয়ারিং সেন্টারে। একটা মাত্র হলুদ আলো ছেটানো ষাট পাওয়ার হবে না, হয়তো চল্লিশ পাওয়ারের বাল্ব ছিল সেটা। তার ফিলামেন্ট ঘিরে বিদ্যুৎ। আলো। 

রঘুবাবু রেডিও সারিয়ে দিলেন সাত দিনের মাথায়। সেই রেডিও ঘাড়ে নিয়ে বাবা আবার বাড়ি— ভাড়া বাসায় ফিরলেন, শিবপুরের বেতাইতলায়। সঙ্গে আমি। সেবার মূষিকমুক্তি মানে নেংটি ইঁদুরদের বাসা থেকে অলওয়েভ সেট— মার্কনি সেটটিকে মুক্ত করার পর আবার যখন আমরা পাঞ্জাব লরিতে সংসারের সমস্ত ‘মাল’— অ্যাঁকোঢ্যাঁকোসহ লাদাই করে বালিতে এলাম গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্যের ৯৭ নম্বর গোস্বামী পাড়া রোডের একতলায়, তখন সে বাড়িতে ইলেকট্রিক আলো নেই। বিদ্যুৎ নেই, ফলে রেডিও-ও নেই। ইলেকট্রিক রেডিও তো, ইলেকট্রিক ছাড়া চলে না। তখন পায়ের পুরনো সুতি শাড়ি মোড়া এই রেডিও সেট। না চালাতে পারার বড়ো সেটের ভেতর নেংটি ইঁদুর ঢুকে পড়ে ও ছানাপোনাসহ সেখানে তাদের বাড়বৃদ্ধি। তাণ্ডব। নেংটিরা কেটে ফেলল আবার সেই ভেতরে থাকা মুগার সুতো। ইলেকট্রিক আলো জ্বলা লম্বাটে বাল্বটি ফিউজ হয়ে গেল। সেই মার্কনি সেট— অলওয়েভ সেটের ভেতর নেংটি পরিবার। নেংটি বাবা, নেংটি মা। ঘুণ ধরল রেডিও সেটের বার্নিশ করা কাঠের ক্যাবিনেটে। বাবা সেই ঘুণ-গর্ততে পুটিং মারলেন, নিজে। তারপর আবার ৯৭ নম্বর গোস্বামী পাড়ার গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্যের বাড়ি থেকে পুনরায় হাওড়া কদমতলায় রঘুবাবুর রেডিও রিপেয়ারিং সেন্টারে। তখন আমি ছয় প্লাস। বালিতে এসেছিলাম প্রাক গ্রীষ্ম দিনে। হয়তো মার্চে। মা তখন সম্ভবত চার-পাঁচ মাসের প্রেগনেন্সিতে। পরবর্তীতে তিনি আবার দ্বিতীয়বার জননী হলেন। আমার থেকে ঠিক সাত বছরের ছোটো একটি ভাই জন্মাল। এরপর সেই মার্কনি সেট ৬৭ নম্বর গোস্বামী পাড়ার ভাড়া বাসা থেকে ১৯৬২ সালের বৈশাখে অক্ষয় তৃতীয়ার দিন ৫৯/১৩ শান্তিরাম রাস্তার বাড়িতে। নিজেদের বাড়ি। একতলায় সেই মার্কনি সেট। 

বাবার খুব শখের ছিল সেই রেডিও। তাতে তিনি নিয়মিত খবর শুনতেন। এসব কথা বলা এই জন্য মহালয়ার ঠিক আগে আগে বাবা রেডিওটা ঠিক আছে কিনা, তা দেখে নিতেন। কলকাতা বা মফস্বলে ইলেকট্রিক রেডিও— অলওয়েভ সেটের অ্যানটেনা নয় এরিয়াল লাগত। বাবা সেই এরিয়াল খাটাতেন ভাড়াবাড়ির ছাদের ওপর একটি সরু বাঁশের মাথায় তার লাগিয়ে। সেই তারে বেকায়দায় কাক বসলে, উড়ন্ত কাটা ঘুড়ি চেত্তা খেতে খেতে এসে মেসে গেলে এরিয়ালের ঘড়ঘড়ানি। ফলে রেডিও সম্প্রচারে অসুবিধে। 

আরও পড়ুন
‘ইলাহাবাদী বড়ি ফাসাদি’ নয়

আমার রেডিওপ্রেমী বাবা নিয়মিত খবর শুনতেন— ‘আকাশবাণী কলকাতা’, এখন খবর পড়ছি নীলিমা সান্যাল…। আজকের বিশেষ বিশেষ খবর হল…।’ ‘আকাশবাণী কলকাতা— খবর পড়ছি অসিতভূষণ দাস, আজকের বিশেষ বিশেষ খবর হল…।’ ‘আকাশবাণী কলকাতা— খবর পড়ছি ইভা নাগ— আজকের বিশেষ বিশেষ খবর হল…।’ এভাবেই খবর শুনতেন বাবা, বাড়ি থাকলে। কখনও কখনও লতিকা রত্নমের গলায়, ‘দিস ইজ অল ইন্ডিয়া রেডিও…। হিয়ার ইজ দ্য নিউজ বাই লতিকা রত্নম…’ কলকাতা খ-এ সেই খবরের সম্প্রচার। বাবা রবিবার রবিবার সকাল নটা থেকে সাড়ে নটা ‘সঙ্গীত শিক্ষার আসর’ শুনতেন। যা পরিচালনা করতেন পঙ্কজকুমার মল্লিক। সেটা ষাটের দশক। এর বহু বছর পর সুচিত্রা মিত্র কিছুদিন পরিচালনা করেন ‘সঙ্গীত শিক্ষার আসর’। সকাল নটা থেকে সাড়ে নটা— এই প্রচারের পর ইন্দিরা দেবী— ইন্দিরাদির পরিচালনায় ‘শিশুমহল’। ইন্দিরা দেবীর মোহক গলায়, ‘ছোটো সোনা বন্ধুরা ভাই, আদর আর ভালোবাসা নাও। কী ভাল আছো তো সব?’ সঙ্গে সঙ্গে সমস্বরে রেকর্ড করা সব কচি-কণ্ঠ— ‘হ্যাঁ-অ্যাঁ-হ্যাঁ-অ্যাঁ-অ্যাঁ-অ্যাঁ।’

আরও পড়ুন
ইলাহাবাদ— পুরানা কাটরা ও অন্যান্য

এই প্রত্যেকটি আসর-এর আলাদা আলাদা শুরু আর শেষের সুর ছিল। একই টিউন। মনে আছে পঙ্কজকুমার মল্লিক একটি সংস্কৃত শ্লোক সুরে উচ্চারণ করে তাঁর পরিচালনায় ‘সঙ্গীত শিক্ষার আসর’ শুরু করতেন। আমি রবিবারের ‘শিশুমহল’, সোম থেকে শনি ‘বিদ্যার্থীদের জন্য’, ‘গল্পদাদুর আসর’, মজদুরমণ্ডলী, ‘পল্লীমঙ্গল আসর’, শুক্রবারের নাটক— রাত আটটা থেকে, তার জন্য উদগ্রীব থাকতাম। সেইসঙ্গে প্রতি শুক্রবার শুক্রবার বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের মহাভারত থেকে পাঠ। তাঁর কণ্ঠে ‘নহুষ’ উচ্চারণটি মনে আছে আজও। প্রতি রবিবার রবিবার বেলা দেড়টা থেকে বীরূপাক্ষের রস রচনা পাঠ করতেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। বীরূপাক্ষ তাঁর ছদ্মনাম। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রর এক ছেলে চাকরি করতেন ‘যুগান্তর’-এ, সাব-এডিটর। 

আরও পড়ুন
কোম্পানি বাগ, আলফ্রেড পার্ক

বাবা রেডিও ঠিকঠাক আছে কিনা দেখে নিতেন মহালয়ার আগের রাতে, অথবা সকালেই, তাঁর যেমন ডিউটি থাকত। রেলের তো শিফটিং ডিউটি। একটা সময় প্রতি বৃহস্পতিবার ছিল তাঁর অফ ডে। পরে তা রবিবার হয়ে যায়। তিনি ছিলেন কেবিন এ এস এম— হাওড়া রুট রিলে কেবিনে। বাবা মহালয়ে শুনতেন নিয়ম করে, মা, আমরাও। তিনি শুধু মহালয়ার দিন গঙ্গায় গিয়ে নয়, বাড়িতে তর্পণ করতেন, রোজ— সমস্ত পিতৃপক্ষজুড়ে। কৃষ্ণ তিল, গঙ্গাজল, তামার বড়ো কোষাকুষি। সব মিলিয়ে পূর্বপুরুষ, পূর্বনারীদের গঙ্গোদক ও কৃষ্ণ তিল দেওয়া। তাঁর ডিউটি ছিল সপ্তাহে দুদিন মর্নিং, দুদিন ডে, দুদিন নাইট। মর্নিং ডিউটিতে বাবা বেরতেন ভোর সাড়ে ছটায়। ডে ডিউটিতে বারোটায়। আর নাইট ডিউটিতে পৌনে আটটায়। আমাদের শান্তিরাম রাস্তার বাড়ি থেকে হেঁটেই যেতেন বেলুড় স্টেশন। তারপর লোকাল ট্রেনে হাওড়া স্টেশনে পৌঁছে যাওয়া। মাঝে একটি মাত্র স্টেশন লিলুয়া। বাবার মান্থলি ছিল। রেল চাকুরে হিসাবে কনসেশন পেতেন। বেলুড় থেকে হাওড়া মান্থলি দেড় টাকা, ষাটের দশকে। তখন তিন মাসের কোয়ার্টারলিও ছিল। বাবা মান্থলি কাটলেও মান্থলি শো করতেন না সব সময় হাওড়া স্টেশনের চেকিং স্টাফ— টিসিদের। তাঁরা অনেকেই মুখ চিনতেন তাঁর। বাবা খুব চাপা গলায় রেলস্টেশনের গেট পেরনোর সময় বলতেন ‘স্টাফ’। ব্যস, ওতেই যথেষ্ট। কী অমোঘ যে সেই ‘স্টাফ’ শব্দটির উচ্চারণ। বাবার মর্নিং ডিউটি থাকলে ভোরে উঠে মন্ত্র পাঠ করতেন। তর্পণ-মন্ত্র, তিলাঞ্জলির মন্ত্র। পিতৃমাতৃতর্পণ। সেইসঙ্গে পিতৃকূলের সাতপুরুষ, সপ্তনারী। আর মাতৃকূলের তিন পুরুষ, সেই সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের নারীরা। কেন এই ভেদরেখা বুঝি না তখন। পরে পুংতন্ত্রের থাকা লক্ষ করি এখানেও। থাক সে সব বাক্যি। বাবা খুব ভোর ভোর উঠে আমাদের বালির বাড়ির উঠোনের থেকে যে জবা গাছ, সেখানে ফুটে ওঠা পঞ্চমুখী জবা, বাবা সেখান থেকে ফুল তুলে এনে আমাদের পশ্চিমদিকের নোনা ধরা দেওয়ালে টাঙানো ক্যালেন্ডার কেটে, কাচ বাঁধানো দুর্গার ছবির ওপরে অন্তত তিন-চারটে, পাঁচটা জবা, ঐ পশ্চিমদিকেই মায়ের ঠাকুরের তাক। সেখানে বাবার কাশী থেকে কিনে আনা অন্নপূর্ণা মূর্তি, যা পেতলের, ভারী সুন্দরও, হঠাৎ মাটিতে পড়ে শুঁড় ভাঙা পাথরের গণেশ, তার রঙে ঘোলা গঙ্গাজলের রং। মায়ের চেনা অচেনা চিহ্নে বিবর্ণ। পাশেই গাছ কৌটো। তার ভেতর সিঁদুর আর একটা আস্ত রুপোর টাকা। বাবার সেই সাধের মার্কনি সেট, দু ট্রাঙ্ক কাঁসা-পেতলের বাসন, তার মধ্যে মা-বাবার বিয়েতে পাওয়া দানের বাসন, ঠাকুর্দা— অম্বিকানাথ রায়ের পান রাখার গোল ডিবে, যা ভরণের তৈরি, কোজাগরি লক্ষ্মীপুজো, সরস্বতী পুজোর বাসন, পরাত, জোড়া পিলসুজ আর পুষ্পপাত্র— টাট, তামি— কোষার জল ফেলার জায়গা, যা নিয়ে বাবা তর্পণে বসতেন, একটা চামড়ার তৈরি পুরনো ব্যাগে অনেক অনেক, নানা ধরনের পুরনো তামার পয়সা, দেশের বিদেশেরও কিছু— সব একেবারে লোপাট ২০০৪ বা ২০০৫-এ। সব ছিল বালির— বালির ৫৯/১৩ শান্তিরাম রাস্তার এক তলায়, কালো ট্রাঙ্কের ভেতর। বন্ধ ঘরের তালা ভেঙে চুরি। আলমারি, চেয়ার, টেবল, পরে জানলা দরজার পাল্লা— সব চুরি। সব নাকি চুরি হয়ে গেল। যাদের ওপর ভরসা ছিল ঘর-বাড়ি রক্ষার, তারা কী করল জানি না।

আরও পড়ুন
তাড়বান্না ইলাহাবাদ কোম্পানি বাগ

বাবা মহালয়ার ভোরে উঠে জেগে থাকতেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র, বাণীকুমার আর পঙ্কজকুমার মল্লিকের সার্বিকভাবে মেধা আর হৃদয়ের সংমিশ্রণে গড়ে ওঠা ‘মহিষাসুর মর্দিনী’-তে। কত কত বছর হয়ে গেল। প্রতি বছর তর্পণ করতেন বাবা তাঁর না দেখা পিতৃদেব— আমার ঠাকুর্দা— অম্বিকানাথ রায়ের সঙ্গে দুর্গানাথ রায়, হরিনাথ রায়, কালীনাথ রায়েদেরও। আমি তর্পণে থাকি না কোনো বছরই কিন্তু তর্পণের মন্ত্র বড়ো সুন্দর মনে হয় আমার কাছে। বাবা যখন করতেন তর্পণ কানে আসত সেই তিলাঞ্জলির মন্ত্রযান। তার অর্থ, বিষয় বড়োই শোক মিশ্রিত, মধুরও।

Powered by Froala Editor