কোম্পানি বাগ, আলফ্রেড পার্ক

তালকে গোবলয়ে— হিন্দি বলয়ে বলে তাড়। তাড় থেকেই সম্ভবত তাড়ি। বঙ্গদেশে যার নাম ‘তেলো তাড়ি’। এসব তো লিখেছি আগেও। খেজুর গাছের রস থেকেও তাড়ি তৈরি হয়। খেজুর গাছের পুরুষ ও নারী— এই দুই বিভাগ আছে বলে জানি। নারকেল বা তাল গাছের পুং, স্ত্রী আছে বলে শুনিনি। তবে পেঁপে গাছের মদ্দ বা মদ্দা এবং মাগি আছে। ‘মাগি’ শব্দটি এখানে অগৌরবের নয় কোনো। শ্রীরামকৃষ্ণ অনায়াসে মাগি-মিনসে, মদ্দ-মদ্দা উচ্চারণ করতেন। ব্রাহ্ম কালচার— আদি, নববিধান, সাধারণ— সবেতেই খানিকটা যেন ইউরোপের অনুকরণ। এইসব কালচার ফালচার নিয়ে বেশি ডিপ-এ— ভেতরে না গিয়ে, সে নয় পরে যাওয়া যাবে, আপাতত আমরা তালে ফিরি। তবে এটা বলার কুমড়ো ফুল, লাউ ফুলে পুং, স্ত্রী এসব তো জানি দীর্ঘ দিন ধরে। গত পর্বে কথা হয়েছে ইলাহাবাদের তাড় বান্না নিয়ে। কম্পানি বাগ— কোম্পানি বাগ— ইলাহাবাদে প্রবাসী বাঙালি জিভে কোম্পানি বাগ নয়তো কোম্পানি বাগান। কোম্পানি বাগানের খুব কাছাকাছি বেশ প্রাচীন একটি পিরবাবার মাজার। সেই পিরবাবা নাকি খুব জাগ্রত, বিশেষ করে স্ত্রী রোগে, মেয়েদের বাধক বেদনায়, মাসিক অল্পতা, মাসিক আটকে যাওয়া ইত্যাদি প্রভৃতিতে। মাসিক— মেনস্ট্রুয়েশন, ইলাহাবাদে তাকে বলা হয় মাহনা, তার গোলমাল তো বহু নারীর। এছাড়াও এই পির-সাহাবের কারিশমা বা কারনুমা যথেষ্ট। সেই পিরস্থানে ভিড় হয় বৃহস্পতিবার বৃহস্পতিবার। সেখানে ইত্তর— আতর, গুলাবপানি— গোলাব জল, মানতের— মানসার চাদ্দরউদ্দর চড়ায় সবাই। এছাড়া আছেন লোবান, আগরবাত্তির সুগন্ধ। স্থানীয় হিন্দু-মুসলমানদের অনেকেই বিশ্বাস রাখেন এই পিরবাবা সদাজাগ্রত। মূলত আম আদমির ভিড় এখানে। যাঁরা তেমন করে মরিজ-রোগীর ইলাজের— চিকিৎসার জন্য আংরেজি দাওয়াখানা— অ্যালোপ্যাথদের কাছে যেতে পারেন না, পয়সার অভাবে, মূলত, খানিকটা ‘বিশ্বাস’ বা অন্ধবিশ্বাস, যাই বলি না কেন, তার জন্যও বটে, হয়তো। ইলাহাবাদ শহরে তার লাগোয়া সঙ্গমভূমিতে, যেখানে গেরুয়া গঙ্গা, নীলাভ সবুজ যমুনা ও গুপ্তধারা স্রোতের ত্রিবেণীসঙ্গম, পাশেই শাহেনশা আকবর— হিন্দোস্থানের বাদশাহর তৈরি কিলা— কেল্লা বা কিল্লা— ফোর্ট, তার ছায়া যমুনা-জলে। আর আছে অক্ষয় বট। খানিক দূরে গঙ্গার কাছাকাছিই ঝুসি। সেখানে অনেক সাধুর বাস। কারছানা— হ্যাঁ, কারছানাই, খুব দূরে নয়। সেখানে ১৯৬৮-১৯৬৯-১৯৭০-এ প্রচুর ময়ূর। পালতু— পোষা নয়। ছাড়া বন্য মোর— ময়ূর। ইলাহাবাদ থেকে বেশি দূরে নয় শঙ্করগড়। শঙ্করগড়ের জঙ্গলে দূর দূর থেকে শিকারের লোভে আসতেন শিকারীরা। বেশিরভাগই তো ‘রাজা-গজা’। আর থাকতেন পুলিশের সব বড়ো কর্তা, আমির লোকজন— মানে ক্যাপ্টেন, মেজর, ব্রিগেডিয়ার, লোকাল প্রিন্স, সব দেশীয় রাজা। শঙ্করগড়ের জঙ্গলে হরিণ, বন্যবরাহ— বনশুয়োর, শেয়াল, খ্যাঁক শেয়াল, বেজি, নানা ধরনের সাপ। বিষাক্ত, নির্বিষ। বড়ো পাইথন— ময়াল পাওয়া যেত শঙ্করগড়ের জঙ্গলে। হয়তো লেপার্ড আর বাঘডাঁশা। লেপার্ডকে তো অনায়াসে চিতা বলে ডাকেন কেউ কেউ। কিন্তু ১৯৬৭-১৯৬৮-১৯৬৯-এ ভারতবর্ষে চিতা কোথায়? শঙ্করগড়ের শিকারিখেলা— শিকার ইত্যাদি অভিযান নিয়ে আমার একটি গল্প আছে ‘বাঘডুম’, লিখেছিলাম বাংলাদেশের বিশিষ্ট সাহিত্যপত্র ‘কালি ও কলম’-এ। তারপর আমার গল্পসল্প নামের একটি গল্পের বইতে আছে এই ‘বাঘডুম’। শঙ্করগড় তো ঘোর জঙ্গল, অন্তত পঞ্চাশ আর ষাটের দশকে, এমনকি সত্তরের গোড়াতেও। পরে স্বাভাবিকভাবেই পরিবর্তিত হয় অবস্থা।

কোম্পানি বাগ বা কোম্পানি বাগানের লাগোয়া প্রায় গা-ঘেঁষা সেই পির-আস্থান। ইলাহাবাদে বজরঙ্গবলী বা হনুমান মন্দির প্রচুর। যমুনার একেবারে লাগোয়া শোয়ানো হন্মানজি। তিনি নাকি খুবই জাগ্রত। ঘোর বন্যায় গঙ্গা-যমুনার জল বেড়ে গেলে তখন বাঁধ ছাড়িয়ে তুলারাম বাগ ভেসে যায়। আর এই যে আকবর বাদশাহ বা পাদশাহর তৈরি কিলা— লাল রঙের দুর্গ, তার পাশে বীর হনুমানজি— মারুতি শোয়ানো। আগাগোড়া তেল-সিঁদুর ল্যাপা তার সমস্ত শরীরে। এক হাতে গদা, অন্য হাতে বিন্ধ্যপর্বত। তার মধ্যেই বিশল্যকরণী, যা শক্তিশেলে নির্জীব রামভ্রাতা লক্ষ্মণকে পুনর্জীবন দেবে, এমনই বলছেন রামায়ণকার বাল্মীকি এবং অবশ্যই তুলসীদাসজি। তিনিও তাঁর নিজের কথাছন্দে রামায়ণকে অন্যভাবে এনেছেন সামনে। যেমন কৃত্তিবাস ওঝা। যেরকম জগদ্রামী রামায়ণ। অনেক অনেক ধরনের রামায়ণ আছে। আমাদের দেশে ও বিদেশে। থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া সহ গোটা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতেই প্রায় রামায়ণ আর রামায়ণ। সেইসব তথ্যে আর বিস্তারে যাচ্ছি না। তো সেই কোম্পানি বাগের গা লাগোয়া চন্দ্রশেখর আজাদ পার্ক। একসময় মূলত পরাধীন ভারতবর্ষে আলফ্রেড পার্ক নাম ছিল এই বাগানের। এই আলফ্রেড পার্কেই ব্রিটিশ সরকারের পুলিশের সঙ্গে গুলিযুদ্ধে শহিদ হন হিন্দুস্থান রিপাব্লিকান অ্যাসোসিয়েশন এইচ আর এ-র অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা চন্দ্রশেখর আজাদ। কাশীতে থেকে বহুদিন পড়াশোনা করেছেন এই বীর বিপ্লবী তাঁর কিশোরকালে। কাকোরি ট্রেন ডাকাতি মামলায়— যা ছিল স্বদেশি ডাকাতি, তাতে বীর বিপ্লবী রামপ্রসাদ বিসমিল, (গুরুজি) আসফাকউল্লাহ খান, চন্দ্রশেখর আজাদ প্রমুখ অনেক বিপ্লবী অংশ নেন। সম্ভবত শচীন্দ্রনাথ সান্যালও ছিলেন এই কাকোরি ট্রেন ডাকাতিতে। ছিলেন মন্মথনাথ গুপ্ত। যিনি পরে ‘কাকোরি ষড়যন্ত্রের স্মৃতি’ নামে একটি গ্রন্থ নির্মাণ করেন, পরে। 

বাঙালি বিপ্লবীদের অবাধ যাওয়া-আসা ছিল কাশী, যুক্তপ্রদেশের অন্য অন্য জায়গায়। সেসব কথা অতিদীর্ঘ লেখার বিষয় হতে পারে।

কোম্পানি বাগে প্রচুর তালগাছ। সেখানে গাছ থেকে পড়া গাছ পাকা তাল শ্রাবণ ভাদ্রে একেবারে ভর্তি হয়ে থাকে নিচে। পাকা তাল পালতু গায়-ভঁয়স— গরু-মোষ খায় পাকা তালের শাঁস ও রস। তবে সে আর কত খাবে? ফলে আলিশান আলিশান সব পোক্ত তালগাছের নিচে জমে থাকে অনেক অনেক তাল। পরেট হল পুরানা কাটরার মধ্যেই বড়োসড় মাঠ। তার কাছাকাছি, চারপাশেই আহির— পদবিতে যাদব— গোপপল্লি। প্রচুর গরু, মোষ, দুধের ব্যবসা। এখানে মূলে— মূলনারায়ণ যাদব যেমন আছেন, তেমনই আছেন শিউনারায়ণ যাদব ও বাচাউ যাদব। বাচাউ যাদব মেজ, শিউনারায়ণ ছোট। তিন ভাইয়ের মধ্যে সবার বড়ো মূলে বা মূলনারায়ণ। মূলে। আহিরপল্লি তে মদ, ভাঙ নিত্যদিনের ব্যাপার। অন্তত ষাট আর সত্তর দশকেও। মূলনারায়ণ বা মূলে রাতদিন ভাঙে— ভাঙ খেয়ে বুত্— নেশাগ্রস্ত হয়ে থাকেন। তাঁর কথা প্রায় সময়ই বোঝা যায় না। ভাঙ খেয়ে খেয়ে ঠোঁট ও জিভ যথেষ্ট মোটা হয়ে গেছে। মূলের মাথার চুল খুব ছোটো করে ছাঁটা। গায়ে কনুই পর্যন্ত হাতাঅলা গেঞ্জি। পাট করা— ভাঁজ করা সাদা কাপড়— ধুতি লুঙ্গি স্টাইলে পরা। তার ওপর বড়ো একখানা গামছা জড়ানো।

আরও পড়ুন
তাড়বান্না ইলাহাবাদ কোম্পানি বাগ

এই পরেটেই আহিরপল্লির যুবজন ল্যাঙোট পরে কুস্তি লড়ে। লোহার ভারি দমদার শেকল— জঞ্জিরে বাঁধা থাকে ঘন কৃষ্ণবর্ণ মহিষ। আহিররা মূলত দুধের ব্যবসা করেন। গোপালক তাঁরা, পোষেন মহিষও। উত্তরপ্রদেশে গো হত্যা নিষিদ্ধ, কঠিনভাবে। কিন্তু মোষের মাংস বিক্রি হয়, মূলত মদের সঙ্গে চাট হিসাবে খাওয়ার জন্য। ইলাহাবাদের ৯৫৩/৭৩২ পুরানা কাটরার এই ঠিকানার কাছে দূরে থাকতেন মেনা, ইন্দে— এঁরা সবাই কায়স্থ। খারেরা কায়স্ত হন। ইন্দে বা মেনা অবশ্য কেউ খারে নন। তাঁরা সাকসেনা। ইলাহাবাদে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, শিডিউল কাস্ট, ব্যাকওয়ার্ড, ইসলাম ধর্মাবলম্বী এই ফারাক খুব তীব্র সত্তর দশকেও। শুক্লা ব্রাহ্মণ, দ্বিবেদী, ত্রিবেদী, চতুর্বেদীরাও তাই। শুক্লাকে অনায়াসে সম্বোধন করা হয় শুকুল বা শুক্ল বলে। মিশ্র বা মিশ্রাও ব্রাহ্মণ। দ্বিবেদী দুবে, চতুর্বেদী চৌবে। সিংরা সাধারণত ঠাকুর— ছত্রী। কিন্তু তাঁরা ব্যাকওয়ার্ড বা নাপিত— নাউ হন। জয়সোয়াল, আগারওয়াল, এইরকম ভাবেই জাতপাতের বিন্যাস ইলাহাবাদে। পাশী, চামার, কুরমি, কুনরি, কাহার, আহির-যাদব সব আছে— মানে ছিলেন তখন। কাহাররা পালকি বহন করতেন। তাঁরা ‘জল চল’ ফলে উচ্চ বর্ণের বাড়ি বাসন মাজতেন তাঁরা। পাশীরা মদ বিক্রি করেন, মানে করতেন সত্তর দশকে। দিশি— কানট্রি লিকার— ঠররা। ইলাহাবাদে রিকশাচালকরা স্পিরিট খেতেন বা টগবগে দিশি ঠররা। পাশীরা শুয়োরও পোষেন। বিক্রি করেন শূকরের মাংস, চর্বি। কোনো বরো চোট লাগলে— মারামারিতে পোক্ত লাঠির ঘা লাগলে সেই ঘায়ল— আহত স্থান ঠিক করতে শুয়োরের পুরনো চর্বি মালিশ করা নাকি অব্যর্থ ওষুধ। স্টিল, প্লাস্টিক বা পাথরের বাটিতে থকথকে সাদা চর্বি, দুর্গন্ধ। কেউ কেউ বলেন, ভাঙা হাড় জোড়া দিতেও নাকি বরাহচর্বি অবধারিত। কুনরি, কুরমিরাও আছেন। ইলাহাবাদে প্রচলিত ছড়ার মধ্যে উঠে আসে কিছু অপ-উচ্চারণ—

আরও পড়ুন
তাল ঢ্যাঙা, ঢ্যাঙা ও আরও কিছু

১) ‘আহির ড্যাপর ভুজাওয়ে মাঠা’
২) ‘আহির, গারেরিয়া, পাশী— তিনোঁ সত্যানাশী’
৩) ‘আশি বছরেও গোয়ালা বা আহির-যাদবের বুদ্ধি হয় না’

আরও পড়ুন
তাল বিলাইয়া তাল খাইও…

এইসব কহাবত— কথাবার্তা অত্যন্ত অপমানসূচক। যেমন বলা হয়ে থাকে— কাউয়া— কাক যদি দেখে একজন কায়স্থ— খারে বা সাকসেনা মারা গেছেন, তাহলে সেই কায়েস্থ বা কায়স্থ আদপেই মরেছেন কিনা, তা জানার জন্য কাক মুখে-ঠোঁটে করে ঢিল বা পাথর কুড়িয়ে এনে কায়স্থর গায়ে ছুঁড়ে দিয়ে দেখবে সে নড়ে ওঠে কিনা মানে সত্যি সত্যি মারা গেছে, না বেঁচে আছে। উত্তরপ্রদেশের কায়স্থদের চতুরালি নিয়ে আরও আছে অনেক অনেক কাহানি বা কহানি, সে ব্যাপারে আর যাচ্ছি না। ব্রাহ্মণদের নিয়েও এরকম কিস্যা বহু আছে। শুক্লা বা শুকুল, মিশ্রা, চৌবেজি, দুবেজিদের নিয়ে প্রচুর গল্প। একটি কাহাবত আছে, তেলচি কা তেল জ্বলে মশালচিকা গাঁড় জ্বলে। এরকম অনেক কথা, কহাবত।

আরও পড়ুন
ঘুড়ি তো জানে না সে নিজে ওড়ে না

১। ‘বাপ না মারে মেঢকি
বেটা তীরন্দাজ’
২। ‘মন মন ভাওয়ে
মুড়িয়া হিলাওয়ে’
৩। ‘মজবুরি কা নাম গাঁধি’
৪। ‘আল্লা মিলাওয়ে জোড়ি
এক অন্ধা এক কওড়ি’
৫। ‘অন্ধের নগরী চওপাট রাজা
টাকা সে ভাজা টাকা সে খাজা’
৬। ‘চোর কা ডাঢ়ি মে তিনকা’
৭। ‘গুরু গুড় হি রহ গয়া
চেলা বন গিয়ে শকুর’
৮। ‘তেরা মু মে ঘি শক্কর পড়ে’
৯। ‘কাশী মে যিতনা কঙ্কর
উতনা হি শঙ্কর’
১০। ‘ইলাহাবাদী/ বড়ি ফসাদি’
১১। ‘পয়সা না কওড়ি
বাজার যায় দওড়ি’
১২। ‘মান ইয়া না মান
ম্যায় তেরা মেহমান’
১৩। ‘সুম কা ধন/ শয়তান খাতা হ্যায়’

ইলাহাবাদে দেবী অলোপি বা আলোপি দেবীর মন্দির আছে। অলোপি বা আলোপি দেবী নাকি খুব জাগ্রত দেবী। তাঁর নামেই আছে আলোপিবাগ। সেখানেও আছেন প্রবাসী বাঙালি। নকাশকোনা আর চওকে প্রচুর ইসলাম ধর্মের মানুষ। বুরকা বা বোরকা পরা মেয়েরা ইসলাম ধর্মাবলম্বী মেয়েরা। প্রতি মঙ্গলবার মঙ্গলবার বজরঙ্গবলীজি বা হনুমান দেবতার বিশেষ পুজো মুগের লাড্ডু— বেসনকে লড্ডু বা লাড্ডু দিয়ে। হনুমান চালিশা রাখা থাকে রাস্তার ধারে হনু-দেবতার থান বা মন্দিরে। সেখানে যে কেউ— অবশ্যই সনাতনধর্মী হতে হবে তাঁকে, শুদ্ধ লিবাস— শুদ্ধ কাপড়ে বসে তুলসীদাস বিরচিত হনুমান চালিশা পড়তে পারেন। পবনপুত্র হনুদেবের ভক্ত সেখানে প্রচুর। বেসনকে লড্ডু বা লাড্ডু, মুগের লাড্ডু, দুধ কে লড্ডু হল গিয়ে খোয়া ক্ষীরের নাড়ু, মগধকে লাড্ডু হল বোঁদের লাড্ডু। 

ইলাহাবাদে পুরানা কাটরায় ‘লছমি’ বা লক্ষ্মী টকিজের কাছাকাছি রাস্তার ওপরই দিহাত থেকে বিক্রি করতে আসে খোয়া বা ক্ষোয়া ক্ষীর। সেই খোয়া শক্ত যেন ইটের টুকরো। চট করে ভাঙা যায় না দাঁতে। ক্ষোয়া ছাড়া আছে পাতক্ষীর। খানিকটা তরল, মানে থকথকে। সেই পাত ক্ষীর রুটি বা মুড়ি দিয়ে অপূর্ব। ইলাহাবাদে মুড়িকে বলে লাইয়া। ক্ষোয়া ক্ষীর দিয়ে অতি চমৎকার পাটিসাপ্টা পিঠে। অন্য অন্য ক্ষীরের পুলি— সবই বাংলা ঘরানার। ইলাহাবাদে বাংলা মিঠাই ছিল কর্নেলগঞ্জ, জর্জ টাইনে। টেগোর টাউনেও ছিল কী? ‘লছমি’ বা লক্ষ্মী টকিজ-এর খুব কাছে ইলাহাবাদ হাইকোর্ট। সেখানে দূর দূর থেকে মামলা লড়তে আসেন বড়ো বড়ো আইনজীবী— ভকিল সাহাব। নৈনি জেলে রাখা হয় লোকাল অপরাধীদের। বাইরে থেকেও ‘চালান’ হন অভিযুক্তরা।

 মনে আছে, ইলাহাবাদ হাইকোর্টের রায়েই ইন্দিরা গান্ধীর নির্বাচন বাতিল হয়ে যায়। রাজনারায়ণ জিতে যান। রাজনারায়ণ ছিল ‘ফায়ারব্র্যান্ড’ সোসালিস্ট, রামমনোহর লোহিয়ার অনুগামী। পরে জেপি— জয়প্রকাশ নারায়ণের ‘ইন্দিরা তানাশাহি’ বিরোধী সংগ্রামে তিনি নেমে পড়েন। রাজনারায়ণ পরে চৌধুরী চরণসিংয়ের সঙ্গে একসঙ্গে চলতে শুরু করেন। মোরারজি ভাই দেশাইয়ের নেতৃত্বে চলা জনতা পার্টির সরকার পড়ে যায়। চরণসিং প্রধানমন্ত্রী হন। জনতা পার্টি থেকে বেরিয়ে আসার পর তাঁর নতুন দল— ডি এম কে পি— হিন্দিতে দমকিপা। ডি এম কে পি-র পুরো নাম দলিত মজদুর কিষান পার্টি। চৌধুরী চরণসিংহ ছিলেন মোড়ারজি ভাই দেশাই সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী। তিনি ‘শাহ কমিশন’ ইত্যাদি করে ইন্দিরা গান্ধীকে জেল খাটান। চৌধুরী চরণসিংয়ের সঙ্গে ভেঙে যাওয়া সি পি আই (এম এল)-এর একটা অংশের নেতা সত্য নারায়ণ সিং-এর খুব সখ্য ছিল। সত্যনারায়ণ সিং ছিলেন অখণ্ড বিহার থেকে উঠে আসা সি পি আই (এম এল) নেতা। সত্যনারায়ণ সিং দীর্ঘদিন জেলে ছিলেন নকশালবাড়ির ধারায় আন্দোলন করতে গিয়ে। জরুরি অবস্থা উঠে গেলে সাধারণ নির্বাচনে ইন্দিরা গান্ধী, সঞ্জয় গান্ধী ও ইন্দিরা কংগ্রেস পরাজিত হয়। সত্যনারায়ণ সিং ও তাঁর বহু অনুগামী জনতা পার্টির সরকার আসার পর নয়া দিল্লিতে থাকতে শুরু করেন, কিছু পয়সা-কড়ি রোজকারের আশায়। এই সব কথায় তাল হারাল। পরবর্তীতে আবার ফিরে আসবে তাল।

Powered by Froala Editor