তাল বিলাইয়া তাল খাইও…

মুছে যায়? ৫৭
আগের পর্বে

উত্তর কলকাতার শ্যামপুকুর অঞ্চলের তেলিপাড়ায় বিশ্বকর্মা পুজোর আগে, পরে আকাশভরা রঙিন ঘুড়ি। আমার ছোটমাসির বাড়ির ছাদে তীব্র ঘুড়িবাজির আয়োজন প্রাক-বিশ্বকর্মা, বিশ্বকর্মা পুজোর সারাদিন। অপরপক্ষের ঘুড়ি ‘বলি’ হলেই সমন্বয়ে ভো-কাট্টা, ভো-কাট্টা স্বর। তারপর ভাঙা ক্যানেস্তারা, ডালডার টিন, কাঁসর-ঘণ্টার নির্ঘোষ। ঘুড়ির প্রসঙ্গ এসেছে একাধিক সিনেমায়। রাজনীতিতেও জড়িয়ে রয়েছে ঘুড়ি। কলকাতায়, কলকাতার গা-লাগোয়া মফঃস্বলে রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী প্রতীকসহ ঘুড়ি উড়তে শুরু করে সত্তরের দশকে। তারপর...

তাল বিষয়ক এই ছিকুলিটি অখণ্ড বঙ্গের ফরিদপুর জেলায় খুবই প্রচলিত ছিল একসময়। এমনকি তিরিশ চল্লিশের দশকেও। তাল বাঙালির— উভয় বঙ্গে পূর্ব এবং পশ্চিমবঙ্গে নানা ধরনের খাবারের উপমা ও মাধ্যম হিসাবে হাজির হয়ে যায়। যেমন তালপিঠে, তালের বড়া— পশ্চিমবাংলায় যার নাম তালফুলুরি বা ফুরুলি, জিহ্বান্তরে, এছাড়াও তালের কেক, তালমিছরি, দুলাল চন্দ্র ভড় যার আবিষ্কর্তা বলা হয়, তাল গুড়, তাল পাটালি, তেলোতাড়ি, তালের রুটি, তালের পরোটা, তালের লুচি, কাঁসার থালায় গোলা তাল সামান্য চুন মিশিয়ে রেখে দিয়ে, তারপর ছুরি দিয়ে কেটে কেটে বরফি, খুব স্বাদু নয়, কিন্তু খাওয়া যায়। 

কিংবা— ‘তালগাছের আড়াইহাত…’ এই ছিকুলিটিও মিশে রয়েছে আমাদের জীবনে। তাল গাছ আঁটি থেকে হয়। বাড়ে খুব ধীরে। ‘তাল বিলাইয়া তাল খাইও…’ বা ‘তালগাছের আড়াই হাত’— এই দুটি ভাবনালেখই আসলে তালগাছের অত্যন্ত ধীর গতিতে বেড়ে ওঠার চিত্র হিসাবে প্রযুক্ত।

তাল দেখেছি গো-বলয়ে, অখণ্ড বিহার, পরে খণ্ডিত বিহার ও ঝাড়খণ্ডে। উত্তরপ্রদেশের ইলাহাবাদ, বারাণসী, হয়তো লখনউতেও। বিহার ও উত্তরপ্রদেশে তালের তাড়ি— তেলো তাড়ি বলা হয় যাকে বঙ্গদেশে, সেই তাড়ি হয় বিপুল পরিমাণে। মানুষ খেয়েও থাকেন ভরপেট। তবে নীতিশকুমারের ‘মদমুক্ত’ বিহারে এখনও তাড়ি চলে কিনা জানা নেই।

দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা, উত্তর চব্বিশ পরগনা, হাওড়া, হুগলিতে রয়েছে বড়ো বড়ো তাড়ির ঠেক। মেদিনীপুরেও আছে— তাড়ির আয়োজন— বিভক্ত জেলার দুই ভাগেই। 

আরও পড়ুন
ঘুড়ি তো জানে না সে নিজে ওড়ে না

দক্ষিণ চব্বিশ পরগনায় তেলোতাড়িতে কচি কঞ্চির ডগা থেঁতো করে মিশিয়ে পান করার একটা পুরনো রীতি আছে। একেবারে যাকে বলে ঝিম, ঝুম নেশা। তালের রসে বাখর, নিশাদল এসব তো থাকেই তাড়িকে আরও বেশি নেশাদার করার জন্য, সেইসঙ্গে কার্বাইড কখনও। কখনও ঘুমের বড়ি, গুঁড়ো করে।

আরও পড়ুন
কার ঘুড়িতে যে রেখেছি মন সোনা করে

ষাটের দশকের কলকাতায় যেমন পঁচিশ নয়া পয়সা— চার আনা দামের কোকাকোলায় মাথা ব্যথা ও মাথা ধরা ছাড়ানোর ট্যাবলেট পাঁচ নয়া পয়সা দামের একটি ‘স্যারিডন’ বড়ি বা ‘অ্যাসপ্রো’ ফেলে বোতলের মুখ বড়ো আঙুলে চেপে বেশ খানিকক্ষণ ঝাঁকালে নেশালু তরল তৈরি হয়ে যায়। সেই সময়ে, দিনে রাতে অনেকেই নেশা করতেন এই মাধ্যমটি দিয়ে। ভালো নেশা হত।

আরও পড়ুন
ও, ও, ঘুড়ি— ঘুড়ি রে

কলকাতায় তাড়িবার ছিল, এখন আছে কিনা জানি না। কবি তুষার রায়ের একটি কবিতায় উল্লেখ আছে তাড়ির কথা, শক্তি চট্টোপাধ্যায় প্রসঙ্গে। ‘ব্যান্ডমাস্টার’, ‘মরুভূমির আকাশের তারা’, ইত্যাদি গ্রন্থের লেখক তুষার রায় ছিলেন বাংলা ভাষার একজন ব্যতিক্রমী লেখক। যাঁর কবিতা নিয়ে কথা হয় এখনও, অন্তত তরুণদের মধ্যে।

আরও পড়ুন
বিশ্ব ইজতেমা, তবলিগ জামাত, আরও কিছু

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘তালনবমী’ নামের অতিবিখ্যাত গল্পটি আমরা প্রায় সবাই জানি। ‘তালনবমী’ থেকে বাংলা সিনেমাও তৈরি হয়েছে। সেই সিনেমাটিও বেশ। 

বিহার, ঝাড়খণ্ড, উত্তরপ্রদেশে তালের মেঠাই— তালক্ষীর, তালের বড়া তৈরির তরিকা বা পদ্ধতি জানা নেই সাধারণ জনের, যাঁরা তাল কুড়িয়ে এনে হয়তো খান। পাকা তালই। সেও খুব কম সংখ্যায়। অথচ পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা, বাংলাদেশে কাঁচা তাল থেকে তালশাঁস বের করে খাওয়ার রেওয়াজ বহু পুরনো। মনে পড়ে পুরী এক্সপ্রেস আচমকাই দাঁড়িয়ে গেছে সাক্ষীগোপাল স্টেশন, সিগন্যাল না পেয়ে আজ থেকে বছর চৌত্রিশ আগে। ট্রেনের বাইরে টাটকা তালশাঁস পাওয়া যাচ্ছে, পদ্ম পাতায়। একটাকায় তিনটে। জলভরা তালশাঁস। কি তার সোয়াদ। এখন ব্রহ্মপুর বাজারে দশ টাকায় তিনটে তালশাঁস। গোটা কাঁদি ধরে নিয়ে আসা হয় তাদের।

পুরীর কাছাকাছি সাক্ষীগোপালে গিয়ে খুব ভালো কচি তালশাঁস খেয়েছি। তখন মুখার্জি কোম্পানির বাস সাক্ষীগোপাল, পিপলি, চন্দ্রভাগা হয়ে কোনার্ক যেত। তারপর ভুবনেশ্বরের ধৌলি, লিঙ্গরাজ মন্দির, রাজা-রানির মন্দির, নন্দনকানন ইত্যাদি। সেসব রুট বদল হয়ে গেছে বহু বছর। মুখার্জি কোম্পানির বাসও এখন ‘ভাগাভাগি’, পুরনো নতুন ইত্যাদি নানা কলে অনেকটাই নাম পাত্র। এক নামে বাস-ব্যবসা করেন অনেকে। আমি ২০০৭-এ একা একা কোনার্ক ও শ্রীচৈতন্য আবিষ্কার করার জন্য বার বার এই অঞ্চলে নিজের বাঁধা পথে বার বার ঘুরেছি। তখন তালশাঁসের স্বাদ নিয়েছি বার বার।

বাঙালি তার নিজস্ব মেধা ও বুদ্ধিতে বানিয়ে তুলেছে জলভরা সন্দেশ। কলকাতায় তো বটেই, চন্দননগরের সূর্য মোদকের জলভরা সন্দেশ বিখ্যাত সারা ভারতবর্ষে। কলকাতাতে যে জলভরা সন্দেশ তৈরি হয়, তার স্বাদ আলাদা সূর্য মোদকের জলভরা থেকে। চন্দননগরের সূর্য মোদক আবার দু ভাগ, আলাদা আলাদা দোকান। সেখানে এক ভাগে রসগোল্লা, পানতুয়া, কমলাভোগ, অন্য মিষ্টি। সূর্য মোদকের জলভরা-র গায়ে লেখা থাকে সূর্য মোদক। কাঠের ছাঁচে জেগে ওঠে এইসব কথা।

হিন্দি বলয়ে বা গোবলয়ে তাড় বলা হয় তালকে। তাড় থেকেই তাড়ি। তাড়বান্না মানে তাল গাছের সারি। আমরা জেনেছি কবিতায়— ‘তাল গাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে/ সব গাছ ছাড়িয়ে উঁকি মারে আকাশে…।’ তাল গাছের মনে সাধ মেঘ হয়ে ওড়ার কিন্তু পাখা নেই তো তার। ফলে না উড়তে পারার আক্ষেপ তালগাছের, না-ওড়ন পর্বে থেকে যাওয়ার জন্য আক্ষেপ কবিরও। তাল গাছের ইচ্ছে পাখা পাওয়া তো আর হল না। ফলে ওড়ন বন্ধ।

তালগাছের ডালে, পাতায় ভালো করে নিজেকে বাঁচানোর জন্য, আশ্রয় পেতে বাবুই বাসা বোনে। বাবুই পাখির এই বাসা দেখতে অনেকটা যেন ওলটানো কুঁজো। সেই উল্টো কুঁজোর নিচে ফোকর, তা দিয়ে ভেতরে ঢোকে, বেরোয় বাবুই পাখি। ডিম পাড়ে, বাচ্চা হয়। তার বাসাটি বড়োই নিপুণ, পরিপাটি। এই পক্ষীনীড়ের ভেতর নিজস্ব আলোর ব্যবস্থা। কীভাবে হয় সেই আলো? ঘাসে বোনা বাসার ভেতর গোবর এনে, তার মধ্যেই ঠুসে দেওয়া হয় ঠোঁটে করে ধরে আনা জোনাকি। সেই জোনাকি-আলোতেই নিজের বাসা আলোয় আলো। স্বাভাবিকভাবেই না সেখানে ইলেকট্রিক আলো আছে, না রয়েছে জেনারেটর। ছোটদের জন্য লিখতেন অখিল নিয়োগী, তাঁর লেখায় ছিল স্বপন বুড়ো। তিনি ‘বাবুইবাসা বোর্ডিং’ নামে একটি গ্রন্থ নির্মাণ করেন। যতদূর মনে পড়ে ষাট দশকে ‘শিশুসাথী’ পত্রিকায় এই কিশোর আখ্যানটি ধারাবাহিক ভাবে বেরোত, প্রতি মাসে। আশুতোষ লাইব্রেরি ছিল ‘শিশুসাথী’র প্রকাশক। কলেজ স্কোয়ারের উল্টো দিকে মনীষা গ্রন্থালয়-এর একটু আগেই ছিল আশুতোষ লাইব্রেরি। সাদা আদ্দির কাপড়ে তৈরি হাফ পাঞ্জাবি আর ঝকঝকে নিপাট ফর্সা ধুতি পরে আশুতোষ লাইব্রেরির কাউন্টারে বসে থাকতেন একজন মাঝবয়সী। তাঁর মাথায় কাঁচা-পাকা চুল সযত্নে তেল মেজে, উল্টে আঁচড়ানো— কেতাদুরস্ত ভাষায় যা ব্যাকব্রাশ। এই মানুষটির দুচোখে অগাধ শূন্যতা। শুনেছি পূর্ব পাকিস্তানের দাঙ্গায় সর্বস্ব খুইয়ে এপারে চলে এসেছেন তাঁরা। তারপর কলেজ স্ট্রিটে বই-ব্যবসা। মাসান্তিক ‘শিশুসাথী’, অন্য বইও। 

‘অভ্যুদয় প্রকাশ মন্দির’ ছিল ষাট দশকেও অতিবিখ্যাত প্রকাশক। তাদের একটি বিখ্যাত বই ফান বা ভ্যান গঘের আত্মজীবনী ‘লাস্ট ফর লাইফ’-এর বঙ্গানুবাদ ‘জীবনপিয়াসা’। কী অসামান্য সেই ‘লাস্ট ফর লাইফ’ এবং তার বঙ্গানুবাদ। পরে ইংরাজিতে পড়ি ‘লাস্ট ফর লাইফ’। কি অসামান্য কেতাব। আরও পরে পড়ি পল গঁগ্যার মূলত তাহিতি অভিজ্ঞতার ওপর লেখা আত্মকথা। কী যে লেখা এই দুটি বই, কোনো কথা হবে না। ‘অভ্যুদয় প্রকাশ মন্দির’ নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের কিছু বই প্রকাশ করেছিলেন। কালের নিয়মে ‘বেঙ্গল পাবলিশার্স’, ‘জিজ্ঞাসা’, ‘অভ্যুদয় প্রকাশ মন্দির’, ‘আশুতোষ লাইব্রেরি’, ‘নবপত্র প্রকাশন’— সবই জীর্ণ। ‘র্যাডিক্যাল বুক হাউস’, ‘প্রকাশক, ‘নয়ন প্রকাশনী’, ‘ভোস্তক’, ‘বুকফ্রন্ট’ ইত্যাদি প্রকাশকরা হিসাবের বাইরে চলে গেছেন ধীরে ধীরে। আরও আছে কত নাম— ‘গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় অ্যান্ড সনস’— যাঁরা প্রকাশ করতেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বই, একেবারেই অস্তমিত শিখা। ‘নিউ এজ’ বা ‘প্রকাশভবন’-এর সেই আগেকার প্রকাশন-দাপট কী আছে এখনও? ‘প্রকাশভবন’ এক সময় অবনীন্দ্রনাথের রচনাবলী, বিনয় ঘোষের ‘পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি’-র মতো কেতাব তিন খণ্ডে প্রকাশ করেছিলেন। কলেজ স্ট্রিট মার্কেটে নাকি শ্রীমানী মার্কেটের দোতলায় প্রহ্লাদ প্রামাণিকের ‘ওরিয়েন্ট বুক কোম্পানি’? এক কালের খুবই নামকরা প্রকাশন সংস্থা। এরকম কত কত বইয়ের প্রকাশনা ডুবে গেল, উঠে গেল একটু একটু করে। আলাদা ভাবে সেই বিষয়ে একটা লেখা করা যায়। ‘জিজ্ঞাসা’ প্রকাশন শ্রীশ কুণ্ডুর সঙ্গে বহুবার কথা হয়েছে প্রকাশন সংস্থার— বাংলা প্রকাশন সংস্থার নানা সমস্যা, সংকট নিয়ে। শ্রীশবাবু বহু বছর প্রয়াত। ঘনাদার বই— প্রেমেন্দ্র মিত্রর ঘনাদা নিয়ে লেখা অতিবিখ্যাত সব গ্রন্থ যাঁরা প্রকাশ করতেন, আর সেইসব গ্রন্থের মলাট আঁকতেন অজিত গুপ্ত, সে এক দেখার ব্যাপার। অজিত গুপ্ত, প্রতুল বন্দ্যোপাধ্যায়, অহীভূষণ মালিক, সুবোধ দাশগুপ্ত, ধ্রুব রায়, দেবাশিস দেব— সকলেই এঁকেছেন ঘনাদা। আমার কাছে কিংবা অনেকের কাছেই অজিত গুপ্তর আঁকা ঘনাদা, সেরা। প্রতুল বন্দ্যোপাধ্যায় ঘনাদা আঁকতেন দেবসাহিত্য কুটীর-এর বার্ষিকীতে। বেরোত পুজোর সময়। যেমন ছাপা, তেমন লেখা, সেসকমই বাঁধাই। তেমনই কাগজ। ‘দেববাউল’, ‘মণিহার’, ‘পারিজাত’। সেইসঙ্গে ‘হিপ হিপ হুররে’, ‘কত গান তো হল গাওয়া’। ‘দেব সাহিত্য কুটির’-এর অন্য অন্য বার্ষিকীর নাম— ‘দেবালয়’, ‘ইন্দ্রধনু’। এখনও মনে পড়ে। এইসব ‘দেব সাহিত্য কুটির’-এর পুজো বা পূজা বার্ষিকী নিয়েও লেখা যায় আলাদাভাবে ‘মুছে যায়?’। ‘দেব সাহিত্য কুটির’-এর পূজা বার্ষিকীতে ঘনাদার নাকের নিচে ছুঁচোল, পাকানো, ওজনদার আর্মি মুসট্যাস— মিলিটারি গোঁফ, এটি শিল্পী প্রতুল বন্দ্যোপাধ্যায়ের সৃষ্টি। ‘মশা’, ‘ঢিল’ এইসব অতিবিখ্যাত ঘনা-কাহিনিতে বা ‘ফুট’ নামের সেই চমৎকার আখ্যানে প্রতুলবাবুর অঙ্কন। অজিত গুপ্তর ঘনাদার নাকের নিচে কেয়ারিদার সরু গোঁফ। মাথার চুলে ব্যাকব্রাশ। সামনে অতিসামান্য ইন্দ্রলুপ্তির আভাস।

শুরু হয়েছিল তাল গাছ নিয়ে। তালগাছের সারি দেখেছি বীরভূম, এমনকি উত্তর চব্বিশ পরগনাতেও। সেখানে গাছের ডালে ঝুলত শক্তপোক্ত বাবুইবাসা। একদা— দশক বছর আগেও গ্রামীণ মেলাতে বিক্রি হত সেই বাবুইবাসা। পরে তার রেপ্লিকা বেরয়। বিক্রি হতে শুরু করে। নকল বাবুইবাসা।

তালগাছে সাপ ওঠে পাখির বাচ্চা, ডিম, পাখি খেতে। তালের কোটরে বাসা বাঁধে তক্ষক। তাল গাছ কাটার পর তার কাঠের তক্তা দিয়ে নানা কাজ। তাল, নারকেলের গুঁড়ি দিয়ে নদী বা পুকুর ঘাটের ‘রানা’— ঘাটের সিঁড়ি। তালগাছ ও সুপুরি গাছ কাটার পর সেই গাছের মাথা থেকে নরম সরম মেথি বার করলে, তা খেয়ে ঝিমঝিমে নেশা। তাল পাতা থেকে তালপাতার হাত পাখা, ঘরের ছাউনি— এরকম কত কি। নারকেল গাছেও ছোট-বড়ো সাপ উঠে আসে, পাখির বাসা থেকে ডিম, বাচ্চা, মা-পাখি, বাবা-পাখি লুটের জন্য। তালগাছের কোটরে, নারকেল গাছের কোটরে বাসা বাঁধে টিয়া, চন্দনা। ডিম পাড়ে, বাচ্চা দেয়, বড়ো হয়। তারপর বেঁচেবর্তে থাকলে ফু-উ-রু-ত। তাল গাছ, নারকেল গাছে ঠোকুর মারে রূপময় কাঠঠোকরা। সরকারি সংগঠন তালগুড় মহাসংঘ থেকে বেশ কয়েক বছর আগে তালমিছরি, তালগুড়, তালের রস থেকে তৈরি পানীয়— ‘নীরা’। ‘নীরা’ খেয়ে দেখেছি, বেশ খেতে। ‘নীরা’ সম্ভবত এখন আর পাওয়া যায় না। ষাটের দশকে চেতলায় ঝোলা তালের গুড়, লাল ও সাদা তালপাটালি— সবই পাওয়া যেত। ইদানিং হয়তো তেমন করে তালগুড়— তাল ঝোলা গুড় ও তালপাটালি আর আসে না। চেতলা হাটের তালপাটালিও বিখ্যাত। এখন আর পাওয়া যায় কিনা জানা নেই।

নারকেল গাছে, খেজুর গাছে অনায়াসে বেঁধে যায় সুতো কাটা ঘুড়ি। তালগাছে কাটা ঘুড়ি খুব একটা লটকে যেতে দেখিনি। আসলে গেরস্থ বাড়ি, মূলত হিন্দু গেরস্থ বাড়ির একেবারে ভেতরে, যেমন নারকেল গাছ থাকে, তেমন তাল গাছ থাকে না। তালকে বলে ‘কানা’, ‘তালকানা’ শব্দটি তো বহুল প্রচলিত। ‘তালকানা’ অর্থ নতুন করে বলতে হবে না নিশ্চয়ই। 

নারকেল গাছ তথাকথিত ‘ব্রাহ্মণ’। তার ছোবড়া ছাড়ালে তিন তিনটি চোখদার গোল ফল। নারকেলের নাকি চোখ আছে। এসব ভুলভাল সংস্কার চালু আছে। যাঁরা মানেন, এইসব সংস্কার, তাঁরা অবশ্য মনে করেন না ভুলভাল। ফলে নারকেল চক্ষুষ্মান— চক্ষুযুক্ত, তাল— কানা।

সামনের সপ্তাহে তাল, তালগাছ নিয়ে আরও আরও অনেক কিছু। তার সঙ্গে আরও আরও অন্য কিছুও। হয়তো ঘুড়ি, হয়তো ঘুড়ির সুতো, হয়তো সাপ, হয়তো তালডোঙা, হয়তো বা মেঘ, একলা মেঘ। কেটে যাওয়া একলা ঘুড়ি।

Powered by Froala Editor