কার ঘুড়িতে যে রেখেছি মন সোনা করে

মুছে যায়? ৫৫
আগের পর্বে

কলকাতায় বিশ্বকর্মা পুজোয় এবং বালিতে সরস্বতী পুজোতে ঘুড়ি ওড়ে। কলকাতার কারখানায় কারখানায় বিশ্বকর্মার হাতে ঘুড়ি। ষাট-সত্তর দশকে একতে, দোতে, আড়াইতে ঘুড়ির পাশাপাশি পাওয়া যেত 'ভড়' নামের দৈত্যাকার ঘুড়ি। বালি বাজারে ঢোকার ঠিক আগে মনুদার মাছ ধরার সরঞ্জামের দোকান। সরস্বতী পুজোর আগে সেই দোকানই ছিল ঘুড়ির আড়ত। সে দোকানে রেডিমেড মাঞ্জা পাওয়া গেলেও, কদর ছিল না তার। বরং, হাতে তৈরি মাঞ্জাই প্রাধান্য পেত তাবড় ঘুড়িবাজদের কাছে। তারপর...

ঘুড়ি, ঘুড্ডি, কাইট নিয়ে লিখতে বসে মনে পড়ে যায় কত কথাই। এক, দুই, তিন, চার— নম্বর ভাঙা সব স্মৃতি। তার আগে বলি, বালি বাজারে ব্রহ্মা পুজো হত। বেশ গরমের দিনে, হয়তো এখনও হয়। সেই কথা আমাকে আর কে বলে দেবে। আমি খুব বেশি ব্রহ্মা পুজো দেখিনি। না গৃহস্থ ঘরে, না বারোয়ারি। ব্রহ্মা মাটির, বালি বাজারের বারোয়ারির কথা বলছি। কমল যোনি থেকে— সনাতনী পুরাণ কথা ও বিশ্বাস অনুযায়ী বিষ্ণুর নাভি-কমল থেকে সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার উৎপত্তি। তিনি পুরাণ ভাবনায় চতুরানন। অর্থাৎ, চারটি মুখ তাঁর। চার হাত। গায়ের রঙ অগ্নিবর্ণ অথবা লালচে। রাজস্থানে রয়েছে ভারতবর্ষের একমাত্র ব্রহ্মা মন্দির, সনাতনী বিশ্বাস মতে সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা, পালনকর্তা বিষ্ণু, লয় বা ধ্বংসকর্তা শিব।

রাজস্থানের পুষ্করে ব্রহ্মার মন্দির। অনেক অনেক খাড়াই সিঁড়ি ভেঙে উঠতে হয়, পৌঁছতে হয় মন্দিরের সামনে। খুব বড়ো মূর্তি বা মন্দির গৃহ একেবারেই নয়। মন্দিরে ওঠার সিঁড়ির মুখে ডালা বিক্রির দোকান। পাতার বড়ো দোনার ভেতর— নকুলদানা, শুকনো নারকেল, লাল-হলুদ ডোরি, রুড়ি মেটে সিঁদুর, ব্রহ্মার ‘আশীর্বাদ’ নিয়ে আসবে, এমনই ভাবনা সেখানে, তো সেই প্রসাদের দোকানে চিনিবিলি ভিড়, পুণ্যার্থী, পুণ্যলোভিদের। বিরাট বি-ই-শা-ল এক হ্রদ রয়েছে নিচে, সেখানে পিতৃ-মাতৃ শ্রদ্ধানুষ্ঠানের, শ্রাদ্ধকাজ সারেন বিশ্বাসী সনাতনী। সেই সরোবরের নীরগভীরে মীনদল। সেই মাছ ধরার কেউ আছেন কিনা জানি না। কারণ হরিদ্বারেও দেখেছি অনেক অনেক বাঁধানো কুণ্ডে, মীনেরা— মহাশোল মাছ, যাদের কথা আগে লিখেছি, অতি স্বাদু মহাশোলদের অতি-অতিকায় গায়ে, কারও কারও মিশে আছে, লেগে রয়েছে পুরু শ্যাওলার স্তর। জলের ওপর থেকে মৎস্য গাত্রে সেই সবুজাভ ‘পান্না-শোভা’ মিশে আছে, যা স্বচ্ছ জলের ওপর থেকে দেখা যায়।

পুষ্কর খুব গুরুত্বপূর্ণ তীর্থ বিশ্বাসী সনাতনীদের কাছে। রামায়ণ-মহাভারতের কাহিনির সঙ্গে মিশে আছে তার মাহাত্ম্য। পুষ্করের মেলা অতি বিখ্যাত। ব্রহ্মা মন্দিরে ওঠার যে সিঁড়ি, তার পায়ের কাছে, ফাঁকা জমিতে প্রচুর সাজগোজ করা উট, সাজসজ্জা করানো তাগড়া তাগড়া সব ঘোড়া। তারা বিপুল বিক্রমে ঘুরছে ফিরছে। ঘোড়ারা ঘুরছে। কিন্তু বহু উটই বসে। পুষ্করে ঘোড়া, উট, কেনাবেচা হয়। অখণ্ড বিহারের শোণপুরে, শোণ নদের কাছাকাছি বি-ই-শা-ল মেলা বসে কার্তিকী পূর্ণিমায়। সেখানে হাতি, ঘোড়া, উট, বড়ো তাগড়া ষাঁড়, বলদ, অতি বলশালী পুং মোষ ও স্ত্রী মহিষ— সব বিক্রি হয়। দূর দূর থেকে একসময় আসতেন নাচনেওয়ালিরা। বিক্রি হত এই সব নর্তকি, ‘মেয়েমানুষ’, বিহারের সামন্তরা কিনত ঘোড়া, হাতি, উট, পছন্দের ‘মেয়েমানুষ’-ও। প্রয়োজনের দাস। এই তো চল্লিশ দশকের শেষদিকে, এমনকি পঞ্চাশের একেবারে গোড়ায় হরিহরচ্ছত্রের তিন দিনের প্রধান মেলায় বিক্রি হত সব কিছু।

আমি গেছি শোণ মেলা বা হরিহরচ্ছত্রের মেলায় বার দুই তিন। চাষের জন্য পুরুষ মহিষ, যাকে আদিবাসী মূলবাসী বন্ধুরা কাঁড়া বলেন, কোথাও কোথাও তাদের দেখেছি। দেখেছি জমি কর্ষণের বলীবর্দ— বলদ, গাভীগর্ভে পুংবীজ দেওয়ার ষণ্ড— ষাঁড়। তাদের শিঙে পেতলের কারুকাজ। অত সুন্দর, একই সঙ্গে অত্যন্ত বিপজ্জনক ছুঁচলো শিঙ। অনেকটা উঁচু সেই ষাঁড় বা বলদের উচ্চতা মাটি থেকে অনেকটা। তাদের ককুদ— পিঠের কুঁজ সমুন্নত, যেমন দেখায় মহেঞ্জদারো-হরপ্পা থেকে ভূমি খননের পর পাওয়া সীল-ছবি। অণ্ডকোষ ঝুলন্ত, অতি বৃহৎ। লিঙ্গদেশ সমর্থ। আকাঙ্খী। এই দোলায়মান অণ্ডকোষটিকে বীজথলিও বলা চলে। সেই থলিতে লক্ষ শুক্রবীজের গর্জন।

আরও পড়ুন
ও, ও, ঘুড়ি— ঘুড়ি রে

শোণমেলায় হাতি, নানা ধরনের হাতি, ঘোড়া, অশ্বতর— খচ্চর, ছোট ঘোড়া, শিশু ভালুক, চিতাবাঘ, বাঘের ছানা, ময়ূর— সব বিক্রি হতে দেখেছি। সেই সঙ্গে উটও। আর দেখেছি কমন স্পটেড ডিয়ার— হরিণ, শম্বর বিক্রি হতে। সারা রাত জুড়ে ছুটোছুটি করে মশাল-আলো। শোণের বুকে— শোণ নদের বুকে চাঁদ তখন রূপকুমারীর হারানো দর্পণ। কি তার উজ্জ্বল বিভা। জ্যোৎস্নায় চারদিক পুড়ে যাচ্ছে যেন। গায়েও পড়ছে ফোসকা, কারও কারও, আমারও যেমন। কোনো কোনো তাঁবু থেকে নাচের হুল্লোড়, ঘুঙরুর শব্দ ভেসে আসছে। বেশির ভাগ তাঁবু থেকেই বোতলের ঠুমঠাম। গেলাসের টুংটাং।

আরও পড়ুন
বিশ্ব ইজতেমা, তবলিগ জামাত, আরও কিছু

রাতভ’র ঘুরে বেড়াই সেই পশু-মেলায়। ঘোড়া, হাতি, ষাঁড়, মহিষের নাদের আলাদা আলাদা গন্ধ, দুর্গন্ধ, তাদের গা থেকে উড়ে আসা গন্ধ— সব মিলিয়ে সে এক আজব চিড়িয়া-জগৎ, তার সঙ্গে মিশে যাচ্ছে কাটা ও আঁটির খড়, বিচালির ঘ্রাণ। সারা রাত জুড়েই প্রায় ঘুরে বেড়াই মেলায় একা একা। চাঁদে ভিজি, পুড়ি। ডেহরিয়ান শোণ স্টেশনে নেমে ছিলাম কী, সত্তরের শেষ লগ্নে, এই শোণ মেলায় যাওয়ার জন্য? কী জানি সবটা স্পষ্ট নয় সর্বদা। সর্বত্র পশু পূরীষ— তার ভেতর হজম না হওয়া খড়ের কুচো, শস্যদানা। আরও সব হাবিজাবি।

আরও পড়ুন
বলি, কুরবানি— মাংস

পুষ্করের মেলায় প্রচুর দোকান বসে তলোয়ার, বর্শা, বল্লম, নানা ধরনের ছোট-বড়ো ছুরি, ছোরা, কাটার, বাঘনখ। এয়ার রাইফেল, এয়ার পিস্তলের দোকানও আছে অনেক। মেয়েদের জন্য চুড়ি, বালা। রুপো, পেতলের তৈরি। রয়েছে শাড়ির দোকান। অনেক অনেক কাচের চুড়ি, রঙিন ঝলমলদার, দেখার। আছে সালোয়ার-কামিজ, সালোয়ার-কামিজের পিস, ওড়না।

আরও পড়ুন
শাঁকনি সাপের মালা, কালিকানন্দ অবধূত

পুষ্করে সরোবর তীরে মস্তক মুণ্ডন করানো বহু বিশ্বাসী সনাতনী। যেমন প্রয়াগরাজ— ইলাহাবাদে মস্তক মুণ্ডন ও শ্রদ্ধানুষ্ঠান— শ্রাদ্ধ হয়। ন্যাড়া হয় মূলত ছেলেরাই। মস্তক মুণ্ডনের ব্যবস্থা আছে কেদারনাথ সহ বহু সর্বভারতীয় তীর্থক্ষেত্রে। সে কথা আর বিস্তারে যাচ্ছি না। অখণ্ড বিহারের গয়া তো শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানের কেন্দ্র, ফল্গু নদীর তীরে। গুপ্তধারা ফল্গু। কাশীতে, পুরীতে ব্যবস্থা আছে মস্তক মুণ্ডন করে পিতৃশ্রাদ্ধের। 

পুষ্করে অস্ত্রের দোকান, সেখানে তরবারি দেখার মতো। ফঙ্গবেনে খেলনা সোর্ড নয় একেবারেই। ধারালো, ওজনদার, বাহারি।

পুষ্কর ও শোণের মেলা নিয়ে বিস্তারিত লেখা যায়। বহু অভিজ্ঞতা রয়ে গেছে স্মৃতিময় ভাণ্ডারে। কেন পুষ্কর মেলায় এত তলোয়ার আর পাখি শিকারের রাইফেল, শটগানের আয়োজন বুঝি না। মনে মনে নিজেকে বারংবার প্রশ্ন করেও সঠিক উত্তর পাইনি। যেমন উত্তর পাইনি কেন পাহাড়ের ওপর জৈনতীর্থ রাজস্থানে— মাউন্ট আবু— সেখানেও ঢালাও তরবারি পাখি শিকারের বন্দুক ও শটগানের আয়োজন?

আবু পাহাড়ে— মাউন্ট আবুতে কি চমৎকার সেই জৈনতীর্থে দিলওয়ারা টেম্পল, কি তার অসামান্য কারুকাজ— পাথরের ওপর দিলওয়ারার জৈন মন্দির দেখে মুগ্ধ হতে হয়। মাউন্ট আবু চমৎকার, পরিচ্ছন্ন, হালকা শীত, তুলনায় সমতলের থেকে অনেকটাই বেশি। রাস্তাঘাট, অ্যান্টিকের দোকান, মূর্তি আর মূর্তি, ছোট-বড়ো, সেইসঙ্গে দারুণ দারুণ সব স্টিক— বাহারি, মোজরি, লপেটা, নাগরা— এই ডিজাইনের জুতো, সমস্ত রাজস্থান জুড়েই অবশ্য নাগরা, লপেটা আর মোজরির আধিপত্য, পাওয়াও যায় খুব চমৎকার।

আবু পাহাড়ের পরিবেশ অতি চমৎকার। তবে এর মধ্যে বেসামাল যেন সব— খেলনা নয়, এয়ার রাইফেল আর এয়ার পিস্তলের ঢালাও দোকান। রাজস্থানের অতি বিখ্যাত খাবার— স্পেশাল ডিশ দালবাটি চুরমা বা ডালবাটি চুরমা পাওয়া যায় মাউন্ট আবুতেও।

রাজস্থানের জয়পুর যেমন পিঙ্ক সিটি, সেখানে জ্যোতিষী ব্যবসার লোকজন খুব। পাথর বিক্রি— তথাকথিত ‘গ্রহ-ফাঁড়া’ শান্তির জন্য। জয়পুরে জুয়েলারি, নাগরা, লপেটা, মোজরি, শাড়ি— আর্থ কালারে ডিজাইন করা, সবই তো অসামান্য। রয়েছে নানা শো পিস। আগ্রাতেও মোজরি এবং নাগরা বা নাগরাই, লপেটা বেশ সস্তা। ১৯৬১ সালে এক টাকায়, হ্যাঁ এক টাকায় নাগরা বিক্রি হতে দেখেছি ডেকে ডেকে, এক টাকার দাম অবশ্য তখন অনেক, অনেক। চামড়ার শুঁড় তোলা পা ঢাকা নাগরা। আমার অকাল প্রয়াত পিতামহ অম্বিকানাথ রায় নাগরা, মোজরি— দুই-ই পরতেন। রাজস্থানে কৃষ্ণসার মৃগ— ব্ল্যাক বাক ও ময়ূর অফুরন্ত। হরিণও আছে।

কথা শুরু হয়েছিল হাওড়ার বালি বাজারে ব্রহ্মাপুজো নিয়ে। প্রায় প্রত্যেক বড়োসড় বাজারেই একটা সমস্যা থাকে আগুন লাগার, অন্তত ষাটের দশকে তেমনই সম্ভাবনা ধারাবাহিক ছিল। সেই আকস্মিক অগ্নি-দুর্ঘটনা আটকাতেই নাকি পদ্মযোনি সম্ভূত ব্রহ্মার আরাধনা। তখন গরমের দিন। ফলে আগুন লেগে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রচুর। বাঁশ, দরমা, টিন, খাপরা, টালি, অ্যাজবেস্টসের ঘরে তো আধুনিক জতুগৃহ সাজানো আছে, তারওপর পুরনো, অতি পুরনো ইলেকট্রিক লাইন থেকে শর্ট সার্কিটের অতুল সম্ভাবনা। জড়ানো মড়ানো তার, কার মিটার যে কার ঘাড়ে, আদৌ সাবমিটার বা মিটার নেই। এরকম একটা ইলেকট্রিক তারের দলা পাকানো, আধা লিক, লিক অবস্থা থেকে যে কোনো সময় আগুন। আগুন। আগুন…।

তখন ফায়ার ব্রিগেড বা দমকল বাহিনী আছে, রয়েছে তার লাল রঙের জলবাহী গাড়ি, হোস পাইপ, তবু ব্রহ্মা পুজো— আগুন আটকাতে। বালি বাজারে ঢোকার মুখে ডান হাতে মনুদার যে ঘুড়ি-লাটাই সুতোর দোকান, বঁড়শি, ফাতনা, হুইল ছিপের বিক্রির ব্যবস্থা, তেমনই বাজারের ভেতর আর এক মনুদার ডিমের দোকান, সেই দোকানেরই এক পাশে ব্রহ্মা পুজো। ব্রহ্মা পুজো উপলক্ষে বাজার-বিক্রেতাদের যাত্রা, হোলনাইট, সেই সঙ্গে তিন দিন দিনের বেলা দরিদ্র নারায়ণ সেবা, বা সাদা বাংলায় ‘কাঙালি ভোজন’। খিচুড়ি, ছ্যাচড়া বা লাবড়া আর বোঁদে। 

বাজারের বিক্রেতারা নিজেরাই যাত্রার রাজাগজা সাজতেন। ছেলেরাই গোঁফ কামিয়ে ফিমেল রোল। সে এক আলিশান ব্যাপার।

আগেই বলেছি, রাজস্থানের পুষ্কর ছাড়া ভারতবর্ষের আর কোথাও ব্রহ্মার মন্দির নাকি নেই। সরস্বতীর মন্দিরও প্রায় দেখা যায় না, কেন কে জানে।

ঘুড়ির কথাও আসবে এ পর্যায়ে। আমাদের বন্ধু ‘প্রহর’-এর শুভজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছে বজবজ, বাটানগরে বড়োদিনের দিন— ২৫ ডিসেম্বর ঘুড়ি ওড়ে। তথ্যটি খানিকটা জানা ছিল। শুভজিতের কথায় বিষয়টি আরও পাকা হল। বাটানগরে সাহেব কলোনি থেকেই ২৫ ডিসেম্বরে ঘুরি ওড়ানোর চল। সাহেবরা চলে গেলেও রয়ে গেছে সেই রীতি। বিশ্বকর্মা পুজোয় উত্তর কলকাতার, বাগবাজার, তেলিপাড়া, শ্যামপুকুরে ছাদ বোঝাই করে ঘুড়ি ওড়াতে, প্যাঁচ খেলতে দেখেছি। দোতলা, তিনতলার ছাদ, এমনকি ‘ন্যাড়া’ ছাদও। ঘেরা ছাড়া ছাদে ঘুড়ি ওড়াতে গিয়ে, ধরতে ধরতে প্রায়ই দুর্ঘটনায় মৃত্যু তখনকার নৈমিত্তিক ঘটনা। মাঞ্জা রুজতে রুজতে হাত খুলে যাওয়ার দশা। তখনও সর্বঘাতী চিনা মাঞ্জা আসেনি। যে সিনথেটিক সুতোয় পাখিদের ডানা, গলা তো কাটা পড়ছেই, কাটছে মানুষের গলা, কান— সব। ঘুড়ির কাগজকে চিন কাগজ বলার রেওয়াজ থাকলেও, তা ছিল মেড ইন বেঙ্গল।

দক্ষিণ কলকাতার কালীঘাট ১৬/১ ঈশ্বর গাঙ্গুলি স্ট্রিটে আমার ভারতবিখ্যাত ব্যায়ামবীর মামাতুতো ভাই পার্থসারথী ভট্টাচার্য বিছানায় শুয়ে শুয়ে ঘুড়ি ওড়াত। কয়েক মাস হল হার্ট অ্যাটাকে চলে গেল। পার্থ খুব শৌখিন ছিল ঘুড়িতে। ঘুড়িতে ঘুড়িতে কাঁটা, কেটে যাওয়া ঘুড়ি লুটে নামিয়ে আনা ছিল অতি কৌশলের ব্যাপার।

বড়ো কঞ্চির লগা নিয়ে— পাতলা, রোগা বাঁশের লগা ঘাড়ে ফেলে ঘুড়ি ধরা বা লোটার লোকজন তখন অনেক। তাঁরা মুখে বলতেন, ‘ধরা আছে, ধরা আছে।’ না ধরেই বলতেন এই কথা অনেক সময়। বালি, বেলুড়, উত্তরপাড়ায় এই ছবি জ্যান্ত ছিল ষাট-সত্তর দশকে। তখন বালিতে যে ঘুড়িবাজরা বা ঘুড়িয়ালরা ছিলেন তাঁদের কথা আলাদা করে লিখব। তখনও চিনা কাগজের ওয়াটার প্রুফ ঘুড়ি, চিনা লাটাই আর চিনা সুতো বাজারে আসেনি।

তখন বাড়ির মেয়েরা, বৌয়েরাও মাঞ্জার টিপনি বা টিবনি ধরতেন, কাচ গুঁড়িয়ে ন্যাকড়ায় ছেঁকে দিতেন, মাঞ্জার জন্য। বাইরে— মফঃস্বল হলে গাছে গাছে জড়িয়ে বা বাঁশ পুঁতে তার সঙ্গে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সুতোয় মাঞ্জা দেওয়া হত। অনেক সময় বাইরে অসুবিধে থাকলে ঘরে বসে বসে, মেঘলা ইত্যাদি থাকলে লাটাইয়ে লাটাইয়ে মাঞ্জা হত। এক লাটাই থেকে আর এক লাটাইয়ে সুতো জড়িয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঞ্জা। সেই মাঞ্জা অবশ্য যে খুব কেজো হত, এমন নয়। সুতো পচে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকত পুরো মাত্রায়। তবু দেওয়া হত মাঞ্জা, ঠেকে গেলে। উত্তর কলকাতায় এমন সংস্কার ছিল বহু প্রাচীন পরিবারে, বিশেষ করে গন্ধ বণিক, সুবর্ণবণিক পরিবারে, সেইসঙ্গে অন্য অন্য কয়েকটি প্রাচীন পরিবারেও সংস্কার ছিল বিশ্বকর্মা বা বিশ্বকম্মার দিনে ঘুড়ি না ওড়ালেও ঘুড়ি লাটাইয়ে হাত ছোঁয়াতেই হবে। লাটাইকে এঁরা অনেকে নাটাইও বলতেন। আবার ‘নাটাই’ নামে একটি ব্রত আছে পশ্চিমবঙ্গে।

মেয়েরা, শুধু মেয়েরাই দোল খেলছেন, দেখেছি উত্তর কলকাতায়, খেলছেন আবিরও। আবার মেয়েরা— বড়ো বড়ো বাড়ির সুন্দরীরা ওড়াচ্ছেন ঘুড়ি, বিশ্বকর্মা পুজোর দিনে, সেইসঙ্গে জোরে জোরে বাজছে কাঁসি বা কাঁসর একটা ভোকাট্টা হলে। পে হারা— পে পে হারা— ভোমারা, ভোমারা এই ঘুড়ি কাটার রণধ্বনি শুনেছি বালিতে, ষাটের দশকে। রাধু-কালু দুই ভাই লাটাইয়ে সুতো গোটানোকে গুড়িয়ে দেওয়া বলতেন। ষাটের দশকে বালিতে প্রথম গিয়ে সরস্বতী পুজোয় ঘুড়ি ওড়ানো দেখে, সরস্বতী ঠাকুরের হাতে বড়ো ঘুড়ি দেখে অবাকই হয়েছিলাম। কলকাতায় বিশ্বকর্মার হাতে কখনও কখনও জোড়া একতেল বা একতে, সেইসঙ্গে সুতো জড়ানো বা সুতো ছাড়াই লাটাই। বিশ্বকর্মা ভাসানে এই সময়ই শুনি— বিশ্বকর্মা মাঈকি জয়। প্রথম প্রথম বুঝতাম না, পরে তো ভালো করে শুনে হতবাকই যাকে বলে। বিশ্বকর্মা জলে পড়া মানেই তো পুজো— দুর্গাপুজো আসার প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেল।

Powered by Froala Editor