তখনও পরাধীন ভারত; ইংরেজদের হটিয়ে বাংলাতেই জন্ম নিয়েছিল দুটি ‘স্বাধীন’ সরকার

সাল ১৭৫৭। পলাশির আমবাগানে বাংলার নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার পরাজয় শুধু বাংলাতেই নয়, ভারতের আকাশেও সিঁদুরে মেঘ দেখিয়ে দিয়েছিল। একের পর এক বিদেশি শক্তির ভিড়ে ক্রমশ বলিয়ান হল ব্রিটিশরা। বাকিটা টানা ২০০ বছরের পরাধীনতার নির্মম গল্প। ভারত তখন আরও বিশাল, আরও ব্যাপ্তি তার। এমন ‘সোনার রাজহাঁস’কে কি কেউ হাতছাড়া করে? ব্রিটিশ দমনপীড়নের প্রত্যুত্তরও শুরু হল একটু একটু করে। উঠে এল একের পর এক নাম। অখ্যাত কিছু জায়গা, ততোধিক সাধারণ মানুষ; কিন্তু কীসের যে একটা বল পেয়ে বসল তাঁদের! জীবন-মৃত্যুকে পায়ের ভৃত্য করে নেমে এলেন রাস্তায়। তারই ফল ১৫ আগস্ট, ১৯৪৭…

একের পর এক আন্দোলন দেখেছে ইতিহাস; দেখেছে রক্তও। কিন্তু দিনের শেষে পতাকা উড়েছে তরতরিয়ে। আত্মবলিদান দিয়ে ব্রিটিশদের মুখের ওপর জবাব দিয়েছিল এই বাংলাও। বিরুদ্ধে কথা বললে বা বিপ্লবী কাজকর্ম করলে সঙ্গে সঙ্গে হয় কারাবাস, নয় ফাঁসি অথবা দ্বীপান্তর। তাতেও দমে যাননি কেউ। সময় যত এগিয়েছে, আন্দোলনের রেশ ততই এগিয়েছে। এই বাংলাই দেখিয়েছিল ব্রিটিশদের সঙ্গে লড়ে পরাধীনতার গণ্ডির ভেতরে থেকেও কী করে স্বাধীনতা আনা যায়। প্রকৃত স্বাধীনতা আসার আগেই দু’দুটি জায়গায় ব্রিটিশ ইউনিয়ন জ্যাক নেমে উড়েছিল ভারতের ত্রিবর্ণরঞ্জিত পতাকা। স্বল্পকালের জন্য হলেও বাংলা দেখিয়েছিল, ব্রিটিশ সিংহের ভিতও নাড়িয়ে দেওয়া যায়! 

দিনটি ছিল ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল। বৈশাখের গরম ধীরে ধীরে নিজের রাজত্ব শুরু করেছে। রাতের বেলায় চট্টগ্রামের দিকে যাচ্ছিল একটি মালবাহী ট্রেন। ধুম স্টেশনের কাছে হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেল ট্রেনটি। কী ব্যাপার? কারা যেন রেললাইনের ফিসপ্লেট খুলে দিয়ে চলে গেছে। তাহলে তো রেলপথে চট্টগ্রামের সঙ্গে যোগাযোগই করা যাবে না! খবর গেল পুলিশে। কিন্তু এর আড়ালেই ঘটে চলেছে আরও কয়েকটি ঘটনা। সব আগে থেকে ছক কষে রাখা। দলটি ধীরে ধীরে নিজেদের তৈরি করছে। পেশি টানটান। যখন ধুম স্টেশনের কাছে এসব চলছে, তখন দলেরই অন্য একটি অংশ চলে গেল চট্টগ্রাম টেলিগ্রাফ ও টেলিফোনের অফিসে। সমস্ত যন্ত্র ভেঙে, লাইন কেটে বাড়িটায় আগুন দিয়ে দিলেন বিপ্লবীরা। চট্টগ্রাম কার্যত একটি বদ্ধ দ্বীপ হয়ে গেল। বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে কোনো যোগাযোগ রইল না। 

এইভাবেই শুরু হয়েছিল চট্টগ্রামের বিপ্লব। ৬৫ জন যুবক-যুবতীর সাহস আর বীরত্ব আজ প্রায় লোককথা। আর সামনের মানুষটি? রোগা, শ্যামলা, অল্প চুলের একজন— মাস্টারদা সূর্য সেন। অভিযানের প্রথম অংশ সফল। এবার শুরু আসল অধ্যায়। চট্টগ্রাম পুলিশ লাইনের গেটের দিকে আসছিলেন অনন্ত সিংহ আর গণেশ ঘোষ; পেছনে আরও কয়েকজন। সবার পরনেই সামরিক পোশাক। প্রহরারত পুলিশটি সেই ফাঁদে পা দিলও। ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ ধ্বনিতে ছেয়ে গেল গোটা চত্বর। সঙ্গে ছিল ‘বন্দে মাতরম’ মন্ত্র, আর রিভলভার। ব্রিটিশ পুলিশ কার্যত আত্মসমর্পণ করেছিল তাঁদের কাছে। ধীরে ধীরে দলের সবাই এক হল। অস্ত্রাগার লুঠ করতে হবে এবার। সমস্ত শহরকে স্বাধীন করতে হবে। ব্রিটিশদের দেখাতে হবে বাঙালিদের শক্তি, ভারতীয়দের শক্তি। একইভাবে পদানত হল চট্টগ্রামের অক্সিলিয়ারি ফোর্স আর্মারি। নির্মল সেন, লোকনাথ বলদের গুলিতে লুটিয়ে পড়লেন সার্জেন্ট মেজর ফেরেল। 

আরও পড়ুন
দিনটি 'অশুভ’ – জানিয়েছিলেন জ্যোতিষীরা; কার জেদে বেছে নেওয়া হল ১৫ আগস্টকেই?

অস্ত্রাগার লুণ্ঠন ও অস্ত্রাদি পেলেও কার্তুজ পাননি তাঁরা। কিন্তু শেষমেশ ১৯৩০-এর এপ্রিল মাসে ব্রিটিশদের হাত থেকে চট্টগ্রাম শহরকে মুক্ত করতে পেরেছিলেন। লোকনাথ বলের আদেশে জ্বলে উঠল অস্ত্রাগার। যেন ব্রিটিশ রাজশক্তি জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে। তারই মধ্যে মাস্টারদা জাতীয় পতাকা উত্তোলন করলেন। ঘোষিত হল স্বাধীন চট্টগ্রাম সরকারের। মাস্টারদাকে গার্ড অফ অনার দিলেন তাঁর সতীর্থ বিপ্লবীরা। তিনদিন ব্রিটিশমুক্ত ছিল চট্টগ্রাম। 

আরও পড়ুন
দেশভাগ ও বাংলা সাময়িকপত্রের বিজ্ঞাপন

আরেকটি ঘটনার হদিশ পেতে গেলে আমাদের এগোতে হবে আরও কয়েকটা বছর। ১৯৪২ সাল। গান্ধীজির আহ্বানে শুরু হয়েছে ‘ভারত ছাড়ো আন্দোলন’। কংগ্রেসের সমস্ত বড়ো নেতাকে জেলবন্দি করেছে ব্রিটিশ পুলিশ। কিন্তু আন্দোলন থামেনি। দিকে দিকে অত্যাচার বেড়েছে, আন্দোলনের তীব্রতাও বেড়েছে। অত্যাচার দেখেছিল মেদিনীপুরও। তমলুক, মহিষাদলের মতো বহু গ্রামে ব্রিটিশ পুলিশের অত্যাচারের মাত্রা সমস্ত সীমা অতিক্রম করেছিল। ঠিক সেই জায়গা থেকেই শুরু হয়েছিল লড়াইটা। আর সেই লড়াইয়ের সামনের সারিতে উঠে আসে তমলুক। ১৯৪২-এর ২৯ সেপ্টেম্বর। তমলুক থানা ও আদালত অবরোধ করেন হাজার হাজার মানুষ। সেখানে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন রামচন্দ্র বেরা আর মাতঙ্গিনী হাজরা। হাতে ত্রিবর্ণরঞ্জিত পতাকা নিয়ে আদালতের দিকে এগোতে থাকেন তিনি। এরই মধ্যে গুলি চালাতে শুরু করে পুলিশ। তখনই প্রাণ হারান ‘গান্ধীবুড়ি’ মাতঙ্গিনী হাজরা। 

আরও পড়ুন
ব্যারাকপুরের নীলগঞ্জে হত্যা করা হয়েছিল ৩০০০ আজাদ হিন্দ সৈন্যকে, ইতিহাসের ‘অজানা’ অধ্যায়

’৪২-এর এমন পরিস্থিতির মধ্যেই ভেতরে ভেতরে নতুন আগুন তৈরি করার প্রচেষ্টা করছিলেন সতীশচন্দ্র সামন্ত। এভাবে চলতে পারে না; এত মানুষের মৃত্যু, মেয়েদের সম্মানহানি— ব্রিটিশ পুলিশের এত অত্যাচার সহ্যের বাইরে বেরিয়ে গেছে। উপযুক্ত জবাব দিতেই হবে। নারকেলদহ গ্রামে সমস্ত বিপ্লবীরা একজোট হয়ে গোপন বৈঠকে বসলেন। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, আর কিছু না হোক, অন্তত তমলুক থেকে ব্রিটিশদের বিতাড়িত করা হোক। স্বাধীন সরকার গঠন করা হোক। এভাবেই গোটা দেশে ছড়িয়ে যাবে আন্দোলন। 

যেমন ভাবা, তেমনই কাজ। দীর্ঘ আন্দোলনের পর ১৯৪২ সালের ১৭ ডিসেম্বর ইউনিয়ন জ্যাক নামে তমলুকে। জাতীয় পতাকা ওঠে, তৈরি হয়ে স্বাধীন তাম্রলিপ্ত সরকার। ইতিহাস বলে, স্বাধীনতার আগে গঠিত স্বাধীন সরকারগুলির মধ্যে সবথেকে বেশিদিন টিকেছিল তমলুক। সমস্ত নিয়ম, মন্ত্রকও ঠিক করা হয়। সর্বাধিনায়ক হন সতীশচন্দ্র সামন্ত; অর্থসচিবের দায়িত্ব নিয়েছিলেন অজয়কুমার মুখোপাধ্যায়, যিনি পরবর্তীকালে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীও হয়েছিলেন। সুশীলকুমার ধাড়া ছিলেন সমর এবং স্বরাষ্ট্রসচিব। এইভাবেই শুরু হয়েছিল সরকার। বাসিন্দাদের সমস্ত রকম সুবিধা অসুবিধায় এগিয়ে গিয়েছিল তাঁরা। ঘূর্ণিঝড় হলে তাঁরা ত্রাণের কাজও চালায়। যেভাবেই হোক, তমলুকবাসীর পাশে থেকেছেন সর্বক্ষণ। 

১৯৪৪ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্রিটিশমুক্ত ছিল তমলুক। ইতিমধ্যেই ১৯৪৩ সালে সতীশচন্দ্র গ্রেফতার হন। কিন্তু বাকিরা এক মুহূর্তের জন্যও সরকারকে দুর্বল হতে দেননি। শেষমেশ গান্ধীজির ডাকে সরকার ভাঙেন তাঁরা। কিন্তু ব্রিটিশদের কাছে পদানত হননি। হননি আরও দুজন মানুষ। দেশের বাইরে থেকে লড়ে গেছেন স্বাধীনতার জন্য। তৈরি করেছেন ‘আজাদ হিন্দ ফৌজ’। রাসবিহারী বসু ও সুভাষচন্দ্র বসুর নেতৃত্বে তৈরি হয়েছে বাহিনী। ‘দিল্লি চলো’র ডাকে সাড়া দিয়েছেন সবাই। সেখানেই তৈরি হল আজাদ হিন্দ সরকার। সর্বাধিনায়ক স্বয়ং নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু! এভাবেই একদিন ব্রিটিশদের ভারী বুটের আওয়াজ থেমে যায়। ভারত স্বাধীনতার নতুন স্বপ্নে জেগে ওঠে। বাকিটা তো জানেন সকলেই...

Powered by Froala Editor

More From Author See More