দিনটি 'অশুভ’ – জানিয়েছিলেন জ্যোতিষীরা; কার জেদে বেছে নেওয়া হল ১৫ আগস্টকেই?

দীর্ঘ একশো নব্বই বছরের পরাধীনতা। তারপর ১৯৪৭ সালের ১৫ অগস্ট শৃঙ্খলমুক্তি। স্বাধীনতার স্বাদ পেল ভারত। ব্রিটিশ শাসকের হাত থেকে ক্ষমতার হস্তান্তর। ‘কত প্রাণ হল বলিদান’ তার হিসেব নেই। বিশ শতকের গোড়া থেকেই ব্রিটিশ সরকার বুঝেছিল, একটু-একটু করে মাথা চাড়া দিচ্ছে একটা অবদমিত দেশের মানুষ। আন্দামান সেন্ট্রাল জেলের সামনেই লর্ড মায়োর হত্যা, মুজফফরপুরে বোমা নিক্ষেপ কিংবা চট্টোগ্রাম অস্ত্রাগার দখল ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছিল ব্রিটিশ শক্তির বুকে। সেই কম্পনের মাত্রা বহুগুণে বেড়েছিল ১৯৪০ সালের পর। নেতাজির কার্যকলাপ ছত্রভঙ্গ করে দিয়েছিল দেশের ব্রিটিশ সরকারের ভিত। অন্যদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল গান্ধীজির অসহযোগ আন্দোলনের আগুন।

১৯৪৫ সালে যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়, তখন ব্রিটিশ সরকারের ভাঁড়ার প্রায় শূন্যের দিকে। যুদ্ধে জয় এলেও দেউলিয়া দেশ। উপনিবেশ তো দূরের কথা, নিজেদের দেশ চালাতেই তখন নাভিশ্বাস ইংল্যান্ডের। এরই মধ্যে ব্রিটিশ শাসকদের আরও একটি ধাক্কা। ১৯৪৫ সালে ব্রিটেনের ভোটে শ্রমিক পার্টির জয়। শ্রমিক পার্টির ইস্তাহারেই উল্লেখিত ছিল ইংল্যান্ডের সকল উপনিবেশের স্বাধীনতা অর্পণ। অনেকটাই মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা যেন। স্বাধীনতা আন্দোলনের সামনে ধুঁকতে থাকা ব্রিটিশ রাজের ওপর আরও একটি বাড়তি চাপ যোগ করেছিল শ্রমিক দলের জয়।

লর্ড ওয়েভেল প্রাথমিকভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা-বার্তা শুরু করেছিলেন দেশের বিভিন্ন দলের নেতাদের সঙ্গে। তারই মধ্যে ১৯৪৭-এর ফেব্রুয়ারিতে ব্রিটেনের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ক্লিমেন্স অ্যাটলি ঘোষণা করেন, ১৯৪৮ সালের জুন মাসে স্বাধীনতা পাবে ভারত। ১৯৪৭ সালের মার্চে ভারতের শেষ ভাইসরে হিসাবে ক্ষমতায় আসেন মাউন্টব্যাটেন। ভারতের স্বাধীনতা অর্পণের বিষয়টি তত্ত্বাবধান করার উদ্দেশ্যেই তাঁকে এই পদে নিয়োগ করেছিল ব্রিটিশ শাসক। কিন্তু সমস্যা বাঁধে অন্য জায়গায়। দেশের স্বাধীনতার জন্যই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এতদিনের যে লড়াই, তাতেই চিড় ধরল শেষমেশ। বৈঠকেও সমাধান হল না তার। মহম্মদ আলি জিন্না আর নেহেরুর সেই মতানৈক্যই ঠিক করে দিল ভারতের বুকের ওপর দিয়েই টানা হবে কাঁটা তারের বেড়া। 

এই দেশভাগের কথা ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই ছড়িয়ে পড়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার আগুন। সম্প্রীতি সংঘাতে বদলে যায় অচিরেই। ধীরে ধীরে তার পরিধি বাড়তে থাকে দিন দিন। হাতের বাইরে চলে যেতে থাকে পরিস্থিতি। ব্রিটিশ সেনাবাহিনী পাঠিয়েও দাঙ্গা-পরিস্থিতি আয়ত্তে আনা দুষ্কর হয়ে ওঠে মাউন্টব্যাটেনের পক্ষে। বাড়তি কোনো ক্ষয়ক্ষতির ঝুঁকি নিতে চাননি মাউন্টব্যাটেন। অবস্থার চাপে পড়েই একবছর এগিয়ে আনা হল ক্ষমতা হস্তান্তরের দিনক্ষণ। তবে পরবর্তীতে মাউন্টব্যাটেন এই সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের বিষয়ে বলেছিলেন, তিনি রক্তপাত চান না।

আরও পড়ুন
বাকিরা চলে গিয়েছেন আগেই, স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম শেষ সৈনিক কার্তিকচন্দ্র দত্ত

জুন ৩ ছিল তারিখটা। নেহেরু আর জিন্নার উপস্থিতিতেই ঠিক হয়ে গেল স্বাধীনতার তারিখ। ১৫ অগস্ট। তবে এই ১৫ অগস্ট তারিখের প্রস্তাবনা ছিল মাউন্টব্যাটেনেরই। প্রস্তাবনা বলা ভুল হবে, এই তারিখের ব্যাপারে এক প্রকার অনড়ই ছিলেন তিনি। ‘ফ্রিডম অ্যাট মিডনাইট’-এ তিনি উল্লেখ করেছিলেন এই কথা। কারণ, এই ১৫ অগস্ট তাঁর কাছে ‘পয়মন্ত’। তার বছর দুয়েক আগেই মিত্রশক্তির কাছে বশ্যতা স্বীকার করেছিল জাপান। আর সেই সময়ে ব্রিটিশ বাহিনীর কমান্ডার ছিলেন মাউন্টব্যাটেন। জাপানের আত্মসমর্পণের সেই তারিখকেই ভারতের স্বাধীনতা দিবস হিসাবে বেছে নেন তিনি। ভারতের স্বাধীনতার সঙ্গেই পরাধীনতার একটা ছাপ রেখে দিয়ে যেতে চেয়েছিলেন কি তিনি? জানা নেই। শুধু ‘ফ্রিডম অফ মিডনাইট’ যেটুকু জানায় তা হল, “আই ওয়াজ ডিটারমাইন্ড টু শো আই ওয়াজ মাস্টার অফ দ্য হোল ইভেন্ট”। এমনটাই বলেছিলেন মাউন্টব্যাটেন।

আরও পড়ুন
স্বাধীনতাকামী নামিবিয়ায় নির্মম গণহত্যা, শতাব্দী পেরিয়ে ক্ষমাপ্রার্থনা জার্মানির

তবে মাউন্টব্যাটেনের এই ঘোষণাতে আরও একবার তোলপাড় পড়ে গেল দেশজুড়ে। মাউন্টব্যাটেনের এই সিদ্ধান্ততেই উত্তপ্ত হয়ে উঠলেন ভারতীয় জ্যোতিষীরা। দেশের বিভিন্নপ্রান্ত থেকেই আওয়াজ উঠল, ১৯০ বছর যখন পরাধীনতার ঘানি টেনেছে ভারত, তখন আরও একদিন টানতে আপত্তি নেই। কিন্তু ১৫ আগস্ট যেন স্বাধীনতা না দেওয়া হয় ভারতকে। কারণ তাঁদের মতে এই ১৫ আগস্টের মধ্যরাত ভারতের পক্ষে অশুভ। কলকাতার এক জ্যোতিষী মদমানন্দ মাউন্টব্যাটেনের উদ্দেশ্যে চিঠিও লিখলেন। জানালেন, মকর রাশির সঙ্গে রাহু, কেতু এবং শনির যোগ রয়েছে এই দিন। এই অশুভক্ষণে দেশের জন্ম ডেকে আনবে খরা, বন্যা, দুর্ভিক্ষ। অনুরোধ করলেন ১৪ কিংবা ১৬ অগস্ট স্বাধীনতা প্রদানের জন্য। শুধু মদমানন্দই নয়, সারা ভারতের জ্যোতিষীদের গণনাই প্রায় একই ছিল। 

আরও পড়ুন
মে মাসে কাজ হারিয়েছেন দেড় কোটি ভারতীয়, স্বাধীনতার পর এই প্রথম

অনেকেই প্রশ্ন তুলেছিলেন মধ্যরাতে অর্থাৎ রাত ১২টায় স্বাধীনতার প্রসঙ্গে। রাত পেরিয়ে সকালে ক্ষমতা হস্তান্তর এবং স্বাধীনতার ভাষণের জন্য প্রস্তাব দিয়েছিলেন তাঁরা। তবে সিদ্ধান্ত থেকে এতটুকু সরেননি মাউন্টব্যাটেন। ১৯৪৭-এর ১৫ অগস্ট পেরনোর ঠিক পরেই স্বাধীন হল ভারত। ভাষণ দিলেন প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু। তবে ১৯৪৭-এর পরের সেই ইতিহাস নতুন

Powered by Froala Editor

More From Author See More