স্বাধীনতাকামী নামিবিয়ায় নির্মম গণহত্যা, শতাব্দী পেরিয়ে ক্ষমাপ্রার্থনা জার্মানির

সময়টা উনিশ শতকের শেষের দিক। জার্মানির সিংহাসনে তখন সম্রাট প্রথম উইলহেল্ম। ব্রিটিশ, পর্তুগিজ কিংবা ফরাসিদের মতোই ততদিনে শুরু হয়ে গেছে জার্মানির ঔপনিবেশিক রাজত্ব বিস্তারের লড়াই। জার্মান শাসকের থেকে নিস্তার পেল না আফ্রিকাও। কিছুদিনের মধ্যেই জার্মান সীমানার মধ্যেই ঢুকে পড়ল নামিবিয়া-সহ বিস্তীর্ণ অঞ্চল। কিন্তু কতদিন আর সহ্য করা যায় পরাধীনতার গ্লানি? মাঝে মাঝেই তাই বিদ্রোহের আগুন ছড়িয়ে পড়ত উপনিবেশে।

জার্মান সম্রাট দ্বিতীয় উইলহেল্মের রাজত্বকালে ঠিক এভাবেই ঐতিহাসিক এক আন্দোলনের সাক্ষী থেকেছিল নামিবিয়া। স্বাধীনতা এবং নিজেদের অধিকার বুঝে নিতে বিদ্রোহের পথ বেছে নিয়েছিলেন সেখানকার নামা ও হেরেরো জনগোষ্ঠীর মানুষেরা। আর জার্মান শাসকরা? না, চুপ করে বসে থাকেননি তাঁরাও। নির্মম গণহত্যার মাধ্যমেই তাঁরা ইতি টেনেছিলেন সেই অধ্যায়ে। 

এক শতাব্দীরও বেশি সময় পেরিয়ে আসার পর এবার সেই ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করল জার্মানি। সম্প্রতি জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাইকো মাস একটি সাংবাদিক সম্মেলনে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করে নেন গণহত্যার দায়। এক বিবৃতিতে নামিবিয়ার জনগণ ও গণহত্যার শিকার হওয়া উপজাতি গোষ্ঠীর উত্তরসূরিদের কাছেও ক্ষমা প্রার্থনা করে জার্মানি। 

কিন্তু বারো দশক আগে ঠিক কী হয়েছিল নামিবিয়াতে? সেই প্রেক্ষাপট হুবহু যেন মিলে যায় সিপাহী বিদ্রোহের ঠিক আগে ঘটে যাওয়া হুল বিদ্রোহের সঙ্গে। নামিবিয়ার আদিম ভূমিপুত্র হেরেরো ও নামা উপজাতির মানুষদের থেকেই কেড়ে নেওয়া হয়েছিল তাঁদের দৈনিক যাপনের অধিকার। নিজস্ব জমির জন্যেও জার্মান শাসককে দিতে হত মোটা অঙ্কের কর। আর গবাদি পশু, ফসলের দখলদারি তো নিত্যদিনের ঘটনা। জার্মান শাসকের এই অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়েই আন্দোলনের পথে নেমেছিলেন তাঁরা। 

আরও পড়ুন
বিশ্বযুদ্ধের ৭৬ বছর পরেও নাৎসি শাসন! জার্মানিতে আজও রয়েছে এই গ্রাম

সেটা বিংশ শতকের একেবারে শুরুর দিক। নামিবিয়ায় অবস্থানরত জার্মান সেনাবাহিনীর প্রধান তখন লোথার ভন ট্রোথা। ১৯০৪ সালে আন্দোলন অবদমিত করতে দুটি উপজাতি জনগোষ্ঠীর অস্তিত্বই নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার হুকুম দিলেন তিনি। জার্মান সেনাদের সশস্ত্র আক্রমণের সামনে টিকল না সেই আন্দোলন। ফাঁকা হয়ে গেল গ্রামের পর গ্রাম জুড়ে। উচ্ছেদের পরেও শান্ত থাকলেন না জার্মান শাসকরা। ধ্বংস করে দেওয়া হল ঘর-বাড়ি। আর সেখানকার আদি ভূমিপুত্রদের জায়গা হল মরুভূমিতে। কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে। এক কথায় তা বন্দিশালাই।

আরও পড়ুন
বিশ্বযুদ্ধে লুঠ করেছিল নাৎসি বাহিনী, ৭৭ বছর পর পোল্যান্ডে ফিরছে ৪০০ কেজির চার্চ-বেল

সেখানেই চলত তাঁদের নির্মম অত্যাচার। স্বাধীনতার কথা মুখ থেকে বেরলেই গুলি করে হত্যা করা হত তাঁদের। তাছাড়াও অনাহারে মারা যান বহু মানুষ। আর যাঁরা বেঁচে গেছিলেন, তাঁদের ওপরে চলত যৌন হেনস্থা। টানতে হত দাসত্বের ঘানি। কখনও আবার নানান ধরনের অনৈতিক চিকিৎসা পরীক্ষাও করতেন জার্মান চিকিৎসকরা। সবমিলিয়ে ঠিক কত মানুষ মারা গিয়েছিলেন, তার হিসাব নেই কোনো। তবে সংখ্যাটা লক্ষের কাছাকাছি। সেসময় দুই জনগোষ্ঠীর জনসংখ্যাই হ্রাস পেয়েছিল ৮০ শতাংশ।

আরও পড়ুন
দুই ভাইয়ের বিবাদেই জন্ম পুমা এবং অ্যাডিডাসের, ‘রাইভালরি’ ভেঙেছিল জার্মানির শহরকেও

২০১৮ সাল থেকেই নামিবিয়ার এই গণহত্যা নিয়ে রীতিমতো চর্চা চলছে আন্তর্জাতিক স্তরে। চলছিল জার্মানির সঙ্গে নামিবিয়ার টানাপোড়েনও। শেষ পর্যন্ত গণহত্যার দায় স্বীকার করল জার্মানি। শুধু স্বীকার করাই নয় বরং ক্ষতিপূরণ দেওয়ারও আশ্বাস দিল স্টেইনমিয়ারের দেশ। সম্প্রতি সরকারি বিবৃতিতে ১১০ কোটি ইউরোর অর্থাৎ ১৪৪ কোটি মার্কিন ডলারের আর্থিক সাহায্যের কথা ঘোষণা করল জার্মানি। আগামী তিরিশ বছরে নামিবিয়ায় স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা ও অন্যান্য পরিকাঠামো গঠনে ব্যবহৃত হবে এই অর্থ। এমনকি চলতি বছরের মধ্যেই নিজে নামিবিয়ায় গিয়ে ক্ষমাপ্রার্থনা করার কথাও জানিয়েছেন জার্মান প্রেসিডেন্ট ফ্র্যাঙ্ক স্টেইনমিয়ার।

তবে জার্মানির এই ক্ষতিপূরণে সন্তুষ্ট নয় নামিবিয়া। ক্ষয়ক্ষতির তুলনায় এই অর্থ সাহায্য সামান্য বলেই দাবি করছেন তাঁরা। পাশাপাশি হেরেরো ও নামা উপজাতির মানুষরা বর্তমানে ভূমিসমস্যায় জর্জরিত। আর্থিক অনুদানে তাঁদের বাস্তবে কিছু উন্নতি হবে না বলেই অভিযোগ নামিবিয়া প্রশাসনের। তবে উপায়? নামিবিয়ার দাবি, বিশ শতকে অধিকৃত অঞ্চলে এখনও বসবাস করেন জার্মান ভাষাভাষীর কিছু মানুষ। তাঁদের সংখ্যা হাতে গোনা হলেও, বিপুল পরিমাণ জমির মালিক তাঁরাই। তাঁদের সেই অধিকৃত জমি যাতে নামিবিয়ার প্রাচীন জনগোষ্ঠীর মানুষদের হাতে তুলে দেওয়া হয়, সেই আবেদনই রাখছে নামিবিয়ার প্রশাসন। কিন্তু সেটা সম্ভব কীভাবে, তা নিয়েই থেকে যাচ্ছে প্রশ্ন। এক শতাব্দী আগে কাদের পূর্বপুরুষেরা শিকার হয়েছিলেন এই গণহত্যার তার নির্দিষ্ট পরিসংখ্যান ও তথ্য না থাকায় জটিলতা তো থেকেই যাচ্ছে। পাশাপাশি এটাই যদি সমাধান হয়, তবে তৎকালীন সময়ে নামিবিয়া ছেড়ে ক্যামারুন বা টোগো-তে আশ্রয় নেওয়া মানুষরা কি বিচার পাবেন? অস্পষ্ট থেকে যাচ্ছে সেই জায়গাটাই। তবে ঔপনিবেশিক শাসনকালে ঘটে যাওয়া অপরাধের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার সৎ পদক্ষেপ, এর আগে অন্য কোনো দেশই দেখায়নি। সেদিক থেকে জার্মানি তৈরি করল এক অনন্য নজির।

Powered by Froala Editor