দক্ষিণীরা ক্রমশ কাশীর দখল নিচ্ছেন

মুছে যায়?— ৪৫
আগের পর্বে

কাশীতে বংশানুক্রমে জ্যোতিষচর্চা করতেন ভৃগু পণ্ডিতেরা। তবে ভবিষ্যৎ নয়, বরং গতজন্মের, জন্মান্তরের অতীত জানতেই তাঁদের কাছে ভিড় করতেন মানুষ। সাম্মানিক বা দক্ষিণার ওপর ভিত্তি করে তাঁদের মধ্যে ছিল শ্রেণীবিভাগও। প্রায়ান্ধকার ঘরে বসে জাতক বা জাতিকার কোষ্ঠীপত্র খুলে তাঁরা অবিরাম বলে যেতেন গত জন্মের গল্প। অধিকাংশক্ষেত্রে বহু পুরনো বাড়ির একতলার ঘরে চলত এই রহস্যময় স্মৃতিমন্থন। কাঠের ধোঁয়ায় আর আলো-আঁধারিতে সেখানে দিন-রাত্রির ফারাক করাই দায়। কাশীর বুক থেকে হারিয়ে গেছে সেই জ্যোতিষীরাও। তারপর…

উত্তরবাহিনী গঙ্গায় সূর্যোদয় বা সূর্যাস্ত— সবই কেমন যেন তাম্রাভ-তামাটে, অন্তত এই শীতের বেলায়। সেই স্রোতে— গঙ্গায় দেখেছি গ্রীষ্মে মোটা বাঁশের হাত তিনেক লম্বা টুকরো অর্ধেক করে, মানে মাঝখান দিয়ে চিরে দোফালা করে তার নিচে দড়ি দিয়ে ভারি পাথর বেঁধে ভাসিয়ে রাখা হয় জলের ওপর। সেখানে ভোর, ভোর, দুপুরেও এসে এসে চার-ছটি পায়রা, সেই কবুতরেরা গঙ্গাস্রোতে ঠোঁট ডুবিয়ে জলপান করতে থাকে সারাটা গ্রীষ্ম। কাশী, বেনারস, বারাণসী— যে নামেই ডাকি না কেন তাকে, সেই ‘শিবনগরী’ বা ‘শিবস্থল’ নিয়ে এত ছবি তোলাতুলি, ডকুমেন্টারি, ডকুফিচার হয়েছে, কোথাও দেখিনি এই পারাবত পানালাপ।

ঘোর গ্রীষ্মে নৌকা নিয়ে গঙ্গাপারাপার নয়, গঙ্গা বিহারও বলা যাবে না তাঁকে, গঙ্গা স্রোতারোহণও কি বলা যাবে তাঁকে? যাই হোক, সেই উত্তরবাহিনী যাপনে চোখে পড়ে এই ছবি। জলে ভাসা চেরা বাঁশের ওপর বসে বহমান জলে বার বার ঠোঁট ডোবাচ্ছে পায়রারা। সঙ্গে হয়তো অন্য অন্য প্রজাতির পাখিও দু-একটি।

ভৃগু-পণ্ডিতের কাছে যাঁরা যাঁরা পরচি বা পর্চি খুলে গত গত জন্ম বা তারও আগের জন্মের কথা জানতে গেছিলেন, তাঁরা অনেকেই আজ আর নেই এই পৃথিবীতে। যাঁরা আছেন, তাঁরা প্রায় বৃদ্ধ অথবা প্রৌঢ়ত্ব আর বার্ধক্যের সীমানায় দাঁড়িয়ে। সিঁড়ির নিচে— ভৃগুবাড়ির ঘোরানো সিঁড়ির নিচে গোলানো অন্ধকার। সেই সিঁড়ির পাশে যে অনেক উঁচু ছাদটি, তার গায়ে লাগানো লোহার আংটা থেকে একটি পাখির খাঁচা ঝুলিয়ে দিলে চিত্রটি অন্যরকম কোন পূর্ণতা পেত? ছবি তৈরি হয়ে যেত আর এক রকমের?

পুরনো কাশীতে, কলকাতাতেও তো তখন প্রায় ঘরে ঘরে পোষা পাখি, খাঁচায়, দাঁড়ে। গ্যালভানাইজড টিনের পাতের বড়োসড় পিঞ্জর, তার সঙ্গে সঙ্গে বেতে তৈরি, মানে বাঁশ দিয়ে তৈরি পিঁজরা, এছাড়াও আছে পিত্তল নির্মিত খাঁচা। দাঁড়, তাতেও লোহা আর পেতলের ভাগাভাগি— লৌহ নির্মিত, পিত্তল নির্মিত। দাঁড়ে বসে কাকাতুয়া, ময়না, টিয়া, মদনা, ফুলটুসি। কাকাতুয়ার মধ্যেও আবার জাত-ফারাক-ব্রিডের পার্থক্য। অস্ট্রেলিয়ান কাকাতুয়া সবচেয়ে ভালো। অতি দ্রুত কুকথা— খিস্তি রপ্ত করতে জুড়ি নেই যাদের, মাথায় হলুদ রঙের ফুলঝুঁটি বড্ড বাহারি। খুলে-মেলে ধরলে কথা হবে না কোনো, কি রূপ, কি রূপবাহার তার।

আরও পড়ুন
বারাণসীর ভৃগু-পন্ডিত, গতজন্ম, তারও আগের আগের জন্মে…

ময়না থাকত বাঁশের পোক্ত খাঁচাতেও— আয়তনে বেশ বড়োসড়, খাবার দেওয়ার বাটিদার, সেই পিঁজরাখানি বেশ। স্মৃতির ছোট ছোট বদলাবদলিতে যদি ভৃগু-পণ্ডিতের অতীতযাপন কথা, কখনও ভবিষ্যতের টুকরো আলো-অন্ধকার— সব মিলিয়ে যে অপার্থিব ভাব ও বোধ, তার সঙ্গে খাঁচাটিও— পাখি সমেত পিঞ্জরটিও বেশ যায়, মানিয়ে যায়।

আরও পড়ুন
বারাণসী–বেনারস–কাশী

বেশ্যাবাড়ির চৌহদ্দিতে অগুনতি বেড়াল আর পাখির খাঁচা, কে জানে কেন, এইখানে তারা বড়োই যত্নে বাড়ে, তা সে নব্বই দশক পর্যন্ত তো বটেই। সোনাগাছি, খিদিরপুর-ওয়াটগঞ্জ, হাড়কাটা গলি, প্রেমচাঁদ বড়াল স্ট্রিট, কালীঘাট— সর্বত্র একই ছবি। এই কলকাতাতেও যেমন, কাশীর ডাল কি মণ্ডি, লখনউয়ের তওয়ায়েফখানা— সর্বত্র এক, একই ছবি। বেড়াল আছে, বেড়ালরা আছে বড্ড যত্নে, পাখিরা— সাধের পক্ষীকূল, তারাও রয়েছে অসম্ভব ভালো খেজামতে— তত্ত্বাবধানে, একেবারে আদরে-গোবরে যাবে বলে।

আরও পড়ুন
ধর্মশালা, ধরমশালা, কিছু কথা

কলকাতার পার্কস্ট্রিটের ‘খালিকোঠি’-তে কোনো পাখি পোষার কেস ছিল না সত্তর আশির দশকেও। 

আরও পড়ুন
কমলাপতি, চন্দ্রশেখর, বহুরানি

ষাত-সত্তরে তো কলকাতায় প্রচুর অ্যাংলো ইন্ডিয়ান কল গার্ল, বেশ্যা, কলকাতা পুলিশে অনেক অনেক অ্যাংলো ইন্ডিয়ান সার্জেন্ট, বহু ইলেকট্রিক মিটার রিডার কলকাতা ইলেকট্রিক সাপ্লাইয়ে, ষাটের দশকে কয়লায়টানা রেল ইঞ্জিনে, মানে কয়লা থেকে তৈরি স্টিম বা বাষ্পীয় ইঞ্জিনের চালক, গার্ড অ্যাংলো ইন্ডিয়ান। তাঁদের ‘ফিরিঙ্গি’, ‘ট্যাঁশ’ এইসব নামেও সম্বোধন করে থাকেন হিন্দু বাঙালি মধ্যবিত্ত।

কলকাতার পার্ক স্ট্রিটে। ‘ট্রিঙ্কাস’ সহ নানা বারে অ্যাংলো ইন্ডিয়ান গিটারিস্ট— গিটার বাজিয়ে, ড্রামার— ড্রাম বাজিয়ে। গাইয়ে— অ্যাংলো ইন্ডিয়ান গাইয়ে দেখিনি। ধর্মতলার ‘সাকি’ বারে অবশ্য সত্তর দশকের একেবারে শেষ লগ্নে, আশির দশকের গোড়ায় গোড়ায় একজনও অ্যাংলো ইন্ডিয়ান গিটারিস্ট নেই।

কাশীর ভৃগু-পণ্ডিতদের কথায় আবার ফেরা যাক। সারা ভারতবর্ষ জুড়ে, এমন কি বিদেশেও ছড়ানো ছিল ভৃগু-পণ্ডিতদের ক্ষমতা-কাহিনির কথা। বিদেশ থেকেও লোক এসেছেন তাঁদের কাছে। কিন্তু এত নিষ্ঠাকাষ্ঠা মানা ব্রাহ্মণেরা এই বিদেশিদের সঙ্গে কথা-বার্তাতে খুব একটা রাজি ছিলেন না।

তার প্রথম এবং প্রধান কারণ ছিল ভাষার অসুবিধে। দ্বিতীয়ত তথাকথিত ‘ম্লেচ্ছ’ স্পর্শ। ‘ম্লেচ্ছ ভাষা’, ‘স্পর্শ দোষ’— ছোঁয়াছুঁয়ি ইত্যাদি প্রভৃতি। ফলে ভৃগু-পণ্ডিত সরাসরি ‘ম্লেচ্ছ-দর্শন’, ‘ম্লেচ্ছ ভাষা’র সঞগে সংস্কৃতগন্ধী— ফারসি, উর্দু বাদ দেওয়া হিন্দুস্থানি হিন্দি অথবা কাশিকা বোলিতে কথা বিনিময়, সে তো এক অতি বড়ো সমস্যা বিশেষই, ফলে শার্ট-প্যান্ট, শ্যুট পরা সাহেব-মেমসাহেব দূরে, সাদা চামড়া দূরে। সে এক বেড়াঘেরা জগৎ, যাকে বলে। বেড়াঘেরা না বলে পাঁচিল তোলা, উঁচু উঁচু প্রাকার, তেমনটি বললেই বোধহয় আরও সঠিক হবে।

ষাটের শেষে, সত্তরের মাঝামাঝি সময়েও কাশীর উত্তরবাহিনী গঙ্গাস্রোতে প্রচুর প্রচুর বজরা, সাজানো, পরিপাটি। তখন সান্ধ্য গঙ্গারতি নেই একেবারেই। সান্ধ্য আরতি, গঙ্গাপুজো ইত্যাদি সব হর কি পৌড়িতে— হরিদ্বারে। 

কাশীর ঘাটে ঘাটে, বিশেষ করে দশাশ্বমেধে তখন প্রচুর প্রচুর সারবাঁধা বজরা আর অনেক অনেক নৌকো, ছোট বড়ো। দোতলা, অতি সুসজ্জিত বজরাও তখন দশাশ্বমেধ ঘাটে। শক্ত শিকলে বাঁধা তাঁরা। সেইসব বজরায় সাদা চামড়ার মানুষজনের ভিড়। বজরা ভাড়া নিয়ে থাকে অনেকেই। আগে সম্পন্ন এদেশিয়— ভারতীয়রা থাকতেন ষাটে, সত্তরে সাহেব ট্যুরিস্ট, তাঁরা কেউ কেউ আবার ‘হিপি’ নামে পরিচিত। ষাটের দশকে ‘বিট’, ‘বিটলস’, ‘হিপি’। গাঁজা, চরস, এল এস ডি, মারজুয়ানা, ব্রাউন সুগার, এলাহি নেশার আয়োজন, শুকনো নেশা, ‘ব্যোমপথে’ যাত্রা তাদের। সাধারণভাবে মদ্যপানকে ‘জলপথ’ বলে থাকেন অনেকে। ‘ব্যোমপথ’ হল শুকনো নেশা।

ষাটের শেষে দশাশ্বমেধ ঘাটে বজরা ভাড়া করা অনেক হিপি, হিপিনী। উদ্দাম যৌনজীবন, বাধাহীন নেশা— ‘ড্রাই’ নেশা। মাথার চুল ঝুঁটি করে, চুড়ো করে বাঁধা, গালে দাড়ি, মাথার চুলে জটা ভারও যেন কখনও, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, রঙিন, ভারি পাথরের মালাও কখনও। এইসব হাবিজাবি গলায়, কানে দুলও, হাতে তামা বা স্টিলের বালা, রিস্টব্যান্ড।

কাশীর ঘর-বাড়ির বিন্যাস, অর্থনীতি ভাড়া দেওয়া, ভাড়াটে, সবই বদলাতে থাকল যে একটু একটু করে। বেনারস বা বারাণসীতে বহু হিন্দু বাড়িতেই শিবালা— শিবালয় বা শিব মন্দির। পাথরের মন্দির, ভেতরে দেবতা। বাঙালিটোলায় আমার বড়ো মেসোমশাই— মহেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যর মামারবাড়িতেই যত্রতত্র শিবলিঙ্গ বসানো। তাঁদের জন্য— প্রত্যেকটি লিঙ্গমূর্তির জন্য আতপচাল আর বিল্বপত্র— চক্রহীন বিল্বপত্র— বেলপাতা বরাদ্দ। হয়তো কিঞ্চিৎ ফুলও।

সেই শিবলিঙ্গেরা মাটিতেই— আলাদা কোনো উপাসনালয়, আসন— মন্দির নেই তাঁদের জন্য। তাঁরা ধূলিশয়ানের শিব। শঙ্কর। ‘শঙ্কর ভগবনে’। কাশীতে সম্পন্ন বাঙালিদের বড়ো বড়ো বাড়ি, যাদের অনেকটাই বাঙালি টোলা আর হাতিফটকায়, তারা বিক্রি হয়ে গেল রাতারাতি— মালিকানা হস্তান্তর হল। কিনলেন মূলত আহির— যাদব পদবিধারী গোপ বা গোয়ালারা। আর খরিদ করলেন ইসলাম ধর্মের মানুষেরা। বানারস বা বেনারসের মদনপুরায় বেনারসী ব্যবসায়ী যে সম্পন্ন মুসলমানরা থাকেন, তাঁরাই অনেকে এই হাভেলি সদৃশ বাড়ি, কিনে ফেললেন একে একে। অতি দ্রুত বদল হতে থাকল মালিকানা, ঘর-বাড়ি, সম্পত্তির। 

আমার বড়ো মেসোমশাইয়ের মামাবাড়ির ভিজে আতপ চাল মাখা কালো কালো শিবলিঙ্গরা বৃষ্টিস্রোত হলে কেমন যেন অন্যরকম রং পেয়ে যায়। সেই আলিশান বাড়িও সম্ভবত বিক্রি হয়ে গেছে।

আগেও লিখেছি, আবারও লিখছি, গত কুড়ি বছর কাশীতে তামিল প্রচাব, তামিল বসবাসকারীর সংখ্যা অনেকটাই বেড়েছে। তাঁরা বাড়ি ভাড়া নিচ্ছেন। বাড়ি কিনছেনও। ইদানিং প্রচুর সাউথ ইন্ডিয়ান ফুডের দোকান কাশীতে। বড়ো বড়ো দক্ষিণী খাবারের দোকান। তাদের ব্যবসাও খুব ভালো। 

আদি শঙ্করাচার্য একসময় দক্ষিণভারত থেকে ব্রাহ্মণদের নিয়ে গেছিলেন হিমালয় ছোঁয়া কেদারনাথের পূজারী হিসাবে। যাঁরা আদি শঙ্করাচার্যকে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ বা ধর্মনেতা বলে মনে করেন, তাঁরা বলেন, এভাবে নাকি ভারতবর্ষকে এক করতে চেয়েছিলেন শঙ্করাচার্য, এই তথাকথিত একীকরণ, বহুত্ববাদ— বহুসূত্রের মধ্যে, বিভেদের মধ্যে ঐক্যের সুর, যা অনুভব করেছিলেন মহাত্মা গান্ধী, পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুরা তার বিরুদ্ধে আজ সারা ভারত জুড়েই এক রকম জোর করেই চাপানো হচ্ছে তথাকথির একীকরণ সূত্র। রাজনৈতিক ও সামাজিক বহুত্ববাদ, যা ভারতীয় সমাজের অন্যতম বৈশিষ্ট্য, তাকে সম্পূর্ণভাবে চেষ্টা করা হচ্ছে হত্যার। আর পুরানো বানারসকেও ‘মল’ আর সুপার মার্কেটের কর্পোরেট কালচারের বুলডোজারে ভেঙে দিচ্ছে এরা। 

এইসব কথা উঠে এল বারাণসীতে সাম্প্রতিক অতীতে দক্ষিণীদের প্রভাব বিস্তারের ছবি মনে রেখে। তাঁরা একজন আসছেন, ঘর ভাড়া নিচ্ছেন প্রথম, ছোটো ঘর থেকে বড়ো ঘর। তারপর আরও অনেকে। মূলত বয়স্করা, বৃদ্ধরা, যাঁরা মহাযাত্রার জন্য বেছে নিচ্ছেন বারাণসী ধামকে।

বারাণসীতে মারা গেলে ‘শিবালোকে’ যায়— ‘শিব’ হয়, এমন একটা প্রচলিত ধারণা ছিল পুরনো বঙ্গভূমিতে। আর রামনগর বা ব্যাসকাশীতে মরলে গাধা। এর পেছনেও আছে এক পৌরাণিক গল্প। হিন্দু পুরাণের সেই গল্পে শিব ও ব্যাসদেবের দ্বন্দ্ব এসব উঠে আসে। আমি আর কোনোভাবেই পৌরাণিক কাহিনির ভেতরে মন দিয়ে ঢুকছি না। বাইরে কয়েকটি সংকেত— বার্তা মাত্র উচ্চারণ করলাম। তার আগে যে কথা বলছিলাম, আশির দশক থেকেই শিবালা বা শিবমন্দির সমেত পাথরে তৈরি বড়ো বড়ো বাড়িগুলির একটা বড়ো অংশই গেস্ট হাউস বানিয়ে ফরেনার, ফরেন গেস্ট রাখা শুরু করল। মন্দিরের গায়েই হয়তো গড়ে উঠল ‘আধুনিক’ টয়লেট। কমোড, ইন্ডিয়ান। ষাট-সত্তরের বজরাবাসী হিপি-হিপিনীরা থাকতেন গঙ্গাবক্ষেই। তারও অনেক অনেক বছর আগে অতীত গড়গড় করে বলা ভৃগু-পণ্ডিত ‘ম্লেচ্ছ’ বা ‘ম্লেচ্ছ’ ভাষায় কথা বলা সাহেব-মেমসাহেবদের অনুমতি দেননি, তাঁদের কাছে আসার। কিন্তু পরে— কয়েক দশক পরেই সব কেমন বরাবর হয়ে গেল।

কাশীর প্যাঁড়া বা পেঁড়া, চমচম, রাবড়ি, মালাই, দহি, পান, কচৌরি— সবের সঙ্গে নতুন নতুন মিশে গেল অনেক, অনেক কিছু। মনে পড়ে ইন্দিরা গান্ধী হত্যার পর দেশ জুড়ে যে লোকসভা নির্বাচন, তার রিপোর্টিং করতে গিয়ে সি পি আই— ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির অফিস। সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে দোতলায় উঠে এলে অফিস বেয়ারার সেই মানুষটি, যিনি পার্টি অফিসেই থাকেন, সমস্ত রকম কাজ তাঁর এই পার্টি অফিসেই। সেই নির্বাচনী তরঙ্গ— চুনাওকে লহর বুঝে নিতে, চুনাও কা মুদ্দা— ভোটের মূল ইস্যু কি বুঝে নিতে বানারস গিয়ে কোথাও জায়গা নেই, ‘দশাশ্বমেধ লজ’-এ তো একেবারেই না। শেষ পর্যন্ত সেই মহেশ ভট্টাচার্যদের হরসুন্দরী ধর্মশালা। সেখানেও কোনো ঘর নেই। সব ফুল। পূর্ণ। সমস্ত ঘরেই তীর্থযাত্রী-যাত্রিনী, হয়তো ভোটের কারণে অন্যরকম একটা ভিড়। রাজনৈতিক দলের কর্মীরা এসেছেন হয়তো। থেকে গেছেন। এসেছেন ছোটমোট পত্রকার— সাংবাদিক— চুনাওয়ি মশলা ঠিক করার জন্য।

ঘরে জায়গা হল না কিছুতেই। এই ধর্মশালার যিনি ম্যানেজার কাম কেয়ার টেকার, তাকেই ধরে ধরে শেষ পর্যন্ত অফিস ঘরের সামনের বারান্দায় চাদর মুড়ি দিয়ে একটা গোটা শীতার্ত রাত। শীতকে সঙ্গে নিয়ে। আর কী আশ্চর্য, আমার পাশেই এক নগ্ন— দীর্ঘকায়, জটাফটা সমেত নাগা সাধু। দাড়িও আছে তার। রাতে খাওয়াদাওয়া ইত্যাদি নিয়ে কথা বলতে বলতে শেষ পর্যন্ত তার সঙ্গে তর্কই তো লেগে গেল একরকম। আলুকে ‘আনাজ; বলছে সেই জটাদাড়ি। প্রথমটায় তো বুঝতে পারিনি মোটে। তারপর যখন বুঝে ওঠা গেল, তখন তো তরকার— বাহাস— তর্ক বেড়ে উঠল আরও। গোল আলু আমাদের কী কী ক্ষতি করা, তা নিয়ে তার দীর্ঘ বক্তৃতা, আলুতেই নাকি সব শীর খারাপের উৎস লুকিয়ে রয়েছে। এটি অবশ্য তার যুক্তি। পাল্টা আমি বলে যেতে থাকি, আলুর উপকারিতা। কী কী কারণে আলু খাওয়া অবশ্য কর্তব্য, তা বলতে বলতে রাত বাড়ে।

বারান্দা সরু নয় খুব। একটা টিমটিমের থেকে একটু বেশি আলো দেওয়া বাল্ব তখন দেওয়ালের গায়ে, ব্র্যাকেটেম যেমন পুরনো দিনের ডিজাইন হয় আর কি! কোনো রোশনিদার টিউব লাইটের বালাই নেই কোথাও। তার মধ্যেই আমাদের গোল আলু বনাম গোল আলু নয়। এভাবেই কখন যেন রাত অনেকটাই গড়িয়ে গেল।

সারি সারি পায়খানা এই হরসুন্দরী ধর্মশালার নিচে— একতলায়, কমন টাট্টি— সর্বজন ব্যবহারের ল্যাট্রিন। খুব যে অপরিচ্ছন্ন তেমন তো নয়। মোটামুটি পরিষ্কারই। সতার ধর্মশালা বা ধরমশালায় আর কী পাওয়া যাবে? ভোর ভোর পেট সাফাইয়ের কাজটি সারলাম সেখানে। কাল রাতে পাঞ্জাবী— শিখ হোটেলের ডিম-তরকা আর রুটি খেয়ে ঢুকেছিলাম এখানে।

Powered by Froala Editor