গরুর গলায় তেত্রিশ কোটি দেবতা

মুছে যায়? - ৪০
আগের পর্বে

ভবা পাগলা বলেছিলেন, ‘কমনের যে ইষ্ট করে, সেই কমিউনিস্ট।’ যদিও ষাটের দশকে বহু অঞ্চলে তাঁরা ছিলেন রাক্ষসসম। ১৯৬৭ সালে বালিতে সিপিআই (এম) প্রার্থী পতিত পাবন পাঠকের বিপরীতে দাঁড়িয়ে জেতেন জাতীয় কংগ্রেসের শৈলেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়। তাঁর ছিল এক রুগ্ন বাইসাইকেল। ৬৭-তে বাংলায় জাতীয় কংগ্রেস হেরে যায়। হাওড়ায় জাতীয় কংগ্রেস বিরোধী জোটের মূল পরিকল্পক ছিলেন প্রশান্ত সরকার। ‘ধরণী’ টেকনেম নিয়ে সি পি আই করতেন তিনি। শৃঙ্খলা ভাঙার অভিযোগ কমিউনিস্ট পার্টি বহিষ্কার করে তাঁকে। প্রশান্তদা দুঃখ করে বলেছিলেন আজ পর্যন্ত কমিউনিস্টদের কোনো নিজস্ব ডেটা ব্যাঙ্ক হল না। তারপর…

ভোট ফর কংগ্রেস
ভোট ফর কংগ্রেস

ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস— ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের এই ছিল নির্বাচনী প্রচার ধ্বনি। তখনও নির্বাচনী প্রতীকে কংগ্রেস জোড়াবলদ। যাঁরা এই প্রতীক নির্ধারণ ও তৈরি করেছিলেন, তাঁরা মনে করতেন জোড়াবলদ কৃষকের প্রতীক। কিন্তু স্বাধীনতার আগে যাও বা একটু আধটু, স্বাধীনতার পর— ১৯৪৭-এর ১৫ আগস্ট পার হতে না হতেই জাতীয় কংগ্রেস জমিদার, পুঁজিপতিদের দল। তবুও তার মধ্যে কিছু কিছু ‘সেফ সমাজতান্ত্রিক ভাবনা’, জাতীয়করণ, সোভিয়েত ইউনিয়নের মডেলে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা। প্রধানমন্ত্রী জবাহরলাল নেহরু সোসালিস্টিক প্যাটার্ন, ‘সমাজতান্ত্রিক ধাঁচ’, ‘মিশ্র অর্থনীতি’— ‘মিক্সড ইকোনমি’।

সেই স্বাধীনতা-উত্তর ভারতবর্ষে মিনু মাসানি, রাজাগোপালাচারি, এন জি রঙ্গ বা এন জি রঙ্গা-দের স্বতন্ত্র পার্টি এবং শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের অখিল ভারতীয় জনসঙ্ঘ— সবই বৃহৎ পুঁজি ও বড় জমিদারদের পক্ষে। তারা সমস্ত কিছুর বেসরকারিকরণ চায়। পুঁজির বৃদ্ধিকে স্বাগত জানায়। মিনু মাসানি আবার ইউথেনশিয়া— স্বেচ্ছামৃত্যুর পক্ষে ছিলেন। তাঁর বইও ছিল এই বিষয়টি নিয়ে, ইংরাজিতে— বহু বছর আগে ছাপা।

‘গুজারিশ’ বলে একটি সিনেমা এসেছিল বেশ কয়েক বছর আগে। ঋত্বিক রোশন ছিলেন। আর ঐশ্বর্য রাই। ‘ভোট ফর কংগ্রেস’ আসলে এই যে নির্বাচনী ধ্বনি, তা কোনোভাবেই কী কাছাকাছি আসে গরিব মানুষের? দেশে তখন অন্নহীনতা, গরীবি প্রবল। পর পর পাঁচ সালা— মানে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা হচ্ছে, কিন্তু উন্নতির হার খুব স্লো, ধীর।

আরও পড়ুন
কমনের যে ইষ্ট করে ও অন্যান্য

বালিতে ভোটের— সাধারণ নির্বাচনের সময় একজন প্রায় মধ্যবয়সিনী বাঙালি হিন্দু মহিলাকে দেখেছিলাম, যিনি বলেছিলেন, কংগ্রেসকে ভোট দেব না তো, কাকে ভোট দেব বাবা! গরুর গলায় যে তেত্রিশ কোটি দেবতা আছে। দেবতা শব্দটি তিনি ‘দেপ্তা’ বলে উচ্চারণ করেছিলেন ও দু হাত জোড় করে কপালে ঠেকিয়েছিলেন।

আরও পড়ুন
ভোট, চোট, ফোট

ষাটের দশকে— বালিতে নির্বাচনের সময় জাতীয় কংগ্রেস ছাপানো পোস্টার দিত— কেরালার নীল সমুদ্র লাল হয়ে গেল, জনতার রক্ত ধারায়। সাদার ওপর হালকা নীলে ছাপা কিছু মানুষের অবয়ব, এখনও মনে আছে। এই সেই ছবি। যা তার স্মৃতিতে আজও অমলিন, জাতীয় কংগ্রেসের ছাপানো পোস্টারে।

আরও পড়ুন
সৌরেন বসু, অসীম চট্টোপাধ্যায়, অচলপত্র

স্মৃতিতে থেকে গেছে ফরোয়ার্ড ব্লক তাদের পোস্টারে, ছাপানো পোস্টারেই ‘বেরুবাড়ি চুক্তি বাতিল কর’ বলছে। তখন অল ইন্ডিয়া ফরোয়ার্ড ব্লক। বালি থেকে তারা নির্বাচন লড়ত কী না মনে নেই। তবে তাদের ঐ ছাপানো পোস্টারে ‘বেরুবাড়ি চুক্তি বাতিল কর’। বেরুবাড়ি ছিটমহল। তা নিয়ে চুক্তি হয়েছিল পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে। পূর্ব পাকিস্তান— পাকিস্তান সরকার কার্যত বেরুবাড়ির দখল নিয়ে নেবে, এমন একটা আশঙ্কা করছিলেন ফরোয়ার্ড ব্লকের অনেকেই।

আরও পড়ুন
পূর্ণ নামে সুশীতল রায়চৌধুরীর দলিল

তখন ফিজো হচ্ছেন নাগা বিদ্রোহীদের নেতা। তিনি প্রায়ই চিনে থাকেন। চিনের মদত পান। অস্ত্র পান। সহায়তা পান। আর পাকিস্তানও তাঁকে আশ্রয় দেয়। অস্ত্রও। নাগা বিদ্রোহীরা ফিজোর নেতৃত্বে স্বাধীন নাগাল্যান্ড দাবি করতে থাকেন।

ফিজোর আগে নাগাদের রানি গুইদালোর নাম খুব শোনা যেত। বানি গুইদালো— রানি গুইদালো। ফিজো, গুইদালো, আর একটু পরে মিজো নেতা লাল ডেঙ্গা, যিনি মিজো উপজাতির জন্য স্বাধীন ‘হোমল্যান্ড’ দাবি করেছিলেন, সবাই একসময় ছিলেন বেতার— রেডিও আর খবরের কাগজ আলোড়নকারী। এখন তাঁদের কথা, নাম, কীর্তি, অথবা অপকীর্তি সবই আর্কাইভ, লেখ্যাগারে।

এরকম তো কতই হয়। একদা পূর্ব ইউরোপের অতি ডাকসাইটে কমিউনিস্ট শাসকেরা ইতিহাসের পর্দার আড়ালে। রুমানিয়ার চাওসেস্কু বা সেসেস্কু, পোল্যান্ডের গোমুলকা, পূর্ব জার্মানির হোনেকার— সবাই। সবাই। নেই নেই। রোমানিয়া বা রুমানিয়ার চাওসেস্কু বা চেসেস্কু চানঘরে সোনার রুল লাগিয়েছেন, এমন অভিযোগ। সত্যি মিথ্যে বলতে পারব না। ওয়ারশ প্যাকটের পূর্ব ইউরোপ— পোল্যান্ড, পূর্ব জার্মানি, বুলগেরিয়া, চেকোশ্লোভাকিয়া, রুমানিয়া— সব— সব ভাষা, নয়ত ধর্মের ভিত্তিতে ছিন্নভিন্ন। ভাঙা পড়েছে বার্লিন পাঁচিল— বহু বছর। বন-বার্লিনের সেই গুলিময় সম্পর্ক অনুপস্থিত বহু বছর।

চেকোশ্লোভাকিয়ার এলান বা অ্যালান ডুবচেক, ‘প্রাগের বসন্ত’, ভারী সোভিয়েত ট্যাঙ্ক আর সাঁজোয়া গাড়ির ঘর্ঘর প্রাগের রাস্তায়। ষাট দশক। সেই ষাট দশক। সোভিয়েত ব্লক থেকে বহু বছর আগেই আলাদা হয়ে গেছে মার্শাল টিটোর যুগোশ্লাভিয়া, এনভার হোজা বা হোকসার আলবেনিয়া বা আলবানিয়া।

সেই আলবেনিয়া বহু বছর ইসলামিক রাষ্ট্র। যারা ছিল চিনের সঙ্গে এক ব্লকে, তারপর ‘তৃতীয় বিশ্ব’— থার্ড ওয়ার্ল্ড ইত্যাদি তত্ত্ব নিয়ে চিনের সঙ্গে চিন পার্টির সঙ্গে তীব্র মতবিরোধ। তার আগে একাশি পার্টির দলিলে সোভিয়েত বিরোধিতায় চিন-আলবেনিয়া যুক্ত স্বর। কী যে হয়, কত কী যে হয়ে যায়, পর পর পর পর। ইতিহাস মনে রাখে। মনে রাখে কেবল ইতিহাস অনুসরণ করা লোকজন।

মনে কী রাখে ইতিহাস অনুসরণ করা লোকজন?

আশির দশকে লেক ওয়ালেশা বা লেক বা লেস ওয়ালেশার উত্থান। ভ্যাটিকান সিটি, পোপের প্রত্যক্ষ মদতে ‘সলিডারিটি’ নামের কমিউনিস্ট বিরোধী— পোল্যান্ডের সরকারি কমিউনিস্ট বিরোধী সংগঠন তৈরি হল।

ওয়ালেশার বিখ্যাত মোটা, ঝোলা গোঁফ। ওয়েলশা সামান্য চুল কম— যেমন অনেক পোলিশেরই হয়। মুখে পোল্যান্ডের মানুষের মুক্তির কথা— ‘গোমুলকাতন্ত্র’ থেকে। পোপ প্রত্যক্ষ মদত দিচ্ছেন তাঁকে। সলিডারিটি। সলিডারিটি। সলিডারিটি।

নির্বাচনে জিতল ওয়ালেশা— লেক বা লেস ওয়ালেশা। তারপর? তারপর? ইতিহাস তার খবর রাখে। কিংবা অতি বিখ্যাত বা কুখ্যাত রাশিয়ার গর্বাচভ? যাঁর মাথার সেই অতি পরিচিত ভূমণ্ডলের মানচিত্রসম জড়ুল? পুরো মানচিত্র— ম্যাপ নয়। খানিকটা, জড়ুলাকারে। বাকিটা টাক।

গর্বাচভ, গোর্বাচভ বা পশ্চিমি মিডিয়ার অতি আদরের গোর্বি কী সি আই এ প্রেরিত? এত সহজ সমাধান নয় এই প্রশ্নের। এর উত্তর নিহিত রয়েছে আরও অনেক অনেক গভীরে।

রুশি করঞ্জিয়া, তাঁর তিনটি ভাষায় ছাপা সাপ্তাহিক ‘ব্লিৎস’, যতদূর জানি বহু বছর বন্ধ। ইংরেজি, হিন্দি এবং উর্দু— আলাদা আলাদা তিনটি ভাষায় বেরয় সাপ্তাহিক ‘ব্লিৎস’। রুশি করঞ্জিয়া সোভিয়েত লবির মানুষ ছিলেন। ষাট-সত্তর দশকে তাঁর রাজনৈতিক প্রভাব, প্রতাপ, ব্যাপ্তি অনেক। তিনি জাতীয় কংগ্রেসের একটা বড় অংশ ও সি পি আই-এর রাজনৈতিক দোস্ত। সে অন্য ইতিহাস। রুশি করঞ্জিয়া ধরপতি। ‘ব্লিৎস’ ছাড়াও অন্য পত্রিকাও তিনি সম্পাদনা করেছেন, প্রকাশ করেছেন।

রুশ করঞ্জিয়া ‘মিড ডে’ নামে একটি দুপুরবেলার কাগজ বের করেছিলেন কী? একটু স সি-সেনসেসানাল। খবর নিয়ে জাগলারি, ট্যুইস্ট। সেই কাগজ নিয়ে খুব বেশি কথা বলে কী কেউ?

ধর্মতলায় পণ্ডিতের পণ্ডিতজির পত্রিকা স্টল ছিল বিখ্যাত। পণ্ডিতের অ্যাসিস্ট্যান্ট ফুলেলা। বড় বড় দু চোখ, ধুতি, টেরিকটের শার্ট, পায়ে চটি। ফুলেলার কাঠ কাঠ গড়ন, নাকের নিচে গোঁফ, সব সময় যেন বিরক্তি লেগে আছে মুখে। কিন্তু ব্যবহার অত্যন্ত ভালো। পণ্ডিতের গালে দাড়ি-মোছ কম। দেখা হলেই এক হাত তুলে নমস্কার করেন।

‘দৈনিক বসুমতী’-তে যে রোজকার কাগজ সাপ্লাই করার কথা, ডেইলি, ম্যাগাজিন, পিরিওডিক্যালস মিলিয়ে, সব পণ্ডিতজি। দিয়ে যান ফুলেলা। পণ্ডিতজির ফুটপাথের ওপর স্টলে রেসের বই, সব ধরনের ম্যাগাজিন— বাংলা, হিন্দি, ইংরেজি, উর্দু— সব পাওয়া যায়। পণ্ডিতজি-কে মন দিয়ে আমি হিন্দি ব্লিৎস পড়তে দেখেছি। সাপ্তাহিক ‘ব্লিৎস’ পত্রিকাই দাবি করে ষাট দশকের একেবারে শেষে, মার্কিন মেরিনসরা এসে নামবে মুম্বাই বন্দরে।

সেই খবর নিয়ে সেনসেসানও হয়েছে অনেক। লেক ওয়ালেশা বা লেস ওয়ালেশার খবর, ছবি খুব গুরুত্ব দিয়ে ছাপতে থাকে পশ্চিমি মিডিয়া, লেক ওয়ালেশা ও তাঁর স্বাধীন শ্রমিক সংগঠন ‘সলিডারিটি’-র।

‘সলিডারিটি’ আর লেক ওয়ালেশাকে নিয়ে কভার স্টোরি করে ‘টাইম ম্যাগাজিন’ আর ‘নিউজউইক’, সেই তথ্য মনে আছে অনেকেরই। পরে বার্লিন পাঁচিল ভাঙা, গর্বাচভের উত্থান আর পতন— সবই খুব গুরুত্ব দিয়ে ছাপে ‘টাইম ম্যাগাজিন’, ‘নিউজউইক’।

লেক ওয়েলেশার কথা, গর্বাচভের ছবি, সংবাদ কেউ কী মনে রেখেছে? নিক্সনের সঙ্গে গর্বাচভের সেই অতি পরিচিত ছবি। সবে ‘স্টারওয়ার’ যুগ শেষ হয়েছে। ঠাণ্ডা যুদ্ধ বা কোল্ড ওয়ারও অস্তগামী। তখনই একদা চিত্রতারকা, তারপর মার্কিন প্রেসিডেন্ট— রিপাব্লিকান পার্টির রিচার্ড নিক্সনের পাশে গর্বাচেভ বা গর্ভাচভ।

লেক ওয়ালেশা ও তাঁর শ্রমিক সংগঠন ‘সলিডারিটি’র তথাকথিত বিদ্রোহ, আন্দোলন, নির্বাচনের দাবি নিয়ে লড়াই, সেই সঙ্গে তাঁর ও পোপের ছবি, তখন পশ্চিমি মিডিয়ার অন্যতম খোরাক। কত কত ছবি ওয়ালেশার।

সোভিয়েতের পতন, তার ইতিহাস, চেরনেনকো নামের সোভিয়েত কর্তৃত্ব, তারও বহু বছর আগে নিকিতা ক্রুশ্চভ, বুলগানিন, কোসিগিন, পদগর্নি— এই সব নাম ক্রমশ স্মৃতিময়ই কেবল। ১৯৬৫-র ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী। তিনি উত্তরপ্রদেশের মানুষ, খুব গরীব ঘরের সন্তান। সেই সময়টাতেই সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী কোসিগিন। লাইনোতে ছাপা বাংলা, ইংরেজি, হিন্দি খবরের কাগজে কোসিগিনের ছবি দেখি। লালবাহাদুর শাস্ত্রী, আইয়ুব খান।

মনে আছে ইলাহাবাদে নির্বাচনে দাঁড়িয়েছিলেন জাতীয় কংগ্রেসের পক্ষে সুনীল শাস্ত্রী। তিনি লালবাহাদুর শাস্ত্রীর পুত্র। সুনীল শাস্ত্রীর নামের সঙ্গে কংগ্রেস— জাতীয় কংগ্রেস নির্বাচনী ব্যানার হিসাবে তাদের দলের প্রার্থী সুনীল শাস্ত্রীর নামের সঙ্গে ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রীর নামও ব্যবহার করছিল।

সেখানে এক নির্বাচনী সভায় ভারতীয় জনতা পার্টির হয়ে বলতে গিয়ে অটলবিহারী বাজপেয়ী বলেছিলেন, ভারতবর্ষের কোনো প্রধানমন্ত্রী যে নেহরু পরিবারের বাইরে আছেন, তা কংগ্রেস স্বীকার করল এত বছর পর। ভুলে যাওয়া, প্রায় ভুলে যাওয়াই হয়ত নামটিকে বার করে আনল ইতিহাসের গহ্বর থেকে।

তখন রাত প্রায় নটা। সাংবাদিকতার সূত্রে সেই মিটিং কভার করতে গেছি। অটলবিহারী বাজপেয়ীর সেই ভাষণ ভোলার নয়। এমনিতেই তিনি চমৎকার বলেন। ঠেট, হিন্দুস্থানি হিন্দি, কলোকাল দু-একটি কথা, উর্দু-মিশালবিহীন তাঁর বক্তব্য পেশকারী। চুপ করে শুনতে হয়। যেমন ছিল হীরেন মুখার্জি, সোমনাথ লাহিড়ী, সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর, হরিপদ ভারতী, এস এ ভাঙ্গে প্রমুখের বক্তৃতা। সঙ্গে অবশ্যই হরেকৃষ্ণ কোঙারের নামও আসবে। অটল বিহারী বাজপেয়ীর বক্তব্য ছিল শোনার, তাঁর তত্ত্বে, রাজনীতিতে বিশ্বাস করি আর না করি।

ইলাহাবাদ কেন্দ্রে অমিতাভ বচ্চন, হৈমবতী বা হেমবতীনন্দর বহুগুণা নির্বাচনে লড়েছেন লোকসভায়। হেমবতী বা হৈমবতী নন্দন বহুগুণা প্রথমে ইন্দিরা কংগ্রেস ছিলেন। পরে তিনি ও বাবু জগজীবন রাম— মূলত জগজীবন রামই, সি এফ ডি— কংগ্রেস ফর ডেমোক্রেসি তৈরি করেন। সি এফ ডি পরে মূলত জয়প্রকাশ নারায়ণের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা জনতা পার্টিতে মিশে যায়। জনতা পার্টিতে আদি কংগ্রেস, সযুক্ত সোসালিস্ট পার্টি (এস এস পি), প্রজা সোসালিস্ট পার্টি (পি এস পি), অখিল ভারতীয় জনসঙ্ঘ, স্বতন্ত্র পার্টি, সি এফ ডি, লোকদল ও আরও দু-একটি সংগঠন হয়ত মিলে যায়। জরুরী অবস্থার সময় ইন্দির গান্ধীর জেলখানায় জন্ম হয় জনতা পার্টির। এই সব ভিন্ন মত ও পথের দলকে একসঙ্গে, এক ছাতার নিচে নিয়ে আসতে সক্ষম হন জেপি— জয়প্রকাশ নারায়ণ— লোকনায়ক জয়প্রকাশ নারায়ণ।

হু-হু করে ছড়িয়ে পড়ে জনতা পার্টি। আবার অতি দ্রুত ভেঙে পড়ে ঝুর ঝুর ঝুর ঝুর করে। সম্পূর্ণ বিপরীত আদর্শ— মত ও পথে বিশ্বাসী বিভিন্ন দলের নেতারা ইন্দিরা গান্ধী ও ইন্দিরা কংগ্রেসের স্বৈরাচার সহ্য করতে না পেরে তৈরি করলেন জনতা পার্টি। অতিষ্ঠ মানুষ জরুরী অবস্থার মোকল থেকে মুক্তি চাইছিল। 

সেই সময় ভজনলাল, বংশীলাল, দেবীলাল—হরিয়ানার জাঠ বলয়ের ‘কৃষক নেতা’ নামে এইসব কুলাক নেতাদের নাম খুব শোনা যেত রাজনীতির জমাখরচে। নাম শোনা যেত বসন্ত শেঠের। ‘ইন্দিরা ইজ ইন্ডিয়া’ বলা দেবকান্ত বড়ুয়াও তখন ইন্দিরা কংগ্রেসের অন্যতম স্তম্ভ। আর ছিলেন সন্তোষমোহন দেব। সন্তোষমোহন দেবও খুবই ডাকাবুকো নেতা ইন্দিরা কংগ্রেসের।

হেমবতী নন্দন বহুগুণা বা হৈমবতী নন্দন বহুগুণার পূর্বপুরুষ নাকি বাঙালি, এমন কথা শুনেছি লোকমুখে। কালে দিনে তাঁদের ‘গুণ’ ইত্যাদির জন্য বহুগুণাত্বপ্রাপ্তি। একটি নির্বাচনে অভিতাভ বচ্চন জাতীয় কংগ্রেস প্রার্থী হয়ে হৈমবতী নন্দন বহুগুণাকে হারিয়ে দেন। তখন জনতা পার্টি খণ্ডবিখণ্ড। প্রায় সব নেতারাই আপন আপন মহিমা প্রচারে ব্যস্ত। জনতা পার্টির ভেতর থেকে ‘অখিল ভারতীয় জনসঙ্ঘ’, ‘ভারতীয় জনতা পার্টি’— বিজেপি হওয়ার মূল শিকড় সঞ্চয় করে ফেলেছে, প্রসারিত করেছে ধীরে ধীরে সকলের অলক্ষ্যে।

ভারতীয় রাজনীতির এই মত ও পথের সংঘর্ষ, পণ্ডিত জবাহরলাল নেহরুর ‘মিকসড ইকোনমি’-র পথ, সবটাই একটু একটু করে বাতিলের চেষ্টা করেছে একটা সংগঠিত শক্তি। সেই শক্তিই এখন ভারতীয় রাজনীতি— ইন্ডিয়ান পলিটিকস-এর অতি দোলাচলের জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ি। গরুর গলকম্বলে যে তেত্রিশ কোটি দেবতা! সেই মধ্যবয়সিনীর বিশ্বাস অনুযায়ী।

Powered by Froala Editor