কমলাপতি, চন্দ্রশেখর, বহুরানি

মুছে যায়? — ৪১

আগের পর্বে

নির্বাচনে কংগ্রেসের প্রতীক ছিল জোড়া বলদ। বালিতে এক মধ্যবয়সী মহিলা বলেছিলেন, গরুর গলায় তেত্রিশ কোটি দেবতা। সুতরাং, কংগ্রেসকেই যে ভোট দিতে হবে। প্রধানমন্ত্রী জবাহরলাল নেহরু সোভিয়েতের মডেল পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। তাঁর ছিল মিক্সড ইকোনমি। অন্যদিকে অখিল ভারতীয় জনসঙ্ঘ ছিল পুঁজিপতি ও জমিদারদের পক্ষে। অখিল ভারতীয় জনসঙ্ঘ, স্বতন্ত্র পার্টি, এসডিএফ, লোকদল ইত্যাদি বেশ কয়েকটি সংগঠনকে একত্রিত করে জয়প্রকাশ নারায়ণ তৈরি করেন জনতা পার্টি। পরে এই দল ভেঙে গেলেও, প্রশস্ত হয় ভারতীয় জনতা পার্টির পথ। একটু একটু করে বাতিল হয়ে যায় নেহরুর ‘মিক্সড ইকোনমি’। তারপর...

আশির দশকে, সত্তর দশকেও উত্তরাখণ্ডকে কেটে আলাদা না করা উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন কমলাপতি ত্রিপাঠী। কমলাপতি ত্রিপাঠীজির পোশাক নিষ্ঠাকাষ্ঠা মানা হিন্দু ব্রাহ্মণ-বিশেষ করে গোবলয়ে যেমন হয়, তেমনই। কমলাপতির শ্মশ্রু-গুম্ফহীন গালে চাকচিক্য। ক্লিন শেভেন। কপালে টীকা, হলুদ ও কুমকুমের। ধুতি-পাঞ্জাবি।

উত্তরপ্রদেশের অবিসংবাদিত নেতা কমলাপতি ত্রিপাঠীজি। তাঁর চেহারায় কাশীর পাণ্ডা ধরনের ছাপ স্পষ্ট। একেবারে পাণ্ডা কালচার যাকে বলে, সেটা আশির দশক। খুব স্বাভাবিক ভাবেই জাতীয় কংগ্রেসের কালচার অনুযায়ী নেহরু-গান্ধী পরিবারের প্রতি তাঁদের অসীম আনুগত্য। এই আনুগত্য না থাকলে মন্ত্রিত্ব, নেতৃত্ব থাকে না।

কমলাপতি ত্রিপাঠীজির পুত্র লোকপতি ত্রিপাঠী। কমলাপতিজির আরও সন্তান বর্তমান। তাঁর পুত্রবধূ— বাড়ির বহুরানি তিনিও চন্দৌলি থেকে দাঁড়ান নির্বাচনে। বহুরানি বেশ সুদর্শনা, সুবেশা।

ভারতীয় রাজনীতিতে জাতীয় কংগ্রেস একটা সময় পর্যন্ত ব্রাহ্মণ ভোট পেতই, সঙ্গে ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের ভোট। জনতা পার্টি হওয়ার পর ছত্রী বা ক্ষত্রিয় ভোটের প্রধান দাবিদার হয়ে ওঠে তারা। বানিয়েদের ভোট পেত মূলত অখিল ভারতীয় জনসঙ্ঘের ভাগে। তথাকথিত পশ্চাদপদ— পিছড়েবর্গের ভোট অনেকটাই বাঁধা ছিল জাতীয় কংগ্রেসের ভাগে। সে সব অঙ্ক বহুদিনই অস্তাচলগামী। 

আরও পড়ুন
গরুর গলায় তেত্রিশ কোটি দেবতা

প্রধানমন্ত্রীর তখতে বসতে চাওয়া চৌধুরী চরণ সিং জনতা পার্টি থেকে বেরিয়ে ডি এম কে পি— হিন্দি বলয়ের মুখের ভাষায় দম কিপা তৈরি করেন। দলিত মজদুর কিষান পার্টি করেন। একদা সোসালিস্ট— রামমনোহর লোহিয়া আর জয়প্রকাশ নারায়ণের চেলা রাজনারায়ণ, যিনি উত্তরপ্রদেশের রায়বেরিলি কেন্দ্র থেকে নির্বাচনে দাঁড়িয়ে পরাজিত করেন ইন্দিরা গান্ধীকে, সেই ‘সোসালিস্ট’ রাজনারায়ণ একদা লোকদল করা চরণ সিংয়ের হনুমান বললেন নিজেকে। এই রাজনারায়ণই স্বৈরতন্ত্রী ইন্দিরা শাহী— ইন্দিরা তানাশাহির পতনের পর রাজঘাট ধুয়ে ছিলেন ঘড়া ঘড়া গঙ্গার জল আনিয়ে, তখন জনতা পার্টির শাসন আসব-আসব সময়।

আরও পড়ুন
কমনের যে ইষ্ট করে ও অন্যান্য

ইলাহাবাদ হাইকোর্ট তার ঐতিহাসিক রায়ে ইন্দিরা গান্ধীর নির্বাচন বাতিল করেছিল। রাজনারায়ণের কাছে হেরেছিলেন ইন্দিরা— নৈতিক ভাবে। দ্বিতীয়বার তিনি হারলেন নির্বাচনে, যখন জনতা পার্টির প্রার্থী রাজনারায়ণের সঙ্গে তাঁর মুখোমুখি নির্বাচনী লড়াই হল।

আরও পড়ুন
ভোট, চোট, ফোট

‘সোসালিস্ট’ রাজনারায়ণ ভোটে জেতার পর গোবলয়ের বহু মানুষ অনেকদিন পর্যন্ত মুখে মুখে ছড়া কাটত—

আরও পড়ুন
সৌরেন বসু, অসীম চট্টোপাধ্যায়, অচলপত্র

পহেলে হারি কোর্ট মে
অব তো হারি বোট (ভোট) মে…

রাজনারায়ণকে কার্টুনে চমৎকার ধরলেন ‘টাইমস’ অফ ইন্ডিয়ার আর কে লকসমন। তিনি প্রায় সুকুমার রায়ের ‘আবোলতাবোল’-এর কুমড়োপটাশ এঁকে ফেললেন, রাজনারায়ণকে বোঝাতে গিয়ে।

মাথা জোড়া টাক অনেকটা যেন মুম্বাইয়া সিনেমার ভিলেন ও নায়ক প্রেমনাথ যিনি, মুম্বাইয়া সিনেমার অন্যতম শোম্যান রাজ কাপুর সাহাবের শ্যালকও বটে, প্রেমনাথের ‘ববি’, ‘কালা সোনা’ ইত্যাদি সিনেমা ভোলাই যায় না। এছাড়া আরও বহু সিনেমাতে তিনি হিরু— হিরো অথবা ভিলু— ভিলেন। মারিয়ো পুজোর ‘গডফাদার’ থেকে মেরে যে হিন্দি ছবিটি হল, তারও তিনি অন্যতম চরিত্র। তো রাজনারায়ণের মুখছবি অনেকটা যেন মেলে সেই প্রেমনাথের সঙ্গে। ছবির নাম ‘কালা পাথর’ ছিল কী? নাকি অন্য কিছু?

রাজনারায়ণ তাঁর চকচকে টকটকে টাকে একটা সবুজ রুমাল বাঁধলেন। গালে দাড়ি, মানে গালে নয় থুতনিতে অবিন্যস্ত গোটি। তিনি যতদিন না মোরারজি ভাইয়ের— মোরারজি দেশাইয়ের সরকার পড়ে যাবে ততদিকে চুল-দাড়ি কাটবেন না এই প্রতিজ্ঞা করেছিলেন।

মোরারজি ভাই দেশাই স্বর্ণ নিয়ন্ত্রণ আইন প্রবর্তন করেছিলেন। আঠারো ক্যারেট, বাইশ ক্যারেট, চব্বিশ ক্যারেট— নানা হিসাব তখন।

মোরারজি ভাই দেশাই বা মোরারজি দেশাই জনতা পার্টির সরকারের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। তিনিই ভারতের প্রথম অ-কংগ্রেসি প্রধানমন্ত্রী। নিরামিষভোজি মোরারজি দেশাই স্বমূত্র— নিজের ইউরিন পান করতেন, এমন কথা শোনা যেত। ‘শিবাম্বু’ বলে অভিহিত করা হত স্বমূত্রকে। শিবাম্বু পানের উপকারিতা আর সর্বরোগহর ‘শিবাম্বু’ নিয়ে একাধিক পুস্তক পুস্তিকা বেরল হিন্দি, ইংরেজিতে। বাংলায়ও। ‘শিবাম্বু’ বা স্বমূত্র পানের রীতি আছে বিভিন্ন সহজিয়া সাধন পথের পথিকদের মধ্যে। আছে রজঃবীর্য পানের— চন্দ্র-সূর্য সাধনা। বাউলরা গোপনে এই সাধনা করেন।

যাঁরা স্বমূত্র পানকে সমর্থন করেন বা স্বমূত্র-শিবাম্বু পান করেন, তাঁরা ভোরের প্রথম ইউরিনটি ধরে খাওয়ার কথা বলেন ও বাসি স্বমূত্র ব্যথায় লেপে দেওয়া— লেপনের পরামর্শও দেন। অনেকে হাতে-কলমে অভ্যাসও করতে থাকলেন স্বমূত্র পান। তাতে নাকি অসম্ভবকে সম্ভব করা যাচ্ছে। সুগার, প্রেসার— সব হাওয়া, টেকোর— টেকোদের টাকেও নাকি চুল গজাচ্ছে। ক্যানসারও কমাচ্ছে নাকি স্বমূত্র পান— সারিয়ে দিচ্ছে। বাসি স্ব-ইউরিন লেপনে নাকি কমে যাচ্ছে সব ব্যথা।

এর মধ্যেই— জনতা পার্টির সরকার আর সেই সরকারের প্রধানমন্ত্রী থাকতে থাকতে বিমান দুর্ঘটনার কবল থেকে নিজেকে নিজেই বাঁচালেন মোরারজি ভাই দেশাই। লাফিয়ে নেমে এলেন এয়ারপোর্টের মাটিতে। প্লেন তখনও টেকঅফ করেনি।

মোরারজি ভাই দেশাইয়ের পিত্র কান্তিভাই দেশাই নানা আর্থিক কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়েন জনতা সরকারের সময়। তখন তাঁর বাবা প্রধানমন্ত্রী, সেই সুযোগকেই কী কাজে লাগালেনু কান্তিভাই। একটা নাম করা ন্যাশনাল ডেইলি কান্তিভাই দেশাইয়ের এই আর্থিক কেলেঙ্কারির প্রেক্ষিতে খবরের হেডিং করেছিল ‘সন স্ট্রোক’। সঙ্গে কান্তিভাই দেশাইয়ের ছবি। চোখে চশমা, মাথার চুল পাতলা। মনে আছে।

শুরু করেছিলাম অখণ্ড উত্তরপ্রদেশে জাতীয় কংগ্রেসের একদা প্রায় প্রধানতম মুখ কমলাপতি ত্রিপাঠীকে নিয়ে। তাঁর বক্তৃতা শুনেছি, ইলেকশান মিটিং কভার করতে গিয়ে, খুব যে ভালো বলতেন, তা একেবারেই নয়। বানারসি হিন্দিতে তিনি খানিকটা স্বচ্ছন্দ।

বারানসী বা কাশীর পাশের জেলা ভাদোই বা ভাদোহি। ভাষা কাশীর থেকে সামান্য আলাদা। কাশীর নিজস্ব বোলি— ভাষা কাশিকা তো প্রায় অবলুপ্তির পথে। কাশীর আশপাশে গঙ্গার পলি সমৃদ্ধ জমিতে চমৎকার আখ— গন্না, গম— গেঁহু, ভুট্টা— মকাই। মকাই আর বাজরার রুটি যে কি ভালো, সে যাঁরা খেয়েছেন, তাঁরাই জানেন। সত্তর দশকে পালিয়ে পালিয়ে— পলাতক রাজনৈতিক জীবনে কাশী, ভাদোহি বা ভাদোই, চান্দৌলি কতবার।

কিন্তু ১৯৮৪ সালের ৩১ অক্টোবর শিখ দেহরক্ষীর গুলিতে নিহত ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যুর পর যে তড়িঘড়ি নির্বাচন, সেই সাধারণ নির্বাচনে নিহত ইন্দিরার শরীরই রাজীব গান্ধীর নেতৃত্বে বিপুল জয় এনে দেয় রাজীব গান্ধী পরিচালিত জাতীয় কংগ্রেসকে। সেই ভোট কভার করতেই ‘প্রতিক্ষণ’-এর হয়ে হিন্দি বলয়। মানে গো-বলয়ের অনেকখানি। কাশী, চান্দৌলি বা চন্দৌলি, আরা, বালিয়া। আরা বিহারে, বালিয়া উত্তরপ্রদেশে। এক অতি পরিচিত কহাবত ছিল— মুখে মুখে ফেরা কথা। আরা মে পুলিশ, বালিয়া মে ডাকু। অর্থাৎ যত পুলিশ সব আরায়, মানে আরা থেকে। আর ডাকাত দল বালিয়ার।

সত্তর দশকে রাজনৈতিক কারণে জেলে থাকার একটা চালু কাহাবত— সেই কাহাবত থেকে গানা— গান হয়ে যাওয়ার কয়েকটি লাইন শুনেছি—

আরে আরা হিলে ছাপরা হিলে
বালিয়া সেতো হিলে না— হিলে না রে হিলে না…

বালিয়া বিখ্যাত মঙ্গল পাণ্ডে, চিতু পাণ্ডে বা চিতু পাঁড়ের জন্য। চিতু পাঁড়ে বা পাণ্ডে সংগ্রামে, বিদ্রোহে— বাগাবত জঙ-এর অন্যতম সৈনিক ছিলেন। আর মঙ্গল পাণ্ডে তো ছিলেন ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম সিপাহি বিদ্রোহ— সাহেবদের বলা সিপয় মিউটিনির প্রথম বিদ্রোহী। আমি সেই এনফিল্ড রাইফেলের টোটা দাঁতে কেটে বন্দুকে ভরার কাহিনী, এই টোটায় গরু, শুয়োরের চর্বি মাখান আছে, তা নিয়ে সিপাহীদের বাগাবত— বিদ্রোহ, সেই কাহিনীতে যাচ্ছি না। 

যাচ্ছিনা কোনো সাধু-মহাত্মা শুকনো চাপাটি— রুটি আর শুকিয়ে যাওয়া পদ্ম ফুলের পাপড়ি পৌঁছে দিয়েছেন সিপাহিদের ‘বাগি’— বিদ্রোহী হওয়ার সংকেত দেওয়ার জন্য, সেইসব মুখে মুখে ফেরা কাহিনীতে যাচ্ছি না।

বালিয়াতে দাঁড়িয়েছেন চন্দ্রশেখর। অকৃতদার এই মানুষটি মাত্র কয়েক দিনের জন্য প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন জাতীয় কংগ্রেসের সমর্থনে। তিনি ও মোহন ধারিয়ে ছিলেন ইন্দিরা গান্ধীর চোখে মণি বিশেষ— ‘ব্লু আইড বয়’ যাকে বলে। মোহন ধারিয়া, চন্দ্রশেখর সবাই তখন জাতীয় কংগ্রেসের ‘তরুণ তুর্কি’। সংগঠন কংগ্রেস— সিন্ডিকেট কংগ্রেসের বিরুদ্ধে, কামরাজ নাদার, অতুল্য ঘোষ, নিজলিঙ্গাপ্পা, মোরারজি ভাই দেশাই— এঁরাই ছিলেন সিন্ডিকেত কংগ্রেস বা কংরেস (ও)-র লোকজন। পরে অতুল্য ঘোষ সরে আসেন প্রত্যক্ষ রাজনীতি থেকে, সেই সঙ্গে সঙ্গে মনোনিবেশ করেন বিধান শিশু উদ্যান আর ছোটদের নিয়ে থাকার ব্যাপারে, ‘কষ্টকল্পিত’ নামে তিনি তাঁর এক রাজনৈতিক স্মৃতিকথা লিখেছেন সাপ্তাহিক ‘দেশ’-এ। পরে ‘কষ্টকল্পিত’ গ্রন্থ হয়ে প্রকাশিত হয়। তো সেই ‘ঠাকুর’ চন্দ্রশেখর দাঁড়িয়েছেন বালিয়া থেকে। তখন ১৯৮৪-র ঘন শীত। প্রায় মোড়ে মোড়ে মাইকে বাজছে— বাগি বালিয়া কে কাহানি/ কাহানি নহি বা।

চন্দ্রশেখর ভোড়সিতে ‘আশ্রম’ তৈরি করেছিলেন। সেখানে বড় জলার ধারে তিনি তাঁর পোষা রাজহাঁসেদের খাবার খাওয়াচ্ছেন, এই ছবি তখনকার ‘ইলাসট্রেটেড উইকলি’-তে বেরিয়েছিল। জরুরি অবস্থার সমর্থক, ইন্দিরা মুগ্ধ খুশবন্ত সিং তখন ‘ইলাসট্রেটেড উইকলি’-র এডিটর নন। এডিটর নন ন্যাড়ামাথা প্রীতিশ নন্দীও। ‘ইলাসট্রেটেড উইকলি’ তখন ইংরেজি, হিন্দিতে বেরয়— প্রতি সপ্তাহে। আর একটি সাপ্তাহিক ছিল ‘হিন্দুস্থান’। সবই বন্ধ হয়ে গেছে বহু বছর।

‘ইলাসট্রেটেড উইকলি’-তে কবিতা, গল্প ছাপা হত। বহু বিখ্যাত বাঙালি কবির কবিতা, গদ্য ছাপা হয়েছে সেখানে। থাক সে সব কথা। চন্দ্রশেখর খুব ভালো বক্তা। জরুরি অবস্থা উঠে গিয়ে জনতা পার্টির সরকার এলে দক্ষিণ কলকাতার হাজরা পার্কে তাঁর জনসভা, ভুলব না। সরু পায়ের খদ্দরের চোস্ত পায়জামা, ওপরে খদ্দরের মোটা, রঙিন পাঞ্জাবি, গালে কাঁচাপাকা কেয়ারলেস দাড়ি, মাথার চুল কালো, ব্যাকব্রাশ করা। হাতে ঘড়ি নেই। চমৎকার বললেন তিনি। একটা বাক্য, কথার মাত্রা হিসাবে বার বার ঘুরে ঘুরে আসছিল, ম্যায় ইতমিনান সে কহে সাকতা হুঁ— আমি বিশ্বাসযোগ্যতাসহ, নিশ্চিত হয়ে বলতে পারি, মনে আছে এখনও। তখন সবে ছাড়া— মুক্তি পেয়েছি জেল থেকে। জনতা সরকারের প্রতি খানিকটা বিশ্বাস আছে।

চন্দ্রশেখর শুনেছিলাম ওড়িশার বিশিষ্ট রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, জাতীয় কংগ্রেসের নন্দিনী শতপথীর সঙ্গে ‘বিশেষ বন্ধুত্বের’ সম্পর্কে আছেন। এর সত্যমিথ্যা আমি যাচাই করে দেখিনি। সবই শোনা কথা। তো সে যাই হোক ১৯৮৪-র ঘন শীতে বিহারের আরা হয়ে বালিয়া। নদীর পার করে, নৌকোয়— গঙ্গানদী। শীতের গঙ্গা, তেমন খুব জলটল নিয়ে বহতা নয়। আরা থেকে বালিয়ায় এসে রাত্রিবাস। হোটেল। খুব দামি কিছু নয়। তারপর বালিয়ে কভার করে চন্দৌলি বা চান্দৌলি, বাসে।

বাস গুমটিতে চমৎকার পাকা পেঁপে, কলা। পাকা কলা, কাঁঠালি, চাঁপা বা মর্তমান নয়, সম্ভবত ডুসোয়ালের কলা। সেই কলা আর পেঁপে এই দুপুরের খাদ্য। বাসে উঠে চললাম চন্দৌলি বা চান্দৌলি ‘বহুরানির’ নির্বাচনী ছেত্র বা ক্ষেত্র কভার করতে।

সরাইখানা ধরনের একটা বাড়ি। চান্দৌলি বা চন্দৌলি কিংবা অন্য কোনো স্ট্রেশনও হতে পারে, তার পাশে শীতে থাকা। কম্বল, খাটিয়া সব দেবে। খাবার পাওয়া যাবে বাইরে। কোনো শৌচালয় নেই, ‘বড়’ বা ‘ছোট’ কর্মের জন্য। ‘বড়’ বা ‘ছোট’ কাজের জন্য সেই জট পাকানো রেল লাইন, মালগাড়ি পেরিয়ে যেতে হবে সামনের ময়দান— মাঠে। একদিন তো ভোর ভোর ‘পেট খুলাসা’-র তাগিদ নিয়ে লাইন পেরতে পেরতে ট্রেনে কাঁটা পড়ি আরকি! যেন কোনো রকমে কানের পাশ দিয়ে বেরিয়ে যায় মৃত্যু। এরকম যে কতবার হয়েছে জীবনে।

রেল লাইনের ওপারেই খোলা ময়দান, জলের ব্যবস্থা একটি পুকুর। খুব ভোর ভোরই মাঠকৃত্য বা প্রাতঃকৃত্য সেরে আসতে হয়। তারপর সারাদিন দৌড়নো। চান্দৌলি বা চন্দৌলিতে তখন ঘোর শীত। খুব ঠান্ডা। সম্ভবত ডিসেম্বর মাস। ‘কালিয়ে দেওয়া’ ঠাণ্ডা পড়েছে একেবারে।

খুব ভালো পাকা পেঁপে, চমৎকার কলা, আখের রস— সবই চন্দৌলি বা চান্দৌলির সম্পদ। রুটির স্বাদ দুর্দান্ত, তরকারির টেস্টও খুব ভালো। এরই মধ্যে ঘুরে ঘুরে ‘বহুরানির’ নির্বাচনী ক্ষেত্র— চুনাও ছেত্র ঘোড়া। হিন্দি বলয়ে চুনাও— ভোট খুব রংদারি। চার দিকে রং, রং আর রং। চন্দৌলি বা চান্দৌলি থেকে বেনারস— বারানসী— কাশী— ট্রেনে। ট্রেকারে। সেখানে হরসুন্দরী ধর্মশালায় রাতে থাকা। খুব কাছেই দশাশ্বমেধ ঘাট, বিশ্বনাথ, অন্নপূর্ণা মন্দির, উত্তরবাহিনী গঙ্গা, জ্ঞানবাপী, জ্ঞানবাপী মসজিদ। হরসুন্দরী ধর্মশালায় খুব ছোটবেলা থেকে থাকি। নয়ত মনমোহন পাঁড়ের ধর্মশালায়। মনমোহন পাঁড়ের ধর্মশালায় মনমোহন পাঁড়ের বুক পর্যন্ত নয়, পেট পর্যন্ত মূর্তি। হরসুন্দরী ধর্মশালা চালাতেন কলকাতার বিখ্যাত হোমিওপ্যাথি ওষুধ কোম্পানি মহেশ ভট্টচার্যরা।

Powered by Froala Editor