জাতীয়তাবাদের উত্থান

‘কালাপানি’ আন্দামান— ২৭
আগের পর্বে

সেলুলার জেল বন্ধ হয়েও বন্ধ হল না যেন। রাজবন্দিদের দেশের মাটিতে ফিরিয়ে আনার পরেও বিক্ষিপ্তভাবে বিভিন্ন বিদ্রোহ দমন করতে আন্দোলনকারীদের সেলুলার জেলে পাঠাতে থাকে ব্রিটিশ সরকার। ১৯২২ সালে মালাবার উপকূলে মোপলা আন্দোলনের পর ২৫৮ জন বিদ্রোহীকে চালান করা হয় আন্দামানে। রূম্পা বিদ্রোহের সময় বহু কৃষকের জায়গা হয়েছিল সেলুলার জেল। আবার বাব্বর আকালি ষড়যন্ত্র মামলায় দণ্ডিতদেরও পাঠানো হয় সেখানে। রাজবন্দিদের মতোই তাঁদের ওপরে চলত বর্বর শাসন। কিছুদিনের মধ্যেই সেলুলার জেলে পুনরায় শুরু হয় হরতাল, ঘর্মঘট। ২৮ দিন ধরে ধর্মঘট চলার পর শেষ পর্যন্ত নত হয় ব্রিটিশ প্রশাসন। এক বছরের মধ্যেই তাঁদের ফিরিয়ে আনা হল কলকাতার আলিপুর জেলে। তারপর…

১৯১৪–১৯১৯। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে একদিকে ব্রিটেন, ফ্রান্স, রাশিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি এবং জাপান আর অন্যদিকে জার্মানি, অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি এবং টার্কি। এই যুদ্ধকালীন সময়ে ভারতীয় জাতীয়তাবাদ কিছুটা যেন পরিপক্কতা লাভ করল। তিন ধরনের মতবাদ দেখা গেল – (১) মধ্যমপন্থী – এঁরা যুদ্ধের সময়ে কর্তব্য মনে করে সরকারকে সমর্থন করল; (২) চরমপন্থী – তিলকসহ এই গোষ্ঠী মনে করল যে এই যুদ্ধ থেকে শিক্ষা নিয়ে ব্রিটিশরা এবার ভারতীয়দের স্বায়ত্ত্বশাসনের দাবি মেনে নেবে, তাই তাঁরা যুদ্ধের সময়ে ব্রিটিশদের সমর্থন জানাল; এবং (৩) বিপ্লবপন্থী – এঁরা মনে করলেন যে ভারতবর্ষকে ব্রিটিশদের হাত থেকে মুক্ত করতে এটি উপযুক্ত সময়, তাই তাঁরা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলেন (যেমন গদর বিপ্লবীরা)।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে আমেরিকা ও কানাডার মতো ভারতবর্ষে স্বায়ত্ত্বশাসনের দাবিতে ১৯১৬-র এপ্রিল এবং সেপ্টেম্বরে যথাক্রমে বালগঙ্গাধর তিলক এবং ব্রিটিশ সমাজসংস্কারক ও অন্যতম কংগ্রেস নেতা, অ্যানি বেসান্ত আলাদা ভাবে ‘হোম লিগ আন্দোলন’ শুরু করেন। কিছুটা অগ্রসর হলেও শেষপর্যন্ত একাধিক কারণে এই আন্দোলন তুলে নেওয়া  হয়। ইতিমধ্যে কংগ্রেসের নরমপন্থী ও চরমপন্থীদের মধ্যে যে বিভাজন দেখা গিয়েছিল এবং যার ফলে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড প্রায় স্তব্ধ হবার মুখে এসে দাঁড়িয়েছিল তাতে কিছুটা প্রলেপ পড়ল লক্ষ্ণৌ কংগ্রেসে ১৯১৬-তে। বেসান্ত এবং তিলক এ বিষয়ে উদ্যোগ নিলেন এবং ইতিমধ্যে মধ্যপন্থীরা যাঁরা চরমপন্থীদের বিরোধিতা করছিলেন, তাঁদের নেতা, ফিরোজ শাহ মেহতা মারা গেলেন। এবার সব ধরনের মতবাদের নেতৃত্ব এক জায়গায় আসতে সক্ষম হলেন। এই অধিবেশন থেকে ইতিমধ্যে ১৯১২-তে গড়ে ওঠা মুসলিম লিগের সঙ্গে সমঝোতাও সাধিত হল।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশদের অর্থ এবং সৈন্য দিয়ে ভারতবর্ষ সহযোগিতা করেছিল। গান্ধী এবং তাঁর সহযোগীরা এই যুদ্ধে ব্রিটিশদের প্রতি নিঃশর্ত সমর্থন দিয়েছিলেন। এই যুদ্ধে বিভিন্ন ফ্রন্টে ভারতের প্রায় হাজারখানেক সৈন্য নিহত হয়। ভারতীয়দের ওপর কর চাপিয়ে সেই অর্থে সেনাদের অস্ত্র ও খাদ্য সরবরাহ করা হয়। যুদ্ধ শেষ হলে দেখা গেল যে এই যুদ্ধের অভিঘাত বিভিন্ন শ্রেণির ভারতীয়দের ওপর এসে পড়েছে। শিল্পক্ষেত্রে মূল্যবৃদ্ধি এবং আর্থিক মন্দার প্রভাবে ভারতীয় শিল্পগুলির নাভিশ্বাস ওঠার জোগাড়। শিল্পগুলি একে একে রুগ্ন হয়ে পড়ছে, বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তারা এবার সরকারের কাছে আর্থিক সাহায্যের দাবি জানাচ্ছে। মূল্যবৃদ্ধির ঠেলায়  শ্রমিক এবং কারিগরদের প্রাণ ওষ্ঠাগত, সংসার চালানোই দায় হয়ে পড়েছে। কৃষকদের ওপর মারাত্মক করের বোঝা তাদের দারিদ্র্যের দিকে ঠেলে দিচ্ছে এবং তারা বিদ্রোহের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। বিশ্বযুদ্ধে যে সমস্ত সৈনিকরা অংশ নিয়েছিলেন তাঁরা অন্য দেশের গ্রামীণ জনগণের স্বচ্ছলতা ও স্বাধীনতার অভিজ্ঞতা নিয়ে বিদেশের যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরে এসে তার সঙ্গে তুলনা করে দেখছেন যে দেশ যেন আরও বেশি করে দারিদ্রে  আক্রান্ত এবং আগের তুলনায় স্বাধীনতা যেন আরও কমে গেছে। আর শহরের শিক্ষিত যুব সম্প্রদায় অনুভব করছেন বেকারত্বের জ্বালা; শিক্ষিত হয়েও কাজ পাবার বিষয়ে সাদা চামড়ার কাছে তাঁরা যে কতটা অস্পৃশ্য সেই ব্রিটিশ মনোভাবের পরিচয় পাচ্ছেন।

যুদ্ধকালীন সময়ে মিত্র শক্তি তাদের উপনিবেশগুলির সাধারণ মানুষকে কথা দিয়েছিল যে যদি সেই উপনিবেশগুলি যুদ্ধে তাদের সমর্থন ও সহযোগিতা করে তাহলে যুদ্ধশেষে তাদের গণতন্ত্র এবং স্বায়ত্ত্বশাসনের অধিকার দেওয়া হবে। কিন্তু যুদ্ধশেষে প্যারিসে যখন শান্তিচুক্তি সই হল তখন দেখা গেল যে সবটাই ভাঁওতা; উপনিবেশগুলি থেকে সরে যাবার কোনো ইচ্ছে বা পরিকল্পনা – কোনোটাই সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির নেই। বরং এবার তা্রা নিজেদের মধ্যে উপনিবেশগুলিকে  নিজেদের মধ্যে ভাগ করার খেলায় মাতল। এর বিরুদ্ধে এবার বিভিন্ন দেশে জাতীয়তাবাদের উত্থান ঘটল। এশিয়ায় এবং আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে – টার্কি, ইজিপ্ট, আয়ারল্যান্ড, ইরান, আফগানিস্তান, বার্মা, মালয়, ফিলিপিন্স, ইন্দোনেশিয়া, ইন্দো-চীন, চীন এবং কোরিয়া – দেশে দেশে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে বিপ্লবী শক্তি দানা বাঁধতে লাগল।

আরও পড়ুন
বিরামকালে বিরামহীন সেলুলার জেল

নভেম্বর ৭, ১৯১৭। রাশিয়ায় জারেদের বিরুদ্ধে ঘটে গেল ভ্লাদিমির ইলিচ উলিয়ানভ বা লেনিনের নেতৃত্বে বলশেভিক বিপ্লব। রাশিয়ায় দীর্ঘদিনের সাধারণ মানুষের শোষণের অবসান ঘটল, জার রাজত্ব উৎখাত করে সমানাধিকারের ভিত্তিতে তৈরি হল শ্রমিক-কৃষক পরিচালিত সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন। এই সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের জন্ম, এই অক্টোবর বিপ্লব সারা বিশ্বের শোষিত মানুষের কাছে নতুন বার্তা নিয়ে এল যে মানুষ যদি সংগঠিত, ঐক্যবদ্ধ এবং সংকল্পবদ্ধ হতে পারে তবে যে কোনো অত্যাচারী শাসকের হাত থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। সোভিয়েত বিপ্লব ও মার্কসবাদের শিক্ষা পরবর্তীকালে ভারতীয় বিপ্লবীদের অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল যা আমরা পরে দেখব।  

আরও পড়ুন
বিরামকাল

যুদ্ধশেষে ব্রিটিশদের কাছে ভারতীয়রা প্রতিদান হিসাবে কিছু নাগরিক অধিকার আশা করেছিল। তা তো পাওয়া গেলই না বরং শোষণ-দমন আরও বেড়ে গেল। আগস্ট ১৯১৭, মন্টেগু-চেমসফোর্ড বা মন্টফোর্ড প্রস্তাবমতো ভারতীয়দের সীমিত পরিমাণে স্বায়ত্ত্বশাসনের অধিকার দিয়ে ব্রিটিশ রাজত্বের অধীনে প্রস্তাব পাশ হল ব্রিটিশ পার্লামেন্টে। এই প্রস্তাব অনুযারী ১৯১৯-এ ‘Government of India Act, 1919’ লাগু হল। এই আইনানুযায়ী কেন্দ্রীয় সরকারের দুটি ভাগ – প্রশাসনিক এবং আইনসভা। প্রশাসনিক ক্ষেত্রে গভর্নর জেনারেল হবেন মূল প্রশাসনিক কর্তা। তাঁর কর্তৃত্বে কেন্দ্রীয় এবং প্রাদেশিক স্তরে দুটি প্রশাসনিক স্তর থাকবে। কেন্দ্রীয়ভাবে গভর্নরকে সহায়তা করবেন আট সদস্যের একটি একজিকিউটিভ কাউন্সিল, যার মধ্যে তিনজন সদস্য হবেন ভারতীয়। অন্যদিকে আইনসভা হল দ্বিস্তরীয়। নিম্নোক্ত সভা হল সেন্ট্রাল লেজিস্লেটিভ অ্যাসেমব্লি, যার সদস্য সংখ্যা – ১৪৫ (৪১ জন সরকার দ্বারা মনোনীত, ১০৪ জন নির্বাচিত – ৫২ জন সাধারণ, ৩০ জন মুসলিম, ২ জন শিখ এবং বাকি ২০ জন বিশিষ্ট জন)। উচ্চস্তরীয় কক্ষ বা সভা হল ‘কাউন্সিল অফ স্টেট’, যার সদস্য সংখ্যা হল – ৬০ (২৬ জন সরকার দ্বারা মনোনীত, ৩৪ জন নির্বাচিত – ২০ জন সাধারণ, ১০ জন মুসলিম, ৩ জন ইউরোপীয়ান এবং ১ জন শিখ)। কাউন্সিল অফ স্টেটের মেয়াদ হল ৫ বছর এবং সেন্ট্রাল লেজিস্লেটিভ অ্যাসেম্বলির মেয়াদ ৩ বছরের।

আরও পড়ুন
মাফিনামা

মন্টফোর্ড প্রস্তাব ভারতবর্ষে চালু হবার ছ’মাস আগে ‘Defence of India Regulations Act, 1915’-কে বর্দ্ধিত করে মার্চ ১৯১৯-এ চালু হল ‘Anarchical and Revolutionary Crimes Act’ বা রাওলাট আইন। এই আইন মোতাবেক রাষ্ট্রদ্রোহের সন্দেহে বা অপরাধে যে কোনো মানুষকে গ্রেপ্তার করে বিনা বিচারে চালান (দ্বীপান্তরিত) দেওয়া যাবে। এর জন্য শুধুমাত্র রাষ্ট্রদ্রোহী কিছু কাগজপত্র তাঁর কাছ থেকে উদ্ধার হওয়াটাই যথেষ্ট প্রমাণ হিসাবে গ্রাহ্য হবে। এই বিলটি লেজিস্লেটিভ কাউন্সিলে উত্থাপিত হলে ভোটাভুটি হয়, ভারতীয় প্রতিনিধিরা এই বিল-প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভোট দেন, কিন্তু তাঁরা সংখ্যালঘু হওয়াতে ভোটে হেরে যান এবং রাওলাট আইন পাশ হয়ে যায়। এর প্রতিবাদে সমস্ত ভারতীয় প্রতিনিধি, যার মধ্যে ছিলেন – মহম্মদ আলী জিন্নাহ, মদন মোহন মালব্য এবং মাজহার উল হক – লেজিস্লেটিভ অ্যাসেমব্লি থেকে পদত্যাগ করেন।

আরও পড়ুন
মুক্তি এল অবশেষে

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় জরুরি পরিস্থিতিতে ভারতীয়দের ওপর বিভিন্ন দমনমূলক আইনি প্রয়োগ যদিও বা ভারতীয়রা মেনে নিয়েছিলেন এবং রাজনৈতিক একটা অংশ এই যুদ্ধে ব্রিটিশদের সমর্থন জানিয়েছিলেন। এবার যখন তাঁরা মনে করছেন যে এই সমর্থনের প্রতিদান হিসাবে ব্রিটিশরা তাঁদের স্বায়ত্ত্বশাসনের অধিকার আরো বেশি বেশি করে দেবে, স্থানীয় প্রশাসনের ভার তুলে দেবে তাঁদের হাতে তখনই তাঁদের রুখতে নিয়ে আসা হল রাওলাট আইন। এই আইন মোতাবেক যুদ্ধকালীন যেসব দমনমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল সেগুলিকে আরো জোরদার করা হল। এটাকে অনেকেই তাঁদের ব্রিটিশদের প্রতি আনুগত্যের প্রতিদানে বিশ্বাসঘাতকতা বলে মনে করলেন। গান্ধীজী সারা দেশ জুড়ে সর্বাত্মক বিরোধিতার ডাক দিলেন। তিনি কিন্তু একবারও মন্টফোর্ড সংস্কারের বিরুদ্ধে বা স্বরাজের স্বপক্ষে আন্দোলনের কথা বললেন না। তিনি শুধুমাত্র রাওলাট আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের কথা বললেন। এরপর খুব শীঘ্রই যখন দেখা গেল যে এই প্রতিবাদ আন্দোলন শাসক কর্তৃক মারাত্মক নিপীড়নের শিকার হচ্ছে গান্ধীজী অন্য পথ ধরলেন, তিনি দেশজুড়ে হরতাল, উপবাস, আইন অমান্য এবং গ্রেপ্তারবরণের ডাক দিলেন। আন্দোলন এবার গণ আন্দোলনের চেহারা নিল।

Powered by Froala Editor