মাফিনামা

‘কালাপানি’ আন্দামান— ২৪

আগের পর্বে

অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে মারা গেলেন ভান সিং। যার ফলে নতুন করে স্ফুলিঙ্গের সংযোগ হল আন্দোলনে। হরতাল শুরু করলেন পৃথ্বী সিং, সোহন সিং ভাকনা-সহ আরও অনেকে। বাঘাযতীনের সহযোগী জ্যোতিষচন্দ্র পাল অনশন করার সময় আক্রান্ত হলেন রক্ত আমাশায়। উদ্মাদ হয়ে গেলেন তিনি। স্বাস্থ্য ভাঙল বাকি রাজবন্দিদেরও। অন্যদিকে ব্যারী সাহেব অসুস্থ হয়ে ছুটি নিলেন জেল থেকে। ১৯১৯ সালে রাওলাট আইন প্রত্যাহৃত হওয়ার পরেই জেল বন্ধের সিদ্ধান্ত নিল সরকার। বন্দিদের দেশে ফেরানো হল আন্দামান থেকে। তবে সেলুলার জেল বন্ধ হয়ে গেলেও মুক্তি পেলেন না সকলে। তারপর…

রাওলাট অ্যাক্ট প্রত্যাহৃত হবার ঠিক পরপরই ডিসেম্বর ১৯১৯-এ আন্দামানে সেলুলার জেল বন্ধ করে দেবার সিদ্ধান্ত নিল সরকার। ইংল্যান্ডের রাজা মন্টেগুর প্রস্তাবমতো ‘রাজকীয় ক্ষমা’ (Royal Amnesty)-র কথা ঘোষণা করলেন। তৎকালীন ভাইসরয়, চেমসফোর্ডের আপত্তি সত্ত্বেও মন্টেগুর ব্যবস্থাপিত বাজবন্দিদের এই কারামুক্তির বিষয়টা ভারত সরকারকে মেনে নিতেই হল। সরকারের পক্ষ থেকে তৈরি হল ‘মার্জনাভিক্ষা পত্র’। এই পত্রে রাজবন্দিদের সই করতে হবে, তবেই পাওয়া যাবে মুক্তি, এই পত্রে সই করলেই আন্দামানের কালাপানি থেকে দেশের মাটিতে ফেরা যাবে।  অনেক আলোচনা, তর্ক-বিতর্কের পর এই বিষয়ে একত্রে সদর্থক একটি সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রায় প্রত্যেকেই দেশে ফেরার জন্য ওই শর্তাধীন-পত্রে সই করলেন।

কিন্তু সেই সময়ের বহু আগেই অনামী বিপ্লবীরাও যে কাজ করতে ঘৃণা বোধ করতেন, সেই কাজটিই করেছিলেন ‘বীর’ সাভারকর৷ প্রথমবার ১৯১১ সালের ৩০ আগস্ট তখন তাঁর নির্জন কারাবাসের শাস্তি চলছে তিনি ক্ষমাভিক্ষার আবেদন করলেন৷ চারদিনের মাথায় সেই ‘মার্সি পিটিশন’ খারিজ হয়ে যায়৷ এরপর ২৯ অক্টোবর ১৯১২, নভেম্বর ১৯১৩, সেপ্টেম্বর ১৯১৪, তারপর ১৯১৫ এবং ১৯১৭ সাভারকর ক্ষমাভিক্ষার আবেদন করে গেছেন৷

শেষ দুটি আবেদনে আগের আগুনখেকো সাভারকরের সমস্ত আগুন নিভে গেছে। তিনি তখন সওয়াল করছেন হোমরুলের পক্ষে। সেই সময়ে মন্টেগু-চেমসফোর্ড রিফর্মস’এর কথা চলছে যা আসবে ১৯১৯-এ। সাভারকর লিখছেন, কোনও দেশপ্রেমিকই ভালো সংবিধানের আওতায় কাজ করার সুযোগ পেলে সহিংস বিপ্লবের কথা ভাববে না। এও বললেন যে, আজ যখন ইংল্যান্ড ও আমেরিকার মতো প্রগতিশীল এবং নমনীয় সংবিধান রয়েছে তখন বিপ্লবের কথা বলা ‘অপরাধ’(!)। 

কনস্টিটিউশনাল রিফর্মের ভিত্তিতে যখন অনেক রাজবন্দিকে মুচলেকা দিয়ে ‘রয়্যাল অ্যামনেস্টি’ বলে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছিল তখনও সাভারকর ভাই সহ জনা তিরিশেক রাজবন্দি ছাড়া পেলেন না। অথচ ওই ‘রাজকীয় ক্ষমা পেয়ে দেশের মাটিতে ফিরে গেলেন পাঞ্জাবের মার্শাল ল’য়ের অভিযুক্তরা ছাড়াও মানিকতলা, লাহোর এবং বেনারস ষড়যন্ত্র মামলার দণ্ডপ্রাপ্তরা। দেশে ফিরলেন ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী, বারীন ঘোষ, উপেন ব্যানার্জী, হেমচন্দ্র দাস এবং ভাই পরমানন্দ। কিন্তু সবাই যে জেল থেকে ছাড়া পেলেন এমনটা নয়। যেমন ত্রৈলোক্যনাথ মহারাজ দেশে ফিরে আরও প্রায় কুড়ি বছর জেল খেটেছেন। তিনি অনেকের মতো ক্ষমা ভিক্ষার সরকারি দস্তাবেজে দস্তখত করেননি।  

আরও পড়ুন
মুক্তি এল অবশেষে

লক্ষণীয়, সাভারকর সেলুলারে থাকার সময় প্রথমদিকে ১৯১২ থেকে ১৯১৪ পর্যন্ত কাজ করতে অস্বীকার করা ও নিষিদ্ধ কাগজপত্র রাখার অপরাধে আটবার শাস্তি পেয়েছিলেন। কিন্তু পরের পাঁচবছর তাঁর আচার-আচরণ ছিল ‘ভেরিগুড’। তবু ‘তিনি সাংবিধানিক পথেই থাকবেন এই আশ্বাসন সত্ত্বেও ব্রিটিশ সরকার তাঁকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। সাভারকর ভাইরা সম্রাজ্ঞীর মার্জনা পেলেন না।

আরও পড়ুন
সাহসী প্রতিরোধ

সাভারকর আবারও আবেদন করলেন। তারিখ – ৩০-শে মার্চ, ১৯২০। তাতে তিনি লিখলেন, সরকার বাহাদুর যদি তাকে ছেড়ে দেন, তাহলে সরকার যতদিন বলবে ততদিন কোনো ধরনের রাজনৈতিক কাজের সঙ্গে তিনি যুক্ত হবেন না, তাকে ধার্য করে দেওয়া এলাকার বাইরে পা রাখবেন না এবং থানায় নিয়মিত হাজিরা দেবেন।

আরও পড়ুন
বীভৎস সেই বর্বরতা

সাভারকর তাঁর কারাবাসের অভিজ্ঞতা সম্পর্কিত আত্মজীবনীতে লিখছেন, সেলুলারে থাকার সময় তিনি জেলে তাঁর সহ-রাজবন্দিদের শিবাজী এবং কৃষ্ণের উদাহরণ দিয়ে বোঝাতেন, জেলের ভেতরে জীবন নষ্ট করে কী লাভ। তার থেকে মুচলেকা দিয়ে বেরিয়ে এসে নতুন উদ্যম নিয়ে দেশের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়াটাই লক্ষ্য হওয়া উচিত। উনি বলছেন বটে, কিন্তু ওঁর যুক্তি কেউ মানছেন না।

আরও পড়ুন
আবারও ‘কালাপানি’

মে, ১৯২০। গান্ধীজী ইয়ং ইন্ডিয়া’য় লিখলেন, “এত লোককে মাফ করা হল, শুধু এই দুই ভাই বাদ! ওরা তো বিপ্লবের পথ ছেড়ে রিফর্ম অ্যাক্টের শর্তাবলী মোতাবেক কাজ করবে বলে কথা দিয়েছে। ওদের অবিশ্বাস করার কী কোনো কারণ আছে? বর্তমান ভারতে সহিংস পথের অনুগামী কেউ নেই বলা যায়।” 

ইংল্যান্ডের লেবার দলের এমপি, ওয়েজউড ডেইলি হেরাল্ড’এ এক নিবন্ধে লিখলেন, সেলুলার জেল এক নরকবিশেষ। তাঁর লেখা ইংল্যান্ডে সাধারণ মানুষের মধ্যে ঝড় তুলল। শান্তিনিকেতন থেকে সি. এফ. অ্যান্ড্রুজ বম্বে ক্রনিকল পত্রিকায় এক নিবন্ধে সেলুলার জেলের অব্যবস্থা নিয়ে লিখতে গিয়ে প্রসঙ্গক্রমে বোম্বের গভর্নর জর্জ লয়েডের কাছে আবেদন রাখলেন যাতে তিনি সাভারকর ভাইদের মুক্তি দেবার বিষয়টি বিবেচনা করেন। ব্রিটিশরাজ ১৯২১-এ বোম্বের গভর্নরকে একমাসের মধ্যে এই বিষয়টি সম্পর্কে পুনঃবিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে আদেশ দিল। অবশেষে, মে ১৯২১-এ দুই সাভারকর ভাইকে আন্দামান থেকে ভারতের জেলে ফেরত আনা হল।

সাভারকর লিখেছিলেন, ‘‘…সরকার যদি তাদের বহুমুখী দয়ার দানে আমাকে একটু মুক্ত করে দেন তবে আমি আর কিছু পারি বা না পারি চিরদিন সাংবিধানিক প্রগতি এবং ব্রিটিশ সরকারের আনুগত্যের অবিচলিত প্রচারক হয়ে থাকব৷ …সরকার আমাকে যত কাজ করতে বলবে, সেই মতো প্রায় সব কাজ আমি করতে প্রস্তুত৷ কেন না আমার আজকের পরিবর্তন যেহেতু বিবেকের দ্বারা পরিচালিত, তাই আমার ভবিষ্যতের আচরণও সেই রকমই হবে৷ অন্যভাবে যা পাওয়া যেতে পারে সে তুলনায় আমাকে জেলে আটকে রাখলে কিছুই পাওয়া যাবে না৷ শক্তিশালীর পক্ষেই একমাত্র ক্ষমাশীল হওয়া সম্ভব৷ কাজেই অনুতপ্ত সন্তান পিতৃতুল্য সরকারের দরজায় ছাড়া আর কোথায় ফিরে যাবে? মহামান্য হুজুর অনুগ্রহ করে বিষয়গুলি বিবেচনা করবেন এই আশা রইল।’’ (পেনাল সেটলমেন্টস ইন আন্দামানস, আর সি মজুমদার, পৃ: ২১১–১৩)৷ ক্ষমার জন্য কোনও ভিক্ষা, কোনও আবেদন, এর চেয়ে বেশি নীচ, বেশি হীন হতে পারে না৷ ক্ষমাভিক্ষার আবেদনের ছত্রে ছত্রে ফুটে উঠেছে একজন আত্মমর্যাদাহীন ব্যক্তির আত্মসমর্পণ৷ যে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামীরা হাসতে হাসতে ফাঁসির দড়িকে চুম্বন করেছেন, সেই দেশের একজন ‘স্বাধীনতা সংগ্রামী’ হয়ে সাভারকর জেল থেকে বাইরে আসার জন্য নীতি–আদর্শ–মর্যাদা– সবই হেলায় বিসর্জন দিয়েছেন৷

কেশরী এবং শ্রদ্ধানন্দ  পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে সাভারকর তাঁর ১৪ বছরের কালাপানির অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ করছেন। এই লেখাগুলি একত্রিত করে বই আকারে The Story of My Transportation for Life প্রকাশিত হয় মে, ১৯২৭-এ। প্রখ্যাত রাজনৈতিক কর্মী এবং কানপুরের দৈনিক প্রতাপ পত্রিকার সম্পাদক গণেশ শঙ্কর বিদ্যার্থি শ্রদ্ধানন্দ পত্রিকায় খোলা চিঠি লিখে বলছেন, “যাঁরা দেশের জন্য শহিদ হবার স্বপ্ন দেখতেন তাঁরা কীভাবে মার্জনা চেয়ে চিঠি লিখতে পারেন? Why didn’t they embrace death in prison?” সাভারকর মাফিনামায় যা লিখেছিলেন – “যদি পথভ্রষ্ট সন্তান (prodigal son) নিজের ভুল বুঝতে পেরে ফিরে আসে তাহলে পিতার আশ্রয়লাভ থেকে নিশ্চয়ই বঞ্চিত হবে না!” – এই বাক্যবন্ধটি সবাইকে আহত করেছিল।

সাভারকর তাঁর মাফিনামার স্বপক্ষে যুক্তিও সাজিয়েছেন। তিনি এর উত্তরে বলছেন, “দেশের বিভিন্ন প্রান্তে অনেক দেশপ্রেমিক ঘর ছেড়ে হোমের আগুনে নিজেকে আহুতি দিতে বেরিয়েছিল। তারা লড়ল, অমানুষিক অত্যাচার সহ্য করে প্রায় মৃত্যুমুখে পৌঁছে গেল। এরপর তারা যদি ভবিষ্যত লড়াইয়ের জন্য প্রাণ বাঁচাতে শত্রুর শর্ত মেনে সাময়িকভাবে যুদ্ধের ময়দান থেকে সরে আসে? এমনটি শিবাজী আগ্রা দুর্গে বন্দি অবস্থায় কি তা করেননি? ঔরঙ্গজেবের শর্ত মেনে জান বাঁচিয়ে আবার যুদ্ধের জন্য ময়দানে ফিরে যাননি? যখন তিনি আফজল খাঁর সামনে হাতজোড় করে দাঁড়িয়েছিলেন, তখন তার হাতে লুকনো ছিল বাঘনখ।”

এরপর সাভারকর এও লেখেন, ১৯২৮-এ কাকোরি রেল ডাকাতির মামলায় রামপ্রসাদ বিসমিল, শচীন সান্যাল এবং আরও দু-একজন প্রাণভিক্ষার আবেদন করেছিলেন, মঞ্জুর হয়নি। সাভারকর এও বলেছিলেন যে বারীন ঘোষ, হেমচন্দ্ররা মাফিনামা দিয়ে বেরিয়ে এসেছেন। এরপর তিনি গণেশ শঙ্করের কথা তুলে ধরে বলেন যে তিনি নিজেই একটি আদালত অবমাননার মামলায় জেল হবার সম্ভাবনায় আদালতে ভুল স্বীকার করেছিলেন। তিনি আরও বলেন যে তাঁর বিশ্বাস লড়াই না করে জেলে পচে মরার বীরত্বে ওঁর আস্থা নেই। তার চেয়ে যেভাবে হোক জেল থেকে বেরিয়ে এস, তারপর আবার লড়াই কর।  

সাভারকরের এই কথায় নিঃসন্দেহে যুক্তি আছে। এটাকে রণকৌশল বলে ধরে নিলে এটাকে সাবাশি দিতেই হয়। তবু প্রশ্ন ওঠে। ওঁর উদাহরণ হিসাবে সবাই শ্রীকৃষ্ণ, শিবাজী, ওঁর গুরু তিলক, এমনকি গান্ধী, নেহেরু – প্রত্যেকে ছাড়া পাবার পর লড়াইয়ের ময়দানে ফিরে এসেছেন, নিজের নিজের মতাদর্শে অবিচল থেকে লড়াই চালিয়ে গেছেন, দুশমনকে আঘাত হেনেছেন। কিন্তু সাভারকর?

ভারতের মাটিতে ফিরে এসে জেল থেক মুক্ত হয়ে সাভারকর কিন্তু তাঁর মাফিনামার শর্ত হিসাবে আর কখনোই ব্রিটিশ বিরোধী – কি সহিংস, কি অহিংস কোনো ধরনের আন্দোলনেই আর নিজেকে যুক্ত করেননি। বরং তিনি ব্রিটিশ সংবিধানের মধ্যেই দেশের বিকাশের সম্ভাবনা দেখেছেন। গান্ধীবাদী অহিংস আন্দোলনকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা সাভারকর তখন পেছন দিকে হাঁটছেন। গান্ধীরা এগিয়ে চলেছেন। তাঁরা গণ-আন্দোলন করছেন, জেলে যাচ্ছেন, সত্যাগ্রহ করছেন। অন্যদিকে বিপ্লবীরা দেখা দিচ্ছেন – পশ্চিমে ভগৎ সিং, পুর্বে মাস্টারদা সুর্য সেন, তাছাড়া আরো আরো …কিন্তু ‘বীর’ সাভারকর ব্রিটিশ বিরোধিতায় কোথাও নেই। সাভারকর পিছিয়ে গেছেন। ওই মুহূর্তে তিনি খুঁজে পেয়েছেন তাঁর নতুন শ্ত্রু – ‘মুসলমান’।

Powered by Froala Editor