হরতালই হাতিয়ার

‘কালাপানি’ আন্দামান— ৪০
আগের পর্বে

দ্বিতীয় পর্যায়ে সেলুলার জেলে প্রাথমিকভাবে জায়গা হয়েছিল প্রায় ১০০ জন বন্দির। তবে দীর্ঘ ২৪ বছর বন্ধ থাকার পর সেলুলার জেলের অবস্থা হয়ে ওঠে শোচনীয়। মশা, বিছা, পোকামাকড়ের উপদ্রব তো ছিলই; সেইসঙ্গে সেলের দেওয়াল, সিলিং থেমে চাবড়া খসে দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল। ছাদ থেকে ঝরত বৃষ্টির জল। তবে অত্যাচারী ব্যারি সাহেব অবসর নিলেও বিন্দুমাত্র মাত্রা কমেনি শাস্তির। বন্দিদের জন্য খাবারের ব্যবস্থাও ছিল তথৈবচ। গুদামে সঞ্চিত চাল, আটায় অধিকাংশ সময়েই পোকা ধরে যেত। ঝাড়াইবাছাই না করেই তা দিয়ে খাবার বানানো হত রাজবন্দিদের জন্য। এর ফলে অধিকাংশ বন্দিই আক্রান্ত হন আমাশা, কৃমি, ম্যালেরিয়া, ডিস্পেপসিয়া, ইনফ্লুয়েঞ্জাস-সহ দুরারোগ্য নানান রোগে। তারপর...

সেলুলার জেলের আভ্যন্তরীণ অবস্থা, খাবারের মান ইত্যাদির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে ও জেল ব্যবস্থার উন্নতি ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার দাবি জানিয়ে ৩ জানুয়ারি, ১৯৩৩-এ অনশন ধর্মঘট শুরু করলেন ৭-জন রাজবন্দি – বিমলকুমার দাশগুপ্ত, সুশীল কুমার দাশগুপ্ত, প্রবোধ চন্দ্র রায়, প্রবীর গোস্বামী, বিমলেন্দু চক্রবর্তী, বারীন্দ্র কুমার ঘোষ (মানিকতলা বোমা মামলা ও ঋষি অরবিন্দর ভাই নন) এবং সুবোধ রায়। তাঁদের  ১৫ দফা দাবির মধ্যে ছিল – তৃতীয় শ্রেণির কয়েদিদের জন্য উন্নত মানের ভাতের চাল এবং সবজি; নিরামিষাশীদের জন্য বিশেষ খাদ্যতালিকা; সেলের ভেতরে রাত্রে প্রস্রাবের জন্য লোটার পরিবর্তে উপযুক্ত পাত্র; সমস্ত বন্দিদের জন্য ‘ইমোলা’ সাবান; যথাযথ চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নতি; শৌচাগার সংস্কার; সবার জন্য বিছানার চাদর এবং তোয়ালে। জেল কর্তৃপক্ষ সঙ্গে সঙ্গে হস্তক্ষেপ করে তাঁদের দাবি মেটানোর প্রতিশ্রুতি দিলে ধর্মঘট প্রত্যাহৃত হল ৯-ই জানুয়ারি, ১৯৩৬-এ। এই ৬-দিনের অনশনে সবারই স্বাস্থ্য ঠিক থাকার জন্য জোর করে কাউকে খাওয়ানোর প্রয়োজন হয়নি। তবে যাঁরা ধর্মঘটে গিয়েছিলেন চিফ কমিশনারের নির্দেশে তাঁদের ওপর নেমে আসল নানা ধরনের শাস্তির খাঁড়া।

কিছুদিন অপেক্ষা করে দেখা গেল যে সবটাই ভাঁওতা। তাঁদের কোনো দাবিই কার্যক্ষেত্রে রূপায়ণ করা হয়নি। চারমাস অতিক্রান্ত। ইতিমধ্যে আন্দামানে এলেন বটুকেশ্বর দত্ত এবং ভূপাল ঘোষ। এপ্রিল, ১৯৩৩-এ রাজবন্দিরা পুনরায় নিজেদের মধ্যে আলোচনা করলেন। এবার তাঁরা ঠিক করলেন যে এর শেষ না দেখে ছাড়বেন না। সেই মতো জেল কর্তৃপক্ষকে একমাস সময়সীমা দিয়ে চরমপত্র দেওয়া হল। নিজেদের জন্যও এই একমাস সময় চিন্তাভাবনা করার জন্য নির্ধারিত হল। বলা হল একবার যদি অনশন ধর্মঘট শুরু করা হয় তাহলে মাঝপথে পিছিয়ে আসা যাবে না। সমস্ত দিক বিবেচনা করে ১২ মে, ১৯৩৩ থেকে আবারও শুরু হল অনশন ধর্মঘট। এই ধর্মঘটে ৫৬-জন তৃতীয় শ্রেণির রাজবন্দিদের মধ্যে ২৩-জন অনশন ধর্মঘটে বসলেন, বাকিরা কাজ বন্ধ করে হরতালে গেলেন।

কাকোরি রেল ডাকাতির অন্যতম নায়ক, বিজয় কুমার সিংহ-র In Andamans – the Indian Bastille থেকে আমরা ওই দিনগুলির সবিস্তার বর্ণনা পাই। মে ১৯৩৩-এ ৩৩-জন রাজবন্দি অনশন ধর্মঘট শুরু করেন। সঙ্গে সঙ্গে এই সমস্ত অনশনকারীদের ৫ নং ব্লকের একতলা ও দোতলার সেলগুলিতে আটক করা হয়। অনশনকারীরা ছাড়াও অনেকে তাঁদের সমর্থনে জেলের ভেতরে কাজ করা বন্ধ করে দিয়ে হরতাল শুরু করলে তাঁদের ৩ নং ব্লকের নিচতলার সেলগুলিতে বন্দি করা হয়। এরপর এই সমস্ত বন্দিদের নানা ধরনের ভারী শিকল পরিয়ে রাখা হয়। সেলের ভেতর থেকে একটি কাঠের পাটাতন, জেলের কম্বল এবং পরনের পোশাক ছাড়া সমস্ত কিছু সরিয়ে নেওয়া হয়।  

আরও পড়ুন
যন্ত্রণাবিদ্ধ রাজবন্দিরা

এই মে-মাসের অনশনে দেখা গেল রাজবন্দিদের মধ্যে যথাযথ ঐক্য স্থাপিত হয়নি, অনেকেই ধর্মঘট থেকে নিজেদের দুরে সরিয়ে রাখলেন। এর একটা বড়ো কারণ ছিল অনেকেই তখন সবেমাত্র সেলুলারে এসেছেন, তাঁরা এখানকার অবস্থা সম্পর্কে একেবারেই অন্ধকারে। আবার একই দলের সদস্যরা যাঁদের দ্বীপান্তর হয়েছে, তাঁদের সবাই তখনও এসে পৌঁছাননি, ফলে যাঁরা আগে এসেছেন, তাঁরা সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধায় ভুগেছেন। আবার অনেকে যাঁরা যাবজ্জীবনের জন্য এখানে কারাদণ্ড ভোগ করতে এসেছেন তাঁদের যুক্তি ছিল যে যাঁরা ধর্মঘটে ইন্ধন দিচ্ছেন তাঁরা কয়েক বছরের মেয়াদে এখানে এসেছেন, তাঁরা তো তাঁদের মেয়াদ ফুরোলে চলে যাবেন, থাকতে হবে যাবজ্জীবন আসামিদের। তাই তাঁরা এখনই কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কোনো ঝামেলায় জড়াতে চান না। আবার কেউ কেউ নতুন এলেও এবং এখানে বন্দিদের পরিস্থিতি সম্পর্কে পুরোপুরি ওয়াকিবহাল না হলেও শুধুমাত্র বৈপ্লবিক ও জাতীয়তাবাদী চিন্তাধারা থেকে অনশনে যোগ দিয়েছেন।

আরও পড়ুন
আবারও সেলুলার জেল

জেল কর্তৃপক্ষ যুক্তপ্রদেশ থেকে আসা লাহোর ষড়যন্ত্র মামলার ভগৎ সিংহের অন্যতম সহযোগী বটুকেশ্বর দত্ত এবং বিহারের কমলনাথ তেওয়ারিকে এই অনশন ধর্মঘটের পাণ্ডা সাব্যস্ত করে তাঁদের সবার থেকে পৃথক করে ৫ নং ব্লক থেকে সরিয়ে আলাদা রাখার ব্যবস্থা করলেন। এঁরা ছাড়াও এই ভুখা হরতালের নেতৃত্বে ছিলেন ৩ জানুয়ারি, ১৯৩৩-এর অনশন আন্দোলনের ৭-জন অংশগ্রহণকারী। জানুয়ারি মাসের অনশনের দাবির সঙ্গে সকালবেলা দাঁত মাজার জন্য টুথপেস্ট বা টুথপাউডার এবং পায়ের স্যান্ডেলের দাবিও যুক্ত হয়েছিল।

আরও পড়ুন
মাস্টারদার গ্রেপ্তারি এবং ফাঁসির প্রহসন

এই অনশনে যে শুধুমাত্র তৃতীয় শ্রেণির রাজবন্দিরাই ছিলেন তা নয়, এঁদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন কয়েকজন দ্বিতীয় শ্রেণির রাজবন্দিও। যদিও তাঁদের দাবিতে আরো কিছু সংযোজন ছিল যার মধ্যে ছিল দেশ ও বিদেশ থেকে সরকারি খরচে তাঁদের পড়ার জন্য সংবাদপত্র আনতে হবে, তাঁদের বাড়ি থেকে টাকা পাঠালে তা তাঁদের হাতে দেবার ব্যবস্থা করতে হবে এবং সরকারের কাছে তাঁদের অভাব-অভিযোগ পাঠানোর ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করতে হবে।  

আরও পড়ুন
জালালাবাদের যুদ্ধ

সত্যি কথা বলতে কি, ভারতের জেলগুলিতে তৃতীয় শ্রেণির বন্দিদের যে ধরনের সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হত, তার কোনোটাই দেওয়া হত না সেলুলার জেলে। জেল-কোড ৪৬৬ মোতাবেক সমস্ত ভারতীয় কারাগারে প্রত্যেকটি কারাকক্ষে ৮-৯ ফুট উচ্চতায় একটা লোহার রডে কেরোসিন লণ্ঠন বা অন্য কোনো আলো ঝুলিয়ে সারারাত ধরে জ্বালিয়ে রাখতে হত। সমস্ত কারাকক্ষে যাতে রাত্রে আলোগুলো ঠিকমতো জ্বলে তা খেয়াল রাখতে হত কারারক্ষীদের। কিন্তু আন্দামানে সেলগুলির ভেতরে কোনো ধরনের আলোর ব্যবস্থা ছিল না। তার ফলে রাতের অন্ধকারে স্যাঁতস্যাতে সেলগুলিতে মশার উপদ্রব থেকে বাঁচা তো যেতই না কিন্তু তার থেকেও যেটা মারাত্মক ছিল তা হল বিষাক্ত বিছের কামড় খাওয়া। তার ফলে জ্বর ও ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হতেন রাজবন্দিরা। জেলের নিয়মবিধির ১০৫২ ধারা মতে খাদ্যতালিকায় বন্দিদের পছন্দমতো সবজির সংস্থান ছিল। সকালের খাদ্য তালিকায় রাখা ছিল পরিমাণমতো লবণ সহযোগে ভাতের মাড় (লপসি)। তাছাড়া অন্য সময়ে ভাত, ডাল ও সবজি। তাছাড়াও একদিন অন্তর যে কোনো একটি খাবারের সঙ্গে মাছ অথবা সেই দামে মাংস পাওয়া গেলে তাই দেবার সংস্থান ছিল। সেলুলার জেলে সকালের খাবার হিসাবে যে লপসি বা কঞ্জি দেওয়া হত তাতে লবণের লেশমাত্র ছিল না। সবজি বলতে ছিল ঘাস-পাতা; রুটির আটা বা ভাতের চাল শুধু নিম্নমানেরই ছিল না, তা ছিল পোকামাকড় ও কাঁকড়ে ভর্তি। আর ডাল বলে যা দেওয়া হত তাতে ডালের লেশমাত্র খুঁজে পাওয়া যেত না। মশলাপাতির ব্যবহার ছিল তথৈবচ, ফলে খাবারে না ছিল স্বাদ না পুষ্টিগুণ।

ভারতবর্ষের কারাগারগুলিতে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির বন্দিদের পড়ার জন্য বরাদ্দ ছিল ইংলিশম্যান, স্টেটসম্যান ও সঞ্জীবনী সংবাদপত্র। জেল কোড অনুযায়ী বন্দিদের জন্য সংবাদপত্রের বরাদ্দ থাকলেও আন্দামানে তা দেওয়া হত না।  আর বাড়ি থেকে কারো নামে মানি-অর্ডারে টাকা এলে আন্দামানে তা গ্রহণ করা হত না। যদিও জেল-কোড অনুযায়ী তা নিয়ম বিরুদ্ধ। অবশ্য কোনো উৎসবের সময়ে কোনো একজন বন্দি তাঁর নিজের বা কোনো বন্ধুর জেল-রোজগারের টাকা দিয়ে ফল-দুধ বা অন্য কোনো কাঁচা খাবার সুপারিন্টেন্ডেন্টের অনুমতি ক্রমে কিনতে পারতেন। এখানে অবশ্য বন্দিদের সরস্বতী পুজো, দুর্গা পুজো, দোলযাত্রা, ঈদ-অল-ফিতর, ঈদ-উজ-জোহা, মহরম, ক্রিসমাস, গুড ফ্রাইডে এবং ইংল্যান্ডের সম্রাটের জন্মদিন পালন করার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। জেল-কোড অনুসারে প্রথম শ্রেণির বন্দিরা প্রতি পনেরো দিনে একবার এবং দ্বিতীয় শ্রেণির কয়েদিরা মাসে একবার পরিবারের কেউ এলে তার বা তাদের সঙ্গে দেখা করার অনুমতি পেত, কিন্তু আন্দামানে এই নিয়ম ছিল প্রতি ছয়মাসে একবার। (অবশ্য সমুদ্র পেরিয়ে বন্দিদের সঙ্গে দেখা করার জন্য কেই বা আর আসতে পারত!)

Powered by Froala Editor