সঞ্চারিত চেতনা এবং ঐক্য – মার্কসবাদ চর্চা কেন্দ্র

১৯৩২ থেকে আন্দামানে সেলুলার জেলের যে পর্যায় শুরু হল সেই পর্বে রাজবন্দিদের ওপর নানা ধরনের অত্যাচার চললেও এবং নিম্নমানের খাবারের জোগান ও মান অপরিবর্তিত থাকলেও, কাজের ভার অনেক হালকা হয়ে গিয়েছিল। কঠিন কাজ বলতে তখন শুধু ছোবড়া পেটানো; কলুতে ঘানি টানার কাজে রাজবন্দিরা আর নিযুক্ত হন না, জেল কর্তৃপক্ষ একটু ভয়ে ভয়েই থাকেন এই বুঝি বা ‘সন্ত্রাসবাদীদের দল’ হামলা চালাল।  

আন্দামান সেলুলার জেলে জীবন কিছুটা হলেও সহনীয় হল। এই সময়ে বন্দিরা চিকিৎসার সুযোগ পেতে শুরু করলেন; এক্স-রে মেশিন আনা হল এবং টিবি রোগ ধরা পড়লে একেবারে প্রাথমিক অবস্থাতে না হলেও পরবর্তীতে সেলের  বিছানা থেকে উঠিয়ে জাহাজে তুলে ভারতের জেলে পাঠিয়ে দেওয়া হত। অন্যান্য অসুস্থ রাজবন্দিদেরও অবস্থা সঙ্কটাপন্ন হলে তাঁদেরও ফেরত পাঠানো হত ভারতের জেলে। বারীন-উপেন-উল্লাসকরদের প্রথম জেলজীবনের যে মারাত্মক অত্যাচারের কাহিনি ছিল, তার তুলনায় এই পর্যায়ের বন্দিরা সুযোগ-সুবিধা কিছুটা হলেও বেশি আদায় করে নিতে  পেরেছিলেন।  

এঁরা পেয়েছিলেন পড়াশুনার সুযোগ। সেলুলার জেল হয়ে উঠল ‘মার্কসবাদী বিশ্ববিদ্যালয়’। সরকারের তরফ থেকেও বিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, ইতিহাসের বইয়ের জোগান দেওয়া হচ্ছিল। সুবোধ রায়-এর লেখায়, Chiitagong Armoury Raid – A Memoir -এ আমরা পাই ১৯৩০-এর মেছুয়াবাজার বোমা মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত নিরঞ্জন সেনগুপ্ত, ডাঃ  নারায়ণ রায়, সতীশ পাকড়াশী, নলিনী দাস এবং সুধাংশু দাশগুপ্ত সেলুলার জেলে এলেন ১৯৩২-এ। তাঁদের সঙ্গে এল ট্রাঙ্ক ভর্তি সমাজবাদ, সাম্যবাদ ও সোভিয়েত সংক্রান্ত নানা বই। পরবর্তীতে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিতে যাঁরা যুক্ত হবেন সেইসব নেতারা সেলুলার জেলের ভেতরেই খুলে বসলেন কমিউনিস্ট কনসোলিডেশন – পাঠচক্র। ১৯৩৫-এর ২৬-এ এপ্রিল আন্দামান সেলুলার জেলে গঠিত হল এই কনসোলিডেশন যার ঘোষণা আনুষ্ঠানিক ভাবে হয় বিশ্ব শ্রমিক দিবস – ১-লা মে-তে।

সেলুলার জেলের রাজবন্দি, সত্যেন্দ্রনারায়ণ মজুমদার’এর In Search of Revolutionary Ideology and a Revolutionary Programme থেকে জানা যায় ১৯৩৫ সালের ১-লা মে যেদিন আন্দামানে কনসোলিডেশন গঠন করা হয় সেদিন খুব ভোরে জেল কর্তৃপক্ষের নজর এড়িয়ে কমিউনিস্ট বন্দিরা লাল পতাকা উত্তোলন করেন এবং বক্তৃতা, আবৃত্তি ও শপথ গ্রহণের মধ্য দিয়ে দিনটি উদযাপন করেন। ওই সময়ে প্রথম যে ৩৫-জন বন্দিকে নিয়ে কনসোলিডেশন গঠিত হয় তাঁরা এসেছিলেন অনুশীলন, যুগান্তর, বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার্স, শ্রীসংঘ, রিভোল্টিং গ্রুপ, চট্টগ্রাম গ্রুপ এবং হিন্দুস্থান সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশন (HSRA) থেকে। HSRA থেকে সর্বোচ্চ পরিমাণ বিপ্লবী, আটজন যোগ দিয়েছিলেন কমিউনিস্ট কনসোলিডেশনে।

আরও পড়ুন
ক্রান্তিকাল

কমিউনিজম পাঠ ও আলোচনায় বিপ্লবীদের চোখ খুলছে। জনগণের, বিশেষ করে মেহনতি মানুষের সমর্থন ছাড়া যে কোনো বিপ্লবই সফল হয় না, তা সে স্বাধীনতা যুদ্ধই হোক বা রাষ্ট্র-বিপ্লবই হোক তা এখন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের দ্বারা ‘সন্ত্রাসবাদী’ বলে দেগে দেওয়া দেশপ্রেমী বিপ্লবীরা উপলব্ধি করতে পারছেন।

আরও পড়ুন
ভুখা হরতাল – মহাবীর সিং, মোহন কিশোর নমোদাস ও মোহিত মোহন মৈত্র

আন্দামানের সেলুলার জেল ১৯৩৫-৩৭ কালপর্বে প্রকৃত অর্থেই হয়ে উঠেছিল কমিউনিজম বা মার্কসবাদ চর্চার অন্যতম প্রধান শিক্ষাকেন্দ্র। কারাগারে যে সমস্ত কমিউনিস্ট নেতা বন্দি জাতীয় বিপ্লবীদের মধ্যে কমিউনিজম ও মার্কসবাদের ভাবাদর্শ প্রচার করতেন তাঁরা জেলের ভেতরেই নিয়মিত রাজনৈতিক শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করতেন।  মার্কসবাদ-লেনিনবাদ সম্পর্কিত ইংরেজি বই, অসংখ্য অনুদিত পুস্তক-পুস্তিকা গোপনে বা সেন্সরশিপের মাধ্যমে জেলে নিয়ে আসা হত এবং অত্যন্ত্ গোপনে সেগুলি সংঘবদ্ধভাবে পাঠ করা, ব্যখ্যা-বিশ্লেষণ এবং আলোচিত হত। জেলে আটক কমিউনিস্ট বন্দিরা  শুধু যে মার্কসবাদী তত্ত্বই পাঠ করতেন এমনটা নয়, পাশাপাশি তাঁরা সাধারণ জ্ঞান-বিজ্ঞান, দর্শন, কাব্য, সাহিত্য এবং বিশ্ববিদ্যালয় পাঠ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত সাধারণ রাজনীতি বিষয়ক গ্রন্থাদিও পাঠ ও আলোচনা করতেন। বন্দিদের মধ্যে থাকা পরবর্তী সময়ে কমিউনিস্ট নেতারা যেমন ডাঃ নারায়ণ রায়, ডাঃ ভুলাল বসু, নিরঞ্জন সেন ক্লাস নিতেন। বন্দিদের মধ্যে উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়েছিল। তাঁরা পরিণত হয়ে উঠছিলেন।

আরও পড়ুন
হরতালই হাতিয়ার

এই সময়ের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠনের অন্যতম নায়ক গণেশ ঘোষ তাঁর মুক্তিতীর্থ আন্দামান গ্রন্থে (কলকাতা, ১৯৭২) লিখেছেন –

আরও পড়ুন
যন্ত্রণাবিদ্ধ রাজবন্দিরা

‘১৯৩৪ থেকে ১৯৩৭-এর মাঝামাঝি পর্যন্ত আন্দামান বন্দীদের নতুন করে জীবন গড়ার কাল। জেল-জীবনের কঠিন বিধি-নিষেধের নিগড় কিছুটা শিথিল করে নিয়ে আমরা শুরু করলাম সংগ্রামলব্ধ সুযোগ সুবিধার উপযুক্ত ব্যবহার। নিয়মিত প্রচুর পত্রপত্রিকা আমদানির ব্যবস্থা হল। নানা বিষয়ে পুঁথিপুস্তক আনা হল। ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত পড়াশুনা, আলোচনা ও বিতর্ক সভার আয়োজন হল, জেলে  কাজের ঘণ্টা কমে গেল, কাজের প্রকৃতিও আয়াসসাধ্য হল। নির্যাতন-ভারাক্রান্ত কঠিন ও রূঢ় বন্দী জীবনে মানসিক বিকাশের রুদ্ধদ্বার অবশেষে খুলে গেল।

অধ্যয়ন শুরু হল। যাঁরা ভাল জানেন তাঁরা অপরকে নানা বিষয়ে শিক্ষাদান করতে লাগলেন। সকাল থেকে সন্ধ্যা কাজের ফাঁকে ফাঁকে চলল অফুরন্ত জিজ্ঞাসার জবাব প্রচেষ্টা। শত শত বন্দীর ত্রস্ত পদক্ষেপ, উন্মুক্ত আকাঙ্খা, অফুরন্ত জিজ্ঞাসায় বন্দীনিবাসের এদিক ওদিক সকাল সন্ধ্যায় পরিপূর্ণ হয়ে উঠল। … প্রাথমিক প্রচেষ্টার অনেক ত্রুটি থাকা সত্বেও অতিদ্রুত, অতি দৃঢ়ভাবে আমাদের মানস-জগত এক বিরাট আবর্তে পাক খেয়ে অতীতের সকল মহত্ত্বের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়েও এক নতুন পথের সন্ধান খুঁজে পেল। সে-পথ সাধারণ মানুষের প্রতি অগাধ বিশ্বাসের পথ, সে-পথ সাধারণ মানুষকেই ইতিহাসের চালিকা শক্তি হিসাবে উপলব্ধির পথ – সে পথ শোষণমুক্ত সমাজগড়ার পথ – সমাজতন্ত্রের পথ, ব্যক্তি-সংগ্রাম, ব্যক্তি-শৌর্যের পরিবর্তে গণ-সাহস ও গণ-সংগ্রামের পথ। এই বিরাট টানাপোড়েন ও আলোড়ন বিলোড়নের মধ্য দিয়ে আমাদের সামগ্রিক জীবন সমবেত ভাবে ব্যক্তি-সংগ্রামের পথ  ছেড়ে গণ-সংগ্রামের পথ বেছে নিল।’

জেলের ভেতরে মার্কসবাদ-লেনিনবাদের পাঠ, আলোচনা-বিতর্ক – ক্রমশ আলোর রেখা খুঁজে পাচ্ছেন বিপ্লবীরা।  যাঁরা এতদিন ছোটো ছো্টো বিপ্লবী দল গড়ে জনসংযোগহীন সন্ত্রাসবাদের মাধ্যমে ব্রিটিশদের তাড়াবার কথা ভেবে এসেছিলেন তাঁরা এখন উপলব্ধি করছেন যে জনগণকে বাদ দিয়ে আসলে কোনো বৃহত্তর লক্ষ্যে পৌঁছানো যায় না।

চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের কনিষ্ঠতম নায়ক, সুবোধ রায় (তখন মাত্র ১৪ বছর বয়স) অন্যতম আসামি হয়ে আন্দামানে গেলেন। সেলুলার জেলের কমিউনিস্ট কনসোলিডেশন সম্পর্কে স্মৃতিচারণা করেছেন Chittagong Armoury Raid – A Memoir ( LeftWord, p. 93-95) গ্রন্থে। তিনি কীভাবে জেল থেকে একজন কমিউনিস্ট হয়ে বেরোলেন সে সম্পর্কে লিখছেন –

‘The government thought that they would be able to divert the minds of political prisoners by making them interested in socialist ideas, which they thought were less evil than “terrorist” actions such as the murder of oppressive British officials. Thus, the government had some hand in making political prisoners in the Andamans interested in socialism. They had unknowingly sowed the seeds of communism among political prisoners detained in other jails as well. The government was like the proverbial one-eyed deer.

At first, my knowledge of socialism was scanty. I gradually took some interest in these books, but could not make much headway in grasping their philosophy. I received help from Dr. Narayan Roy and other senior leaders who made me interested in communist ideology and helped me understood it and clarified my doubts.

…. Like many others, I debated with myself and gradually came over to communism and decided to work under the Communist Party of India after coming out of jail.’

ডাঃ নারায়ণ রায়, সুবোধ রায় এবং গণেশ ঘোষ

 

সেইসময়ে সশস্ত্র বিপ্লববাদীরা যাঁরা কমিউনিস্ট কনসোলিডেশনে যোগ দিয়েছিলেন তাঁদের স্মৃতিকথা ও সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায় যে কেউ কেউ কমিউনিস্ট আদর্শ নিয়ে জেলখানায় এলেও অনেকের ভেতরেই তীব্র মানসিক দ্বন্দ্ব ও টানাপোড়েন ছিল। নানা ধরনের বিরোধিতার সম্মুখীনও হতে  হয়েছিল তাঁদের। প্রথমত আনুগত্য পরিবর্তনের একটা বিষয় ছিল। কেউ কেউ ভেবেছেন যে সারা জীবন যে সমস্ত সহযোদ্ধাদের সঙ্গে মিলে ব্রিটিশ বিরোধী কার্যকলাপ চালিয়ে গেছেন তাঁদের মধ্যে অনেকেই দেশের ভেতরে বিভিন্ন জেলে জারাদণ্ড ভোগ করছেন, তাঁদের সঙ্গে বেইমানি করা হবে না তো! তাঁদের সঙ্গে কথা না বলে পুরনো দলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করা ঠিক হবে না। এঁদের অনেকেই দেশের জেলে ফিরে  তারপর যোগ দিয়েছেন কনসোলিডেশনে। আবার কেউ কেউ জেল থেকে ছাড়া পেয়ে তারপর কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়েছিলেন। নিরঞ্জন সেনগুপ্ত, ডাঃ  নারায়ণ রায়, সতীশ পাকড়াশী, নলিনী দাস, ভুলাল বসু, সুধাংশু দাশগুপ্ত, গণেশ ঘোষ, সুবোধ রায়, হরেকৃষ্ণ কোঙার, সুকুমার সেনগুপ্ত প্রমুখ সেলুলার জেলের কনসোলিডেশন থেকে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়েছিলেন।

এরপর বিপ্লবীরা চাইলেন আন্দামান থেকে মূল ভূখণ্ডের জেলগুলিতে ফিরে আসতে। তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে সুবোধ রায় লিখেছেন –

‘…From jail we watched with bated breath the rise of fascism in Italy and Germany, and naked aggression by fascism on weak and peace-loving nations. We watched the British Government conniving with fascist aggression. We saw how the Soviet Union was the only country that stood by the weak and the oppressed. We understood that if the aggression by the fascist powers supported by the imperialist powers continued unabated, a world war was sure to break out before long. Keeping all this in mind, and watching the rising war clouds generated by imperialist rivalry, we realised that if we lost more time and did not fight for our release from jail and repatriation from the Andamans, we would be doomed in the Cellular Jail.’

Powered by Froala Editor