মাস্টারদার গ্রেপ্তারি এবং ফাঁসির প্রহসন

'কালাপানি' আন্দামান- ৩৭
আগের পর্বে

২২শে এপ্রিল মাস্টারদার নেতৃত্বে রিপাবলিকান আর্মির বিপ্লবীরা এসে পৌঁছলেন জালালাবাদ পাহাড়। অন্যদিকে বিপ্লবী-দমনে ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার রাইফেলস ও সুর্মা ভ্যালি লাইট ইনফ্যান্ট্রির সশস্ত্র সেনাবাহিনীর দল পাঠাল ব্রিটিশ সরকার। পার্শ্ববর্তী পাহাড়ে বসল মেশিন গান। ততক্ষণে আট ভাগে ভাগ হয়ে বিপ্লবীরা অবস্থান নিয়েছেন পাহাড়ের নানা অংশে। ব্রিটিশ বাহিনীকে ওপরে উঠতে দেখেই শুরু হল বন্দুকচালনা। একে একে লুটিয়ে পড়ল ব্রিটিশ সেনারা। অন্যদিকে গুলিবর্ষণ শুরু করল মেশিনগানও। শহিদ হলেন নির্মল লালা, নরেশ রায়, বিধু ভট্টাচার্য, জিতেন দাশগুপ্ত, ত্রিপুরা সেন, পুলিন ঘোষ, শশাঙ্ক দত্ত, মধু দত্ত, মতি কানুনগো। যুদ্ধের পরদিন জালালাবাদ ছেড়ে মাস্টারদারা আশ্রয় নিলেন সুবোধ রায়ের চট্টগ্রামের বাড়িতে। তারপর...

জালালাবাদ যুদ্ধের পর কেটে গেছে পনেরো দিন। কোয়েপাড়ার বিনয় সেনের বাড়িতে উঠেছেন মাস্টারদা। সঙ্গে নির্মল সেন। সবাইকে বলা হল যাঁরা পুলিশের চোখে অপরিচিত তাঁরা যেন বাড়ি ফিরে যান। সময় হলে আবার ডেকে নেওয়া  হবে সবাইকে।

এর দুদিন পর এল এক হৃদয়বিদারক খবর। পুলিশের হাতে ধরা পড়েছেন ফণীন্দ্র আর সুবোধ। শহিদের মৃত্যুবরণ করেছেন মনোরঞ্জন, স্বদেশ, রজত আর দেবপ্রসাদ।

চট্টগ্রামে তখন ভয়াবহ অবস্থা। চারদিকে শুধু পুলিশ আর মিলিটারি। সান্ধ্য আইন জারি হয়েছে, পরিচয়পত্র ছাড়া বাইরে বেরনো মানা। ছাত্র-যুবদের ওপর চলছে অকথ্য নির্যাতন। নানা জায়গা থেকে গ্রেপ্তার হলেন অনেকে। এমনকি জালালাবাদ যুদ্ধের শহিদদের পরিবারের লোকজনকেও ছাড়া হল না। এঁদের জিজ্ঞাসাবাদের পর ছেড়ে দেওয়া হলেও যে সব বিপ্লবীদের গ্রেপ্তার করা হয়েছিল তাঁদের নানা অভিযোগে অভিযুক্ত করে জুলাই, ১৯৩০-এ চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠন মামলা শুরু হল। এই মামলায় বিপ্লবীদের পক্ষে মামলা লড়ার জন্য এগিয়ে এলেন নেতাজির অগ্রজ শরৎচন্দ্র বসু। আর এগিয়ে এলেন প্রখ্যাত আইনজীবী সন্তোষকুমার বসু এবং বীরেন্দ্র শাসমল। কুমিল্লা থেকে এলেন অখিল দত্ত এবং কামিনী দত্ত। চট্টগ্রামের বিখ্যাত ব্যারিস্টার যামিনীকুমার ঘোষাল স্বেচ্ছায় এগিয়ে এলেন বিপ্লবীদের প্রাণ রক্ষার তাগিদে।

এরপর চেষ্টা হল জেল ভেঙে বিপ্লবীদের উদ্ধার করার। পরিকল্পনা সফল করতে ল্যান্ডমাইন তৈরি করতে হবে। দরকার একটা কারখানা। মাস্টারদার পুরনো এক নিষ্ঠাবান কর্মী অর্ধেন্দুকে দায়িত্ব দেওয়া হল এই পরিকল্পনা সফল করার। আরেকজনকেও পাওয়া গেল – কালিকিঙ্কর। তাঁর কাকা নিশি দে নিজের একটা ঘর ছেড়ে দিলেন বোমা কারখানার জন্য। দেখতে দেখতে গোটা বাড়িটাই হয়ে উঠল একটা বারুদের কারখানা। নাইট্রিক ও সালফিউরিক অ্যাসিড জোগাড়ের ভার পড়ল কল্পনা দত্তের ওপর। নিবারণ ঘোষ, রেণু রায় ও কমলা ব্যানার্জীর সাহায্যে কল্পনা অ্যাসিড সংগ্রহ করলেন কলকাতা থেকে। রসায়ন বিজ্ঞানের ছাত্রী কল্পনা বিপ্লবীদের ফর্মুলা অনুসরণ করে নিজের বাড়িতে বসেই তৈরি করে ফেলল গান কটন। আর ওদিকে কালিকিঙ্করের কাকার বাড়ির কারখানায় ল্যান্ডমাইন তৈরির কাজে উদয়াস্ত পরিশ্রম করে চলেছে অপূর্ব সেন, প্রফুল্ল মল্লিক, সুশীল সেন, রবি সেন সহ আরও কয়েকজন।

আরও পড়ুন
জালালাবাদের যুদ্ধ

অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে বেশ কয়েকটা শক্তিশালী ডিনামাইট, আধমণ ল্যান্ডমাইনের বারুদ, পঞ্চাশ গজ ইলেকট্রিক তার, বেশ খানিকটা গান কটন ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি জেলের ভেতরে পাঠিয়ে দেওয়া হল। কিন্তু পরিকল্পনা কার্যকর করার আগেই ল্যান্ডমাইন সহ ধরা পড়ে গেলেন নিবারণ ঘোষ।

আরও পড়ুন
চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহ

জেল ভেঙে বন্দিদের মুক্ত করার পরিকল্পনা ব্যর্থ হল। নিশি দে’র বাড়িতে তল্লাশি হল। সেখান থেকে ধরা পড়লেন অর্ধেন্দু গুহ, সুশীল সেন, প্রফুল্ল মল্লিক। অন্যান্য জায়গা থেকে ধরা হল অনিল রক্ষিত, রবি সেন, নিবারণ ঘোষ, হৃদয় দাস, প্রভাত দত্ত প্রভৃতিকে। শুরু হল ‘চট্টগ্রাম ডিনামাইট ষড়যন্ত্র মামলা’।  

আরও পড়ুন
মোহে রং দে মেরা বাসন্তী চোলা

জালালাবাদ পাহাড়ের লড়াইয়ের পরে দু-বছর কেটে গেছে, মাস্টারদা তখনও ধরা পড়েননি। তিনি এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় আস্তানা পালটে পালটে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। চোখে তখনও ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়ে দেশকে মুক্ত করার স্বপ্ন। ১৯৩২-এ মামলার রায় ঘোষণা হল, মাস্টারদা তখনও অ্যাবস্কন্ডার। 

আরও পড়ুন
সার্ফরোসি কি তামান্না আব হামারে দিল মে হ্যায়

১৩-ই জুন, ১৯৩২। সন্ধ্যা থকেই টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে। মাস্টারদা তখন ধলঘাটের গোপন আস্তানায়। সেদিন রাতে সঙ্গে আছেন নির্মল সেন, ভোলা, মণি দত্ত এবং মাস্টারদার স্নেহের রাণী, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার। ইতিমধ্যেই প্রীতিলতা নির্মলবাবুর প্রশিক্ষণে শিখে গেছে রিভলবার চালানো। সেই রাত্রে ধলঘাটের সেই গোপন আস্তানায়, সাবিত্রীদেবীর বাড়িতে হানা দিল পুলিশ ও গোর্খা বাহিনী। সেনাবাহিনী গুলি চালালে নির্মল সেনের বুকে গুলি লাগল। তিনি তখন মরণাপন্ন, কোনমতে মাস্টারদাকে বললেন, আমি fatally wounded. বেশিক্ষণ আর নেই। আমাকে ছেড়ে দিন, এখুনি রাণী আর ভোলাকে নিয়ে এখান থেকে চলে যান। মাস্টারদা তাঁর ডানহাত নির্মল সেনকে চিরতরে হারালেন। রাণী আর মণি দত্তকে নিয়ে মাস্টারদা এসে পৌঁছলেন জৈষ্ঠপুরার গোপন আস্তানায়। আগের রাতে ধলঘাটে নির্মল সেনের সাথে প্রণোচ্ছ্বল ভোলাও নিহত হয়েছে। সে বেচারা এমনিতেই জ্বরে কাবু ছিল, মাস্টারদা’দের সঙ্গে পালানোর সময়ে ঘন অন্ধকারে বেতঝোপের মধ্যে থেকে একটা গুলি এসে লাগল ভোলার বুকে। সেখানেই সব শেষ।

প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, তারকেশ্বর দস্তিদার এবং কল্পনা দত্ত

 

মাস্টারদাকে হন্যে হয়ে খুঁজছে পুলিশ। তাঁর মাথার দাম ধার্য হয়েছে দশ হাজার টাকা। ইংরেজ শাসকেরা জানত, মাস্টারদা চট্টগ্রাম শহরের আশেপাশে গ্রামাঞ্চলে কোথাও লুকিয়ে আছেন। কিন্তু বহু চেষ্টা করেও কোনো বিশ্বাসঘাতককে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। মাস্টারদার প্রতি হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে চাষি, গরিব-নিম্নবিত্ত গৃহস্তের এক অদ্ভুত ভালোবাসা ! সারোয়াতলী গ্রাম, পড়ৈকড়া গ্রাম, জৈষ্ঠ্যপুরা গ্রাম, কদুরখিল গ্রামের গোপন আস্তানায় মাস্টারদা লুকিয়ে আছেন। সঙ্গে আছে হরিপদ ভট্টাচার্য, তারকেশ্বর দস্তিদার, সুশীল দে, কল্পনা দত্ত। মাস্টারদার নাম সবাই জানত কিন্তু অনেকেই তাঁকে চেহারায় চিনত না। সদাসতর্ক উপস্থিত বুদ্ধি ও স্নায়ুর ওপর অসীম নিয়ন্ত্রণের ফলে বহুবার ইংরেজ পুলিশের চোখ এড়িয়ে যেতে তিনি সক্ষম হয়েছিলেন। বারেবারেই নানা ছদ্মবেশ ধারণ করে তাঁকে আস্তানা পাল্টাতে হচ্ছিল। কিন্তু ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের পরিকল্পনা থেকে কখনোই সরে যাননি।

চট্টগ্রাম পাহাড়তলী ইনস্টিটিউট নামে বেঙ্গল রেলওয়ে ইউরোপীয়ান ক্লাব ছিল যেখানে বাইরের সাইনবোর্ডে লেখা থাকত, ‘ভারতীয় এবং কুকুরদের প্রবেশ নিষিদ্ধ’। দিনটা ছিল ২৪-এ সেপ্টেম্বর, ১৯৩২। তখন রাত ন’টা।  পুরুষবেশী প্রীতিলতা ওয়দ্দেদারের নেতৃত্বে সাতজন তরুণ খাঁকি সামরিক পোশাক পরে আক্রমণ করে বসল এই ক্লাব। সেখানে পুলিশের সঙ্গে লড়াইয়ের শেষে প্রীতিলতা পটাসিয়াম সায়ানাইডের অ্যাম্পুল মুখে পুড়ে শহিদ হলেন।

১৫-ই ফেব্রুয়ারি, ১৯৩৩। সারাদিন চলল আলাপ-আলোচনা। বিকালে মাস্টারদা বুঝতে পারলেন, গোপন এই আস্তানা আর গোপন নেই। এক বিপ্লবীর ভাই, নেত্র সেন পুলিশে খবর দিয়েছে। কিন্তু রাত না হলে আস্তানা ছাড়া যাবে না। মাস্টারদা ব্রজেন সেনকে বললেন, “হাবিলাস দ্বীপে পৌঁছে দেবার ভার তোমাকেই নিতে হবে টুনু”। মাঘ মাসের প্রবল শীতে অন্ধকার গাঢ় হতেই সেই বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে এলেন মাস্টারদা, কল্পনা, ব্রজেন, শান্তি চক্রবর্তী, মনীলাল দত্ত আর সুশীল দাশগুপ্ত। ইতিমধ্যে পুলিশ ঘিরে ফেলেছে বাড়ি। বাড়ির পশ্চিমে বাঁশবাগান। তাঁরা গেলেন সেইদিকে। বাঁশবাগানের বেড়া পাড় হতে গিয়ে সেই শব্দে ছুটে এল গুলি। সেই গুলিতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে সংজ্ঞা হারালেন সুশীল। পরে মাঝরাতে বৃষ্টির ছাঁট মুখে এসে পড়তে জ্ঞান ফেরে তাঁর। তিনি মাঘ মাসের প্রবল শীতে কাঁপতে কাঁপতে কোনমতে গিয়ে আশ্রয় নিলেন প্রথমে হরিশ বিশ্বাসের বাড়ির উঠোনে, পরে পাশের গড় পার হয়ে চলে গেলেন হাবিলাস দ্বীপে ধীরেন দাসের বাড়িতে। কল্পনা ও মণিলাল পুকুরের কাঠের তক্তার নিচে ডুবে কোনোমতে নাকটা তুলে ছিলেন। কিছুক্ষণ পরে গোলাগুলি থামলে রাতের অন্ধকারে তারা গ্রামের শেষ প্রান্তে এক চাষির বাড়িতে গিয়ে উঠল। ওই বাড়ির ছেলে লক্ষ্মণ দলের সদস্য। কল্পনা ও মণিলালের আশ্রয় হল বাড়ির ধানের গোলায়। কিন্তু সেই আশ্রয় টিকল না। বাড়ির মালিক তাঁদের হাতজোড় করে আনুনয় বিনয় করলেন, তার ছেলেও সন্দেহভাজনের দলে। যে কোনো সময়ে পুলিশ চলে আসতে পারে, যদি তাঁরা এখান থেকে চলে যান। অবশেষে ভোররাতে সেই বাড়ি ছেড়ে পাশের গ্রামে এক নিরাপদ আস্তানায় আশ্রয় পেল তারা। এইদিকে শান্তি পুলিশের বেড়াজাল ছিঁড়ে নিরাপদে চলে গেল পাশে হাবিলাস দ্বীপে, আশ্রয় নিল রমণী চৌধুরীর বাড়িতে।

মাস্টারদা ও ব্রজেন সেন সাবধানে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু তাঁরা ধরা পড়ে গেলেন। ওঁদের হাত-পা বেঁধে ওই প্রবল শীতের রাতে মাটিতে ফেলে রাখা হল। ঘড়িতে রাত তখন দুটো।

মাস্টারদা গ্রেপ্তার হলেন বটে নেত্র সেনের বেইমানিতে কিন্তু সেই নেত্র সেনকেও বেঁচে থাকতে দিল না মাস্টারদা’র অনুগামীরা। অনেকদিন পর, ১৯৩৪ সালে, মাসটারদা তখন আর ইহজগতে নেই কিন্তু প্রতিশোধ নেওয়া হয়ে গেল। এক অজ্ঞাতনামার গুলিতে প্রাণ হারাল বেইমান নেত্র সেন। আততায়ী কে, তাঁকে চিনতে পেরেছিলেন নেত্র সেন’এর স্ত্রী। কিন্তু কখনই তিনি কারও কাছে সেই নাম প্রকাশ করেননি।

মাস্টারদা সূর্য সেনের ফাঁসির মঞ্চ

 

১৯-এ মে, ১৯৩৩ কল্পনা দত্ত এবং তারকেশ্বর দস্তিদার গেলেন গাহিরা গ্রামের পূর্ণ তালুকদারের বাড়িতে আয়োজিত গোপন মিটিংয়ে। সেখানে গোপন আলোচনায় হাজির হলেন মনোরঞ্জন দাস সহ আরও কয়েকজন আত্মগোপনকারী বিপ্লবী। গোপন সূত্রে খবর পেয়ে বাড়ি ঘিরে ফেলল পুলিশ। শুরু হল গুলির লড়াই। কিন্তু শুধুমাত্র রিভলবার দিয়ে কতক্ষণ আর লড়া যায়? পুলিশের গুলিতে নিহত হলেন মনোরঞ্জন, গৃহস্বামী পূর্ণ আর তাঁর ভাই নিশি তালুকদার। ধরা পড়লেন কল্পনা, তারকেশ্বর সহ বাকি বিপ্লবীরা। ধরা পড়ার পর মেজর কিম তারকেশ্বরের মুখে বুট জুতো পরা পায়ে মারলেন সজোরে এক লাথি। তারকেশ্বরের চোখের ভেতর থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটল।

জুন মাসে শুরু হল চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠনের অতিরিক্ত মামলা। ১৪ আগস্ট রায় বেরোল। মাস্টারদা ও  তারকেশ্বরের ফাঁসির আদেশ হল। কল্পনার হল যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। আন্দামানে দ্বীপান্তরিত হলেন গণেশ ঘোষ, হরিপদ ভট্টাচার্য, ফকির চন্দ্র সেনগুপ্ত, হিমাংশু ভৌমিক, কালিকিঙ্কর দে, লালমোহন সেন, ফণীন্দ্রলাল নন্দী, রণধীর দাশগুপ্ত, সহায়রাম দাস, সুবোধ কুমার চৌধুরী, সুবোধ রায়, সুধীর রঞ্জন চৌধুরী, কালিপদ চক্রবর্তী এবং সুখেন্দু দস্তিদার।  আন্দামান সেলুলার জেল মাঝে ১৯২২ থেকে প্রশাসনিক নির্দেশে রাজবন্দিদের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু আবারও ১৫-ই অগাস্ট, ১৯৩২-এ চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন ও অন্যান্য বিপ্লবী কার্যকলাপের অভিযোগে দণ্ডপ্রাপ্ত ২৪ জন রাজবন্দিদের নিয়ে  খুলে গেল সেলুলার জেলের ফটক। 

কারাগারে মাস্টারদার ওপর চলল নারকীয় অত্যাচার। ফাঁসির আদেশের পর সাধারণত দণ্ডিতকে নিজের মতোই থাকতে দেওয়া হয়, তার শেষ ইচ্ছে শোনা হয়। মাস্টারদার ক্ষেত্রে কিন্তু তা ঘটল না। ফাঁসিতে ঝোলানোর আগেরদিন জেলের ভেতরে মাস্টারদাকে মেরে একটা একটা করে তাঁর হাড়গোড় ভেঙে দেওয়া হল, সাঁড়াশি-হাতুড়ি দিয়ে তাঁর দাঁতগুলো ভেঙে উপড়ে নেওয়া হল। বীভৎস অত্যাচারে তাঁর হাত-পায়ের নখগুলো উপড়ে নেওয়া হল এরপর প্রায়মৃত শরীরটিকে ১২-ই জানুয়ারি, ১৯৩৪-এ চট্টগ্রাম কারাগারে ফাঁসিকাঠে টাঙিয়ে দিয়ে আদালতের আদেশ কার্যকরী করল মহান ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ। তারপরেও মাস্টারদার নশ্বর শরীরটির রেহাই মিলল না। তাঁর মৃতদেহ আত্মীয়স্বজনদের হাতে তুলে দেওয়া তো দূরস্থান, তাঁর লাশ জেলখানা থেকে ট্রাকে করে ৪ নম্বর স্টিমার ঘাটে নিয়ে গিয়ে ব্রিটিশ ক্রুজার ‘দি রিনাঊন’এ তুলে বুকে লোহার টুকরো বেঁধে বঙ্গোপসাগর-ভারত মহাসাগর সংলগ্ন কোনো এক অজ্ঞাত স্থানে ফেলে দেওয়া হল। মাত্র ৪০ বছর বয়সে চিরবিদায় নিলেন মাস্টারদা। একইভাবে মাস্টারদার সহকারী তারকেশ্বর দস্তিদারকে নৃশংস অত্যাচার করে, অর্ধমৃত অবস্থায় ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেহ লোপাট করে দেওয়া হল।

Powered by Froala Editor