নামাঙ্কনের কলমকারি হরফদারি

মানিকলমকারি - ৫৫
আগের পর্বে

সিনেমা তৈরির নানা ঘটনা নিয়ে সত্যজিৎ রায় লিখলেন ‘একেই বলে শুটিং’। প্রথমে বইটিতে ছিল ৫টি লেখা। পরে আরও ২টি লেখা যোগ হয়। প্রথম ৫টির মধ্যে তিনটি ‘গুপি গাইন বাঘা বাইন’ নিয়ে, আর দুটি ফেলুদা সিরিজের দুটি সিনেমা নিয়ে। আসলে সিনেমার ছবি তোলা পর্যায়ের এক বৈঠকী গল্প বলেছেন সত্যজিৎ। কতরকমভাবে বুদ্ধি খাটিয়ে ছবি তোলা যায় এবং এর সঙ্গে কত মানুষের পরিশ্রম জড়িয়ে থাকে, তাই এই লেখার বিষয়বস্তু। আর এর মধ্যে দিয়েই খুদে পাঠকদের মধ্যে সিনেমা নিয়ে একধরণের ভালোবাসা তৈরি করে দেন তিনি। আবার সেই ছবি তোলার গল্পই ফিরে আসে পরের সিনেমাতেও।

সিনেমার শুরুতে নাম দেখানো হয়। আর সেখানেও থাকে এক কলমকারির গল্প। কারণ, ছবির নাম, অভিনেতা অভিনেত্রীর নাম, কলাকুশলীর নাম, পরিচালকের নাম--- আরো কত তথ্যই না লিখতে হয় সেথা। সেই নাম লেখা হবে কীভাবে? সেও কি এক অভিনব কলমকারি নয়? কখনো কলমের টানে লেখা হয় নাম-টাম আবার কখনো ছাপার হরফ ব্যবহার করে লেখা হয় সিনেমার নাম-দেখানোর দৃশ্য--- সিনেমাতে যাকে বলে টাইটেল কার্ড। কিন্তু এই টাইটেল কার্ডকেও যে শিল্পসম্মত করে তোলা যেতে পারে--- তাকেও যে ছবির মেজাজ মর্জির সঙ্গে মিলিয়ে তৈরি করা যেতে পারে, সেই পথ দেখিয়েছিলেন সত্যজিৎ তাঁর প্রথম ছবি থেকেই। ধরা যাক, তাঁর অপু ট্রিলজির কথা। ‘পথের পাঁচালী’, ‘অপরাজিত’ আর ‘অপুর সংসার’-এর কথা। মনে আছে, এই তিন ছবির টাইটেল কার্ডের চিত্ররূপ। ‘পথের পাঁচালী’-র টাইটেল কার্ডে ছিল পুথির পাতার ছবি, পুথির উপরে পুথির ধরনে লেখা ছিল নাম। সেই টাইটেল কার্ড তো অবিস্মরণীয়। বরং তারপরের ‘অপরাজিত’-তে অনেকের কাছেই বরং একটু সহজ তার টাইটেল কার্ড। সাদার উপরে ছাপার হরফে লেখা আছে নামগুলি। আর ‘অপুর সংসার’-এ এলো কালোর উপরে সাদা এক ধরনের বিশেষ টানে লেখা কলাকুশলীর নাম। এবার একটু মন দিয়ে দেখতে বলি ওই নামাঙ্কনের ধরনগুলি। আর তার সঙ্গে জুড়ে নেওয়া যাক এই তিন ছবির গল্পমালা। ‘পথের পাঁচালি’ যেমন অপুর গল্প, তেমনই তা তার বাপ হরিহরের গল্পও বটে। হরিহর পেশাগতভাবে পুরোহিত, কিন্তু তাঁর স্বপ্ন একদিন একটা যাত্রা লেখা। তাই তিনি সর্বজয়াকে বলেন, তাঁর স্বপ্নের যাত্রাপালা লেখার কথা। তাঁর যাত্রালেখার আকাঙ্ক্ষার সঙ্গেই তো যুক্ত হয়ে এগল ওই পুথির পাতা। হরিহরের স্বপ্ন যেমন ছিল যাত্রা লেখা, তেমনই অপরাজিত আর অপুর সংসারের অপুর স্বপ্নে আসে ছাপার জগৎ। হাতে লেখার দুনিয়া থেকে ছাপার হরফের দুনিয়া। অপুর পথের পাঁচালি তো এক অর্থে সেই পুথির জগৎ থেকে মুদ্রণ সংস্কৃতির মানুষ হয়ে ওঠার গল্পও। সে কলকাতায় আসে পড়াশোনা করতে। কিন্তু এই নাগরিক সংস্কৃতির সঙ্গে তার যোগ কোন সূত্রে? মনে পড়বে, তার গ্রামের মাস্টারমশাই তাকে উপহার দিয়েছিল ছাপা-বই। সাহেবদের ছাপা বই পড়েই সে চিনতে শেখে বাইরের জগৎ--- আফ্রিকি সংস্কৃতি সম্পর্কে তার ধারণাও যে কেবল কালো অরণ্যচারী মানুষ হয়েই রইল, তার পিছনেও আছে সেই সাহেবদের দেখা আফ্রিকি ইতিহাস। মনে আছে, সর্বজনশ্রদ্ধেয় সদ্যপ্রয়াত, আমাদের প্রিয় মাস্টারমশাই মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় একবার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিল্ম স্টাডিজের ক্লাসে নয়ের দশকের গোড়ায় ‘অপরাজিত’ ছবিটি দেখবার সময় পাশ থেকে তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ধরনে একটু হেলে, একেবারে কানের কাছে এসে কারো ছবি দেখার অসুবিধা না করে, হাল্কা মৃদু স্বরে বলেছিলেন, ‘মাস্টারের পোশাকের ওপর ওই ক্রশচিহ্নটি দেখো কিন্তু!!’ এঁরাই শিখিয়েছিলেন, ‘দেখা’ কাকে বলে! যাই হোক, তাহলে, ছাপার জগতে প্রবেশ করছে অপু। কলকাতায় এসে সে কাজ নিল কোথায়? সেও তো এক ছাপাখানায়। আর ‘অপুর সংসার’ ছবিতে তো তার স্বপ্নই হল একটা উপন্যাস লেখা। মানে ছাপার বই। সেই উপন্যাসের প্লট শুনেই তার বন্ধু পুলুর সেই বিখ্যাত কথা, ‘ আরে এ উপন্যাস কোথায়, এ তো আত্মজীবনী!’ এই ছাপার জগতে প্রবেশের গল্প বলেই কি ‘অপরাজিত’-র টাইটেল কার্ড ওইভাবে তৈরি? এবার লক্ষ করলে বুঝি। জমিতে ঘষা একটা ব্যাপার আছে আর তার ওপরে আছে নানা মাপে সাজানো হরফ--- এই জমি তো ছাপার জন্য ব্যবহৃত পাতা আর তার উপরে সেই ছাপার হরফ! ‘পথের পাঁচালি’-র লিখন সংস্কৃতি আর পুথির দুনিয়া থেকে ‘অপরাজিত’-র হরফের জগৎ আর মুদ্রণবিশ্ব!

এই কাহিনিসূত্র মনে রাখলে, ‘অপুর সংসার’-এর ওই টাইটেল কার্ডের টানকে পড়ার কাজটা সহজ হয়ে যায়। ‘অপুর সংসার’-এর কাহিনি অপুর বিয়ে--- অপরাজিত-র কাহিনিতে ওয়ার্ল্ড অফ অপু বলতে যা ছিল, তা কীভাবে ধীরে ধীরে অপুর সংসার বলতে, ফ্যামিলি অফ অপুর কাহিনি হয়ে ওঠে, এ তো নিঃসন্দেহে তারও কাহিনি! সে নিজের লেখা উপন্যাসের পাতাগুলি উড়িয়ে দেয়--- এক গভীর বিরহ থেকে। সে নিজের ছেলে কাজলকে প্রথমে বর্জন আর পরে গ্রহণ করে, সেও তো তার এক গভীর বিরহ থেকেই। সেখানেই অপু আর অপর্ণার গল্প। এই বিবাহের সূত্রেই তার দৃশ্যগত উপাদান আল্পনা। বিয়ের দৃশ্যকল্পরূপে আল্পনার টান আর অপুর উপন্যাস লেখার সূত্রে তার হাতের লেখার টান--- এই দুই মিলেই সত্যজিৎ তৈরি করলেন, ‘অপুর সংসার’-এর নামপত্র। লক্ষ করলেই চোখে পড়বে এই টান। এখানে, মনে আছে তো ‘অপুর সংসার’-এর সেই পোস্টারের নামঙ্কন। সেখানে পোস্টার ডিজাইনে ছিল বিয়ের পিঁড়ির আদল আর তার নাম লেখার শিল্পে স্পষ্ট ছিল আল্পনার টান।

এইবারে মনে পড়বে, একেবারে অন্য প্রসঙ্গে বলা সত্যজিতের একটি কথা। ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ ছবির আবহসংগীত বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে সুরকার সত্যজিৎ লিখেছিলেন, ‘‘পাহাড়ি লোকসংগীতের সুর ইচ্ছামতো ভেঙে দেশি ও বিলাতি যন্ত্রে একক ও সমবেতভাবে বাজিয়ে এ ছবির মেজাজ আনবার চেষ্টা করা হয়েছিল।’’ সে তো আবহ সংগীতে। কিন্তু ওই নামপত্রে? নামপত্রে সত্যজিৎ ব্যবহার করলেন সুরে যেমন পাহাড়ি লোকসংগীতের সঙ্গে বিলিতি বাদ্যযন্ত্র মিশিয়েছিলেন, তেমনই এই টাইটেল কার্ডে আনলেন পাহাড়ি থানকা-র সঙ্গে পশ্চিমি পার্সপেক্টিভে আঁকা দার্জিলিংয়ের জীবনচিত্র। থানকার ছবির বিষয় বুদ্ধ-জীবন আর তার লিপি নেওয়ারি। বুদ্ধ-জীবনকথাকে বদলে নিলেন দার্জিলিংয়ের চলমান ছবিতে আর ওই নেওয়ারি লিপির গড়নে তিনি লিখলেন বাংলা হরফ। দেখনশোভায় ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’-র টাইটেলকার্ড এক অসামান্য শিল্পবস্তুও নিঃসন্দেহে। ছবির সঙ্গে দোস্তালি পাতানো এই শিল্পসামগ্রী হয়ে উঠতে পারে ছবির টাইটেল কার্ড, তার আরেকটি নিদর্শন তো অবশ্যই সোনার কেল্লা। সেখানে বালক মুকুলের আঁকা ছবির জগতের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে ছবির টাইটেল কার্ড, তার হাতের লেখার সঙ্গে মিলিয়ে ভেসে উঠছে ছবির কলাকুশলীদের নাম। এই প্রসঙ্গ বহু আলোচিত বলে, আপাতত সেই কথায় বিস্তার নিষ্প্রয়োজন।

আরও পড়ুন
শুটিংয়ের বৈঠকি গপ্পো: এক অভিনব গদ্যবিষয়

তবে এই ধারায়, সত্যজিতের একটি বাতিল কলমকারির কথাও এখানে বলে নেওয়া ভালো। তা হল, ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’-এর না-দেখা টাইটেল কার্ডের শিল্প। সত্যজিৎ নিজে হাতে ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ ছবির পুরো টাইটেল কার্ড এঁকেছিলেন। সেখানে তিনি ব্যবহার করেছিলেন বেনারসের বাড়ির দেওয়ালে আঁকা ছবির গড়ন আর সেখানকার লোকায়ত হিন্দি লেখার ধাঁচ। সেই ধাঁচে তিনি লিখলেন বাংলা হরফ। লিখলেনই যখন, তৈরি করলেনই যখন, তখন, তাকে বাদ দিলেন কেন? কী মনে হয়েছিল তাঁর? সম্ভবত ‘সোনার কেল্লা’-র ধরনের সঙ্গে অনেকটা এক ধরনের হয়ে যেত সেই নামাঙ্কনের ভিস্যুয়াল। ফলে তাকে আর ফেরালেন না তিনি। তার বদলে আনলেন অন্য একটি ধরন।

আরও পড়ুন
তারিণীখুড়োর পঞ্চভূত

আরও পড়ুন
গল্পকার তারিণীখুড়োর গল্প

‘জয় বাবা ফেলুনাথ’-এ দেখি একটি সেখানকার স্থানীয় পৌরাণিক মানচিত্র। তার উপরে চারটি গোলাকার বৃত্ত। তার এক-একটিতে এক-একবার ফুটে ওঠে এক-একটি নাম। অকস্মাৎ বোঝা যায় না, এই ছবির মানে। ছবির মানে বুঝতে আমাদের হানা দিতে হল রুকুর ঘরে। রুকুর ঘরের দেওয়ালে লাগানো ছিল কাশীর ওই মানচিত্রটি। আর ওই চারটি গোলকার চাকতি? তারা কোথা থেকে এলো? তোপসে কাশীর হোটেলে একটি খেলনা নিয়ে আসে--- সেখানে চারটি চুম্বকের ওপরে একটি ঝুলন্ত লোহার বল এপাশ ওপাশ সরে যায়। সেই খেলনাটিকে সত্যজিৎ নিয়ে এলেন ছবির নাম-দেখানোর দৃশ্যে। মনে পড়বে, ওই এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ানো লোহার বল আর চুম্বকের খেলার সঙ্গেই কিন্তু ফেলুদার মনের মধ্যে রহস্যের জট ছাড়াবার দৃশ্যটি এক্কেবারে আষ্টেপৃষ্টে জোড়া।            

আরও পড়ুন
সোনার কেল্লার সংলাপ

Powered by Froala Editor