তারিণীখুড়োর পঞ্চভূত

মানিকলমকারি - ৫৩
আগের পর্বে

‘যখন ছোট ছিলাম’ পড়তে পড়তে সবাই আকৃষ্ট হয়েছেন ছোটকাকা সুবিমল রায়ের চরিত্রটির দিকে। এমন সদাহাস্য রসিক মানুষ খুব কমই দেখা যায়। ছেলেবেলার সব চরিত্রই যেন ফিরে ফিরে এসেছে সত্যজিৎ রায়ের গল্পে কাহিনিতে। ঠিক সেভাবেই যেন গড়ে উঠেছে তারিণীখুড়োর চরিত্রটি। তাঁর জীবনের বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা ভাগ করে নেন খুদে বন্ধুদের সঙ্গে। সুবিমল রায়ের মতোই তারিণীখুড়োও চা-রসিক মানুষ। চায়ে চুমুক না দিয়ে তিনি গল্প শুরু করেন না। সত্যজিতের তিন প্রধান চরিত্রের গল্প বলার ধরন আলাদা আলাদা। ফেলুদার গল্প তোপসে লেখে একেবারে গল্পের মতো করেই। প্রফেসর শঙ্কু লেখেন ডায়রি। আর তারিণীখুড়ো গল্পগুলি বলেন নিজের মুখে।

‘যখন ছোট ছিলাম’-এর পাতায় সত্যজিৎ বলেছিলেন তাঁর ধনদাদু কুলদারঞ্জন রায় আর তাঁর ছোটোকাকা সুবিমল রায়ের কথা। সুবিমল রায়ের কাছে ভূতের গল্প শোনার কথা ‘যখন ছোট ছিলাম’-এ আছে। তবে সুবিমল রায়ের ভূতের গল্প পড়ার বৃত্তান্ত লিখে গিয়েছিলেন লীলা মজুমদার। লীলা মজুমদার তাঁর প্রিয় সেই নানকুদার কথা লিখেছিলেন সুবিমল রায়ের বই ‘প্রেতসিদ্ধের কাহিনী ও অন্যান্য’-র ভূমিকায়। লীলা মজুমদার লিখেছিলেন, ‘নানকুদা সেদিন এডগার অ্যালান পো-র টেলস এফ হরর পড়বে। নিজে পড়বে, আমাদের শোনাবে না। রাত ন-টা থেকে তার তোড়জোড় হতে লাগল। তাড়া দিয়ে চাকরদের খাওয়াদাওয়া, রান্নাঘর ধোয়ার পাট চুকিয়ে, তাদের তিনতলার ঘরে পাঠানো হল। তারপর একতলার সব আলো নিবিয়ে, একটিমাত্র মোমবাতি জ্বেলে, ওই হরিবল্ বই পড়তে বসল। দেয়ালে নিজের ছায়া নড়তে লাগল, মনে হল চেয়ার টেবিল আলমারি সব কেমন বেঁকে বেঁকে ধোঁয়া ধোঁয়া হয়ে যাচ্ছে। বাইরে ঘোড়ানিম গাছে অদ্ভুত একটা শিঁ শিঁ শব্দ হতে আরম্ভ করল আর নানকুদা রাত দেড়টা অবধি ওই বই পড়ে, ফুঁ দিয়ে মোমবাতি নিবিয়ে অন্ধকারে একা ঘরে শুয়ে পড়ল। ভূতের গল্প নাকি ওইভাবে উপভোগ করতে হয়।’ এই সুবিমল রায়ের শেষ জীবন কেটেছিল ভাইপো সত্যজিতের কাছে। সাতের দশকের মাঝামাঝি চলে গেলেন সুবিমল আর তার বছর আটেক পরে ‘আনন্দমেলা’-র পাতায় তারিণীখুড়োর আবির্ভাব। নানাসূত্রেই অনুমান করা চলে গল্পবলিয়ে ছোটোকাকা সুবিমল রায়ের ধরনটিই ফিরে এসেছে গল্পবলিয়ে তারিণীখুড়োর চরিত্রে। সুবিমল রায়ের সম্পর্কে বলতে গিয়ে তাঁর চা-প্রিয়তা, সাধুসন্নিসি- সঙ্গ আর ভূতের গল্পের কথা রায়বাড়ির সকলের কথাতেই ফিরে ফিরে আসে। ফিরে আসে তাঁর ভাঙা পরিবারের সক্কলের খোঁজখবর নেওয়ার স্বভাব। সেই সূত্রগুলিও ফিরে এসেছে তারিণীখুড়োর মধ্যে। সুবিমলও গল্প ‘বলতেন’, ‘লিখতেন’ কম। তাঁর ছড়িয়েছিটিয়ে থাকা লেখাগুলি একত্র করে, তাঁর মৃত্যুর পরে, ১৯৭৮ সালের মহালয়ায় প্রকাশিত হয় তাঁর বই ওই ‘প্রেতসিদ্ধের কাহিনী’। ভূমিকা লেখেন তাঁর বোন লীলা মজুমদার আর প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন ভাইপো সত্যজিৎ। সে এক বই বটে! তার কথা স্বতন্ত্র আলোচ্য। 

সত্যজিতের ছোটোকাকা সুবিমল

 

মজা হল, তারিণীখুড়োর একটি গল্পের নাম ‘ধুমলগড়ের হান্টিং লজ’। মনে পড়বে সেখানেও ভূতের গল্পের আদর্শ পরিবেশ বলতে গিয়ে যে চারপাশের কথা বলা হয়েছিল, সেখানেও আছে লোডশেডিং, টিম টিম করে দুটো মোমবাতি জ্বলা আর দেওয়ালে ‘সকলের প্রকাণ্ড ছায়া’ পড়ার কথা। সেখানে ভূতের প্রকারভেদ বলতে গিয়ে বেশ ইস্কুলমাস্টারি কেতায় তারিণীখুড়ো বলেছিলেন চার রকম ভূতের কথা। ‘এক অশরীররী আত্মা, যাকে চোখেদেখা যায় না, দুই ছায়ামূর্তি, তিন নিরেট ভূত--- দেখলে মনে হবে জ্যান্ত মানুষয় কিন্তু চোখের সামনে ভ্যানিশ করে যাবে, আর চার নরকঙ্কাল--- যদিও সে কঙ্কাল চলে ফিরে বেড়ায় এবং কথা বলে।’ এই চতুর্বিধ ভূতের ভেদ বলে, তারিণীচরণ জানায়, ‘আমার চার রকম ভূতেরই অভিজ্ঞতা আছে।’ যারা তারিণীখুড়োর গল্পের সঙ্গে পরিচিত তারা জানে, সত্যিই এই চার ধরনের ভূতের সঙ্গেই তারিণীচরণের মোলাকাতের গল্প ছড়িয়ে আছে, তারিণীখুড়োর পনেরোটি গল্পমালায়।

কাকা সুবিমলের গ্রন্থে সত্যজিতের প্রচ্ছদ

 

আরও পড়ুন
গল্পকার তারিণীখুড়োর গল্প

যেমন, ‘আত্মা’ ভূতের দেখা পাওয়া যাবে ‘কনওয়ে কাসলের প্রেতাত্মা’-য়। ‘ছায়ামূর্তি’ ভূতের দেখা পাওয়া যাবে ‘ধুমলগড়ের হান্টিং লজ’ গল্পে, সেখানে অবিশ্যি নরকঙ্কালও আছে। তবে ‘নরকঙ্কাল’-এর খোঁজ মিলবে ‘তারিণীখুড়ো ও বেতাল’ গল্পেও। তবে নরকঙ্কাল তো আর ভূতের উপাদান নয়, সে সম্পর্কেও স্পষ্ট করে দেন তারিণীখুড়ো। কারণ, নরকঙ্কাল তো মানবশরীরের একটি একেবারে শারীরিক অংশ। তাই সেখানে আলাদা করে কাহিনিতে বলা হয়, ‘স্কেলিটন ইজ্ নট আ গোস্ট’। শুধু তাই নয়, ‘কঙ্কাল হল মৃতব্যক্তির দেহের পরিণাম’। সেই নরকঙ্কালে জড়বস্তুর লক্ষণ না থাকলে তবে তা ভূতের গল্পের উপাদান। আর ‘নিরেট ভূত’-এর চোখের সামনে ভ্যানিশ করে যাওয়ার গল্প তো ‘লখনৌয়ের ডুয়েল’।  

আরও পড়ুন
সোনার কেল্লার সংলাপ

সত্যজিতের মনের ভেতর এই চার রকম ভূতের অঙ্ক যে বেশ বসে গিয়েছিল, সেটার আরেকটা মোক্ষম প্রমাণ ‘গুপি গাইন বাঘা বাইন’-এর ভূতের সারি। মনে করে দেখুন, সেখানেও ছিল ওই ছায়া ছায়া ভূতের চেহারাওয়ালা কৃষক আর শ্রমিক ভূতের দল আর নিরেট ভূতের দলে ছিল বাবু ভূত আর সাহেব ভূতরা। কঙ্কালকে নাচালে তা দৃশ্যগতভাবে ঠিক কার্যকর হবে না, সে কথাটাও সত্যজিৎ বলেছিলেন অ্যান্ড্রু রবিনসনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে। ফলে, সচেতনভাবে তাই সেখানে নরকঙ্কাল-ভূত অনুপস্থিত। তবে সেই নরকঙ্কাল ভূত ফিরে এসেছে সত্যজিতের ‘মণিহারা’-য়। আর ‘প্রেতাত্মা’ তো দৃশ্য নয়, ফলে তাকে ব্যবহার করাও সম্ভব ছিল না ভূতের নাচে। 

আরও পড়ুন
ছন্দের জাদুকর সত্যজিৎ

তারিণীখুড়োর গল্পের অলংকরণ

 

আরও পড়ুন
ছন্দোশিল্পী সত্যজিৎ

তবে এই ভূতের প্রকারভেদ ছাড়াও, আরেক ধরনের ভূতের ইঙ্গিতও তো দিয়েছিলেন সত্যজিৎ তারিণীখুড়োর ‘জুটি’ গল্পে। সেই গল্প শুরু হতেই গল্পের শ্রোতা ন্যাপলা জিজ্ঞাসা করে, ‘এটাও কি ভূতের গল্প?’ তার উত্তরে ভূতের গল্প সম্পর্কে একটা মোক্ষম সূত্র ধরিয়ে দেন তারিণীখুড়োর জবানবন্দিতে গল্পকার সত্যজিৎ। তারিণীচরণ বলেন, ‘না ভূত নয়। তবে ভূত বলতে তো শুধু প্রেতাত্মা বোঝায় না, ভূতের আরো মানে আছে। একটা মানে হল অতীত। অর্থাৎ, যা ঘটে গেছে। ভবিষ্যতের উল্টো। সেই অর্থে এটা ভূতের গল্প বলতে পারিস।’ এই একটি সংলাপেই বদলে যায় অকস্মাৎ ভূতের গল্পের দুনিয়াটা। ভূত মানে তো সত্যিই অতীত--- যা ঘটে গিয়েছে। যা ঘটে গিয়েছে তার গল্পও তো তাই ভূতের গল্প। সেদিক থেকে তারিণীখুড়োর জীবনে ইতোপূর্বে ঘটে-যাওয়া সব ঘটনাই গল্প হয়ে গেলে তা ভূতের গল্পই বটে। তার সঙ্গে তারিণীখুড়োর গল্পের নিয়মিত পাঠকরা জানেন, তারিণীখুড়োর গল্প-বলায় উঠে আসে আরেক ধরনের অতীতকাল। যে অতীতকে ভুলে গেছে পরের সময়, সেই ভুলে-যাওয়া অতীতকালের গল্পগাছাও তো করেন তারিণীচরণ। তার মধ্যে রয়েছে ‘জুটি’ গল্পে নির্বাক যুগ থেকে টকির যুগে বাংলা ছবির ইতিহাসে হেঁটে আসার পর্ব কিংবা ছবিতে সংলাপ আসার পরের ঘটনা নিয়ে ‘টলিউডে তারিণীখুড়ো’ গল্প। সত্যজিতের পছন্দের তিনটি বিষয় সিনেমা আর ক্রিকেট। একদিকে বাংলা সিনেমার ইতিহাস-ও ভূত, আরেকদিকে ভূত ভারতীয় ক্রিকেটে মহারাজা রনজির অবদান। ফলে ফেলে আসা সময়ের সিনেমা তৈরির গল্প আর মহারাজা রনজির নিজস্ব ক্রিকেট ব্যাটের গল্পও তো তাই তারিণীখুড়োর কাছে এক ধরনের ‘ভূতের গল্প’-ই নিঃসন্দেহে।   

Powered by Froala Editor