গল্পকার তারিণীখুড়োর গল্প

মানিকলমকারি - ৫২
আগের পর্বে

‘সোনার কেল্লা’-র কথা বললেই দর্শকের মনে ভেসে ওঠে হয় নানা সংলাপ। কোথাও জটায়ুর রসসিক্ত কথা আবার কোথাও সিধু জ্যেঠার সংলাপ। ফেলুদার তো প্রায় প্রতিটা সংলাপই কিংবদন্তি পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে। কিন্তু এইসমস্ত সংলাপের বাইরেও যে বেশ কিছু সাধারণ সংলাপের মধ্যে শিল্প বুনেছেন সত্যিজিৎ, তা আমরা সহজে খেয়াল করি না। সেখানে মুকুল আর সাংবাদিকের কথোপকথনের ভিতর দিয়ে উঠে এসেছে ভারতের ইতিহাস সম্পর্কে একমুখী ধারণার কথা উঠে আসে। আবার জটায়ুর কথায় বাংলার প্রচলিত বাগধারাকে ব্যবহার করেই ফেলুদা তাঁর সন্দেহের ইঙ্গিত দিলেন। আর ‘টেলিপ্যাথি’ শব্দটাকে নিয়ে খেলা তো রীতিমতো অবাক করে। সিনেমার ভিতর দিয়েই কখন যে দর্শক শব্দটির সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন, তা বোঝা হয়ে ওঠে না। আসলে এসবের মধ্যে যেন সংলাপ রচয়িতার পরিমিতিবোধটাই ফুটে ওঠে বারবার।

‘যখন ছোট ছিলাম’ বইটি অবশ্যই একখানা চরিত্রের চিত্রশালা। কত রকম মানুষ সেখানে। তবে যাঁরাই মন দিয়ে পড়েছেন সে বই, তাঁদের মনে সবচেয়ে গভীরভাবে রেখাপাত করেছে এই স্মৃতিকথার যে চরিত্রটি, তিনি নিঃসন্দেহে সত্যজিতের ছোটোকাকা সুবিমল রায়। সেই সুবিমল রায়, যাঁর কথা বলতে গিয়ে সত্যজিৎ লিখেছিলেন ‘ছোটকাকার বিষয় অল্প কথায় বলা মুশকিল’ আর এই ছোটোকাকার কথা বলা শুরুই হয়েছিল এইভাবে, ‘ছোটকাকার ভাত খেতে সময় লাগত আমাদের চেয়ে ঝাড়া এক ঘণ্টা বেশি। কারণ, তাঁর নিয়ম ছিল প্রতিটি গ্রাস বত্রিশবার করে চিবোনো।’ এই ছোটোকাকা সুবিমল রায়ের উদ্যোগেই সত্যজিৎ ছেলেবেলায় শিখতে গিয়েছিলেন জুদো। তিনি নিজে জুদো শিখতে ও কিশোর সত্যজিৎকে জুদো শেখাতে নিয়ে গিয়েছিলেন সেকালের বিখ্যাত যুযুৎসুবিদ তাকাগাকির কাছে। ইনিই সেই তাকাগাকি, যাঁর হাত ধরে রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে জুদো-চর্চা শুরু করেন। এই এই ছোটোকাকা সুবিমল রায়ই তো নিজের পেয়ারের বিভিন্ন প্রকার চা-এর দিয়েছিলেন বিচিত্ররকম নাম আর ইনিই বাড়ির সকলের জন্য নিজেই বরাদ্দ করেছিলেন অদ্ভুত সব নাম। তাঁর দেওয়া নামেই সত্যজিতের মা ছিলেন ‘বজ্র বৌঠান’ আর ‘নুলমুলি’ ছিলেন শিশু সত্যজিৎ স্বয়ং। সত্যজিতের মেজোপিসেমশাই অরুণনাথ চক্রবর্তীকে তিনি ডাকতেন ‘ভোরয়েড’ নামে--- কারণ অরুণনাথ খুব ভোরে ওঠেন। বোঝা যাচ্ছে, সত্যজিতের মা সুপ্রভার ব্যক্তিত্বই ওই ‘বজ্র বৌঠান’ নামের নেপথ্য কারণ। তারপর ধরা যাক, তিনিই তো চার রকম কালি দিয়ে লিখতেন তাঁর ডায়রি। সেখানে প্রকৃতির কথা থাকলে তা লেখা হত সবুজ কালিতে, বিশেষ্য থাকলে তা লেখা হত লাল কালিতে, আর অন্য কথাগুলি লেখা হত নীল বা কালো কালিতে। এমন কত বিচিত্র স্বভাবে তিনি বিশিষ্ট। কেমন দেখতে ছিল তাঁকে? সত্যজিৎ লিখেছিলেন, ‘রোগা পটকা আলাভোলা মানুষ, এম এ পাশ করার পর থেকেই ইস্কুল মাস্টারি করছেন।’ ‘ছোটকাকা মাস্টারি করতেন সিটি স্কুলে। খাটো ধুতি, ঢোলা হাতা পাঞ্জাবি, কাঁধে চাদর, হাতে ছাতা আর পায়ে ব্রাউন ক্যাম্বিসের জুতো।’ ‘ছোটকাকা বিয়ে করেননি।’ এই সুবিমল রায়, সত্যজিতের এই ছোটোকাকা সুবিমল রায়েরই গভীর প্রভাব রয়েছে সত্যজিতের গল্পকার সত্তায়। সত্যজিৎ নিজেই বলেছিলেন, তিনি ছেলেবেলায় গল্প শুনতেন দুজনের কাছে। এক, তাঁর ধনদাদু কুলদারঞ্জন রায়ের কাছে আর দুই এই ছোটোকাকা সুবিমল রায়ের কাছে। কুলদারঞ্জনের কাছে শুনতেন মহাভারতের গল্প আর ছোটোকাকার কাছে শুনতেন ভূতের গল্প। লক্ষণীয়, ঠাকুরদা উপেন্দ্রকিশোর আর বাবা সুকুমার রায়কে সত্যজিৎ পেয়েছেন লেখার মধ্যে দিয়ে, তাঁদের লেখা গল্পের ভেতর দিয়ে তাঁদের পেয়েছেন তিনি আর ঠাকুরদার ভাই কুলদারঞ্জন আর বাবার ভাই সুবিমলকে তিনি পেয়েছেন তাঁদের বলা-গল্পের ভেতর দিয়ে। গল্প-শোনার মধ্যে দিয়ে এই পাওয়ার ব্যপারটা বেশ কৌতূহলপ্রদ। কারণ, একজন গল্পবলিয়ে আর খুদে গল্পশুনিয়ের এই ধরনটাই তো ফিরে আসবে সত্যজিতের ষাট বছর বয়সে তৈরি করা নতুন চরিত্র তারিণীখুড়োর মধ্যে। তারিণীখুড়ো, মানে তারিণীকাকা। সুবিমলই কি ফিরে এলেন তারিণী নামে, ছোটোকাকাই কি ফিরে এলেন খুড়োরূপেণ?

সত্যজিতের ধনদাদু কুলদারঞ্জন আর ছোটোকাকা সুবিমল।

 

এই তারিণীখুড়ো কেমন? তিনি থাকেন বেনিয়াটোলায় একটা ভাড়াবাড়িতে। তিনি অনায়াসে বেনেটোলা থেকে বালিগঞ্জে চলে আসতে পারেন হেঁটে। তিনি আসলে তাঁর কাছে যারা গল্প শোনে, তাদের সম্পর্কে দাদু, কিন্তু তিনি নিজেই বলেছেন, ‘এখনো বাস না পেলে অক্লেশে হেঁটে আসি বেনেটোলা টু বালিগঞ্জ--- দাদু আবার কী? খুড়ো বলবি।’ তারিণীখুড়োর কাছে গল্পের স্টক অফুরান। বেশির বাগ গল্পই ভূতের গল্প আর সেই সব গল্পই তাঁর জীবনের বিচিত্র সব অভিজ্ঞতার গপপো। তিনিই বলেছেন, ‘ভূতের গল্প অনেকে বলতে পারে, তবে পার্সোনাল এক্সপিরিয়েন্স থেকে বলা গল্পের জাতই আলাদা। সেটা আর কজন পারে।’ ইনিও সুবিমল রায়ের মতোই ভারি চা-রসিক। দুধ-চিনি ছাড়া চা খান ইনি। নিজেও খোঁজ পেলে জবরদস্ত চা নিয়ে হাজির হন গল্প-শোনাবার আসরে। এই তারিণীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ওই বেনেটোলা টু বালিগঞ্জ হেঁটে আসার গল্পটাও তো সত্যজিৎ পেয়েছেন তাঁর পরিবার থেকেই। এই ছোটোকাকার সম্পর্কেই তিনি লিখেছিলেন, ‘উত্তর কলকাতা থেকে দক্ষিণে চলে আসার ফলে বাপের বাড়ির দিকের আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে যোগ কমে গেলেও, ধনদাদু আর ছোটকাকা প্রায়ই আসতেন আমাদের বাড়ি।’ আর তার সঙ্গেই জানা গিয়েছিল, ‘একা মানুষ বলেই বোধহয় ছোটোকাকার কাজ ছিল হেঁটে বা বাসে পালা করে চতুর্দিকের আত্মীয় স্বজনের বাড়ি গিয়ে তাদের খবর নেওয়া। আমার বিশ্বাস আমাদের বিরাট ছড়ানো রায় পরিবারের সসব্বাইকে একমাত্র ছোটকাকাই চিনতেন।’ ওই যে লক্ষ করুন, ‘হেঁটে বা বাসে’ শব্দগুলি। মানে বাসেও যেতে পারেন, তবে না হলে হেঁটেই পৌঁছে যান ঠিক ঠিকানায়। সুবিমল রায়ের কাছে সত্যজিৎ শুনেছিলেন ভূতের গল্প আর কে না জানে তারিণীখুড়োর গল্পের বেশির ভাগটাই অদ্ভুত যত ভূতের গল্প।

যখন ছোট ছিলাম-এর অলংকরণে ছোটোকাকা সুবিমল। উপরে, ডায়ারি লেখাতে মগ্ন সুবিমল। চার রকম কালি লক্ষণীয়। নিচে, জুদো শেখার ক্লাসে দূরে দাঁড়িয়ে সুবিমল।

 

আরও পড়ুন
সোনার কেল্লার সংলাপ

তারিণীখুড়োর গল্পের ভেতরে আছে নানা রকম বাবাজির কাহিনিও। মনে পড়ছে কি সত্যজিতের লেখা ‘যখন ছোট ছিলাম’-এর সেই লাইনগুলি? ‘নিজে বাড়াবাড়ি রকম ধার্মিক না হলেও, সাধু সন্ন্যাসীদের সম্পর্কে ছোটকাকার একটা স্বাভাবিক কৌতূহল ছিল। তাঁদের জীবনী পড়তেন আর জীবিতদের মধ্যে যাঁদের উপর ছোটকাকার শ্রদ্ধা ছিল, তাঁরা শহরে এলেই তাঁদের সঙ্গে গিয়ে দেখা করে আসতেন। তিব্বতী বাবা, ত্রৈলঙ্গস্বামী, বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী, সন্তদাস বাবাজী, রামদাস কাঠিয়া বাবা--- এই সব সাধুদের সম্বন্ধে কত গল্পই না শুনেছি ছোটকাকার কাছে।’

আরও পড়ুন
ছন্দের জাদুকর সত্যজিৎ

সংসারের মধ্যে থেকেও এক আশ্চর্য সন্ন্যাসী-মানুষ ছিলেন এই সুবিমল। এই ধরনের মানুষ একান্নবর্তী বাঙালিজীবন যত নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি তৈরি হতে থাকল, তত কমতে থাকলেন। তত কমতে থাকল এমন গল্প-বলিয়ে বিচিত্রকর্মা মানুষগুলি। বাঙালিজীবনে গল্প ‘লেখা’ এলো, সিনেমায় গল্প-তোলা এলো, হারিয়ে গেল গল্প-‘বলিয়ে’ চরিত্ররা। সেই মুখচলতি- মুখবোলতি হারানো গল্পের সন্ধানেই যেন জন্ম হয়েছিল তারিণীচরণের। নিজের বাড়ির ভেতরে থেকে গল্পের উপাদান নিলেন সত্যজিৎ। কিন্তু বাঙালির এক লাইভ-গল্প বলার গল্প লিখলেন, না ‘লিখলেন’ না বলে, বলা উচিত ‘শোনালেন’ সত্যজিৎ।

আরও পড়ুন
ছন্দোশিল্পী সত্যজিৎ

এটা বেশ মজার ব্যাপার না! তাঁর তৈরি তিন চরিত্রের তিন রকম গল্পকথন ধরন। তোপসে ফেলুদার গল্পগুলি গল্প-হিসেবেই লেখে, প্রফেসর শঙ্কু লিখেছিলেন তাঁর ডায়রি আর তারিণীখুড়ো তাঁর গল্পগুলো লেখেন না বলেন। বলেন ভূতের গল্প, অলৌকিক গল্প নিজের অভিজ্ঞতা থেকে। এই নিজের অভিজ্ঞতা থেকে ভূতের গল্প বলতে গিয়ে তারিণীখুড়ে তাঁর ভূতের গল্প নিয়ে তত্ত্ব খাড়া করেন, ‘ভূত সচরাচর চার প্রকার হয়।’ তারিণীখুড়ের পরিকল্পিত সেই চারপ্রকার ভূত আর আরেক প্রকার নতুন ভূত-ধারণার কথা নিয়েই না হয় শুরু করা যাবে  আগামী কিস্তির মানিকলমকারি।

আরও পড়ুন
হারানো এক কলমকারি- ১

Powered by Froala Editor