হারানো এক কলমকারি- ২

মানিকলমকারি - ৪৮
আগের পর্বে

সত্যজিৎ প্রতিটা লেখার সঙ্গে অসাধারণ হেডপিস রচনা করতেন। সন্দেশ পত্রিকার পাতায় গল্পটা কীভাবে প্রকাশিত হবে, তার দিকে নজর দিতেন সবসময়। আবার এই হেডপিসের মধ্যেই ফুটে উঠত গল্পের চরিত্রও। অক্ষরশিল্পের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলতেন বিষয়বস্তুকে। রচনার দিক দিয়ে প্রফেসর শঙ্কুর গল্প এবং ফেলুদার গল্পের মেজাজ আলাদা। তাই হেডপিসেও সেই পার্থক্য বজায় রেখেছেন সবসময়। আবার সন্দেশের বদলে যখন গল্প আনন্দমেলায় প্রকাশিত হয়েছে, তখন রঙের বৈচিত্র নিয়েও খেলার সুযোগ পেয়েছেন তিনি। তবে পরবর্তীকালে গ্রন্থাকারে প্রকাশের সময় এইসব সৃষ্টির কথা আর মনে রাখেননি কেউই। পত্রিকার পাতা থেকেও হারিয়ে যাচ্ছে এই কলমকারি।

আগেরবারে কথা ছিল ফেলুদার গল্পের পত্রিকাপাঠের শুরুর কলমকারি নিয়ে কথা চলবে। সত্যজিৎ যে নতুন ধরনের একটা হেডপিস তৈরির ধরন তৈরি করলেন, তার একটা ধরন ছিল তাঁর প্রফেসর শঙ্কুর গল্পমালায় আর ছোটোগল্পে। অন্য একটা ধরন ছিল তাঁর ফেলুদার অ্যাডভেঞ্চারে। শঙ্কুর আর ছোটোগল্পের ওই হেডপিস বা শিরোনামাঙ্কনের শিল্পরূপ কালের সঙ্গে হারিয়ে গেলেও ফেলুদার ক্ষেত্রে তেমনটা ঘটেনি বহুদিন। সত্যজিৎ নিজেই তাদের একভাবে রক্ষা করার একটা উপায় করেছিলেন। অবশ্য ইদানীংকার বই-বাণিজ্যের ধরণধারণে তা ক্রমশ বিলীয়মান। ফলে আজকের কিস্তি একদিকে সেই হারানো কলমকারিকে দুই-তরফে বোঝার চেষ্টা।

ফেলুদার গল্পের শিরোনাম করার সময়ে কী এক আশ্চর্য ছন্দে নির্দিষ্ট একটি পটভূমিকে নির্দিষ্ট এক ধরনের রেখায় ধরতে চেয়েছিলেন তিনি। অনেকেরই মনে আছে, পূর্ণেন্দু পত্রী সত্যজিতের গুণমুগ্ধ হয়েও, সত্যজিতের নিজের বইয়ের প্রচ্ছদ অঙ্কন নিয়ে কিঞ্চিৎ অনুযোগের সুরে বলেছিলেন, ‘অভ্যস্ত দক্ষতার মামুলি ফসল’। কথাটি অনেকটা মেনে নিয়েও বলতেই হবে, আসলে সেকালের বাংলা গোয়েন্দা গল্পের অলংকরণের একটি ধরন ততদিনে কিন্তু বেশ প্রতিষ্ঠা পেয়ে গিয়েছে। যেখানে দেখা যেত, গল্পের ক্লাইম্যাক্সের দৃশ্যটিকে উঠিয়ে আনা হত শুরুতে। পাঠকের মনোরঞ্জনের জন্য, সেই সব গল্পের একটা প্যাটার্নই হয়ে গিয়েছিল শেষের সবচেয়ে ধূমধাড়াক্কা দৃশ্যটিকে সামনেই হাজির করে আনা। তার সঙ্গে একেবারে যেন দেখছি তেমন ছবির ধরন--- সেটাও এই ধরনের গল্পে প্রায় অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে গিয়েছিল। তার অন্য আকর্ষণ নেই, তা বলা যাবে না, তবে এটাও ঠিক, সেখানে শিল্পিত উপস্থাপনার অভাব ছিল বই কী! সত্যজিৎ এই ধরনটি সম্পর্কে খুব সচেতন ছিলেন বলেই তাঁর তৈরি জটায়ুর যে-বইগুলির প্রচ্ছদ ফেলুদাকে নিয়ে বানানো দুটি ছবিতে দেখা যায়, সেখানে ওই গোত্রের প্রচ্ছদই এঁকেছিলেন তিনি। ‘সোনার কেল্লা’-য় ‘সাহারায় শিহরন’-এর প্রচ্ছদ আর ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’-এ ‘করাল কুম্ভীর’ গল্পের প্রচ্ছদে এই ধরনটিই ফিরে এসেছে। এমনকি জটায়ুর রাইভ্যাল নিশাচরের লেখা ‘ক্যাপ্টেন স্পার্ক’ উপন্যাসের কভারও ঠিক সেই রকম--- গল্পের চূড়ান্ত মুহূর্তটি ধরা রয়েছে প্রচ্ছদে। অথচ, ফেলুদার বইয়ের কভার আঁকতে গিয়ে তিনি এই ধরনটিকে এক্কেবারে বাদ দিয়ে একটি নতুন ধরন সন্ধান করলেন। ফেলুদার গল্পের পত্রিকাপাঠের শিরোনামাঙ্কনে যেমন, তেমনই তার প্রচ্ছদেও সেই মেজাজটিকে রাখলেন। যেমন, ফেলু সিরিজের একেবারে পয়লা নম্বর গল্প ‘ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি’-তেই দেখা যায়, সামনে ফেলু-তোপসে আর তাদের ঠিক পিছনে দার্জিলিংয়ের ম্যাল। সেই ম্যালের ভিড়, ম্যালের বেঞ্চির আবহে তৈরি হয়ে ওঠে দার্জিলিংয়ের ম্যাল। ‘গ্যাংটকে গণ্ডগোল’ যখন দেশে প্রকাশিত হয়, তখন সেখানেও ছিল রাস্তার ধারে বসা পাহাড়ি হাটের ছবি অথবা ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’-এ ছিল কাশীর ঘাটের একাংশের ছবি। ‘সোনার কেল্লা’-তে কেল্লার গা ঘেঁষে হেঁটে যাওয়া আর ‘রয়্যাল বেঙ্গল রহস্য’-তে জঙ্গলের ভেতরে ফেলুদা তোপসের ছবি। লক্ষণীয়, কোথাও কিন্তু নেই রহস্যের ঘনঘটার ছোঁয়া--- তার জায়গায় রয়েছে একটি জায়গার নিজস্ব রহস্যের ইঙ্গিত। কৌতূহলপ্রদ হল ব্যবহৃত রংরেখার ধরনও। যেমন, রাজস্থানে প্রচণ্ড রোদের আলোতে চোখ ধাঁধানো পরিবেশ বলেই, সেই ‘সোনার কেল্লা’-র ছবি আঁকা হয় একেবারে সাদার মধ্য থেকে ছায়ামূর্তির মতো কালো ভরাট রঙে সত্যজিৎ আঁকেন সেই ছবি। ঠিক যেমন ‘রয়্যাল বেঙ্গল রহস্য’ উপন্যাসে বাঘের আঁচড় গল্পের মুখ্য বিষয় বলেই যেন ছবিও আঁকা হয় ছোটো-বড়ো অনেক ধরনের রেখার ‘আঁচড়ে’-ই।

আরও পড়ুন
হারানো এক কলমকারি- ১

আরও পড়ুন
প্রোফেসর শঙ্কুর কাল-ক্যালেন্ডার

নিজের ফেলুদা গল্পের এই ধরনটি তিনি একবার ব্যবহার করেছিলেন ‘সন্দেশ’ পত্রিকার পাতায় নলিনী দাশের লেখা একটি গণ্ডালু-র অ্যাডভেঞ্চারের অলংকরণে। গল্পের নাম ‘টাওয়ার হিলের রহস্য’। গল্পের শুরুতে না আছে কোনো চরিত্রের ছবি, না আছে কোনো ঘটনার ইঙ্গিত, আছে শুধু পাতা জোড়া ওই টাওয়ারহিলের ছবি আর তার সামনে মুড়ে-রাখা তুলোট কাগজের উপরে মূল গল্প শুরু হচ্ছে। কেউ বলতেই পারে, হঠাৎ পুরোনো তুলোট কাগজের ধরনটি ব্যবহার হল কেন? তার এমনিই? দেখনশোভার জন্য? এর উত্তরও রয়েছে সেই গল্পে। গল্পের রহস্য শুরুই হবে সেখানে, যখন বেড়াতে গিয়ে গল্পের চার প্রধান চরিত্র একটা বইয়ের তাকের পিছনে পাবে ‘একখানা তুলোট-কাগজ’, সেই কাগজ ‘ধুলোমাখা এবং হলদে হয়ে যাওয়া’--- গল্পের চরিত্ররা সেই ‘কাগজটা খুলে দেখেই’ ‘ভীষণ উত্তেজিত’ হয়ে পড়ল! কত ছোটো ছোটো প্রসঙ্গ যে তিনি এই শিরোনামাঙ্কনের কলমকারিতে লুকিয়ে রাখেন।  

আরও পড়ুন
যখন ছোট ছিলাম থেকে-২

আরও পড়ুন
যখন ছোট ছিলাম থেকে-১

‘বাদশাহি আংটি’ যখন ধারাবাহিক প্রকাশিত হচ্ছিল ‘সন্দেশ’ পত্রিকায়, তখন পাতা জোড়া ছবি তো আর আঁকা যায়নি, তবে সেখানে সত্যজিৎ খেলেছেন ক্যালিগ্রাফি দিয়ে। গল্পের নাম বাদশাহি বলে আর গল্পের আংটির মূল মালিক স্বয়ং সম্রাট আওরঙ্গজেব ছিলেন বলেই বুঝি গল্পের নাম তিনি লিখেছিলেন আরবীয় লিপির ধাঁচে। সেখানকার সেই লিপি, বা তাঁর শিল্পগুরু নন্দলাল বসুর ভাষায় ‘লেখাঙ্কন’, যে কেন তিনি বইপ্রকাশের সময় বাদ দিলেন! বহু পরে, ওই উপন্যাস থেকে যখন ছবি করলেন তাঁর পুত্র সন্দীপ রায়, তখন পত্রিকার পাতা থেকে সেই লেখাঙ্কন উঠে এল ছবির পোস্টারে আর সিনেমার পর্দায়।

বলছিলাম, প্রফেসর শঙ্কুর কাহিনির জন্য যে সব শিরোনামাঙ্কনগুলি করেছিলেন সত্যজিৎ, সেগুলি সেভাবে আর ফিরে আসেনি তাঁর বইয়ের পাতায়। সেগুলি প্রায়শই হারিয়ে গিয়েছে। হয়ত তা রাখলে উত্তরকালের সত্যজিৎ ভক্তদের সত্যজিৎ-ভক্তি আরো নতুন এক পথ পেত তাঁকে চেনার। তবে সত্যজিৎ ফেলুদা-উপন্যাসের ওই শিরোনামাঙ্কনগুলি অন্যভাবে ঘুরিয়ে নিয়ে এসেছেন তাঁর বইয়ের ভেতরের পাতায়। বইয়ের ভেতরে যে-পাতায় বইয়ের নাম, লেখকের নাম থাকে, সেই আখ্যাপত্রে, বেশ অদ্ভুতভাবে সেই পত্রিকার নামাঙ্কনকে অনেকটা ফিরিয়ে এনেছেন সত্যজিৎ। পত্রিকার শিরোনামাঙ্কনের একটি অংশ তিনি সুন্দরভাবে কখনো কখনো ব্যবহার করেছেন সেখানে। এই ব্যবহারটিকে মাথায় রেখেই তাঁকে নিশ্চয়ই ছবি আঁকতে হয়েছিল পত্রিকার জন্যেও। কারণ, পত্রিকার পাতায় যে ছবির ধরন চওড়াটে, এখানে তা হয়ে যায় লম্বাটে--- ফলে সেই নতুন মাপে ছবিটা সাজাতে হয়। প্রথম থেকে এর সবটাই নিখুঁতভাবে মাথায় না থাকলে এটা বইতে করে ওঠে মুশকিল। ফলে যা আঁকেন, সেটা যেমন দেখবার আর ভাববার খোরাক, তেমনই যেভাবে তা মূর্ত করেন তিনি, সেই গণিতগুলি মনে রাখলে আঁকার সময় আর যা-যা ভাবছেন, সেটাও বেশ লক্ষ করার মতো। 

তাই সত্যজিৎ থাকাকালীন ফেলুদার শেষ গল্পে ছবি আঁকার দায়িত্ব পেয়ে সুব্রত গঙ্গোপাধ্যায় সেই ধরনটিকেই অনুসরণ করলেন তাঁর আঁকার ধরনে। 'রবার্টসনের রুবি' গল্পের প্রথম ছবিতে মামা-ভাগ্নে পাহাড় থাকল, থাকল সেখানকার জমির ধরন। গোয়েন্দা গল্পের পরিবেশ মানে শুধু রোমাঞ্চকর পরিবেশ নয়, চারপাশের পরিবেশ-ও হতেই পারে। 

এই শিরোনামাঙ্কন বইতে রাখার একটা ভাবনা সত্যজিতের ছিল। কিন্তু এখন প্রায় ফেলুদার বইগুলি ক্রমশ আলাদা আলাদা নিজেদের স্বাতন্ত্র্য হারিয়ে ফেলছে থিমকেন্দ্রিক ফেলুদার গল্পগুচ্ছ বানাবার লক্ষ্যে। ফল? ফল হল, এমন উদ্যোগ ধারাবাহিক হলে ধীরে ধীরে ওই শিরোনামাঙ্কনের শিল্পরূপ আরো হারিয়ে যাবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে।

Powered by Froala Editor