যখন ছোট ছিলাম থেকে-১

মানিকলমকারি - ৪৪
আগের পর্বে

সত্যজিৎ রায় ছোটবেলায় শিক্ষক হিসাবে পেয়েছিলেন কবি গোলাম মোস্তাফাকে। তাঁর কবিতায় বারবার ফিরে এসেছে প্রকৃতি প্রেম। আর তার সঙ্গে থেকেছে ভাষার সারল্য এবং প্রাচীনতা। গোলাম মোস্তাফার এই চরিত্রগুলিকেই ফেলুদার গল্পে সত্যজিৎ তুলে আনলেন জটায়ুর কবি-মাস্টার বৈকুণ্ঠ মল্লিকের চেহারায়। মজার ব্যাপার, যে এথিনিয়াম ইনস্টিটিউটে লালমোহনবাবু পড়েছিলেন তার ঠিকানা ১০০, গড়পার লেন। আর লালমোহনবাবুর ঠিকানাও তাই। আশ্চর্যজনকভাবে, গড়পারের সেই বাড়িতেই শৈশব কেটেছে সত্যজিতের। লালমোহনবাবুর পৈতৃক ব্যবসা এল. এম. অ্যান্ড সন্সের সঙ্গে মিলে যায় উপেন্দ্রকিশোরের তৈরি ইউ রায় অ্যান্ড সন্সের ইতিহাসও। ফেলুদার পাশাপাশি জটায়ুর মধ্যেও নিজের কিছুটা স্থাপন করেছিলেন মানিকবাবু।

যখন ছোট ছিলাম, তখন সত্যজিৎ রায়ের আত্মকথা ‘যখন ছোট ছিলাম’ একভাবে পড়ি আমরা আর পরে সত্যজিতের অন্য সব সাহিত্যকীর্তির সঙ্গে বেশ মোলাকাত হওয়ার পরে, কী আশ্চর্য এক উপায়ে যেন, হঠাৎ বদলে যায় সেই বইটা। তার একটা-দুটো নমুনাই ছিল আগের কিস্তি। ওই ১০০ নম্বর গড়পার রোডের বাড়িটা নিজেদের পৈতৃক বাড়ি হিসেবে উপহার দিলেন নিজের প্রিয় চরিত্র লালমোহনবাবুর কাছে আবার সেই বাড়িটাই পরে এথিনিয়ম ইনস্টিটিউট হল বলে, সেই স্কুলেরই ছাত্র করলেন লালমোহনকে। সঙ্গে সত্যজিতের নিজের ছেলেবেলার বাংলার মাস্টারমশাই গোলাম মোস্তাফা হয়ত হলেন লালমোহনের প্রিয় বাংলার শিক্ষক-কাম-কবি বৈকুণ্ঠ মল্লিক। ইতিহাস- ভূগোলের অঙ্কে যেটা হতে পারে না, মনের অঙ্কে সেটা বেশ সহজ। শুধু সহজ নয়, সেখানেই এক অন্য সত্যজিতের সঙ্গে পাঠকের নিবিড় যোগাযোগ। এই যোগাযোগের পথগুলো সন্ধান করতে যেতে হয়নি, অনায়াসেই সেই যোগাযোগগুলো যেন একে-একে চোখের সামনে খুলে গেল পরের ‘যখন ছোট ছিলাম’ পড়ার ভেতর। দেখলাম কত পরম যত্নে তিনি তাঁর চরিত্রদের মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখেছেন নিজের শৈশবের দিনগুলি।   

এইভাবেই, এক্কেবারে ছোটোবলার স্মৃতিতে পিতা সুকুমার রায়ের কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, বাড়ির বৃদ্ধ চাকর প্রয়াগের কথা। লিখেছিলেন, ‘গিরিডির ঘটনায় বাবা নেই, আছে আমাদের বুড়ো চাকর প্রয়াগ। আমি আর প্রয়াগ সন্ধ্যাবেলা উশ্রীর ধারে বালিতে বসে আছি। প্রয়াগ বলল বালি খুঁড়লে জল বেরোয়।’ এটা কি বেশ অদ্ভুত নয়, সেই ছোট্টোবলার গিরিডি ফিরে এলো ১৯৬১ সালে, সত্যজিতের চল্লিশ বছর বয়সে। তিনি লিখলেন প্রফেসর শঙ্কুর প্রথম গল্প ‘ব্যোমযাত্রীর ডায়রি’। সেই থেকে শঙ্কুর ঠিকানা হল গিরিডি আর তার বৃদ্ধ পুরোনো চাকরের নামও প্রয়াগ। শিশু সত্যজিতের কাছে ওই যে মাটি খুঁড়লে জল পাওয়া যায়, সেটা শুনে অত্যন্ত উৎসাহের সঙ্গে খেলনা খোন্তা নিয়েই মাটি খোঁড়া শুরু আর এক সময়ে একটু জলেরও সন্ধান পাওয়া--- সেটা কি শিশু সত্যজিতের কাছে বিজ্ঞানের প্রথম পাঠ নয়? ফলে গিরিডিতে তিনি বুড়ো চাকরের কাছে পেয়েছিলেন বিজ্ঞানের প্রথম পাঠ আর নিজে যখন কল্পবিজ্ঞান-নির্ভর গল্প ফাঁদলেন শেষতক, তখন মনের অজান্তেই হানা দিল গিরিডি আর সেখানকার বৃদ্ধ চাকরের নামও হতে হল প্রয়াগ। কী আশ্চর্য! একটু কখনো মন দিয়ে ওই ‘ব্যোমযাত্রীর ডায়রি’-র প্রয়াগের ছবি আর ‘যখন ছোট ছিলাম’-এর প্রয়াগের ছবি দেখবেন! বেশ অদ্ভুত মিল দুজনের চেহারাতে ও তাদের চুলের ছাঁটেও।

এটা কি নিতান্তই সমাপতন? ওই ‘যখন ছোট ছিলাম’ বইয়ের ‘ছুটিতে বাইরে’ অধ্যায়ে যেসব জায়গাগুলোতে তিনি বেড়াতে যাওয়ার কথা বললেন, সেখানেই একে একে নিয়ে ফেললেন তাঁর আরেক চরিত্র ফেলুদার গল্পমালা। ধরা যাক, ওই অধ্যায়ের শুরুতেই আছে দুটো জায়গার কথা, এক, লখনৌ, দুই, দার্জিলিং। কাকে আর বলে দিতে হবে, ফেলুদার প্রথম গল্প ‘ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি’ শুরুই হচ্ছে দার্জিলিঙে আর সেই সিরিজের প্রথম উপন্যাস ‘বাদশাহী আংটি’-র ঘটনাস্থল লখনৌ। শুধু লখনৌ-ই নয়, নিজের ছেলেবেলার স্মৃতিতে ঠিক যে-যে জায়গাগুলোর কথা তিনি বলেছেন, সেই সেই পটভূমিই হুবহু ফিরে এসেছে ফেলুদার প্রথম উপন্যাসে। নিজেই ওই লখনৌ সম্পর্কে লিখেছেন, ‘শহরটার উপরেও একটা টান পড়ে গিয়েছিল।’ বলা বাহুল্য, বাদশাহী আংটি লেখার বহু পরে শতরঞ্জ কি খিলাড়ি-র সূত্রে সেই প্রিয় শহরে সত্যজিতের ফেরাও কিন্তু ওই ‘টান’-এরই প্রতিফলন। লক্ষ করবেন, লখনৌয়ের কোন কোন জায়গার কথা স্মৃতিকথাতে লিখলেন তিনি? লিখলেন, ‘নবাবদের শহরের বড়া ইমামবড়া, ছোটা ইমামবড়া, ছত্তর মঞ্জিল, দিলখুশার বাগান’ অন্যদিকে, বড়া ইমামবড়ার ভিতরের ভুলভুলাইয়া রেসিডেন্সির ভগ্নস্তূপ--- এইগুলিই তাঁর শৈশবস্মৃতি আর ঠিক এইগুলিই প্রত্যাবর্তিত হল গল্পে আর ছবিতে। নিজেই বলেছেন, ‘ছেলেবেলার স্মৃতি আমার কাজ অনেকটা সহজ করে দিয়েছিল’। এরপরে বছর সাতেক বছর বয়সে তিনি গেলেন দার্জিলিং এবং সেই দার্জিলিং, সেই দার্জিলিং থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখার গল্প ফিরে এলো তাঁর সেই বিখ্যাত সিনেমাতে। এই কাঞ্চনজঙ্ঘার ছবিই ছিল তাঁদের বাড়িতে ঠাকুর্দা উপেন্দ্রকিশোরের আঁকা আর সেই ছবির সঙ্গে মিলিয়েই মন ভরে ভোরবেলা কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখার স্মৃতি কোনোদিন ভোলেননি সত্যজিৎ। নিজের লেখা কাহিনি থেকে সিনেমা করতে গিয়েও তিনি বেছে নিলেন সেই শৈশবের স্মৃতির অনুষঙ্গ।  


আরও পড়ুন
একটা ঠিকানা আর একটা ধাঁধা

এখানে সত্যজিতের জীবনী যাঁরা লেখেন, তাঁদের একটা কথা মনে রাখতে অনুরোধ করি। অনেক সময়েই আমাদের ভুল হয়, সত্যজিতের প্রথম স্কুল বালিগঞ্জ গভর্নমেন্ট বলে। কথাটা মোটের উপর ঠিক। কিন্তু পুরোপুরি ঠিক নয়, কারণ, সত্যজিৎ প্রথম স্কুলে গেছিলেন ওই দার্জিলিংয়ে বেড়াতে গিয়েই। নিজেই জানিয়েছিলেন, সেই মহারানি গার্লস স্কুলের কথা। মা সুপ্রভা প্রথম সেই স্কুলেই প্রথম পড়াতে শুরু করলেন আর সেকালের রেওয়াজমাফিক ছেলে হলেও ওই মেয়েদের স্কলে ভর্তি হয়ে গেলেন সত্যজিৎ। তিনি নিজেই লিখেছেন, মা ‘দার্জিলিঙে কিছুদিন থাকার পরেই হঠাৎ মাস্টারির চাকরি নিয়ে ফেললেন মহারানি গার্লস স্কুলে, আর সেই সঙ্গে আমিও সেই স্কুলে ভর্তি হয়ে গেলাম।’

আরও পড়ুন
বৈকুণ্ঠ মল্লিক: কবি আর মাস্টারমশাই

এরপরেই এলো হাজারিবাগের কথা। হাজারিবাগে ছিলেন তাঁর মেজোপিসি পুণ্যলতা চক্রবর্তী। সেখানে পুণ্যলতাদের সঙ্গেই তিনি গেছিলেন রাজরাপ্পা। ছেলেবেলার স্মৃতি থেকে লিখছেন, ‘হাজারিবাগ থেকে মাইল চল্লিশেক দূরে ভেড়া নদী পেরিয়ে মাইল খানেক হাঁটার পর রাজরাপ্পা। সেখানে গা ছমছম করা ছিন্নমস্তার মন্দিরকে ঘিরে দামোদর নদীর ওপর জলপ্রপাত, বালি দূরের বন আর পাহাড় মিলিয়ে অদ্ভুত দৃশ্য।’ ফেলুদার ভক্তদের কি আর মনে করাতে হবে? মনে পড়েই গেছে ‘ছিন্নমস্তার অভিশাপ’ গল্পটার সেই পিকনিকের দৃশ্য। ‘ছিন্নমস্তার অভিশাপ’-এর চার নম্বর পরিচ্ছেদ শুরুই হচ্ছে, ‘রাজরাপ্পা হাজারিবাগ থেকে আশি কিলোমিটার। ৪৮ কিলোমিটার গিয়ে রামগড় পড়ে, সেখান থেকে বাঁয়ে রাস্তা ধরে গোলা বলে একটা জায়গা হয়ে ভেড়া নদী পর্যন্ত গাড়ি যায়। নদী হেঁটে পেরিয়ে খানিকদূর গিয়েই রাজরাপ্পা।’ শুধু তাই নয়, অবশ্যই রাজরাপ্পায় ‘পিকনিকের কারণ ছিন্নমস্তার মন্দির’। শুধু ভেড়া নদী নয়, দামোদরে গিয়ে সেই নদীর মেলার গল্পটাও বেশ বুনে দিয়েছেন সত্যজিৎ ছিন্নমস্তার অভিশাপ-এ। এইসব যখন বেশ মিলেমিলে যাচ্ছে, তখনই চমকে গিয়ে মনে পড়ল, আচ্ছা এই পটভূমিতেই তো ছিল রাস্তায় গাড়ি খারাপ হয়ে যাওয়ার একটা বর্ণনা। এখানেই তো ছিল, ‘ফেরার পথে গাড়ি খারাপ হয়ে গেল ব্রাহ্মণবেড়িয়া পাহাড়ের ধারে। পাহাড়ে নাকি অনেক বাঘ ভাল্লুক। গাড়ি সারাতে সারাতে রাত হয়ে গেল, কিন্তু বাঘ ভাল্লুকের দেখা পেলাম না।’ কী আশ্চর্য! তোপসে লালমোহনের গাড়িও তো এই হাজারিবাগের পথেই খারাপ হল আর তারা দেখা পেল সার্কাস থেকে পালানো বাঘ সুলতানের। স্মৃতির গতিপথ সত্যিই বেশ বিচিত্র। কত বিচিত্র জানেন? এই হাজারিবাগেই সত্যজিৎ বলেছিলেন তাঁর পিসতুতো দাদা কল্যাণের কথা। পুণ্যলতা- অরুণনাথ চক্রবর্তীর ছেলে কল্যাণকুমার চক্রবর্তী। কল্যাণকুমার সত্যজিতের চেয়ে বছর ছয়েকের বড়ো, তবে নয় বছরের মানিকের বিশেষ বন্ধু। এই কল্যাণকুমারেরই ছিল স্ট্যাম্প জমাবার শখ আর তার কাছেই নয় বছরের মানিক প্রথম দেখেছিল টুইজার বা চিমটে। মনে করে দেখুন, ছিন্নমস্তার মন্দির গল্পে ফেলুদা বাড়ির খুদে সদস্যের হাতে এই টুইজার দেখেই প্রথম সন্দেহ করে এখানে কারো একজনের স্ট্যাম্প জমাবার শখ আছে। এই স্ট্যাম্প-জমানোটা যে ওই গল্পের একটা কৌতূহলপ্রদ উপাদান, সেটা বলে, যারা সেই গল্প এখনো পড়েনি, তাদের গল্প-পড়া আর নষ্ট করব না। এখানেই নয় বছরের ছোট্টো মানিক প্রথম তাস খেলার স্বাদ পেল, পিসতুতো ভাইবোনদের সঙ্গে খেলত দুটো তাসের খেলা ‘আয়না মোহর’ আর ‘গোলাম-চোর’। আবার চমক! এই ‘ছিন্নমস্তার অভিশাপ’-এই মহেশ চৌধুরি নিজের ছেলেদের ডাকতেন টেক্কা- দুরি- তিরি নামে। কে না জানে, এই নামগুলো তো আসলে তাসখেলার কার্ডেরই নাম। আর ‘ছিন্নমস্তার অভিশাপ’-এ মূল চরিত্রের নাম অরুণেন্দ্র আর সত্যজিৎ রায়ের সেই হাজারিবাগের মেজো পিসেমশাইয়ের নাম ছিল অরুণনাথ। কী আশ্চর্য সমাপতন! তাহলে, নয় বছরের মানিকের স্মৃতিতে কিছু দেখা কিছু শোনা আর কিছু স্মৃতি কিনা ফিরে এলো প্রায় পঞ্চাশ বছর পরে লেখা একটি গল্পে!!

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
গল্পে জন্মদিন আর জন্মদিনের গল্প