মানিকলমকারি - ৩৬
আগের পর্বে
অনুবাদ বলতে আমরা বুঝি শব্দ, বাক্য বা ভাবের অনুবাদ। তবে সত্যজিত রায়ের কলমে অনুবাদের মুখ্য বিষয় হয়ে উঠেছিল ধ্বনি। এই ধ্বনি সংস্কৃত অলঙ্কারশাস্ত্রের ধ্বনি নয়। ধ্বনি অর্থে ‘sound’। জ্যাক ক্যারলের 'Jabberwocky' কবিতার নাম সত্যজিতের অনুবাদে হল ‘জবরখাকি’। কবিতার বাকি শব্দেও একই ধরণের ধ্বনিপ্রয়োগ। আসলে মূল কবিতাতেও বিষয়বস্তু নয়, বরং ধ্বনির খেলাই মুখ্য। অনুবাদেও সেটিকে ধরে রেখেছিলেন সত্যজিৎ রায়। আর এভাবেই কবিতার ভাণ্ডারে ঢুকে পড়ল নতুন শব্দ। অভিধানে সেসবের কোনো মানে নেই। কিন্তু সমগ্র বাক্যের অর্থ তৈরি করা যায় সহজেই। এমন অসাধারণ কীর্তি সত্যজিতের পক্ষেই সম্ভব।
এডওয়ার্ড লিয়র তাঁর ‘দ্য বুক অফ ননসেন্স’-এর উৎসর্গপত্রে লিখেছিলেন, তিনি এই বই তুলে দিচ্ছেন তাঁর ‘’গ্রেট গ্র্যান্ডচিল্ড্রেন, গ্র্যান্ড নেফিউ অ্যান্ড গ্র্যান্ড নিসেস’-এর জন্য। পাশে কিঞ্চিৎ ছোটো হরফে বন্ধনীর ভেতরে লিখেছিলেন এই বইয়ের ‘গ্রেটার পার্ট অফ হুইচ ওয়্যার অরিজিন্যালি মেড অ্যান্ড কম্পোজড ফর দেয়ার পেরেন্টস্’। সেই বইয়ের একশো ন-টি আর পরবর্তী ‘মোর ননসেন্স’ বইয়ের আরো একশো তিনটি, মানে মোট প্রায় দুশো বারোটি লিমেরিক থেকে আটাশটি লিমেরিক বেছে নিলেন সত্যজিৎ তাঁর অনুবাদের জন্য। অনুবাদের ধরন কী হবে, তার কৈফিয়ত লিখতে গিয়ে সত্যজিৎ লিখেছিলেন, ‘লিয়রের লিমেরিকগুলিকে সরাসরি অনুবাদ না করে লিয়রেরই আঁকা ছবিগুলিকে অনুসরণ করে নতুন লিমেরিক রচনা করা হয়েছে।’ এই সূত্র থেকেই আজকের কলমকারির গল্প-বলা শুরু। সত্যজিৎ বলেছিলন বটে, সরাসরি অনুবাদ না করে তিনি ‘নতুন লিমেরিক’ লিখছেন, কিন্তু সত্যিই কি তাই? সত্যজিৎ এই অনুবাদে একটা নতুন ধরন তৈরি করলেন। মূল ভাবটিকে গ্রহণ করলেন। শব্দের সঙ্গে শব্দ মেলানোর পথে বাড়ালেন না পা। এক্কেবারে বঙ্গীকরণ করলেন। আগের কিস্তিতে যেমন দেখেছিলেম, ধ্বনি থেকে নতুন নতুন বাংলা শব্দ-বানাবার একটি পরীক্ষা করেছিলেন সত্যজিৎ ‘জবরখাকি’-র অনুবাদে, এখানে ছড়ার গল্পটাকে এক রেখে একেবারে বাঙালির গল্প করে তোলার একটা নিরীক্ষা করলেন সত্যজিৎ। কিন্তু, ওই! মূল ছড়ার ভেতরের গপপোটাকে বিশেষ বদলান না তিনি। তার সঙ্গে আরেকটা বিশেষ দিক লক্ষণীয় এই অনুবাদগুলিতে। মূল ছড়াতে লিমেরিকের ধরনমাফিক মিলের গড়ন ছিল ‘ক-ক-খ-খ-ক’। সেখানে অনেক সময়েই, ওই এক আর দুই লাইনে যে-অন্তমিল তারই কোনো একটি শব্দ হুবহু ফিরে আসে পাঁচে। কিন্তু সত্যজিৎ এক-দুই আর পাঁচে মিল আনলেন রাইম-ওয়ার্ড ধরে। যেমন, মূলে হয়ত ছিল,
There was an Old Man with a beard,
Who said, ‘It is just as I feared!---
Two Owls and a Hen,
Four Larks and a Wren,
Have all built their nests in my beard!
এখানে এক নম্বর লাইনের শেষে বিয়ার্ড আর দুইয়ের শেষে ফিয়ার্ড হলেও, পাঁচে আবার বিয়ার্ড-এ ফিরে এলো। কিন্তু সত্যজিতের অনুবাদে তা কেমন হল? এই একটি উদাহরণেই বোঝা যাবে সত্যজিতের বঙ্গীকরণের ধরন আর তাঁর মিল-দেওয়ার স্বাতন্ত্র্য। তিনি লিখলেন,
বললে বুড়ো, ‘বোঝো ব্যাপারখানা---
একটা মোরগ, চারটে শালিকছানা,
দুই রকমের হুতোমপ্যাঁচা
একটা বোধহয় হাঁড়িচাচা
দাড়ির মধ্যে বেঁধেছে আস্তানা।’
আরও পড়ুন
শব্দ বানাবার ছড়া বা ধ্বনির অনুবাদে ভাবের লেনাদেনা
মিলের ব্যাপারটা তো স্পষ্ট, বোঝানো নিষ্প্রয়োজন। লক্ষণীয়, অনুবাদের ধরনটিও। মূলে প্রথমেই দাড়ির কথাটা বলা হলেও, এখানে সেটা এল শেষে। তাতেই ‘বোঝো ব্যপারখানা’-র মজাটা গড়িয়ে গেল শেষতক। আর ‘Old Man’ হল শুদধু ‘বুড়ো’ আর ‘It is just as I feared!’-এ্রর কী চমৎকার বাংলা! ‘বোঝো ব্যাপারখানা!’ কথার সুরে উদ্বেগও এল আবার কথা বলার সুরটাও ঠিকঠিক ধরা পড়ে গেল। এরপরে, ওদের ‘Two Owls and a Hen’ আর ‘Four Larks and a Wren’ বাংলাতে হয়ে গেল একেবারে অন্যরকম! ইংরাজি আউল হল হুতোমপ্যাঁচা, ‘হেন’ হল মোরগ, তবে ওই বিদেশীয় ‘লার্ক’ আর ‘রেন’-কে বাংলাতে একেবারে করে ফেললেন, ‘শালিক’ আর ‘হাঁড়িচাচা’! এখানেই বঙ্গীকরণের মজা! ঠিক সেভাবেই, মূলে যেমন অনেকটা একই ধরনে, লেখা হচ্ছিল আর তাকে বাংলা করার সময় কত না বৈচিত্র্য আনলেন সত্যজিৎ। যেমন, ‘There was an Old Man who said, Hush’ অনুবাদে হল ‘শালকের শ্যাম গাংগুলি’, ‘There was a young Lady of Bute’ হল গিয়ে ‘বাজায় বাঁশি মেমসাহেবে’, কিংবা ‘There was an Old Man of Nepaul’-হল ‘কাটমুন্ডুর এক নেপালি’, ‘There was an Old Man of the Dee’ হল কিনা ‘লালুবাবু বাড়ি তাঁর লাউডন স্ট্রিট’ ‘There was an Old Person of Ickley’ অনুবাদে হল ‘কেনারাম সরখেল কলকাতা বাস’। লিমেরিকের মূল স্বাদটাকে ধরে রেখে এ এক চমৎকার বঙ্গীকরণ।
আরও পড়ুন
গল্পের ঘরবাড়ি
এই বঙ্গীকরণ শুধু বাইরের দিক থেকে চরিত্রের নামে তো নয়, ভেতরের ধরনধারণেও ক্রমশ এক্কেবারে খাঁটি বাঙালির গল্পের স্বাদ জুড়ে দিলেন অনুবাদক। এখানে আমরা গোটা কয়েক নমুনা বেছে নিয়ে দেখি কীভাবে এই রূপান্তর ঘটালেন অনুবাদক। ধরা যাক, একটি কবিতা মূলে ছিল,
There was an Old man of Boulak,
Who sat on a crocodile’s back;
But they said, ‘Towr’ds the night
He may probably bite.
Which might vex you, old man of Boulak!
আরও পড়ুন
অসমাপ্ত ফেলুদার রহস্য
এর অনুবাদে মূল গল্পটা কিন্তু এতটুকু বদলাননি লেখক। তিনি লিখলেন, ‘কুমির-পিঠে বামনটারে দেখে/ বিজ্ঞলোকে বললে তারে ডেকে/ ‘ব্যাপারখানা নয়কো সোজা/ হাবভাবে ওর যাচ্ছে বোঝা/ ভোরের দিকে দেখবে তোমায় চেখে।’’ এইভাবেই লিয়র লিখেছিলেন, পাখি-মানুষের লিমেরিক। তিনি লিখলেন,
আরও পড়ুন
শঙ্কু আর গুপি-বাঘার গল্প
There was an Old Person of Nice,
Whose associates were usually Geese
They walked out together
In all sorts of weather,
That affable Person of Nice.
এই লিমেরিকেও ছড়ার মূল বিষয়টাকে একেবারে এক রেখে, বলার ধরনটিকে মিলিয়ে নিলেন আমাদের চারপাশের সঙ্গে। যেমন ওই ‘ওল্ড পার্সন অফ নাইস’ হল ‘চক্রদহের সত্যভূষণ চাকি’। মূলের ‘হু অ্যাসোসিয়েটস ওয়্যার ইউজিয়ালি গিজ্’-কে করলেন, ‘হাঁসের সঙ্গে বড্ড মাখামাখি’। একেবারে মূলের সঙ্গে বিষয়ের দিক থেকে আর ছন্দের দিক থেকে একই ধরন। পরের তিন লাইনেও মুখ্য বিষয়টি বেশ একই রকম। সত্যজিৎ লিখলেন, ‘লোকে বলে ব্যাপার দেখে/ ওদের সঙ্গে থেকে থেকে/ চাকি মশাই হয়ে যাবেন পাখি।’
লেখার শুরুতে যে ‘লালুবাবু বাড়ি তাঁর লাউডন স্ট্রিট’ ছড়াটার কথা বলেছিলাম, সেখানেও কিন্তু মূল লেখার ভাবটাকে একেবারে এক রেখে একটি ইংরাজি লেখাকে স্বাধীনভাবে অনুবাদ করার এক সুন্দর নিদর্শন। মূল কবিতায় ছিল, ‘There was an Old Man of the Dee/ Who was sadly annoyed by a flea;/ When he said, ‘I will scratch it,’/ They gave him a hatchet,/ Which grieved that Old Man of the Dee.’ এই লেখাটির মজাটাই পুরোপুরি অনুবাদ করলেন সত্যজিৎ। লিখলেন, ‘লালুবাবু বাড়ি তাঁর লাউডন স্ট্রিট/ পাৎলুনে বসে দেখো অতিকায় কীট/ তাই দেখে রাম দাঁ/ এনে দেন রাম দা/ বলেন, ‘এর এক কোপে কীট হবে ঢিট।’’ পাৎলুনে-বসা ছোট্টো ওই কীট মারতে রাম-দা এনে হাজির করার ঘটনাটাই এখানে কৌতুকের। সেই কৌতুকটিকে একেবারে মূলের সুরে সুর মিলিয়ে হাজির করেছে সত্যজিতের কলম।
লক্ষণীয়, এই পাখি-হওয়ার ছড়া বা ওই পাখির বাসাওয়ালা দাড়ির ছড়া বা এই সব কীট-মারতে কুঠার দাগার বা কুমিরের পিঠে চড়া মানুষের গল্পে কিন্তু এতটুকু বদল এর গল্পে র মধ্যে নেই। মূল ছড়ার স্বাদ আর সুর একেবারে এক রেখে বদলটা শুধু বলার ধরনে করে কী সুন্দর করে তাকে বাংলার ছড়া করে তোলেন সত্যজিৎ, সেটাই লক্ষ করার। এ এক অসামান্য ধরন এই অনুবাদগুলির।
এইবারের কিস্তিতে শুধু সেই লিমেরিকগুলির গল্পই হল, যেখানে মূলের ভাবটিকে বজায় রেখে বঙ্গীকরণ করলেন সত্যজিৎ। কিন্তু তিনিই তো বলেছিলেন, এর মধ্যে লিয়রের আঁকা ছবিকে ধরে তিনি আবার কোথাও কোথাও ‘নতুন লিমেরিক’-ও বেঁধেছেন। পরের সপ্তাহে সেই ‘নতুন লিমেরিক’-এর গল্পগুলো কীভাবে নতুন হল, তার সন্ধান করা যাবে।
Powered by Froala Editor