দার্জিলিং-এর গপ্পোগাছা (তিন)

সময়ভ্রমণ - ৩৩
আগের পর্বে

ভুটিয়া বস্তি থেকে লেবং পর্যন্ত বিস্তীর্ন এলাকা সেনাবাহিনীর দখলে। তবে তার ইতিহাস বেশ পুরনো। কাঁটাতারে ঘেরা এলাকায় সেই ইতিহাসের কোনো স্মারক নেই। আসলে জালাপাহাড় বা কাটাপাহড় সেনাছাউনিতে ঠাণ্ডা অনেক বেশি। তাছাড়া তার উচ্চতাও অনেক বেশি। তাই পাহাড়ের নিচু ঢালে এই লেবং সেনাছাউনি তৈরি হয় ১৮৮২ সাল নাগাদ। এই ছাউনিতে ছিল রেসকোর্স অর্থাৎ ঘোড়দৌরের মাঠও। স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গেও জড়িয়ে যায় সেই ইতিহাস। ১৯৩৪ সালের ৮ মে এখানেই বাংলার লাটসাহেব আন্ডারসনকে গুলি করে হত্যার চেষ্টা করেন ভবানী ভট্টাচার্যের দল। সেই দলে ছিলেন একজন মহিলাও। হাইকোর্টের রায়ে পুরো পরিকল্পনার বিবরণ পাওয়া যায়।

আগেই বলা হয়েছে, ভবানী প্রসাদ ভট্টাচার্য ও অন্যান্যদের বিরুদ্ধে বিশেষ আদালতের যে রায়, তা নিয়ে ভবানী ও তাঁর দলের বাকিরা কলকাতা হাইকোর্টে আপিল করেন। কলকাতা হাইকোর্ট সে আপিল প্রসঙ্গে যে চূড়ান্ত রায় দেয়, সেখানে অ্যান্ডার্সন হত্যা 'ষড়যন্ত্রের' বিষয়ে বিস্তারিত বলা ছিলো। প্রধান বিচারপতি সি জে ডার্বিশায়ারের বয়ানে, এই ষড়যন্ত্রের শুরু ঢাকা শহরে। ডার্বিশায়ারের রায়ে ষড়যন্ত্রের মূল নায়ক মধুসূদন ব্যানার্জীর ভাই মনোরঞ্জন, সে-ই সুরেশ মজুমদারের বাড়িতে ঢুকে তার কচি মেয়ের মস্তক চর্বণ করে, এবং অতঃপর অ্যান্ডার্সন হত্যার ছক করে।  

সুরেশের জবানিতে জানা যায়, ১৯৩৩ সালের কোন একটা সময়ে সে উজ্জ্বলাকে গোটা দুয়েক 'আপত্তিকর রকমের' বিপ্লবী বই পড়তে দেখে। বইগুলো মধুসূদন মারফত এসেছিলো। সুরেশ মেয়েকে সাবধান করে দিয়ে বইগুলো কেড়ে নেয়, মধুসূদনের বাড়িতে ঢোকাও বারণ হয়ে যায়। তাতে অবস্থার হেরফের হয় না, মধুসূদন, মনোরঞ্জন ও লান্টু আগের মতোই যাতায়াত করতে থাকে। সুরেশ তখন কলকাতায়, সে জানতেও পারে না। মধুসূদন, তার ভাই মনোরঞ্জন ও লান্টু, এই তিনজনই যে কোনো একটা সাহেবমারা বিপ্লবী দলের অংশ ছিল, সে বিষয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই, ডার্বিশায়ারের বক্তব্য। ১৯৩৪-এর ফেব্রুয়ারি নাগাদ উজ্জ্বলা ও গোপাল ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেয়। তারপর থেকে উজ্জ্বলার সঙ্গে এই তিনজনের যোগাযোগ বেড়ে যায়। উজ্জ্বলার ভাই গোপালের বক্তব্য, তারা ছাদে উঠে আলোচনা করত। কী আলোচনা সেটা গোপাল বলতে পারেনি। 

এপ্রিল নাগাদ, ষড়যন্ত্র পেকে উঠতে থাকে। ষড়যন্ত্রকারীদের কেউ একজন - সম্ভবত মনোরঞ্জন - উজ্জ্বলাকে বলে যে দলের জন্য কিছু একটা তাকে করতে হবে। উজ্জ্বলা রাজি হয়ে যায়। সেইমতো, মনোরঞ্জন ও উজ্জ্বলা কলকাতা রওনা হয়। সেটা মে মাসের তিন তারিখ। যে কায়দায় সুরেশকে বোকা বানানো হয়, তাতে বিস্তর ধূর্ততার পরিচয় ছিলো, আদালতের মন্তব্য। কলকাতার ওয়ালিউল্লা লেনে সুরেশের বাড়িতে গিয়ে কেউ একটা খবর দেয়, সুরেশকে কলকাতা পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ থেকে এত্তেলা দেওয়া হয়েছে। সুরেশের বাড়িতে সেসময় সুরেশের শ্যালক ও ম্যানেজার 'ভেলু' ছিল। সুরেশকে কলকাতায় আনানোর জন্য নাকি একটা তার পাঠানো হয়, যার মর্ম, গোপাল অসুস্থ। ভেলু জানায়, তার পাঠিয়েছিল মনোরঞ্জন। ভেলু তাকে খরচা বাবদ এক টাকা দেয়। 

এইখান থেকে গল্পটা আলগা হতে শুরু করে। একদিকে বলা হচ্ছে, সুরেশের চোখে ধুলো দেবার চেষ্টা, গোয়েন্দা তলব বলে তাঁকে কলকাতায় ডেকে আনা। গোপালের অসুখ বলে ডেকে আনা, যার অর্থ, গোপাল তখন কলকাতায়। অথচ রায়ের পরের অংশেই বলা হচ্ছে, গোপাল ও উজ্জ্বলা দুজনেই ম্যাট্রিক পাস করে, এবং ঠিক করে ননীবালা নাম্নী কোন আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে যাবে। কলকাতায় সুরেশের কাছে তার পাঠানো হয়। সুরেশ অনুমতি দেয় ও উজ্জ্বলা ও গোপাল ননীবালার বাড়ি না গিয়ে কলকাতার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। আসলে যায় মনোরঞ্জন ও উজ্জ্বলা। গোপালকে মধুসূদন তার বাড়িতে নিয়ে গিয়ে রাখে। কলকাতা যেতে যেতে পথে মনোরঞ্জন উজ্জ্বলাকে বলে, দলের যে কাজের কথা বলে রাখা হয়েছিল, সেটা হচ্ছে দার্জিলিং-এ গিয়ে বাংলার লাটসাহেবকে গুলি করা। উজ্জ্বলার বয়ান অনুযায়ী তারা কলকাতায় ছিল মাত্র একদিন। পরের দিনই মনোরঞ্জন তাকে একটা ট্যাক্সিতে উঠিয়ে শেয়ালদা স্টেশন নিয়ে যায়। ট্যাক্সিতেই উজ্জ্বলা প্রথম দেখে দু স্যুটকেস ভরা মাল যাচ্ছে। মনোরঞ্জন বলে সেগুলোয় গুলি বন্দুক ভর্তি। এতে উজ্জ্বলা ভয় পেয়ে গিয়ে বলে, ধরা পড়লে মৃত্যুদণ্ড অবধি হতে পারে। মনোরঞ্জন বোঝায়, খানাতল্লাশি হতে পারে। সে কারণেই উজ্জ্বলাকে আনা। তার জিনিসপত্র বললে সন্দেহ হবে না। তার পরেও যদি তল্লাশি হয়, বললেই হবে স্যুটকেসগুলো অন্য কারুর। এই করে করে দুজনে দার্জিলিং-এ পৌঁছোয়, সেখানে স্নো ভিউ হোটেলে ওঠে। 

আরও পড়ুন
দার্জিলিংয়ের গপ্পোগাছা (দুই)

ডার্বিশায়ারের রায় খুঁটিয়ে পড়লে বোঝা যায়, কিভাবে কি ঘটেছিলো সে বিষয়ে সরকার পক্ষের কাছে পর্যাপ্ত তথ্য ছিল না। রায়ে একের পর এক স্বীকারোক্তির উল্লেখ করা হয়েছে। সেসব স্বীকারোক্তি কী করে আদায় হয়েছিল, আন্দাজ করতে কষ্ট হয় না। পূর্বপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র প্রমাণ করতে গিয়ে জোড়াতালি দিয়ে কোনরকমে একটা গল্প দাঁড় করানোর চেষ্টা করা হয়েছে। তাতে যে বিস্তর ফাঁক থেকে যাচ্ছে, তা নিয়ে বিচারকরা আদৌ চিন্তিত ছিলেন না। 

দার্জিলিং স্টেশনে উজ্জ্বলার সঙ্গে তার এক আত্মীয়ের দেখা হয়ে যায়। অপরিচিত পুরুষের সঙ্গে হঠাৎ করে একটি অল্পবয়সী মেয়ে দার্জিলিং-এ আসছে, এটা সেকালে স্বাভাবিক ঘটনা নয়, আত্মীয়ের সন্দেহ হয়। তাঁকে এটা ওটা বুঝিয়ে মনোরঞ্জন ও উজ্জ্বলা স্নো ভিউ হোটেলে গিয়ে ওঠে, এক ঘরেই দুজনে থাকতে শুরু করে। রায়ে বলা ছিল, উজ্জ্বলা মনোরঞ্জনের রক্ষিতা ছিলো, মনোরঞ্জন তার মাথায় রাজদ্রোহ তো ঢুকিয়েছিলই, তার 'সম্মান নষ্ট'('দিবচড') করেছিল। উজ্জ্বলাকে দার্জিলিং নেওয়া হয়েছিলো প্রধানত মনোরঞ্জনের ব্যক্তিগত প্রয়োজনে, 'কামনা চরিতার্থ'('ফর য়্যামরাস পারপাসেজ') করার উদ্দেশ্যে। এর পরেই অবশ্য বলা আছে, উজ্জ্বলা দার্জিলিংয়ে অস্ত্র নিয়ে যাবার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়, সে না থাকলে মনোরঞ্জন একা এইভাবে গুলিবন্দুক নিয়ে যেতে পারত না। 

আরও পড়ুন
কাশী মিত্র শ্মশানঘাটে দার্জিলিং লিকার, ব্যতিক্রমী উদ্যোগেই জনপ্রিয় লালুদা

স্নো ভিউ হোটেলে মনোরঞ্জন আর উজ্জ্বলার সঙ্গে ভবানী ও রবীন্দ্রনাথ দেখা করে। সেদিনই মনোরঞ্জন তাদের হাতে পিস্তল ও গুলি তুলে দেয়। রবীন্দ্রনাথের স্বীকারোক্তি থেকে জানা যাচ্ছে, গুলিবন্দুক হাত বদলের সময় উজ্জ্বলা ঘরে ছিল না। অস্ত্র নিয়ে ভবানী তার নিজের হোটেল স্যানাটোরিয়ামে ফিরে যায়। পরের দিন মনোরঞ্জন ও উজ্জ্বলা স্যানাটোরিয়ামে যায়। মনোরঞ্জনের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী, ভবানীদের ঘরে বসে তারা পিস্তল পরিষ্কার করে। ঠিক হয়, পরের দিন দুপুরে পুষ্প প্রদর্শনী, ফ্লাওয়ার শো। লাটসাহেবের আসার কথা। সেখানেই তাঁকে গুলি করা হবে। সাহেবকে চেনা যাবে কী করে? মনোরঞ্জন বলে, সাহেব একটা বড় ঘোড়ায় চড়ে আসবেন, দেখলেই চেনা যাবে। মনোরঞ্জন নিজে সেখানে থাকবে, চিনিয়ে দেবে।

ভবানী ও রবীন্দ্রনাথ জায়গামতো পৌঁছে দেখে, শো তখনো শুরু হয়নি, টিকিট দেওয়া হচ্ছে না। এরপর কাছাকাছি একটা পার্কে তাদের সঙ্গে মনোরঞ্জন ও উজ্জ্বলার দেখা হয়। তাদের না চেনার ভান করে মনোরঞ্জন ও উজ্জ্বলা উঠে চলে যায়। সেদিন কিছু হবে না বুঝতে পেরে ভবানী ও রবীন্দ্রনাথ হোটেলে ফিরে যায়। মনোরঞ্জন ও উজ্জ্বলা পুষ্প প্রদর্শনীতে গিয়ে দেখে যে দুজনের আসল কাজ করার কথা, তারা কেউ নেই। ফলে, কিছুই ঘটে না। সেদিন বিকেলেই মনোরঞ্জন ও উজ্জ্বলা বাকি দুজনকে ভীতু কাপুরুষ বলে বকাবকি করে। পরের দিন যেন ভুল না হয়, সে বিষয়ে বার বার বলা হয়। পরের দিন সকালবেলা, মনোরঞ্জন ও উজ্জ্বলা আবার স্যানাটোরিয়ামে যায়। কী করতে হবে তা নিয়ে আবার কথা হয়। পিস্তল পরিষ্কার করা হয় আবারও। কোনো ভুল যাতে না হয়, সে বিষয়ে বারবার কথা হয়। কাগজ পুড়িয়ে সেই তাপে টোটা গরম করা হয়। গরম করার কাজটা উজ্জ্বলা করে। রায়ে বলা ছিলো, পরে হোটেলের ঘরের গালচের তলা থেকে ছাই উদ্ধার হয়। এর পর উজ্জ্বলা ও মনোরঞ্জন স্নো ভিউ হোটেলে ফিরে যায়। দুপুর দুপুর সবাই রেসের মাঠের দিকে যায়। ভবানী ও রবীন্দ্রনাথ আগে, বাকি দুজন পরে। লাটসাহেবের আসনের কাছাকাছি সাধারণ আসনে ভবানী ও রবীন্দ্রনাথ বসে পড়ে। মনোরঞ্জন সাহেবকে চিনিয়ে দেয়। এর পরে উজ্জ্বলা ও মনোরঞ্জন মাঠ ছেড়ে চলে যায়। বিকেল ৩-৩০টেয় অ্যান্ডার্সনকে লক্ষ্য করে গুলি চলে।  

আরও পড়ুন
দার্জিলিংয়ের গপ্পোগাছা

লেবঙ মাঠে পুলিশের ছোঁড়া গুলিতে ভবানী জখম হন। রবীন্দ্রনাথ নিজের অপরাধের জন্য কিছু অনুতপ্ত, রায়ে বলা ছিল। ভবানীর মধ্যে অনুতাপের চিহ্নমাত্র ছিল না। মনোরঞ্জনের অপরাধের ভুরি ভুরি প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে, ডার্বিশায়ারের মত। মধুসূদন ও লান্টু ঘটনাস্থলের ধারে কাছে ছিল না, কিন্তু তারা ষড়যন্ত্রে যুক্ত, রায়ে বলা হলো। বিশেষত মধুসূদন যে উজ্জ্বলার ভাই গোপালকে নিজের বাড়ি নিয়ে চলে যায়, এতে করে ষড়যন্ত্রের গভীরতা বোঝা যায়। 

যায় কি? হত্যার প্রচেষ্টা ও নতুন অস্ত্র আইনে মামলা হচ্ছে, সাত আসামীর মধ্যে চার জনকে সরাসরি ঘটনার সঙ্গে যুক্ত করা যাচ্ছে। হত্যার প্রচেষ্টা মাত্র, হত্যা নয়। বাকি তিনজন অকুস্থলে ছিলেন না। তাদের দোষ প্রমাণে যে গল্প সরকার পক্ষ থেকে ফাঁদা হল, তার মাথামুন্ডু নেই। একটি ষোলো বছরের বালককে কোথায় নিয়ে রাখা হল, কার বাড়ির ছাদে কারা কি আড্ডা মারত, এসব দিয়ে আদৌ ষড়যন্ত্র প্রমাণ হয়? আসলে লাটসাহেবকে লক্ষ্য করে গুলি, সে অপরাধের মাপ হয় না। সুতরাং সব আসামী দোষী, সাব্যস্ত হল। মনোরঞ্জনের ফাঁসির আদেশ রদ করে যাবজ্জীবন হল, উজ্জ্বলাকে মনোরঞ্জন 'ফুঁসলেছিল' বলে তার যাবজ্জীবন বদলে চোদ্দ বছর করা হল। উজ্জ্বলা প্রসঙ্গে রায়ে প্রথমাবধি যে সব মন্তব্য করা হয়েছে তা থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, গৃহস্থ ঘরের মেয়ে বদলোকের পাল্লায় পড়ে বিগড়ে গেছে, 'নষ্ট' হচ্ছে, এই মার্কামারা পুং ভিক্টরীয় ভাষ্য বিচারকদের প্রভাবিত করেছে বেশি। অথচ ঘটনাপ্রবাহের যে খণ্ডিত গোলমেলে বিবরণ রায়ে বর্ণিত, তা থেকেই বোঝা যায় উজ্জ্বলা পুরো ঘটনায় সক্রিয় অংশীদার(বলাও হয়েছে) ছিলেন। তাঁকে 'ফুঁসলে' দার্জিলিং নিয়ে আসা হয় ও স্রেফ মনোরঞ্জনের কথায় তিনি দলে ভেড়েন, এমন আদৌ নয়। মনোরঞ্জনের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ঠিক কি ছিল, তা নিয়ে কিছু বলা যাবে না। কিন্তু তাঁর যে পর্যাপ্ত সাহস ও স্বাধীন ভাবনাচিন্তা ছিল, বোঝাই যায়। উজ্জ্বলা নিজে তাঁর কাজকর্ম নিয়ে কিছু লিখে যাননি সম্ভবত। উইকিপিডিয়ায় তাঁকে নিয়ে একটি পৃষ্ঠা আছে, তা থেকে জানা গেল তিনি ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে চালান হন, সেখান থেকেই বি এ পাস করেন। ১৯৩৯-এ জেল থেকে বেরুনোর পর উজ্জ্বলা আবার জেলে যান ভারত ছাড়ো আন্দোলনে, ১৯৪২-এ। ৪৭-এ জেল থেকে বেরিয়ে তিনি নোয়াখালিতে দাঙ্গাপীড়িতদের মধ্যে কাজ করেন, পরে ফরোয়ার্ড ব্লক দলের সঙ্গে যুক্ত হন। উইকি পৃষ্ঠা থেকে আরো জানা যাচ্ছে, উজ্জ্বলা একাধিক বিপ্লবী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। 

আরও পড়ুন
দার্জিলিং-এর বহু গল্প

গল্পটা শেষ হব-হব করছে, একটি সরকারি দলিলের, বলা ভালো একটি ফাইলের সন্ধান পাওয়া গেল। ফাইল নং ৪৫/২৬/৩৪-পল('পল' অর্থাৎ পলিটিক্যাল, রাজনৈতিক), সেটার শুরু হচ্ছে ১৯৩৪-এর ৮ই মে থেকে। ফাইলের গোড়ার দিকে বাংলা পুলিশের ইন্সপেক্টর জেনরেলকে দার্জিলিংয়ের তৎকালীন সায়েব পুলিশ সুপার আর ই ইংলিশের পাঠানো একটি রিপোর্ট আছে। পুরো ফাইলটায় যে কাগজপত্র জড়ো হয়েছে, তার বেশির ভাগ হলদেটে, সম্ভবত জল লেগে ঝাপসা, সবটা ভালো পড়া যায় না। ইংলিশের রিপোর্টটা সে তুলনায় পাঠযোগ্য। ছোট ওই রিপোর্টে এবং বিশেষ আদালতের রায়ের বিস্তারিত বয়ানে গোটা ঘটনার বর্ণনা আছে। সবটাই মোটামুটি স্বীকারোক্তির ওপর দাঁড় করিয়ে বলা, ডার্বিশায়ারের রায়ে যা উঠে আসে, তা থেকে খুব আলাদা কিছু নয়। যে দু একটা কথা তবু জানা দরকার, তা এইরকম--১। ভবানীর গায়ে মোট চারটে গুলি লাগে। একটা কাঁধে, তিনটে ঊরুতে। ভবানীর গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে অ্যান্ডার্সনের পিছনের আসনে উপবিষ্ট জনৈক মিস থর্নটনের গোড়ালিতে লাগে। ২। ইংলিশের মত, ভবানী ও রবীন্দ্রনাথ, দুজনের পিস্তলই মোক্ষম সময়ে আটকে যায়, গুলি বেরোয় না। ভবানীর কাছে .৩৮ বোরের পাঁচ নলা মার্কিনি রিভলভার ছিলো। রবীন্দ্রনাথের কাছে .৩২ বোরের 'স্টার' স্বয়ংক্রিয় পিস্তল। ৩। ভবানীকে ভিকটোরিয়া হাসপাতালে কড়া পুলিশ পাহারায় চালান করে ও রবীন্দ্রনাথকে হাজতে রেখে ইংলিশ শহর জুড়ে তল্লাশি চালাতে থাকেন। শহরে আসবার যাবার সবকটি পথ বন্ধ করা হয়। ঘরে ঘরে তল্লাশি চলে, বাঙালিরা যেসব হোটেলে ওঠে সেগুলোতেও। তল্লাশিতে অংশ নেন পাহাড়িরাও(ইংলিশ বলছেন হিলমেন)। বিভিন্ন জায়গায় বাঙালিদের ওপর আক্রমণ, নির্যাতন হতে থাকে। 'উত্তেজিত পাহাড়িরা যেসব বাঙালিদের ধরে ধরে 'লিঞ্চ' করছিল, তাদের উদ্ধার করতে আমার প্রচুর সময় যায়..' বলছেন ইংলিশ। উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারীরা অবধি রেহাই পান না, বিহার উড়িষ্যার ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট নগেন্দ্র নাথ রায় আক্রান্ত হন। আধমরা বাঙালিদের পুলিশ ও 'পাবলিক' থানায় জমা করতে থাকে। 'লোকে যে পরিমাণ ক্ষেপে ছিলো তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই যে মাননীয় লাটসাহেবের বিন্দুমাত্র চোট লাগলেও শহরের অবস্থা খুব খারাপ হত।', ইংলিশের মত। আগেই একাধিকবার বলা হয়েছে, লেবঙ গুলিকান্ড-পরবর্তী সময়ে দার্জিলিংয়ের বাঙালিদের ওপর আক্রমণ চলে। সে গল্প ও ক্ষত পুরুষানুক্রমে দার্জিলিং প্রবাসী বাঙালিরা বহন করে এসেছেন, আমি শুনেছি, আমার বাবা ১৯৪৬ সালে সোস্যালিস্ট দলের হয়ে ট্রেড ইউনিয়ন করবেন বলে দার্জিলিং-এ ডেরা বাঁধেন, তিনিও শুনেছেন। যে সব বাঙালিরা তার পরেও প্রায় এক শতাব্দী ধরে সায়েবি দার্জিলিংয়ের নস্টালজিয়া চাখতে পাহাড়ে আসেন ও হেরিটেজ শুঁকতে ভালোবাসেন, তাদেরও শোনা উচিত, অন্তত মুখ বদলানোর জন্যও। 

দার্জিলিং স্টেশনের কাছে স্নো ভিউ হোটেল। স্টেশন থেকে হুড়মুড়িয়ে নিচে নেমে গেলে লুই জুবিলি স্যানাটোরিয়াম। হোটেলটা এখনো আছে। ইস্পাতধূসর পুরোনো বাড়িটার কিছুটা, সামনের ফুলগাছ। সত্তর, হয়তো বা আশির দশকেও বাঙালিরা ওখানে উঠতে পছন্দ করতেন। হয়তো এককালে ওখান থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যেত, সেজন্য নাম স্নো ভিউ। এখন হোটেলের সামনেটা বড় বড় বাড়ির নিরেট দেয়ালে ঢাকা, কিচ্ছু দেখা যায় না। স্যানাটোরিয়ামের কাঁচের জানলা ভাঙা, বাড়ি ঘিরে আবর্জনার স্তুপ। অনেকদিন অবধি ওখানে পশ্চিমবঙ্গ পর্যটনের একটা হোটেল ছিল, এখন নেই। 

অনুতাপহীন ভবানী ফাঁসিতে ঝুলেছিলেন। তিনি কত বড় দুর্বৃত্ত, তা বোঝানোর জন্য দার্জিলিং-এর বিশেষ আদালত তাঁর জবানবন্দি উদ্ধৃত করেছিল। ভবানী বলেছিলেন, "আমার দেশবাসীর ওপর যে অকথ্য অমানুষিক নির্যাতন চলছে তার প্রতিশোধ নেবার জন্য আমি অ্যান্ডার্সনকে হত্যা করতে আসি। আমি দুঃখিত যে আমি তাঁকে মারতে পারিনি... আমার জ্ঞানত ও বিশ্বাস অনুযায়ী আমি কোনো অন্যায় করেছি বলে মনে করি না। যে কোন শাস্তির জন্য আমি প্রস্তুত।" ভবানীর মৃত্যুর অনেক পর কলকাতা গোয়েন্দা পুলিশের দপ্তর অ্যান্ডার্সন হাউসের নাম বদলে ভবানী ভবন রাখা হয়। ওই বাড়ির সঙ্গে ভবানী ও তাঁর সহযোগীদের কি যোগাযোগ কজন মনে রেখেছেন? পুরোনো বাড়ির, রাস্তার, বনের, লোকজনের মতো গল্পও হলদে হয়ে ঝরে যায়, গল্পে জং ধরে, চলটা খসে পড়ে। তবু কাউকে না কাউকে সেসব খুঁজে খুঁজে বার করতেই হয়।

Powered by Froala Editor