চায়ের গল্প, নানা রকমের শ্রম ও জাতিনির্মাণ(ছয়)

সময়ভ্রমণ - ৬০
আগের পর্বে

বিশ শতকের প্রথম অর্ধে দার্জিলিং অঞ্চলে যে জাতিসত্তার নির্মাণ ঘটছিল, তা স্বাভাবিকভাবেই ব্রিটিশদের অনুগামী এবং সাম্প্রদায়িকতাদুষ্ট। তাই কমিউনিস্ট দলগুলি সচেতনভাবে অন্য জাতিসত্তার কথা মনে করিয়ে দিতে চাইছিল। এই সময় চা-বাগানগুলিতে মজুরিবৃদ্ধির দাবিতে এবং মালিকপক্ষের অত্যাচারের বিরুদ্ধে একাধিক আন্দোলনও দানা বাঁধে। কিন্তু পরে গোর্খাল্যান্ড আন্দোলনের ঢেউয়ে সেইসব হারিয়ে যায়। অনেকেই বিশ্বাস করতে শুরু করেন, গোর্খাল্যান্ড হলে শ্রমিকদের ভালো হবে। কিন্তু কীকরে হবে, তা কেউ জানেন না। বিশেষ করে, এই আন্দোলন যখন মালিকপক্ষের স্বার্থের বিরোধী নয়। প্রথম ও দ্বিতীয় গোর্খাল্যান্ড আন্দোলনের সময় ভিন্ন ভিন্নভাবে জাতিসত্তার নির্মাণ চলেছিল। এমনকি পাহাড়ের সবাই আদিবাসী, এমন দাবিও করেছিলেন সুভাষ ঘিসিং।

২০০৭-৮এ গোর্খাল্যান্ড আন্দোলন নতুন করে শুরু হবার পিছনে একটা কারণ অবশ্যই ঘিসিং, এবং তাঁর আদিবাসী ভাবনা। পাহাড়ের ক্ষমতাবানদের মধ্যে বেশিরভাগই উঁচু জাতের, বাওন-ছেত্রী(ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়), সেইসঙ্গে মঙ্গর গুরুং সুনওয়ার ইত্যাদি, যাঁদের সবাইকে সায়েব সেনাকর্তারা একযোগে গুর্খা বানিয়েছিলেন। এঁদের কেউ কেউ চাকরির সুবিধার্থে আদিবাসী হতে রাজি ছিলেন, যেমন মঙ্গররা, কিন্তু কেউই পাথর বা বাঁদর পুজোয় রাজি ছিলেন না। তাঁদের জাত্যাভিমানে ঘা পড়ল, পাহাড় থেকে তাঁরা ঘিসিং এবং তাঁর দলের লোকজনকে তাড়িয়ে দিয়ে নতুন দল খুললেন, দ্বিতীয় আন্দোলন শুরু হল। সে আন্দোলন পুরনো জাতিপরিচয়কে একেবারে নস্যাৎ করে দিয়ে বলল, সব পাহাড়িই গোর্খা, যে মানে না সে জাতিশত্রু। পরিচিত বন্ধুরা প্রায় সবাই নতুন দলে, তাঁরা কালিম্পং-এ একটা সভা করেছিলেন, মনে আছে। সে সভায় অধুনাপ্রয়াত রামদয়াল মুন্ডা এসেছিলেন। সেটা ২০১০, ২ বছরের আন্দোলনের দম ক্রমশ ফুরোচ্ছে। রাজ্য সরকারের থেকে উন্নততর ষষ্ঠ তফসিল নিয়ে প্রস্তাব এসেছিল, নেতারা অনেকে চাইছিলেন সেটা মেনে নেওয়া হোক। সে কারণে কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে শলাপরামর্শ চালানো দরকার, সে বিষয়ে সাহায্যের জন্য রামদয়াল। তিনি তখন সংসদ সদস্য, কেন্দ্রীয় সরকারের আদিবাসী বিষয়ক উপদেষ্টাও। ঘোর বর্ষাকাল, মিলিটারিদের গলফ খেলার গাঢ় সবুজ মাঠের প্রান্তে, মর্গান হাউসের উল্টোদিকে মেঘে ঢাকা সার্কিট হাউস, সেখানে স্থানীয় কয়েকজন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এলেন। স্থানীয় বলতে গোর্খাল্যান্ড আন্দোলনওয়ালারা নন, কালিম্পং-এর পুরোনো বাসিন্দাদের কেউ কেউ। একজন লেপচা, একজন ভুটিয়া। তাঁরা একবাক্যে বললেন, আলাদা রাজ্য হলে তো বেশ, ভালোই হয়। কিন্তু সে রাজ্যের নাম গোর্খাল্যান্ড কেন হবে? পাহাড়ে কি লেপচা ভুটিয়ারা, এমনকি বাঙালি বিহারি মারোয়ারিও নেই? এঁরা কি সবাই গোর্খা? ভুটিয়া ছেলেটির সঙ্গে অনেকদিন দেখাসাক্ষাৎ হয় না, কালিম্পং ঢোকার মুখে তাদের পারিবারিক নার্সারি, ছোট হোটেল। সে প্রস্তাব দিলো, আচ্ছা, নতুন রাজ্য, স্বশাসিত এলাকা, যাই হোক, সেটার নাম দার্জিলিং রাখা যায় না? 

হতে অনেক কিছুই পারে, হয় না। বাইরে থেকে দার্জিলিং-এর গল্পটা শুনতে, দেখতে বেশ, এই কাঞ্চনজঙ্ঘা, এই টয় ট্রেন, এই ম্যাল, এই ছোট বড় নানারকম হেরিটেজ। তার সঙ্গে চা, পৃথিবীর সেরা, জি আই চা, যার দ্বিতীয়টি এই গ্রহের কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। ভিতর থেকে দেখলে, খুঁজলে, কিছুই নেই প্রায়, যা আছে সেটাও ভাঙাচোরা, ধসে পড়া পাহাড়ের মতো যে কোন সময় নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। বলা হচ্ছে জি আই চা, দার্জিলিং ছাড়া অন্য কোথাও হয় না, অথচ দার্জিলিং লাগোয়া নেপালের ইলাম জেলায় যে বিস্তীর্ণ চা এলাকা, সেখানকার পাতা রাতের অন্ধকারে চালান হয়ে যাচ্ছে দার্জিলিংয়ের একাধিক বাগিচার কারখানায়, জি আই-য়ের কঠিন নিয়মের গেরো ফস্কে এক ভূগোলে অন্য ভূগোল মিশে যাচ্ছে স্বচ্ছন্দে। কী মাত্রায় ভূগোল ভেজাল হচ্ছে, কত চা কোন কোন কারখানায় আসছে, বলা  কঠিন। তবে আসছে তো বটেই। 

না আসার কারণও নেই। ভূগোল কি রাষ্ট্ৰসীমা দিয়ে নির্ধারিত হয়? কাঁকরভিটা দিয়ে নেপালে ঢুকে ইলামের রাস্তায় কিছুটা গেলেই একের পর এক চাবাগিচা। সেই রাস্তা খানিকদূর গিয়ে ডানদিকে পশুপতিফাটকের ঘিঞ্জি ভোগ্যপণ্যের বাজার হয়ে মিরিক-সীমানা-সুখিয়াপোখরির রাস্তায় মিশে যায়। সেখানে গেট, দু দেশের সিপাইসান্ত্রী। তার আগে অবধি একই রকম চাবাগিচা, ধূপিজঙ্গল, একই রকম গ্রাম, ছোট দোকান, লোকজনও এক। মিরিক-সুখিয়ার রাস্তা, সেখান থেকে মানেভনজং হয়ে সান্দাকফু-ফালুটের পাহাড়চূড়া। গিরিশিরা আর পাহাড়শ্রেণির কাঁধে মাথায় গাড়ি যাবার, হাঁটার, ঘোড়া চলাচলের নতুন-পুরোনো সব পথ, তার একদিকে ভারত, অন্যদিকে নেপাল। এদিকের আবহাওয়া, মাটি, গাছ, জল, এসবের সঙ্গে ওদিকের কি ফারাক? এদিক-ওদিকের ভূগোল কেন আলাদা? 

আসলে ভূগোল নয় অর্থনীতি। পুঁজি, মুনাফা, শ্রম। নেপালের বাগিচায় প্ল্যান্টেশন লেবার অ্যাক্টের দায় নেই, সব শ্রমিক বাগিচায় থাকেন না, বাগিচা বহুক্ষেত্রেই আয়তনে ছোট, কম লোকে কাজ চলে যায়। ফলে যে চা রাস্তার ওদিকে ধরা যাক কেজিপ্রতি ৫০০ টাকায় তৈরি হচ্ছে, সেই চা-ই রাস্তার এদিকে তৈরি হচ্ছে ৩০০ টাকায়। এদিকের ওদিকের চা যখন বিদেশি বাজারে ঢুকছে, দুটোই বিক্রি হচ্ছে দার্জিলিং নামে। জেফ কোলার এবং সারা বেসকি দুজনের লেখাতেই দেখলাম, ডিপিএ(দার্জিলিং প্ল্যান্টার্স য়্যাসসিয়েশন)-র কর্তারা বলছেন, নেপালের সস্তা চা দার্জিলিং-এর বাগিচাশিল্পকে শেষ করে দিচ্ছিল, জি আই না হলে সব শেষ হয়ে যেত। 

আরও পড়ুন
চায়ের গল্প, নানা রকমের শ্রম ও জাতিনির্মাণ (পাঁচ)

জি আই হয়ে বাস্তবে কি তফাত ঘটছে? আগে নেপালের চা দেশের বাইরে গিয়ে দার্জিলিং ছাপ্পা লাভ করত, এখন দেশের থুড়ি দার্জিলিং-এর রাষ্ট্ৰস্বীকৃত জিআই-সীমাঙ্কিত ভৌগোলিক চৌহদ্দির মধ্যেই তা ঘটছে। দার্জিলিং-এর বাগিচামালিকদের লাভ বাড়ছে, শ্রমিকদের অবস্থার হেরফের হচ্ছে না, শ্রমের দামও বাড়ছে না।

বেসকির গবেষণার মূল বিষয় ছিলো ফেয়ার ট্রেড, 'সৎ' বাণিজ্য। দার্জিলিং-এর চা এখন বেসকির দেশ আমেরিকায়, অন্যত্রও ফেয়ার ট্রেড ছাপ্পা মেরে বিক্রি হচ্ছে। দার্জিলিং-এ এসে, ঘুরে, থেকে বেসকি দেখলেন সবটাই গপ্পো, অথবা মায়া। ফেয়ার ট্রেড মানে সে ব্যবসায় শ্রমশোষণ হবে না, শ্রমিকরা ন্যায্য মজুরি পাবেন, লাভের গুড় মালিক একা খাবেন না, সে লাভের অংশ শ্রমিকদের মধ্যেও পৌঁছোবে। এরকম হতে পারে, কিন্তু হয় না। বাগিচা পরিবেশবন্ধু হল, বায়ো-অর্গানিক হল, অর্থাৎ কিনা আর দশটা গাছপালার মতো চা-ও নিতান্ত দেশজ, প্রাকৃতিক, বাজারি রাসায়নিক বাগিচাভূমিকে নিরন্তর দূষিত কলঙ্কিত করছে না। ফেয়ার ট্রেড, জি আই, বায়ো-অর্গানিক। ছাপ্পার পর ছাপ্পা লাগছে, চা-কর মালিকদের লাভ বাড়ছে, শ্রমিকদের অবস্থা যে কে সেই, বাগিচায় নতুন গাছ লাগানো এবং পুরোনো গাছের পরিচর্যার জন্য প্রয়োজনীয় খরচা করা হয় না। কিসের ফেয়ার ট্রেড, বেসকির জিজ্ঞাসা। শ্রমশোষণ এবং মুনাফাবৃদ্ধির প্রক্রিয়ায় আকণ্ঠ নিমজ্জিত চায়ের ব্যাপার, সেখানে কোথায় সাম্য, কোথায় ন্যায়? 

আরও পড়ুন
চায়ের গল্প, নানা রকমের শ্রম ও জাতিনির্মাণ (চার)

বাগিচার বাইরের বাকি পাহাড় ঢেকে, গুঁড়িয়ে, সমান করে, বাড়ি উঠছে, শহর বাড়ছে। ম্যাল থেকে একটু নিচে নামলে কিম্বা ওপরে উঠলে, অথবা বাতাসে(বাতাসিয়া লুপ) এলাকা থেকে দেখা যায়, বাড়ির ওপরে, গায়ে, নিচে বাড়ি, আরো আরো বাড়ি। হোটেল, হোমস্টে, মল, দোকান, পুরোনো নতুন লোকের বসতবাড়ি। দার্জিলিং শহর কেন, গোটা পাহাড়েরই প্রায় এক দশা। আগেকার সুদৃশ্য  বাড়িগুলো ভেঙে নতুন বহুতল তৈরি হচ্ছে। পুরোনো সায়েববাড়ি, বাঙালিদের বাড়ি। বেশ কিছু বছর আগে, দার্জিলিং-এর বাঙালিদের সঙ্গে কথা বলছিলাম। তাঁদের একজন, তরুণ সাংবাদিক, ওইরকম সরু লম্বা একটা বাড়িতে থাকেন, তার দুপাশে লম্বা সরুমোটা বাড়ি, চোখ দু-চার ফুটের বেশি যায় না। দ্বিতীয় গোর্খাল্যান্ড আন্দোলনের প্রথম পর্ব শেষ হয়ে জিটিএ রাজত্ব চলছে, দার্জিলিং জুড়ে কর্মযজ্ঞ। সাংবাদিক বন্ধু বলছিলেন, কাকঝোরার কাছে কোথাও তাঁদের পারিবারিক বাড়ি ছিলো। ছবির মতো সেই একতলা বাংলোর বাইরে একফালি ঘাসজমি, ফুলের গাছ। তাঁর মাসি সে বাড়িতে থাকতেন। এরকম আরো অনেক বাড়ি ছিলো, তার একটাও এখন নেই। পোস্টাপিসের সামনে দিয়ে, জলাপাহাড়ের পথে, কিম্বা স্টেশন থেকে বাজার হয়ে চাঁদমারীর দিকটায় হাঁটতে হাঁটতে কতবার চোখে পড়েছে বাড়ির ভিড়ের মধ্যে বড় বড় ফাঁক, চটের পর্দা দিয়ে ঢাকা। পুরোনো বাড়ি ছিলো, ভাঙা পড়েছে, বন্ধু জানালেন। চটের পর্দা সরিয়ে ওই সব ফাঁক ভরাট করে বড় বাড়ি উঠবে। প্রোমোটারদের তৈরি বাড়ি। জমি মাফিয়াদের বাড়ি। গোর্খাল্যান্ড আন্দোলনের সব চাইতে বড় নেতা, গোর্খা জাতির স্বঘোষিত ত্রাতা-অভিভাবক-মেসায়া স্বয়ং সবচাইতে বড় জমি-মাফিয়া, প্রোমোটার, যেখানে যা পুরোনো বাড়ি, ছিটেফোঁটা খালি জায়গা, সবের ওপর তাঁর নজর পড়েছে, কিচ্ছু বাঁচবে না।

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
চায়ের গল্প, নানা রকমের শ্রম ও জাতিনির্মাণ (তিন)