দার্জিলিংপত্তনের পর

সময়ভ্রমণ - ২৯
আগের পর্বে

লয়েড যখন জানতে পারলেন তাঁকে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা চলছে, তখন তিনি এক দীর্ঘ পত্র লিখলেন কৌন্সিল কর্তাদের। একে একে তুলে ধরলেন নানা প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক জটিলতার কথা। কিন্তু কর্তারা কেউই তখন সেই কথা শোনার মতো অবস্থায় ছিলেন না। লয়েড বিদায় নিয়ে তাই কোনো জলঘোলা হল না। ব্রিটিশ সরকার যেমন সম্মান দেয়নি লয়েডকে, তেমনই বর্তমান সরকারি নথিতেও তাঁর কোনো উল্লেখ নেই। অথচ লয়েড না থাকলে দার্জিলিং পত্তন ঘটতই না। চা চাষের বিষয়েও তিনিই কোম্পানির দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। ২০১১ সালে দার্জিলিং-এর কিছু বাসিন্দা লয়েডের সমাধিতে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন।

দার্জিলিং-এর পত্তন হল। লয়েড গেলেন, ক্যাম্পবেল এলেন, কুলি যোগাড় হল, গাছ কাটার কাজ চলতে থাকল, স্বাস্থ্যনিবাস হল, সেনাছাউনিও। উইলসনের হোটেল খুলছি-খুলব করতে করতে খুলল গিয়ে সেই ১৮৪০-এর এপ্রিলে। বন কেটে ছবির মতো বাংলো, সায়েবি কুঁড়ে অর্থাৎ কটেজ, ভিলা এসব হল, সেখানে দলে দলে সায়েবরা আসতে থাকলেন। পাহাড়ে ওঠার ঠিকঠাক রাস্তা তৈরি হতে অবশ্য আরো বহু বছর লেগে যাবে। পাঙ্খাবাড়ির পথটা নামেই কার্ট রোড ছিল, গরু-মহিষ টানা গাড়ি, যেগুলোকে সায়েবরা বলতেন হ্যাকারি, সে পথের খাড়া চড়াই ভাঙতে পারত না। কারসিয়াং-এর পর থেকে দার্জিলিং পর্যন্ত চওড়া রাস্তা তৈরি হতেও বেশ অনেক দিন লেগেছিল। 

রাস্তার জন্য অসুবিধা হচ্ছিল ঠিকই। তা বলে দার্জিলিংপত্তনের, শহর বসানোর, জংলি বন্য নিসর্গ ভেঙে ছবির মতো হিল স্টেশন বানানোর কাজ থেমে ছিল না। আদি সায়েবপূর্ব দার্জিলিং, পুরোনো লেপচা গাঁ, পরে গোর্খা সেনাছাউনি দার্জিলিংয়ের এক টুকরো চৌহদ্দি ছাড়িয়ে নতুন হিল স্টেশন ছড়িয়ে পড়লো গিরিশিরার দু ঢালে, অন্যদিকে জলাপাহাড় পর্যন্ত। 

জলাপাহাড়ের মাথার দিক থেকে নিচে তাকালে দার্জিলিংয়ের ভূগোলটা খানিক ধরা যায়। জোরবাংলো থেকে জলাপাহাড় কাটাপাহাড়ের পথ বেরুচ্ছে, সেখানে এখনো অবধি সেনাছাউনি মোতায়েন, রাস্তা আটকে যত্রতত্ৰ উর্দিধারী শাসনের লালচোখ। বছর দশেক আগেও জলাপাহাড়ের পুরোনো সেনাছাউনির মধ্য দিয়ে হিল কার্ট রোডের দিকে যাওয়া যেত, এখন সে পথে সাধারণের যাতায়াত বন্ধ। জলাপাহাড়ের চূড়ায় ওঠার আগে, যেখান থেকে সেন্ট পলস ইস্কুলের বিশাল প্রাঙ্গণের শুরু, গুটিকয় হোটেল হয়েছে। সেসব হোটেলের ঘর থেকে, কিম্বা সেন্ট পলস ইস্কুলের ভিতর থেকে দেখা যায় সরু দার্জিলিং গিরিশিরা(গিরিশিরা কথাটা খাটে না বোধহয়। ভূগোলের ভাষায় দার্জিলিং হচ্ছে স্পার, পাহাড়ের বাহু, অবজার্ভেটরি হিল থেকে তা সোজা গড়িয়ে পড়ছে রঙয়ো-রঙ্গু নদীতে, অন্যদিকে রঙ্গীতে) চলে যাচ্ছে অবজার্ভেটরি হিল অবধি, দুই ঢালে ঠাসা বাড়িঘর, মাথার দিকে খানিক গাছপালা। সেন্ট পলসের একটা অংশ জলাপাহাড় ছাউনির মধ্যে, সেখানে উনিশ শতকের একটি কাঠ-কাঁচ-পাথরের বাড়ি এখনো জীবিত আছে। সেই বাড়িতে ‘গন উইদ দি উইন্ড’ খ্যাত হলিউডের বিখ্যাত চিত্রতারকা ভিভিয়েন লি'র শৈশব কৈশোর কেটেছিল, এখন সে বাড়িতে মহিলা শিক্ষকদের হোস্টেল। সেন্ট পলস ইস্কুল আর জলাপাহাড় ছাউনি জুড়ে অনেকগুলো পুরোনো বাড়ি আছে। সেসব ছাড়িয়ে পাহাড়ের একেবারে মাথায় উঠলে প্রায় গোটা দার্জিলিং পাহাড়টা দেখা যায়। পরিষ্কার রোদ্দুরের দিনে ইতস্তত পাইন আর অবজার্ভেটরি পাহাড়ের ওক-রডোডেনড্রনের জটলা ঝলমল করতে থাকে, মেঘমুক্ত দিগন্তে থাক থাক পাহাড় শেষ হচ্ছে কাঞ্চনজঙ্ঘায়, তার ওপারে একদিকে নেপাল আর অন্যদিকে তিব্বত। তেমন রোদ না থাকলে, বা মেঘের দিনে, সাদা, সাদাধূসর মেঘ গোল কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠে আসতে থাকে জলাপাহাড়ের চূড়ার দিকে, নিচে আর কিছু দেখা যায় না। খুব শীতে কালেভদ্রে যখন বরফ পড়ে তখন জলাপাহাড়ের মাথা থেকে নিচে তাকালে দেখা যায় গাছের পাতায়, গিজগিজে বাড়ির ছাদে আর সরু সরু রাস্তা সাদা ধবধবে বরফে বোঝাই। উজ্জ্বল রোদে, ঘন কুয়াশায় আর বরফের সময়ে দার্জিলিং-এর সায়েবি ছবিটা ফিরে আসে আবার, সব বেভভুল হয়ে যায়, মনে থাকে না ছবি ছবিই, মায়ামাত্র। 

জলাপাহাড়ের চুড়ো থেকে নামলেই, সেন্ট পলস ইস্কুলের এলাহি ভিক্টরিয় ইমারত। এরকম ইস্কুলবাড়ি দার্জিলিং-এ আরো আছে, লেবং যাবার পথে নর্থ পয়েন্ট, জোরথাং যাবার রাস্তায় মাউন্ট হারমন। ইস্কুল ভেঙে হোটেল বা বাজার করায় সম্ভবত অসুবিধা আছে। ফলে এই সব বাড়িগুলো সায়েবি দার্জিলিংয়ের শেষ অবশিষ্ট চিহ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, সেই সঙ্গে কিছু পুরোনো গির্জা, দু একটা 'হেরিটেজ' হোটেল, কিছু সরকারি বাড়ি। দার্জিলিং-এর যে ছবির কথা বলছিলাম, যেন সেই ছবির পুরোটাই দাগ লেগে, রং চটে নষ্ট, শুধু মাঝে মাঝে কোথাও কোথাও খানিক বোঝা যাচ্ছে। বাকিটা অন্য কিছু হয়ে গেছে, তাল-পাকানো, পিণ্ড হয়ে যাওয়া ক্যানভাস বা কাগজ। ছবি নয়। 

আরও পড়ুন
দার্জিলিংপত্তন: লয়েডের চিঠি ও লয়েডবিদায়

সাহেবি দার্জিলিং-এর কেন্দ্র ছিল পুরোনো দার্জিলিংটাই, অর্থাৎ অবজার্ভেটরি পাহাড় লাগোয়া এলাকা। পশ্চিমের ঢাল জুড়ে নতুন বসতি তৈরি হচ্ছিল, ওপরের দিকে সায়েবরা, নিচে নেটিভ। পাহাড় থেকে একদম নিচে লেবং-এর কিম্বা বাদামতামের দিকে গেলে, বা পূবে তুংসুংয়ের দিকে নামলে লেপচাদের ডেরা ছিল। ১৮৩৯-এ লয়েডের করা জনগণনা অনুযায়ী, গুটিকত সাহেব ও তাঁদের দেশীয় অনুচর ভিন্ন দার্জিলিং ট্র্যাক্টের বাসিন্দা ছিলেন কুল্যে ৮৮ জন, মহিলা ৩৭, পুরুষ ৫১। তাঁরা তখনো অবধি সিকিম রাজাকে কর দিচ্ছেন, অথবা জুমিয়াসমাজের রেওয়াজমাফিক, স্থানীয় মাতব্বরকে। যে ২৩টি পরিবারপ্রধানের সন্ধান পেয়েছিলেন লয়েড, তাঁদের মধ্যে ১৭ জন কর হিসেবে অল্প মাত্রায় শস্য মাতব্বরের কাছে জমা করতেন। বছরে এক টাকা করে কর দিতেন তিন জন। ৭ জন সরাসরি সিকিম রাজার প্রজা, ১ জন রাজার দেওয়ানের, ১০ জন বড় লামার। আলাদা আলাদা গ্রামের এই হিসেব। গ্রাম বলতে জুমিয়া বসতি, সেগুলোর বয়স বড়জোর বছর দুয়েক। লক্ষ্যণীয়, লয়েডের রিপোর্ট কৌন্সিলের কাছে যাচ্ছে ৭ই জুলাই। লয়েডকে তখন সরিয়ে দেওয়া হয়েছে, ক্যাম্পবেল দার্জিলিংয়ে ঢুকে গেছেন। তা সত্ত্বেও, স্থানীয় বাসিন্দাদের বিষয়ে লয়েডের ওপর নির্ভর করতেই হচ্ছিলো। শেষ পর্যন্ত লয়েড চেষ্টা চালিয়েছিলেন যাতে অনটু নিবাসী উদ্বাস্তু লেপচাদের ফিরিয়ে আনা যায়। লেপচা বসতি ও স্থানীয় প্রজাদের কাছ থেকে কর সংগ্রহ বিষয়ে লয়েড বলছেন:

‘...হয়তো আরো কিছু বসতির খোঁজ পাওয়া যেতো। পুরো বনে ঢাকা পাহাড়ি অঞ্চলে সে কাজ করাই মুশকিল… আমি নিশ্চিত যে আরো খুঁজে পাওয়া যাবে, তবে বর্ষার সময়টা না গেলে নয়।...কর যা উঠছে তা নগণ্য, দেখাই যাচ্ছে। এর কারণ হচ্ছে এ দেশের সব প্রতিষ্ঠানগুলো সামন্ততান্ত্রিক, লোকে রাজার বা মাতব্বরদের হয়ে নানানরকম কাজ করে দেয়... সবাই ভূমিদাস, প্রত্যেক পুরুষ, নারী ও শিশু কারুর না কারুর সম্পত্তি...এদের নিয়ে কি করা যায় সরকারকে বিশেষ নির্দেশ দিতে হবে। এদের কাছ থেকে কাজ চাওয়া হবে না টাকা...সম্ভবত তেরিং কাজি এদিকে চলে এলে এই সব লোকেরা তার সঙ্গে থাকবে, যদি তাদের সুরক্ষা ও অনুমতি দেওয়া যায়...যদি না হয় এদের মধ্যে থেকেই কোন ছোটখাটো মাতব্বর বানিয়ে নিতে হবে...’

এর উত্তরে কোম্পানিসরকারের যে নির্দেশ আসে তা বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য:

‘তালিকাভুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তি ও পরিবারের সঙ্গে বন্দোবস্ত করুন, যাতে এরা ব্রিটিশ সরকারের উপযুক্ত প্রজা হয়ে উঠতে পারে। লাটসাহেব চান না যে এই লোকজনের ওপর এমন একটা কর ব্যবস্থা চাপানো হোক, যার সঙ্গে এরা অপরিচিত।...ব্রিটিশ সরকার এদের যে সুরক্ষা দেবে এবং সরকারের সঙ্গে এদের সম্পর্কের স্বীকৃতিবাবদ, টাকায় হোক, অন্য কোনোভাবে হোক(ইন কাইন্ড) এরা সরকারকে কিছু সেবা(সার্ভিস) দিক...’

আরও পড়ুন
দার্জিলিংয়ের ছবি, ছবির দার্জিলিং - দার্জিলিংপত্তন নিয়ে আরও

বোঝাই যায়, নিখাদ সামন্তপ্রথায় প্রজাদের কাছ থেকে বিনামূল্যের শ্রম আদায় করার বিষয়ে কোম্পানিসরকারের কোনোরকম আপত্তি ছিল না। থাকার কথা নয়। সরকারের ইতিমধ্যে সম্যক আক্কেল জন্মেছে বাইরে থেকে মজুরি দিয়ে কুলি আনানোর চাইতে স্থানীয়দের দিয়ে সামন্তপ্রথায় কাজ করানো অনেক সুবিধার। এতে কাজ তো হবেই, সরকারের খরচাও কম হবে। সমস্যা এই যে ঠিকঠাক মাতব্বর না পেলে গহন বনের মধ্যে জুমিয়া প্রজাদের খুঁজে বার করা কঠিন। প্রজা বাড়ানোর উদ্দেশ্যে অনটু থেকে উদ্বাস্তু লেপচাদের ফিরিয়ে আনা হোক, সরকার সিদ্ধান্ত নিল। লয়েড এটা দীর্ঘদিন ধরেই চাইছিলেন, নিশ্চিতভাবে তাঁর উদ্যোগেই উদ্বাস্তু লেপচাদের মাতব্বর তেরিং কাজি ব্রিটিশ সরকারের কাছে দরখাস্ত করেন ১৮৩৯ এর ফেব্রুয়ারিতে:

‘আপনার...দাসানুদাস তেরিং কাজির আবেদন। হে দরিদ্রের রক্ষক, আমার আবেদন নিম্নরূপ: পূর্বে আমার খুল্লতাত বলজিৎ(ওরফে ভো-লোদ, যাকে রাজার ইচ্ছায় খুন করা হয়) সিকিম রাজার দিওয়ানরূপে কর্মরত ছিলেন। দিওয়ানের মৃত্যুর পর এবং রাজার বৈরিতার কারণে আমি এবং আমাদিগের পরিবারসকল রাজ্যহারা হইয়া গোর্খা রাজার এলাকায় প্রবেশ করি। ওই স্থলে আমরা গত বারো বৎসর যাবৎ রাইওত হইয়া বসবাস করিতেছি; কিন্তু নানাবিধ প্রতিকূলতার সম্মুখীন হইতে হইতেছে।...ব্রিটিশ সরকারের নিকট আমি বারম্বার সাহায্য প্রার্থনা করিয়া পত্র দিয়াছি…হুজুর সমীপে এই আবেদন পেশ করিতেছি এবং বলিতেছি যে সিকিম রাজার এলাকায় আপন পরিবারের সহিত আমাকে বসবাস করিতে দেওয়া হউক…নামগা ল্যাচি নচেৎ রংলি রংলিওটে আমাদিগকে থাকিতে দেওয়া হউক; করসংগ্রাহকের যে পদ আমার ছিলো তাহা ফিরাইয়া দেওয়া হউক, যাহাতে পর্বত ও মোরাং অঞ্চলে আমি শাসনপরিচালনা করিতে পারি...খুল্লতাত বলজিৎ যে পদে আসীন ছিলেন সেই দিওয়ানের পদ আমাকেও দেওয়া হউক….সিকিম রাজা ইহাতে সম্মত না হইলে হুজুর সমীপে আমার দ্বিতীয় আর্জি, দার্জিলিংয়ের কাজি রূপে কর্ম করিবার উপযুক্ত মর্যাদা ও সুবিধাদি আমাকে দেওয়া হউক… এই অঞ্চলের করসংগ্রহ, শাসন ও রাইওত যোগাড়ের জিম্মা গ্রহণ করিতে আমি ইচ্ছুক...আপনার আদেশ অনুযায়ী আমি সর্বদাই কর্ম করিব….’

কলকাতার কর্তারা কাজি ও তাঁর অনুগত লেপচা প্রজাদের কোম্পানির মালিকানাধীন দার্জিলিং-এ ফিরে আসতে অনুমতি দেয়। ওই পর্যন্তই। সাফ বলে দেওয়া হয়, কাজি ও তার লোকজন আসতে পারে, কিন্তু তাদের ব্রিটিশ প্রশাসকদের কথা শুনে চলতে হবে। অবশ্য নিজস্ব 'প্রথানুগ' চাষবাস বাণিজ্য এবং স্বশাসনের অধিকারও তাদের থাকবে। কিছুতেই অন্য বাসিন্দাদের সঙ্গে ঝামেলায় জড়ানো চলবে না, কিম্বা নেপাল ও সিকিমের সঙ্গে শত্রুতায়। 

কাজির লোকজন শেষ পর্যন্ত ফিরেছিল কিনা বোঝা যাচ্ছে না। পিন যা দলিলপত্র জড়ো করেছেন, সেখানে এই তথ্য নেই, ও'ম্যালিও তাঁর গ্যাজেটিয়ারে এ নিয়ে কিছু বলেননি। অনটু এলাকা নেপালের অংশ হয়েই থেকে যায়। টঙ্ক বাহাদুর সুব্বার গবেষণাকাজ থেকে জানা যাচ্ছে ইলামে অদ্যাবধি হাজার আড়াই লেপচার বাস। তাঁদের মধ্যে কারা কাজির সঙ্গে এসেছিলেন, আর কারা আগে থেকেই ওখানে ছিলেন তা বুঝবার কোনো উপায় নেই। 

আরও পড়ুন
দার্জিলিংপত্তন : লয়েডের বিদায় ও ক্যাম্পবেলের অভ্যুদয়

লয়েড-পরবর্তী সময়ে ক্যাম্পবেল নেপাল ও সিকিম থেকে দার্জিলিংয়ে কুলি ও প্রজা আনাচ্ছিলেন। ১৮৩৯ থেকে ১৮৪৯ সালের মধ্যে দার্জিলিংয়ের জনসংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১০০০০, যার অধিকাংশ পূর্ব নেপালের বাসিন্দা। কলকাতা থেকে দার্জিলিং পৌঁছনো সহজসাধ্য ছিল না, ফলে ১৮৪৯ অবধি দার্জিলিংয়ে মাত্র ৭০টি সায়েবকোঠি তৈরি হয়েছিল। কলকাতা থেকে শিলিগুড়ি পৌঁছোনোর পাকা বড় রাস্তা তৈরি হয় সেই ১৮৬৬তে, ও'ম্যালি জানাচ্ছেন বন্যাপ্রবণ জলাজমির ওপর দিয়ে সেই পথ নির্মাণে মোট খরচ হয়েছিল সাড়ে ১৪ লক্ষ টাকা। ১৮৬১তে দার্জিলিং-কারসিয়াং কার্ট রোডের কাজ শুরু, সে পথে গাড়ি চলাচল শুরু হয় ১৮৬৬তে। ততদিনে দার্জিলিং পাহাড় এবং নিচের তরাই-মোরাংয়ে বাইরে থেকে অসংখ্য কুলিচালান আসতে শুরু করেছে, গোটা এলাকা জুড়ে কোম্পানি নয়, স্বয়ং মহারাণী ভিক্টোরিয়ার রাজত্ব। এর মধ্যেই, ১৮৫৭য়, সিপাহী বিদ্রোহের পর সামরিক বাহিনী থেকে রীতিমতো বরখাস্ত হয়ে বৃদ্ধ লয়েড ফিরে এসেছেন দার্জিলিং-এ তিনি কোথায় থাকতেন তা'ও জানবার উপায় নেই। ১৮৩৯-এ, কারসিয়াংয়ে খামারবাড়ি করার জন্য সরকারের কাছে ৬৪০ একর জমি বন্দোবস্ত চেয়ে লয়েড যে আবেদন করেন, প্রায় তৎক্ষণাৎ তা সরকার খারিজ করে। সরকারের তরফে ক্যাম্পবেল সে কথা জানিয়ে দেন। সেই সঙ্গে একটি বাসগৃহ ও কিছু বাগান করার মতো ছোট এক খণ্ড জমি দিতে যে সরকার রাজি, সে কথাও। আহত, অপমানিত লয়েড সরকারকে চিঠি দেন, কোন লাভ হয় না। এর পরে দার্জিলিংয়ে উদ্ভিদ উদ্যান বা বটানিক্যাল গার্ডেন করতে চেয়ে লয়েড এবং তাঁর বন্ধুরা জমি চাইলে, সে আবেদন সরকার মঞ্জুর করে। সে বাগান কালক্রমে তৈরি হয়, এখনো অবধি তা লয়েডের বাগান নামে পরিচিত। হায়, সে লয়েড অন্য কেউ। লয়েডের নিঃশব্দমৃত্যুর অনেক যুগ পরে দার্জিলিংয়ের কুলুজিকার ই সি ডোজে মন্তব্য করবেন, 'এই হচ্ছে খ্যাতি! আর এই হচ্ছে পরবর্তী প্রজন্মের কৃতজ্ঞতা! তাঁর নামটা পর্যন্ত দার্জিলিংয়ের কোথাও নেই, রাস্তা আর বটানিক্যাল গার্ডেনে যাঁর নাম অমর হয়ে আছে, তিনি উইলিয়াম লয়েড, ওই নামের একটি ব্যাংকের মালিক'।

Powered by Froala Editor