লয়েড, সিকিমপতি রাজা ও কোম্পানির দার্জিলিংলাভ – ১

সময়ভ্রমণ - ২৪
আগের পর্বে

সিকিমের রাজার সঙ্গে চুক্তির ফলে দার্জিলিং সাহেবদের দখলে আসে। শুরু হয় স্বাস্থ্যাবাস তৈরি। হোটেল তৈরির উদ্যোগ নিলেন ডেভিড উইলসন। তবে কলকাতার সঙ্গে যোগাযোগের কোনো ব্যবস্থা তখনও ছিল না। লয়েডের হাত ধরে নতুন করে সেজে উঠতে শুরু করে দার্জিলিং। ফ্রেড পিনের ‘দার্জিলিং লেটার্স’ সেই ইতিহাসের দলিল। ২০ বছরের মধ্যেই নেপাল থেকে আসা মানুষের বসতিতে ভরে ওঠে পাহাড়। আর সাহেবরা তখন নিজেদের মনের মতো করে সাজিয়ে তুলছেন চারদিক। আজকের পর্যটকদের কাছে সেসব ইতিহাস অনেকটাই ব্রাত্য। তেমনই অবহেলায় পড়ে আছে সাহেবদের পুরনো কবরস্থান।

ফ্রেড পিনের বইটায় যে সব সরকারি নথিপত্র ও সমসাময়িক খবরের কাগজে ছাপা দার্জিলিং সংক্রান্ত চিঠিপত্র বিজ্ঞাপন ইত্যাদি উদ্ধৃত হয়েছে, তা পড়লে লয়েড ব্যক্তিটি সম্পর্কে কৌতূহল তৈরি হতে বাধ্য। কোম্পানি ক্যাম্পবেলকে দার্জিলিং-এর সুপারিনটেনডেন্ট করে না পাঠানো অবধি লয়েড ছিলেন দার্জিলিং-এর যাবতীয় ঘটনার কেন্দ্রে। কোম্পানির তরফে সিকিম রাজার সঙ্গে কথাবার্তা চালাতে হবে, লয়েড। রাজাকে বুঝিয়েসুঝিয়ে দার্জিলিং ভূমিখণ্ড জোগাড় করতে হবে, লয়েড। দার্জিলিং-এ কলকাতার সায়েবসুবোরা জমি নিয়ে বাড়ি করে থাকবেন, সেই জমি তৈরি করতে জঙ্গল কাটতে হবে, পাথর ফাটাতে হবে, লয়েড। কলকাতার সায়েবরা থাকবেন, তাঁদের নেটিভ চাকরবাকর অনুচরসুদ্ধ, এতগুলো লোকের খাবার জোগাড় করতে ও অন্যান্য প্রয়োজন মেটাতে বাজার চাই। বাজার বসাবেন কে, সে-ই লয়েড। যতদিন ঘরবাড়ি বাজার না গড়ে ওঠে, বাইরে থেকে আসা সায়েবরা থাকবেন কোথায়, খাবেন কী? কলকাতা থেকে দীর্ঘ দুর্গম পথ, পথের ব্যবস্থাই বা কি হবে? কেন, লয়েড সব ব্যবস্থা করে ফেলবেন। সবচাইতে বড়ো কথা, পাহাড়ে ওঠা হবে কী করে? রাস্তা, অর্থাৎ এমন রাস্তা বানাতে হবে, যা দিয়ে ভারবাহী কুলি, ছোটো ঘোড়া ও গরুমোষ টানা গাড়ি অক্লেশে যেতে পারে। পাহাড় ফুঁড়ে, জঙ্গল কেটে সে রাস্তা বানানোর জিম্মা কার ওপর? পুনরপি, লয়েড। 

অর্থাৎ লয়েড একাধারে রাজপুরুষ, কূটনীতিক, ব্যবসায়ী, বাস্তুবিদ, ভূবিশেষজ্ঞ, স্থপতি, হোটেলওয়ালা, প্ৰযুক্তিকুশল ইঞ্জিনিয়ার ও কুলি-ঠেঙানো ঠিকাদার। যুদ্ধবিগ্রহ লাগলেও লয়েড, কেননা তাঁর সাকিন কোম্পানির সেনাবাহিনী। একটাই মানুষ এত কাজ করবেন কী করে? এর উত্তর হচ্ছে, সে সময়ে এরকম আকছার হত। কোম্পানির রাজত্ব বিপুল, কোম্পানির হাঁ-ও তাই, ফলে রাজকর্ম ও ব্যাপার চালাতে অনেক সায়েবের দরকার। তত সায়েব কোম্পানির হাতে ছিল না। সাগরপাড়ি দিয়ে যাঁরা আসতেন ও ভারতের আবহাওয়া, রোগজারি ও ধুলোনোংরা সামলে টিকে যেতেন, তাঁরা মূল সুরক্ষিত শাসনকেন্দ্র ছেড়ে দূরে যেতে চাইতেন যে বড়ো একটা, তাও নয়। ফলে এককাজে যিনি যাচ্ছেন, তাঁকে অনেক কাজ করতে হত। 

বলা যত সোজা, করা তত নয়। লয়েডের ঘাড়ে এমনিতেই প্রচুর দায়িত্ব এবং চাপ ছিল, তদুপরি, কলকাতার কর্তারা ঠিক কি চাইছেন আর সিকিম রাজার ইচ্ছাই বা কী, তা লয়েড হয় বুঝে উঠতে পারেননি নয় চাননি। দার্জিলিং সায়েবদখলে আসার একেবারে গোড়ার গল্পটা ফিরে পড়লেই তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। 

তুলনীয় অন্য অন্য জায়গায় বা পরিস্থিতিতে কিভাবে কাজ হত বা হতে পারত, সে প্রশ্নে না ঢোকা ভালো। উত্তর ও দক্ষিণ ভারতে যে সব পাহাড়ি সায়েববসতি বা হিল স্টেশন গড়ে উঠছিল, সেগুলো প্রথমত সীমান্তঅঞ্চলে নয়, দ্বিতীয়ত, ওইসব এলাকায় কোম্পানির রাজনৈতিক আধিপত্য তৈরি হয়ে গিয়েছিল। দার্জিলিং পত্তনের চেষ্টা যখন চলছে, তখনও এ-অঞ্চলে কোম্পানিশাসন জাঁকিয়ে বসেনি, তিতলিয়ার পর বাকি এলাকাটা নিতান্তই বিদেশ। সিকিম ছোটোখাটো গরিব রাজ্য হতে পারে, নেপালের গোর্খা রাজাদেরও একরকম কব্জা করা গেছে, কিন্তু ভুটান? সবচাইতে বড় কথা, সিকিম, ভুটান, নেপাল, তিন দেশের প্রায় অনির্ণিত ও মানচিত্রহীন দিকশূন্যপুরের সীমান্ত বরাবর ছড়িয়ে আছে তিব্বত, অর্থাৎ চিন। চিনের প্ররোচনায় তিব্বতি সেনারা হামেশা সিকিম ভুটান নেপালে ঢুকে পড়ছে, ওদিকে সিকিম ও ভুটানের রাজকর্ম যে তিব্বতের নির্দেশে চালিত হয়, তার ভুরিভুরি প্রমাণ আছে। মোদ্দা, অঞ্চলটি গোলমেলে এবং যতটা গোলমেলে ততটা লাভজনক নয়। পলাশীর যুদ্ধের প্রায় পরপরই কোম্পানি তিব্বতের উদ্দেশ্যে লোকজন পাঠাতে শুরু করে, ওয়ারেন হেস্টিংসের আমলে জর্জ বোগল, পরে স্যামুয়েল টার্নার। তিব্বতের বহু মঠে ও মাটির তলায় কী মহামূল্য সোনাদানা ধনসম্পত্তি জমা হয়ে আছে, সে চিন্তায় শুধু কোম্পানি কেন, কোম্পানির পরের সায়েবদেরও প্রচুর সময় গেছে। সে তুলনায় লাভ হয়নি। আঠেরো শতকের শেষে বোগল আর টার্নারের অভিযান, উনিশ শতকের পুরোটা আর বিশ শতকের গোড়ায় ভুটানে ও তিব্বতে সায়েবি হামলা ও অভিযান নিয়ে বিস্তর বইপত্র আছে, এ-কাহিনিতে সেসব এক্ষুনি আসবে না। মোদ্দা, সিকিম নিয়ে কোম্পানির কলকাতাস্থ বড়ো সায়েবদের খুব একটা আগ্রহ ছিল না। 

আরও পড়ুন
পাহাড়ে ওঠা, থাকা : লয়েড, দার্জেলিং ও ফ্রেড পিনের দার্জিলিং লেটার্স

১৮২৮-এ সিকিম ঘুরে যাবার পর থেকে গ্র্যান্ট দার্জিলিং-এ স্বাস্থ্যাবাস গড়ে তোলার পক্ষে সওয়াল করতে থাকেন, লয়েডও গররাজি ছিলেন না। কলকাতার লাট তখন লার্ড বেন্টিঙ্ক, তিনি যে দার্জিলিং নিয়ে গ্র্যান্টের পেড়াপীড়ির কথা লিখে গিয়েছিলেন, তা জানা যাচ্ছে ১৮৩৮-এ ছাপা বেইলি-র দোর্জে-লিং বই থেকে। পিন বলছেন, দার্জিলিং আবিষ্কার ও পত্তনে গ্র্যান্টের ভূমিকা লয়েড স্বীকার করেননি। গ্র্যান্টের তদ্বিরের কারণে বা লয়েডের কথায় হোক, কোম্পানি বিষয়টায় মনোযোগ দেয়। ১৮৩০-এ, কোম্পানি সরকারের ডেপুটি সার্ভেয়র-জেনরেল ক্যাপ্টেন হারবার্টকে দিয়ে দ্বিতীয় সমীক্ষা করানো হয়, তাঁর সঙ্গে গ্র্যান্টও ছিলেন। হারবার্ট-ও বসতিস্থাপনের পক্ষে মত দেন। কোম্পানি লয়েডকে বলে সিকিম রাজার সঙ্গে 'গোপন আলোচনা' (ডিস্ক্রিট নেগোসিয়েসনস)শুরু করতে। বলে বটে, কিন্তু কোম্পানির কর্তাদের খুব একটা  ইচ্ছা বা উৎসাহ কি আদৌ ছিলো? ১৮২৯-এ গ্র্যান্ট তদ্বির শুরু করেছেন, কলকাতার কোম্পানিমহলে কথাবার্তা চালু হচ্ছে। ১৮৩০-এ হারবার্ট রিপোর্ট দিচ্ছেন। অথচ সিকিম রাজার সঙ্গে কথা শুরু করতে বেন্টিঙ্ক সায়েব লয়েডকে নির্দেশ দিচ্ছেন পাক্কা পাঁচ বছর পরে! ১৮৩৫-এর ২৩শে জানুয়ারি লয়েডের কাছে চিঠি যাচ্ছে, ' আপনি পত্রপাঠ রাজার সঙ্গে সাক্ষাত করার চেষ্টা শুরু করবেন, যাতে ব্রিটিশ সরকার দার্জিলিং নিয়ে নিতে পারে... প্রয়োজনমতো বদলি জমি বা টাকায় উপযুক্ত মূল্য ধরে দিয়ে'। লয়েডকে বলা হয়েছিল যাতে রাজা বুঝতে পারেন যে 'ভালো জলহাওয়া ও সেকারণে স্বাস্থ্যাবাস বানানোর ইচ্ছা ছাড়া এর পিছনে আমাদের অন্য কোন অভিসন্ধি নেই'। যে সভায় এই চিঠি পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, তার দ্বিতীয় এক কার্যবিবরণীতে দেখা যাচ্ছে যে কোম্পানির কৌন্সিল সদস্যরা 'দার্জিলিং' বলতে বোঝাচ্ছিলেন শুধুমাত্র ক্যাপ্টেন হারবার্ট বর্ণিত 'জনমানবহীন পোড়ো গ্রামটা'কে, 'ওই জায়গাটা'র অতিরিক্ত একটুও নয়। ১৮৩৫-এর ১১ই ফেব্রুয়ারি বেন্টিঙ্ক সিকিম রাজাকে ব্যক্তিগত চিঠি দিচ্ছেন -'আপনার দরবারে আমি মেজর লয়েডকে পাঠিয়েছি, যিনি অভিজ্ঞ ও সমর্থ, এবং যাঁর ওপর আমার সম্পূর্ণ আস্থা আছে। তিনি আপনাকে ব্রিটিশ সরকারের কাছে যথাযথ মূল্যের বিনিময়ে দার্জিলিং হস্তান্তর করার প্রস্তাব দেবেন। ...আমি খবর পেয়েছি যে ওই জায়গাটা থেকে আপনার কোন রাজস্ব আদায় হয় না। ওখান থেকে কোনোরকম আর্থিক লাভ করার উদ্দেশ্যও ব্রিটিশ সরকারের নেই।... সমতলের গরম য়ুরোপীয়দের ধাতে সহ্য হয় না... দার্জিলিং-এর ঠান্ডা সেক্ষেত্রে উপকারি হবে।' ১২ই ফেব্রুয়ারি ১৮৩৫, লয়েড সিকিম রাজার সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছেন তিস্তার পাড়ে। যে পারে রাজা শিবির ফেলেছেন, সে পারে যেতে হলে লয়েডকে ভেলা করে নদী পেরুতে হয়, ফলে রাজার সঙ্গে কথা বলার জন্য নিয়মিত পারাপার করতে হচ্ছিল। ১৯শে ফেব্রুয়ারিতেই প্রথম পুরো দরবারে লয়েড হাজির হলেন। কথাবার্তা হল না, তবে সম্ভবত সেদিনই লয়েড রাজার হাতে দার্জিলিং চেয়ে সরকারি চিঠি দিচ্ছেন :

লাটসাহেবের কাছ থেকে সিকিম রাজার সঙ্গে সাক্ষাৎ প্রার্থনা করার জন্য আমার কাছে পত্র এসেছে।...বড় রঙ্গীত নদীর দক্ষিণ, বালাসন, কুহেইল(?) ও ছোট রঙ্গীত নদীর পূর্ব ও মহানন্দা ও রান্য(সম্ভবত রঙনু বা রংগু) নদীর পশ্চিম দিকের পাহাড় ব্রিটিশ সরকার অন্যত্র সমপরিমাণ জমি বা অর্থের বিনিময়ে নিতে চায়।...এ বিষয়ে রাজাকে নিশ্চিত কোননো উত্তর দিতে অনুরোধ করি।  

আরও পড়ুন
টুকরো টুকরো তরাই: নিসর্গের খোঁজ

পরের দিন, অর্থাৎ ২০শে ফেব্রুয়ারি, তিস্তার পাড়েই দীর্ঘ দরবার বসে। লয়েডের চিঠির উত্তরে রাজা পাল্টা একগুচ্ছ অনুরোধ হাজির করলেন। সিকিমের পশ্চিম সীমান্ত(অর্থাৎ নেপালের দিকে) বাড়ানোর কথা বলা হল। জনৈক রাম্মু পরধান, যে কিনা রাজার কর-সংগ্রাহক ছিল এবং দুবছরের জমা খাজনা নিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল, সে এবং কতিপয় লেপচা কাজি আপাতত ব্রিটিশ হেফাজতে, তাদের ফেরত পাঠানো হোক। তৃতীয়ত, দার্জিলিং-এর বদলি হিসেবে রাজা চাইলেন সমতলের ডাবগং(কোম্পানির হাতে লেখা নথি থেকে পিনের পাঠ অনুসারে--সম্ভবত ওটা হালের, শিলিগুড়ি-লাগোয়া ডাবগ্রাম হবে)। 

এই সব অনুরোধের উত্তর দেওয়ার সাধ্য লয়েডের ছিল না। এর পর থেকে কী ঘটছিল, সেটা বুঝে ওঠাও মুশকিল। রাজা একবার বলছেন, তাঁর অনুরোধ রক্ষা করা হলে তিনি দার্জিলিং-এর 'ছোটো ব্যাপারটা'র ফয়সালা করে ফেলবেন, অন্যদিকে এও বলছেন, আমার ছোটো রাজত্ব, কী করা যায়। লয়েড এটার মানে করেছিলেন, জমিটা রাজা ছাড়তে চাইছেন না। অথচ ২৮শে ফেব্রুয়ারি রাজা দরবারে বসে লয়েডের হাতে এক টুকরো কাগজ তুলে দিচ্ছেন, যেখানে বলা ছিল, '...বন্ধুত্বের নিদর্শনস্বরূপ আহমা দিগ্গির(সম্ভবত কোন দিঘির কথা বলা হয়েছিল --আহমা সম্ভবত আম) উত্তরের ডাবগঙ যদি আমাকে দেওয়া হয়, আমার দেওয়ান তাহলে মেজর লয়েডের হাতে আমার লাল সিল দেওয়া দানপত্র ও চুক্তিপত্র তুলে দিতে পারে, যাতে তিনি দার্জিলিং-এ ঘরবাড়ি তুলতে পারেন... আমার দেওয়ানের কাছে বাড়ি বানানোর ছাড়পত্র ইতিমধ্যেই দেওয়া আছে।' ২৬শে ফেব্রুয়ারি লয়েড ফিরতিপথ ধরলেন। লয়েডের কথা অনুযায়ী, রাজা তাঁর সঙ্গে নিজের একজন লোক দিয়েছিলেন, তার কাছে দার্জিলিং-এর দানপত্র থাকার কথা, রাজানুরোধ মেনে কাজ করলেই সেটা হস্তান্তর করা হবে। সেই দানপত্র নাকি এরকম ছিল(লয়েডের আক্ষরিক অনুবাদ অথবা 'ট্রু ট্রানস্লেসন'):

আরও পড়ুন
তরাই: নিসর্গ নির্মাণ, ছবি তৈরি ও ছবি ভাঙা

“ওখানে বাস করলে স্বাস্থ্যলাভ হবে বলে বন্ধুত্বের খাতিরে আমি দার্জিলিং গভর্নর জেনরেল সাহিবকে উপহার দিচ্ছি, ১৯শে মাউগ(মাঘ?), ২৫শে ফেব্রুয়ারি, ১৮৩৫।”

২৬শে ফেব্রুয়ারির তারিখ দেওয়া আর একটা বড় চিঠি লয়েডের চলে আসার পর পাঠানো হয়। চিঠির ভাষা তিব্বতি। সোমা দি করোসে তখন কলকাতায়, তিনি তা অনুবাদ করেন। সেখানে রাজার অনুরোধ বিষয়ে বিস্তারিত বলা থাকলেও, দার্জিলিং প্রসঙ্গে প্রায় কিছুই ছিল না। পিনের বক্তব্য, কোম্পানির কৌন্সিল সদস্যদের দার্জিলিং সম্পর্কে কোন ধারণাই ছিল না, অঞ্চলের ভূপ্রকৃতি বা টোপোগ্রাফি বিষয়ে রাজার ধারণাও ওইরকম, না থাকার মতো। ফলে লয়েড যা তথ্য ও সংখ্যাদি সরবরাহ করেন, তার ওপর দাঁড়িয়ে আলোচনা চলছিল। অর্থাৎ, লয়েড দার্জিলিং বলতে যে নিছক অবজার্ভেটরি হিল লাগোয়া পুরোনো লেপচা গ্রাম বোঝাননি, অনেক বড়ো এলাকা চেয়ে বসেছেন, সেটা কৌন্সিল সদস্যদের গোচরে ছিল না। সিকিমের বিশদ মানচিত্রও তখনো অবধি তৈরি হয়নি, ফলে সমস্যা বাড়ে। পিন বলছেন, সরকারকে কিচ্ছু না জানিয়ে লয়েড এই যে কাজটা করে বসলেন, তার ফলে পরবর্তী সময়ে কোম্পানি সরকারকে খুব অপ্রস্তুত হতে হয়। 

আরও পড়ুন
বদলে যাওয়া তরাই বা শিলিগুড়ি-চরিত (২)

লয়েড বুঝতে পেরেছিলেন বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে। ২৩শে মার্চ কোম্পানিকে লম্বা চিঠি লিখে তিনি নিজের কাজের ব্যাখ্যা দিলেন। তাঁর বক্তব্য ছিল, শুধু দার্জিলিং নিলে চলবে না, দার্জিলিং উঠতে হলে যে রাস্তা তৈরি করতে হবে, সেই পথ যে যে অঞ্চল দিয়ে যাচ্ছে সেগুলোও নিতে হবে। লয়েড আরো বলেন, দার্জিলিং যদি হাতে আসে, রাস্তা বানানোর জন্য একজন ইঞ্জিনিয়ার অফিসার লাগবে, তা ছাড়া স্যাপার ও মাইনারদের একটা দল(বিভিন্ন উপনিবেশগুলোয় যুদ্ধবিগ্রহ সংক্রান্ত নির্মাণকাজ, যথা সাঁকো বাঁধা, দূর্গ তৈরি, রাস্তা ও সেনাছাউনি বানানো ইত্যাদি, যাঁরা করতেন তাঁদের স্যাপার বলা হত। ভারতে স্যাপারের সঙ্গে মাইনার শব্দটা জোড়া হয়)। 

লয়েড চাইছিলেন দুটো রাস্তা হোক, একটা খাড়াই, যেখান দিয়ে ঘোড়া, হাতি, গরুমোষ যেতে পারবে, মানুষ তো বটেই। দ্বিতীয় পথ আস্তে আস্তে উঠবে, সেটা দিয়ে চাকাওলা গাড়ি যাবে। রাস্তা হয়ে গেলে পরের কাজ বাজার বসানো, লয়েডের মনে হয়েছিল ওই অঞ্চলে প্রচুর 'বানিয়া' আছে, একটু উৎসাহ দিলেই তারা ওখানে গিয়ে দোকান খুলে বসতে পারে। ইউরোপীয় ব্যবসায়ীরাও আসতে পারে, অসুবিধার কিছু নেই। 

বাড়িঘর বিষয়ে লয়েড জানান, যদিও রাজা অসুস্থদের জন্য বাড়ি বানিয়ে দিতে রাজি হয়েছেন, কলকাতা থেকে স্থপতিদের ডাকা উচিত, যাঁরা জমি ইজারা নিয়ে ইউরোপীয়দের থাকার যোগ্য ঘরবাড়ি বানিয়ে লাভজনক ব্যবসাবাণিজ্য করতে পারবেন। কলকাতার অনেক বাসিন্দা খদ্দের হতে রাজি হয়ে যাবেন। শুরুর দিকে, স্বাস্থ্যাবাসের অঙ্গ হিসেবে, সরকার অন্তত গুটি কয়েক বাংলো বানাতেই পারে, যেখানে সরকারি অফিসারেরা থাকবেন। 

চিঠির শেষে লয়েড বলছেন এই সব কাজে লেপচাদের সাহায্য লাগবেই। 'নেপালে যে সব লেপচা উদ্বাস্তুরা আছে, তারা নিজেদের দেশে ফিরে আসতেই পারে।... শুধু নিশ্চিত করা দরকার যাতে রাজা তাঁদের কোনোভাবে না ঘাঁটান।'

এতক্ষণের বৃত্তান্ত থেকে দুটো-তিনটে জিনিস দিব্যি বোঝা যাচ্ছে। এক, সেসময়ের কোম্পানিকর্তারা(এবং পিন) লয়েডকে পরের গন্ডগোলের জন্য দোষী ঠাউরেছেন। অথচ, দেখাই যাচ্ছে, কিঞ্চিৎ দেরিতে হলেও, লয়েড যা বলার বলেছেন। ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে কোম্পানির লোকজন সেসময় স্থানীয় রাজত্বগুলো নির্বিচারে নিয়মিত গিলছে। জমি নেওয়া মানে কী, নতুন বসতি স্থাপন করতে গেলে কী করতে হয় এসব কলকাতার কর্তারা জানতেন না, ভাবতে কষ্ট হয়। দুই, লয়েডের সঙ্গে অনটু নিবাসী বিদ্রোহী কোটাপাদের যোগাযোগ ছিলই। সম্ভবত তিনি তাদের দার্জিলিং প্রত্যাবর্তন বিষয়ে কিছু আশ্বাস দিয়েছিলেন। শুধু পুরোনো দার্জিলিং গ্রাম নিলে উদ্বাস্তু ফেরানো সম্ভব নয়, আশপাশের জমিও দরকার। ফলে, লয়েড যে প্রস্তাব দেন তাতে পূব-পশ্চিম-উত্তর-দক্ষিণে নির্দিষ্ট সীমানাবদ্ধ অনেক বড়ো একটা এলাকার কথা বলা ছিল। পরে তিনি বলছেন এলাকাটা উত্তর-দক্ষিণে ৩০ মাইল লম্বা আর ৬ থেকে ১০ মাইল চওড়া। দুটো রাস্তা বানানোর জন্যও এত জমি যে লাগতে পারে না, বোঝাই যায়। 

রাজার অনুরোধ কোম্পানি প্রত্যাখ্যান করে। ডাবগং নিয়ে বলা হয়, সেটা প্রথমত উর্বর জনবহুল এলাকা, দ্বিতীয়ত ১৮২৮ নাগাদই সেটা জলপাইগুড়ি রাজাকে বন্দোবস্ত করা হয়ে গেছে। দার্জিলিংটা একটা জনমানবহীন বুনো জায়গা, ওইরকম কোন একটা জায়গা রাজাকে দেওয়ার কথা ভাবা যেতে পারে। ডাবগং দেবার প্রশ্নই আসে না। বাকি থাকলো রাম্মু পরধানের কথা, সে ফেরার, তাকে ধরা এবং মোরাং-এর বকেয়া খাজনা আদায় সম্ভব নয়। পিন বলছেন, রাম্মুকে না ধরার ব্যাপারটা কোম্পানির নীতি অনুযায়ী, সিকিমের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলাতে কোম্পানি চাইত না। পিনের মত এক্ষেত্রেও যুক্তিগ্রাহ্য নয়। আগামী পনেরো বছরের মধ্যে, অর্থাৎ ১৮৩৫ থেকে ১৮৫০-এর ভিতর, সিকিমের প্রায় অর্ধেক কোম্পানির সরাসরি কব্জায় চলে যাবে, বাকিটার ওপরেও সিকিম রাজার কার্যত কোনো কতৃত্ব থাকবে না। ১৮৪৬-এর পর থেকে কিছু গন্ডগোল এদিক ওদিক হয়েছিল বটে, তবে সেটা এত মারাত্মক না যে তার জন্য নীতি বদলে যাবে। 'নীতি' বলতে কিছু ছিল কি?

১৮৩৫-এ সিকিমপতি রাজা ও ব্রিটিশ কোম্পানিসরকারের আলোচনা শুরু হচ্ছে। রাজা শিবির ফেলেছেন তিস্তার পুব তীরে। লয়েড যাচ্ছেন তিতলিয়া থেকে, অর্থাৎ তরাই-মোরাং-এর বন ঘাসজঙ্গল ধরে পাহাড়ের দিকে। তিস্তার পূর্ব তীর তখন ভূটান দেশের অংশ, সেখানে সিকিম রাজার শিবির ফেলার কথা নয়। সেভক থেকে পাহাড়ি গিরিখাত শুরু হয়ে যাচ্ছে, নদীর পুবদিকে সেখানে নিশ্ছিদ্র বনে ঢাকা খাড়া পাহাড়, শিবির ফেলবার জায়গা নেই। নদী চওড়া হচ্ছে অনেকটা উজানে গিয়ে, এখন যে জায়গাটাকে তারখোলা বলে, যেখান থেকে লাল-কমলা রাবারের ভেলা ট্যুরিস্টদের নিয়ে নদীতে নামে সেইখানে। তারখোলার পরেও এরকম জায়গা একাধিক, কিন্তু আরো উজানে। 

১৮৩৫-এ তিতলিয়া কিম্বা সেভক থেকে সেখানে পৌঁছোনো চাট্টিখানি কথা ছিল না। মহানন্দা-সেভকের গহন বন, যেখানে বাঘ হাতি ভাল্লুক তো ছিলই, গণ্ডার আর বুনো মহিষও। তিস্তার পারে পারে গিয়ে পাহাড় চড়ছেন এমন কোনো ইউরোপীয় বৃত্তান্তের সন্ধান আমার অন্তত জানা নেই। ১৮২৮-এর পর থেকে যে সায়েবরা রাজকাজে বা বেড়াতে সিকিম গিয়েছেন, তাঁরা সবাই তিস্তায় নেমেছেন দার্জিলিং-এর দিক থেকে। সম্ভবত রঙ্গীত পেরিয়েও কেউ কেউ গিয়ে থাকতে পারেন। ফলে সেভক থেকে তারখোলা(যদি রাজা-লয়েড সাক্ষাত সেখানে হয়ে থাকে) এই পুরো পথটা কেমন ছিল, আদৌ পথ ছিলো কিনা, জানা সম্ভব নয়। 

ভাবছিলাম। গভীর বন কেটে পথ করে লয়েডের কুলিবাহিনী এবং বাঙালি মুন্সির দল এগুচ্ছে, অথবা খরস্রোতা তিস্তার পাড়ে পড়ে থাকা বড় বড় পিছল পাথর পেরিয়ে। পাহাড়ের গায়ে, নদীর পাড়ের পাথরে আর গাছের গায়ে শ্যাওলা আর মসের পুরু আস্তরণ। লয়েড সঙ্গে করে হয় টিনের বিলিতি খাবার কিছু নিয়ে গেছেন, বন থেকে হরিণ শুয়োর শিকার করা হচ্ছে, নিদেন পাখি, নদী থেকে মাছ। ওপরপাহাড় থেকে সিকিম রাজা তিস্তার ভাঁটিতে নামছেন, তাঁর সঙ্গে মন্ত্রীসান্ত্রী দেওয়ানভকিল। বনের মধ্যে, পাহাড়ের খাঁজে, মেচ আর লেপচা জুমিয়াদের অস্থায়ী ডেরা, চাষ। সেখান থেকে ধোঁয়া উড়ছে। 

তিস্তার এপারে, পুবতীরে, সামন্তসময় ও কৌম জুমিয়াসময়। প্রাচীন ও 'রহস্যময়' প্রাচ্য। ওপারে পশ্চিমতীরে, প্রবল পরাক্রান্ত সায়েবসময়। পুঁজির সময়, 'আধুনিক' ও 'বৈজ্ঞানিক' প্রতীচ্য। লয়েড আর রাজার কথাবার্তা আসলে এই দুই আলাদা সময়ের সংলাপ। মাঝখানে রঙ-ন্যিয়ো বা তিস্তা, যে দুইসময়েরই, বা, কোন সময়ের নয়। লয়েড বাঁশের ভেলায় নদী পেরিয়ে ওপারে যাবেন, দরবার বসবে। দার্জিলিং নিয়ে কথা হবে। কূটনীতি হবে। তারপর, এক সময় অন্য সময়ে মিশে যাবে, অন্য সময় এই সময়কে গিলে খাবে। লয়েড ফিরে যাবেন, অন্য সায়েবরা আসবেন। নদী সব দেখবে, দেখতেই থাকবে। শেষে একদিন নদীটাও থাকবে না।

Powered by Froala Editor