গল্পের শিল্পীরা

মানিকলমকারি - ২৪
আগের পর্বে

১৯০১ সালে ভারতী পত্রিকায় ‘নষ্টনীড়’ প্রকাশিত হয়েছিল ধারাবাহিক উপন্যাস হিসাবেই। তবে পরে গল্পগুচ্ছে স্থান পায় লেখাটি। সম্ভবত আত্মজীবনীমূলক উপাদান বেশি থাকার কারণেই স্বল্প সংখ্যক উপন্যাসের তালিকা থেকে গল্পের ভিড়ে ঠেলে দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথ লেখায় সময়কাল নির্দিষ্ট না থাকলেও সত্যজিৎ সিনেমায় সেই সময় নির্দিষ্ট করলেন। ১৮৭৯ সালের ৮ এপ্রিল থেকে শুরু কাহিনি। সমস্ত সংলাপ এগিয়েছে সময়কে মাথায় রেখেই। তবুও একটা ভুল করলেন সত্যজিৎ। প্রথম দিনেই আনন্দমঠ থেকে কবিতা আবৃত্তি করতে করতে ঢুকল অমল। কিন্তু আনন্দমঠ প্রকাশ পায় ১৮৮১ সালে। সিনেমায় দেখা যায় অমলের বয়স ২৩ এবং ভূপতির ৩৫। এখানে মনে পড়ে যায় ১৮৮৪ সালে কাদম্বরী দেবীর মৃত্যুর সময় রবীন্দ্রনাথের বয়স ছিল ২৩ এবং জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ৩৫।

এটা বেশ মজার ব্যাপার যে, সত্যজিতের গল্পে ফিরে ফিরে আসে নানা রকম চিত্রশিল্পীর কথা। কেউ রীতিমতো পেশাদার শিল্পী, কেউ আবার অলংকরণ শিল্পী, কেউ ফরমায়েসি শিল্পী, কেউ প্রতিকৃতির কাজে দক্ষ আবার কেউ কেউ নিজে শিল্পী না হলেও, শিল্পের কদরদার বা শিল্পের মনোযোগী সংগ্রাহী। এই সংগ্রাহীরা নিজেদের শিল্প সংগ্রহের সামান্য মাত্রাভেদে কেউ আবার হয়ে যেতে পারে দুষ্টু লোক। আমরা সেই ভেদের কাহিনিতে পরে কখনো যাবো, এখন বরং হোক এই আঁকিয়ে শিল্পীদের কথা। 

সত্যজিতের প্রথম লেখা দুটি ইংরাজি গল্পই দুই চিত্রশিল্পীর কাহিনি। 'পুরস্কার' আর 'বর্ণান্ধ' এই দুই বাংলা শিরোনাম-ধৃত গল্পের মূল নাম ছিল, 'অ্যাবস্ট্রাকশন' আর 'শেডস অফ গ্রে'। ১৯৪১-এ যখন সত্যজিৎ এই গল্প দুটি লিখছেন তখন তিনি নিজেই কলাভবনের এক নবীন শিক্ষার্থী। এই দুটি গল্পের ভেতরেই যেন নিজের অজান্তে নিজের শিল্পভাবনার কিছু কথা বলেছেন তিনি। সকলেই জানেন, সেই অর্থে পুরোপুরি নির্বস্তুকের শিল্পচর্চায় সত্যজিৎ কখনো ততখানি আগ্রহী নন। এই দুই গল্পেও তাই কি তিনি লেখেন, "শিল্পের ব্যাপারে যদি তার কোনো ব্যক্তিগত পছন্দ অপছন্দ থেকেই থাকে, তো বলব যে, সে রিয়ালিজম বা বাস্তবতার অনুরাগী। যা বাস্তব, তার সঙ্গে সে একেবারে আঠার মতো সেঁটে থাকে। প্রকৃতিকে ভেঙেচুরে বিকৃত করে দেখানোই তো আধুনিক শিল্পের রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে, কিন্তু তার সৌন্দর্যবোধ তাতে পীড়িত হয়। শিল্পে যা সুররিয়ালিজম বা অধিবাস্তববাদ বলে যা চলছে, তা তার ভীতি উদ্রেক করে।। তাছাড়া রেখা আর আকৃতি নিয়ে ওই যে সব পাগলামির খেলা, যার নাম দেওয়া হয়েছে 'অ্যাবস্ট্রাকশন' বা বিমূর্ত শিল্প, ওটা তার মনে আদৌ কোনো সাড়া জাগায় না।" উদ্ধৃতি কিছু দীর্ঘ হল, কিন্তু সমকালীন অনেক ধরনের ছবি সম্পর্কে ওই গল্পের শিল্পী চরিত্রটির ভাবনাগুলো বেশ স্পষ্ট। নন্দলাল বসুর ছাত্র, সত্যজিতের শিল্পভাবনার সঙ্গে এই ভাবনার সাদৃশ্য আছে। 

দ্বিতীয় গল্পের মধ্যেও আছে, আরেক ধরনের শিল্পভাবনার কথা। সেখানে তিনি গল্প-কথকের মুখে তার এক শিল্পী-বন্ধু সম্পর্কে বলালেন, "একালের তাবৎ প্রগতিশীল তরুণ বুদ্ধিজীবীর মতো সেও ছিল বামপন্থী--- আর শিল্পের ক্ষেত্রে বামপন্থী হওয়ার যে পরিণাম, তার বেলাতেও তার কোনো ব্যতিক্রম হয়নি। এখানে তখন আয়েসি রক্ষণশীলরাই তো দলে ভারি, তাদের কাছে সে একেবারে অচ্ছুত হয়ে গেল।" 

গল্পের নাম: সহদেববাবুর পোর্ট্রেট

 

আরও পড়ুন
চারুলতার সময় কথা

এ যেমন একদিক ঠিক তেমনি অন্য একটা দিকও আছে। 'সহদেববাবুর পোর্ট্রেট' গল্পের সহদেববাবু নিজের ছবি আঁকার জন্য পোর্ট্রেট-শিল্পী বাছতে গিয়ে অদ্ভুত একটা ভাবনা ভাবেন। যে-ছেলেটি তাঁর প্রতিকৃতি আঁকতে আসে, তার নাম ছিল কল্লোল দাশগুপ্ত। "গভর্নমেন্ট কলেজ অফ আর্টস থেকে পাশ করে রোজগারের চেষ্টা করছে। ছাত্র ভালো ছিল, তার প্রমাণ রয়েছে সার্টিফিকেটে।" তবু এই ছেলেটিকে দিয়ে তিনি নিজের ছবি আঁকালেন না, কারণ, "যার চেহারা এত অপরিষ্কার তার ছবির হাত পরিষ্কার হবে কী করে?" ফলে পরে তথাকথিত "ভদ্র চেহারাসম্পন্ন আর্টিস্টকে ডেকে" তিনি দুদিন সিটিং-ও দিলেন। কিন্তু ছবি তো যথাযথ হল না। এই গল্পটা এক অদ্ভুত কাহিনি, যেখানে আঁকা ছবির সঙ্গে নিজেকে মেলাতে থাকেন সহদেববাবু। এমন আরেক পোর্ট্রেট শিল্পী গগন চৌধুরী। তিনি সারা রাত ছবি আঁকেন আর তাঁর কাছে সিটিং দিতে আসে যারা কোনো না কোনোভাবে মৃত। 

আরো পরে সত্যজিতের কলমে লেখা হল আবার এক চিত্রশিল্পীর গল্প। শিল্পীর নাম সুখময় সেন। তিনিও পোর্ট্রেট আঁকিয়ে। তাঁর কাছে গণেশ মুৎসুদ্দি আনেন এক আশ্চর্য অফার। ছবি আঁকার পঁচিশ বছর পরে কেমন দেখতে হবে গণেশকে, সেই ছবি আঁকতে হবে সুখময়কে। সুখময় সেই ছবি আঁকে, কিন্তু সে ছবির কথা ওই গল্পের পাঠক জেনে নেবেন, আমরা দেখি, সম্পন্ন শিল্পী সুখময় কীভাবে এই পঁচিশ বছরে ধীরে ধীরে প্রায় নিঃসঙ্গ আর নিঃস্ব হয় তার কথা। বহুদিন ধরে এক ধরনের প্রতিকৃতি আঁকতে আঁকতে ক্লান্ত সুখময় বদলে ফেলে নিজের ছবি। ফল হিসেবে তার সেই নতুন ছবি আর সেভাবে বিক্রিই হল না। শেষ পর্যন্ত সুখময়কে গ্রাসাচ্ছাদনের কথা ভেবে আঁকতে হল শুধু সিনেমার হোর্ডিং আর বড়ো বড়ো ব্যানার। এক প্রতিকৃতি শিল্পীর জীবনে এ এক বিরাট পরিবর্তন। সুখময়ের মনে হয়, বিরাট বিরাট সেই বিজ্ঞাপনের ছবি সে আঁকে শিল্পীর মন নিয়ে কিন্তু লোকে সেখানে নায়ক নায়িকার মুখ দেখে, কেউ খোঁজ করে না কে এঁকেছে সেই ছবি। এই বেদনাই আরেকভাবে সত্যজিৎ দেখেছেন এখানকার অলংকরণশিল্পীর জীবনে। মনে পড়বে, 'মানপত্র' গল্পটির কথা। সকলেই দেখে বইতে যে ছবি ছাপা হয় তা, কিন্তু কেউ তো জানতে চায় না কে আঁকলেন সেই ছবি। এমনকি, কবে সেই অলংকরণ শিল্পী বেঁচে আছেন আর কবে তিনি মারা গেলেন, সেই খবরটিও রাখেনি সমকাল, সে খবরে আগ্রহী নয় উত্তরকাল। 

আরও পড়ুন
চারুলতার খেরোর খাতা-৩

গল্পের নাম: গণেশ মুৎসুদ্দির পোর্ট্রেট

 

এই গল্পগুলি লেখার সময় সত্যজিৎ আমাদের কাছে উপস্থিত করেন শিল্পের এক উপেক্ষিত প্রান্ত। আমাদের সামনে প্রচলিত শিল্পের সঙ্গে নিয়ে আসেন ব্যবহারিক বা অ্যাপ্লায়েড আর্টের শিল্পীর কথাও। 

আরও পড়ুন
চারুলতার খেরোর খাতা-২

মনে পড়বেই, সত্যজিৎ নিজেও কিন্তু ছিলেন এক যশস্বী ব্যবহারিক চিত্রশিল্পী। তিনি শান্তিনিকেতন গেছিলেন সেই প্রয়োগ শিল্প শিক্ষার চর্চায়। তিনি সত্যজিৎ রায় বলেই তাঁর তৈরি ছবির পোস্টার, তাঁর করা অলংকরণ উত্তর কাল সন্ধান করেছে। খুঁজে দেখেছে তাঁর আঁকা কত না হারিয়ে যাওয়া ভিস্যুয়াল। তিনি জানতেন, সেই সন্ধান সকলকে নিয়ে তো হবে না। এই উপেক্ষিত শিল্পীদের কি তাই তিনি বেঁধে রাখলেন তাঁর লেখা শিল্পীর গল্পে?

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
চারুলতার খেরোর খাতা