বিজ্ঞাপনি কলমকারি

মানিকলমকারি – ১৭

আগের পর্বে

সত্যজিতের ছোটগল্পের মতো জটিলতা নেই রূপকথার গল্পগুলিতে। সহজ সরল মানুষের জীবনের আখ্যান এগুলি। ছোটোগল্পে নারীচরিত্র বেশি না থাকলেও রূপকথার গল্পে বারবার ফিরে এসেছে নারী চরিত্র। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা রাজকন্যা। চিরাচরিত রীতি মেনে আছে মিলনের কাহিনিও। আবার মাঝে মাঝে তা নতুন রূপ নিয়েছে। ‘সুজন হরবোলা’-র গল্পে নায়িকা নিজেই অভিসারিণী। রূপকথার গল্পে আছে সর্বশক্তিমান জ্যোতিষীদের কথাও। আবার সমসাময়িক পরিস্থিতিকেও সুন্দর ভঙ্গিতে তুলে ধরেছেন সেখানে। প্রজাপালন, যুদ্ধবিগ্রহ থেকে ধর্মীয় আচ্ছন্নতা, উঠে এসেছে সবই। রূপকথার গল্পের আড়ালে অন্য গল্প বলিয়ে নেওয়াই তাঁর বিশেষ ধরন।

সত্যজিৎ-ফ্যানক্লাবের জন্য এবারের পুজোর সময় সবচেয়ে বড়ো দুটো উপহারের একটি হল তাঁর লেখা কিছু চিঠি আর দুই হল তাঁর না-করা একটি বিজ্ঞাপনের খসড়া। প্রকাশিত হয়েছে সন্দেশ পত্রিকায়। সংগ্রহ করে আমাদের জন্য উপহার দিয়েছেন সন্দীপ রায়। তাঁকে ধন্যবাদ দিয়েই তাই আজকের কলমকারির শুরু।

‘সীমাবদ্ধ’-র জন্য সেই ১৯৭১-এ চলচ্চিত্র বিজ্ঞাপন তৈরি করেছিলেন সত্যজিৎ। ছবিতে পিটার পাখার বিজ্ঞাপন সিনেমাতে হাজির হয় সাদা-কালোর ভেতর হঠাৎ রঙিন হয়ে। প্রচণ্ড গরমের মধ্যে লেখা HOT, সেই গরম থেকে রক্ষা করতে হাজির হল নতুন শব্দ COOL। ‘হট’ শব্দের ও লেটারটি ভাগ হয়ে দুটি ‘ও’ হয়ে যায়। দমচাপা আইঢাই ব্যাপারটা যেন ছবিতে একটু এলিয়ে রিল্যাক্সড হয়ে যায়। পর্দাতে হাজির হল পিটার্স ফ্যানের লোগো। ভাবা যায় কি, ছবির শুরুতে একবার নিয়ন আলোয় দেখা গেল পিটার পাখার নাম, তারপরে পাখার কারখানাতে যখন তৈরি হচ্ছে পাখা, সেই সময়ে তার ঢাকনাতে এক ঝলক দেখা যায় পিটার পাখার নাম, আর প্রিন্ট অ্যাডে আর ওই মুভি বিজ্ঞাপনে দেখা যায় পিটার্স ফ্যানের লোগো। এই একটি লোগো বানাবার জন্য, সত্যজিৎ তাঁর চিত্রনাট্য লেখার খসড়া খাতায় অন্তত বারো রকম লোগোর ডিজাইন করেছিলেন। আর বলা বাহুল্য, প্রতিটি লোগোই কী অসামান্য। কতখানি যত্ন নিয়ে করা তা!

 

বিজ্ঞাপনের শিল্পী হিসেবেই তো সত্যজিতের কাজের জগতের সূচনা। সেই জগতের শিল্পী হয়ে যে সব অসামান্য কাজ তিনি করেছেন, তা ঠিক লেখার কলমকারি না হলেও, আঁকার কলমকারি তো বটেই, ফলে কোনো এক কমলকারিতে তা নিয়ে জম্পেশ আড্ডা দেওয়া যাবে, একেবারে ছবি-টবিসুদ্ধু। সত্যজিতের জীবনী সম্পর্কে যাঁরা ওয়াকিফহাল আর যাঁরা পড়েছেন বিজয়া রায়ের লেখা ‘আমাদের কথা’, তাঁরা জানেন, সত্যজিৎ রায়কে বিজ্ঞাপনের মডেল হিসেবে ব্যবহার করে একবার একটি বিজ্ঞাপনের কাজ অনেকটাই এগিয়েছিল। সালটি ছিল ১৯৮৮। এই বছরের গোড়ায় সত্যজিৎ রায় আর বিজয়া রায়কে একসঙ্গে নিয়ে ক্ল্যারিয়ন থেকে বিখ্যাত একটি চা কোম্পানি, স্থির করে একটি বিজ্ঞাপন তৈরি করবে। সেই কথামতো সত্যজিৎ আর বিজয়া রায়কে নিয়ে যাওয়া হল কাঠমাণ্ডু। জায়গাটিও পছন্দ করলেন সত্যজিৎ স্বয়ং। বাঙালির অন্যতম শ্রেষ্ঠ দম্পতির হাতে চায়ের পেয়ালা রেখে তাঁদের ছবি তুললেন নিমাই ঘোষ।

আরও পড়ুন
কানাই, রতন, গঙ্গারাম আর সুজনের গপপো

 

কিন্তু বাবার এতে সম্মানহানি হবে ভেবে এই প্রকল্প থেকে সরে আসতে বললেন পুত্র সন্দীপ। বিজয়া রাজি ছিলেন, মায়ের অনুরোধে বাবাও রাজি হয়েছিলেন। তবু ছেলে রাজি নয় তার ইঙ্গিতমাত্র পেয়ে পিতা সত্যজিৎ বললেন, ‘বাবুর যে এতটা আপত্তি আমি বুঝতে পারিনি। কোনোদিন টাকা নিয়ে মাথা ঘামাইনি। আর এখন টাকার জন্য বিজ্ঞাপনে মুখ দেখাব?’ বিজয়াকে বলে, শুধু সেই বিজ্ঞাপনের কাজটি বন্ধ করলেন না, বললেন, কাঠমাণ্ডু যাওয়া-থাকা-আসার সমস্ত টাকাও ওই কোম্পানিকে ফেরত দিতে। সেই চা-কোম্পানি এরপরেও চেষ্টা করেছিল, কিন্তু সত্যজিতের সেই না আর হ্যাঁ হয়নি।

আরও পড়ুন
শুখনাই, তাই সুখ নাই

 

তবে সত্যজিতের জীবনের একেবারে শেষ পর্যায়ে, ১৯৯০ সালে, আরেকটি বিজ্ঞাপনের জন্য প্রস্তাব এল তাঁর কাছে। এবারে কাজ শুরু হল। বিজ্ঞাপনের বয়ান আর চিত্রনাট্য তৈরি করলেন সত্যজিৎ। ঠিক হল শুটিং করবেন সন্দীপ। পণ্যের নাম হল পেপসি। সারা ভারত জুড়ে তাদের প্রথম আগমন বার্তা ছড়িয়ে দিতে যে বিজ্ঞাপনের পরিকল্পনা করা হয়েছিল, বাংলায় সেই বিজ্ঞাপন তৈরির জন্য পেপসি-র কর্তার হাজির হয়েছিলেন বিশপ লেফ্রয় রোডের বাড়িতে। ঠিক হল বিজ্ঞাপনটির ভাবনা, চিত্রনাট্য, সংগীত তৈরি করবেন সত্যজিৎ আর তা পরিচালনা করবেন সন্দীপ। আর কী অদ্ভুত, সেই বিজ্ঞাপনে পেপসির মডেল হবে কি না বাঙালির চিরকালীন আইকন গুপী গাইন বাঘা বাইন। সবে তখন তৈরি হয়েছে ‘গুপী বাঘা ফিরে এলো’। সেই গুপী বাঘা তপেন চট্টোপাধ্যায় আর রবি ঘোষ-ই অভিনয় করবেন। তারাই ডাক দেবে পেপসি পানের!

আরও পড়ুন
অতিথি যখন আগন্তুক

 

সত্যজিৎ দুটি বিজ্ঞাপনের চিত্রনাট্য তৈরি করে দিলেন। এই দুটি চিত্রনাট্যই এবারের ‘সন্দেশ’-এর পুজো সংখ্যায় প্রকাশ করেছেন সন্দীপ রায়। ফলে বুঝতেই পারছেন এর গুরুত্ব কী সাংঘাতিক। কী ছিল সেই বিজ্ঞাপন-জুটিতে? দুটি মুহূর্তের একটি তিনি নিলেন ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ থেকে অন্যটি ‘হীরক রাজার দেশে’ থেকে। একটি হল হাল্লার রাজার শুন্ডি অভিযানের মুহূর্ত অন্যটি ‘হীরক রাজার দেশে’-র প্রথম দৃশ্য।   

আরও পড়ুন
সই আর সত্যজিৎ

প্রথম বিজ্ঞাপনে দেখা যায়, রঙিন নয়, সাদা কালো পর্দা। সেনাপতি হাঁক দেয়, ‘শুন্ডি চলো’। তার আগে দেখতে পাওয়া যায় রাজস্থানের প্রচণ্ড গরমে গলদঘর্ম হয়ে যুদ্ধযাত্রার জন্য তৈরি হয়েছে সেই সেনাপতি আর তার উটে-চড়া সেনার দল। প্রচণ্ড ঘামে ঘামতে ঘামতে এগিয়ে চলে সেনাবাহিনী। হঠাৎ ভেসে আসে ঢোলের শব্দ। শুরু হয় গুপীর গান। গুপীর গানটি কী রকম? পুরো গানটি না লিখে পারা যাবে না! তাই পুরোটাই লিখে দিলাম। গুপী গেয়ে ওঠে,

 

আরও পড়ুন
বিরিঞ্চিবাবা আর ভবানন্দের চ্যালাদের বদল-বৃত্তান্ত

‘ওরে বাবা দ্যাখো চেয়ে কত সেনা চলেছে গরমে।
গলা যে শুকিয়ে কাঠ, সকলেই মরেছে মরমে---
গরমে, মরমে, গরমে---
কিছু তো করিতে হয় এতো আর নাহি সয়।|
সেনা দেখে লাগে ভয়, লাগে ভয়, লাগে ভয়!
ঘেমে নেয়ে তাপে গেছে দমে--- দমে
যত ব্যটা চলেছে গরমে।’

এরপর সেই ‘আয় আয় আয় রে আয়, আয় রে মিঠাই হাঁড়ি হাঁড়ি’-র সুরে শোনা যায়,

আরও পড়ুন
মানিক বন্দ্যোর গল্প থেকে মানিকবাবুর না-হওয়া ছবি

‘আয় আয় আয় রে আয়
আয় রে আয়, আয় রে আয়
ঠান্ডা পানি, পানির বোতল,
যা খেয়ে ভাই গরম কোতল
গরম কোতল, ঠান্ডা শীতল, পানির বোতল, ও রে---’

 

আরও পড়ুন
সত্যজিতের চিত্রনাট্যের কর্মশালা

লিখে রেখেছেন সত্যজিৎ, এরপরেই সাদা কালো পর্দা রঙিন হয়ে ওঠে। ধূসর পর্দা হয়ে যায় উজ্জ্বল নীল। আকাশ থেকে নেমে আসে একের পর এক পেপসির বোতল। তাই নিয়ে সেনাবাহিনীতে এক হুলস্থুল কাণ্ড। তার ভেতর থেকে খপ করে দুটি বোতল হাতে নিয়ে গুপী আর বাঘা তৃপ্তি করে পান করে পেপসি। গুপী আনন্দ সামলাতে না-পেরে বলে ওঠে, ‘বাঘাদা, জবর!’ আর বাঘা তার স্বভাবোচিত গাম্ভীর্যে বলে, ‘হুম্--- চলবে।’  

দ্বিতীয় বিজ্ঞাপনটিতে দেখা যাবে, শুন্ডির রাজপ্রাসাদে গুপী-বাঘার ঘর। তারা কথা বলছে ছন্দে ছন্দে। এখানে দুটি দৃশ্য। প্রথম দৃশ্যে শোনা যায়, বহুদিন ঘরে বন্দি থেকে থেকে ক্লান্ত হয়ে তারা একটা সুন্দর জায়গার কথা বলে, সেই জায়গার সন্ধান দিয়েছেন খোদ শুন্ডি রাজা। সেই জায়গায় আছে ‘তৃষ্ণার জল--- টলমল।’ কিন্তু জায়গাটির নাম মনে পড়ছে না তাদের কিছুতেই। হঠাৎ সেই জায়গার নামটি বলে গুপী। জায়গার নাম নাকি ‘সিপেরু’। জাদু-জুতো পরে ‘সিপেরু’-র দিকে উড়ে যায় মানিকজোড়। এই উড়ে যাওয়ার পরের দৃশ্যের জন্য দুটি বিকল্প দৃশ্যের কথা ভেবেছিলেন সত্যজিৎ। একটি এক বনে গিয়ে হাজির হয় তারা, সেখানে আসে এক বাঘ। গুপী বলে ‘জা--- জায়গা ভুল’। বাঘা তার উত্তরে বলে, ‘তুৎ--- তুমি একটা--- তুমি একটা ঝুল!’ বিকল্প ভাবনাতে তারা হাজির হল গরম মরুভূমিতে। গুপী বলে, ‘এ যে মরু!’ বাঘা সেখানে তার সঙ্গে মিলিয়ে উত্তরে বলে, ‘তুমি, তুমি একটা গরু।’ এরপরে ‘এখানে মিটেব পিপাসা! পিপাসা।’ ছবিতে ‘ঠিক শুনেছি ঠিক শুনেছি’ বলতে বলতে তাদের মনে পড়েছিল ‘শুন্ডি’-র নাম এখানে ‘পিপাসা’-র সঙ্গে মিলিয়ে তাদের একসঙ্গে মনে পড়ল ‘পেপসি’ শব্দটা। এরপরে তারা হাজির হল পেপসি-র ভর্তি ভর্তি বোতলের সামনে, সেই বোতলের ছিপি খুলতেই দেখা গেল, পেপসির দেশ কাকে বলে! মনপ্রাণ জুড়িয়ে গেল তাদের।

আরও পড়ুন
সত্যজিতের বইতে ‘এ কাহাদের কণ্ঠস্বর?’

তপেন চট্টোপাধ্যায়- রবি ঘোষের সঙ্গে কথা পাকা, অনুপ ঘোষালের সঙ্গে গানের কথাও হল। ঠিক হয়েছিল, কলকাতার স্টুডিও, উত্তরবঙ্গের সুখনার জঙ্গল আর জয়শলমিরে হবে শুটিং। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই বিজ্ঞাপন আর তৈরি হয়নি। সত্যজিৎ তখন ব্যস্ত হয়ে পড়লেন তাঁর ‘আগন্তুক’-এর কাজে। এই লকডাউনের সময় বিশপ লেফ্রয় রোডের বাড়িতে নানা কাগজের ফাঁকে হঠাৎই সেই চিত্রনাট্যের খসড়া থেকে সন্দীপ রায়ের করা কপিটি পাওয়া গেছে। লক ডাউনের অনেক বড়ো আবিষ্কারের মধ্যে এই আবিষ্কারটি একটা বড়ো খবর বলে, আর এটা একেবারে ‘কলমকারি’-তেই বন্দি বলে এখানে বলে রাখা গেল। ভাবছি, কলমকারি ছেড়ে ক্যামেরার কারিকুরিতেও যদি এটা পাওয়া যেত! একেবারে এক নতুন সত্যজিৎকে বুঝি পেতাম আমরা। পরে এই গুপী বাঘাকে ব্যবহার করে কত দুর্বল সব বিজ্ঞাপন দেখে দেখে ক্লান্ত আমরা, অথচ এটাই যদি পেতাম!

Powered by Froala Editor