সত্যজিতের বইতে ‘এ কাহাদের কণ্ঠস্বর?’

মানিকলমকারি – ৯

আগের পর্বে

সত্যজিতের গল্পে পুরনো দিনের বন্ধু ব্যাপারটা ফিরে এসেছে বারবার। সত্যজিতের গল্প সমফ্রে ‘নতুন বন্ধু’ এবং ‘সহযাত্রী’ গল্পদুটিও এই মোটিফেই নির্মিত। কিন্তু সমগ্র সম্পাদনের সময় সন্দীপ রায় লেখেন ‘নতুন বন্ধু’ গল্পটি। ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত হওয়ার দেড় বছর পর অন্যটি খসড়ার খাতায় লিখেছিলেন সত্যজিৎ। কিন্তু কোথাও প্রকাশিত করেননি তিনি। শুধু মোটিফটুকুই এক, দুটি গল্প কিন্তু দু’রকমের। তা সত্ত্বেও সততার কারণেই কোনো পত্রিকায় তা দেননি সত্যজিৎ রায়। কিন্তু কেন দ্বিতীয়বার লিখেছিলেন তিনি, তা অনুমান করা কঠিন বিষয়। 

মজার কথাটা হল, আজ যে লেখাটা নিয়ে কথা বলব মানিকলমকারিতে তার লেখক সত্যজিৎ নন। আরো মজার ব্যাপার হল, তাঁর লেখা নয়, তবু লোকে সাধারণভাবে, এটাকে তাঁর লেখা বলেই জানেন। এ যে ভারী অন্যায়। তাহলে মূল কথায় যাওয়া যাক।  

ঠিক কুড়ি বছর বয়স তখন সত্যজিতের। ১৯৪১-এর মে মাসে খবরের কাগজে প্রকাশিত হল তাঁর লেখা প্রথম গল্প। তারিখটা ১৮ মে ১৯৪১, কাগজের নাম অমৃতবাজার পত্রিকা। ইংরাজিতে লেখা তাঁর লেখা সেই প্রথম গল্পের নাম পত্রিকায় ছিল ‘অ্যাবস্ট্রাকশন’। মজা হল, এই গল্পটির নাম কী জানি কেন, তাঁর গল্প সংকলনে গেছে বদলে। ‘অ্যাবস্ট্রাকশন’ হয়েছে ‘পুরস্কার’। অদ্ভুতভাবে যে-অনুবাদ তাঁর নিজের করা নয়, সেই অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে তাঁর গল্প সংকলনের প্রথম গল্প হিসেবে। যাঁরা সেভাবে সত্যজিৎ রায়কে নিয়ে গবেষণা করছেন না, যাঁরা তাঁর এমনিই আগ্রহী আর সচেতন পাঠক, তাঁরা জানবেন, ‘পুরস্কার’ নামে একটি গল্প যেন লিখছিলেন তিনি। যেন তিনি লিখেছিলেন ‘বর্ণান্ধ’ নামেও একটি গল্প। আর এই দুটি গল্প দিয়েই শুরু হচ্ছে তাঁর গল্প সংকলন। ‘বর্ণান্ধ’ গল্পটির নাম ছিল ‘শেডস অফ গ্রে’! কী করে তার বঙ্গানুবাদ ‘বর্ণান্ধ’ হল--- তা-ই বা কে জানে!! গল্প দুটির প্রকাশ নিয়ে প্রকাশকের কৈফিয়তটিও বেশ নড়বড়ে! শুধু বলা হল, ১৪০২ বঙ্গাব্দে বা ১৯৯৫ সালের শারদীয় ‘দেশ’ পত্রিকায় গল্প দুটি প্রকাশিত হয়েছিল ‘শ্রীমতী বিজয়া রায়ের সৌজন্যে’। সত্যজিৎ চলে গেছেন ১৯৯২-তে। তাঁর প্রয়াণের বছর তিনেক বাদে তাঁর গল্প অনুবাদ করে বাংলায় প্রকাশ করার পক্ষে বা সেই লেখাটিকে তাঁর গল্প-সংকলনের একেবারে প্রথমে বসিয়ে দেওয়ার পক্ষে এটা একটা কোনো জোরদার কৈফিয়ত হল? কে অনুবাদ করলেন, সেই সামান্য তথ্যটুকু না দিয়ে, কেবল বুড়ি-ছোঁয়া-র মতো একবার ‘বিজয়া রায়ের সৌজন্যে’ বললে চলে কি? এই ধরনের একটি বাক্যে একটা ফাঁদ আছে, এই বাক্য থেকে যাঁরা গল্পটা পড়বেন, তাঁরা ভাবতেই পারেন, এই অনুবাদ বুঝি, বিশেষ কোনো অনুবাদকের উল্লেখ নেই যখন, তখন তা বুঝি লেখকেরই করা ছিল--- এতদিন প্রাপ্য ছিল না, তাঁর স্ত্রী-র সৌজন্যে প্রকাশক হাতে পেয়ে তা হাজির করছেন পাঠকের দরবারে। অনেকগুলো এমন লোভনীয় ফাঁদ পেতে পাঠককে বিভ্রান্ত করা সৎ প্রকাশকের কাজ নয়।

মুশকিল হল ওই ‘অ্যাবস্ট্রাকশন’ গল্পটি যাঁরা পড়ছেন, তাঁদের কাছে এই অনুবাদ নিয়ে কিছু প্রশ্ন অনিবার্য। এমনিতে বেশ তরতরে ভাষায় গড়গড় করে পড়ে-যাওয়ার মতো বাংলা হলেও, অনুবাদের একটি লেখা হিসেবে এটা নিয়ে কিছু প্রশ্ন উঠতেই পারে। আজকের ‘মানিকলমকারি’ তাই সত্যজিৎ রায়ের ইংরাজি কলমকারিতে কোনো এক বাঙালি অনুবাদকের খোদকারি-র গপপো। সেই খোদকারি, সুমুদ্রিত হয়ে বছরের পর বছর পাঠকের দরবারে ভুল বার্তা পাঠাচ্ছে। এটা ঠিক কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন তোলার অধিকার পাঠকের আছে, বই কী?

নামের কথা তো প্রথমেই বললাম। ‘অ্যাবস্ট্রাকশন’ গল্পটি যাঁরা পড়েছেন, তাঁরা জানেন, এই গল্পের নাম ‘অ্যাবস্ট্রাকশন’ হওয়াটাই সবচেয়ে যুক্তিযুক্ত। কোনোভাবেই তা ‘পুরস্কার’ হতে পারে না। তাতে গল্পের মজাটাই থাকে না! যে শিল্পীর মনে হয়, তিনি বাস্তবধর্মী ছবি আঁকতে পছন্দ করেন, যে শিল্পী মনেপ্রাণে ছবির ফর্ম ভেঙেচুরে ছবি আঁকাকে অপছন্দ করেন, সুররিয়ালিজম সম্পর্কে ‘He dreaded that thing called Surrealism’ সবচেয়ে অদ্ভুত তার পরের লাইনটি: ‘Abstractions, a term used for those fantastic combinations of lines and forms drawn with a lunatic incoherence’। যে- শিল্পী নিজে বিমূর্ত শিল্প সম্পর্কে এই ভাবনা মনে পোষণ করেন, তাঁর আঁকা একটা অত্যন্ত বাস্তববাদী ছবি কীভাবে সেই ‘বিমূর্ত শিল্প’ হিসেবেই বিরাট এক শিল্প প্রদর্শনীতে প্রথম পুরস্কার পেল, তারই কাহিনি এই গল্প। তাহলে, সহজেই বলা চলে, এইক্ষেত্রে অন্তত, ‘অ্যাবস্ট্রাকশন’-কে ‘পুরস্কার’ করা চলে না।

আরও পড়ুন
এক গল্পই দু-বার দু-ভাবে লিখলেন সত্যজিৎ

'পুরস্কার' গল্পে সুব্রত গঙ্গোপাধ্যায়ের অলংকরণ

 

এবার আসি ভেতরের কথায়। গল্পটা বলার ধরনেই, এখনকার আগ্রহী পাঠক লক্ষ না করে পারবেন না, একজন চিত্রনাট্যকারের গল্প-বলার ধরনটাই আছে। ঠিক। সেই ১৯৪১-এ গল্প লেখার ভাষাতে অদ্ভুতভাবে লক্ষণীয়, গল্প শুরু হয় সিনেমার ভাষায়। মূল গল্পে দেখি, চব্বিশ বছর বয়সী একজন রোগাপাতলা শিল্পীর কথা শুরু হচ্ছে এইভাবে: The story starts at a moment when a casual observer could see him sitting on three-legged chair in an attitude of utmost inertia. A half consumed cigarette hung precariously from his lips, and his hand held a book which seemed to absorb all his attention.’ লক্ষ করে দেখুন, পুরোপুরি একটা ছবির গল্প বলার ধরন। একটা ঘরে একজন রোগাপাতলা লোক একটা চেয়ারে বসে আছে, তার মুখে আধ-খাওয়া সিগারেট, তার বসার ধরন, তার হাতে ধরা বই--- সবটাই যেন একটা ছবির প্রথম দৃশ্য। ক্রমশ ওই ‘ক্যাজুয়াল অবজার্ভার’ এগিয়ে গেলে দেখতে পায়, লোকটির হাতে দ্রা বইটির দিকে সে তাকিয়ে নেই, সেটা সে পড়ছে না, কারণ, সেই বইটা উল্টো করে ধরা তার হাতে। এখান থেকে গল্পের শুরু। লক্ষ করে দেখুন, ধীরে ধীরে এই ‘ক্যাজুয়াল অবজার্ভার’ যেন ক্যামেরার দৃষ্টিকোণ, সে এগিয়ে যায় লোকটির দিকে, আস্তে আস্তে বোঝা যায়, তার হাতে ধরা বইটি উল্টো--- দর্শক কিছু অনুমান করেন, লোকটি সম্পর্কে ইত্যাদি। যাই হোক, এই অংশটি অনুবাদে কী হল? ইংরাজির ওই ‘ক্যাজুয়াল অবজার্ভার’কে ‘ক্যাজুয়ালি’ উধাও করে দিলেন অনুবাদক। ফলে মূল গল্পের প্রথমে ‘এ ক্যাজুয়াল অবজার্ভার কুড সি’ লেখার সূত্রে যখন পরে সত্যজিৎ লিখবেন, ‘বাট এ ক্লোজার ইন্সপেকশন বাই ওয়ান নট সো ক্যাজুয়াল’--- এই লাইনটার মজাটাই বেমালুম ভ্যানিশ হয়ে গেল গল্পের ভাষা থেকে। গল্পের অনুবাদ মানে তো শুধু মচমচে ভাষায় গপপো বলে যাওয়া নয়, যথাসম্ভব গল্পের ভাষাটাকেও অনুবাদক নিজের ভাষায় আনবেন--- সেই কাজটা কোথায় গেল? এরপরেই আরেক কাণ্ড! বাংলায় আছে, ‘এইভাবে বই পড়া যায় নাকি? কী ব্যাখ্যা এর? ব্যাখ্যা আর কিছুই নয়, লোকটি আদৌ পড়ছে না। এমনকী, বইয়ের দিকে চোখই নেই তার।’ সত্যজিতের ভাষার সঙ্গে যারা পরিচিত, কে-ই বা পরিচিত নয়, তাঁকে বলা বাহুল্য এই ধরনের বাক্য সত্যজিতীয় বাক্য নয়! তা দেখা যাক, মূলে কী লিখেছিলেন সত্যজিৎ? সেখানে ছিল, ‘This startlingly unusual way of perusing a novel is explained by the fact that he was not reading at all.’  ব্যস! এইটুকুই ছিল। সোজা কথায়, এর অনুবাদ হবে, ‘এমন অদ্ভুতভাবে অথচ মনোযোগ সহকারে উপন্যাস পড়া একমাত্র তখনই সম্ভব কেউ যদি আদৌ বইটা না পড়ে।’ এর অনুবাদে ‘এইভাবে বই পড়া যায় নাকি? কী ব্যাখ্যা এ্রর?’--- কোত্থেকে এলো? মূল গল্পে প্রদর্শনীর তারিখটি প্রথমেই দেওয়া ছিল--- থাকা দরকারও। কারণ, তাহলেই হাতে একদম সময় নেই, ফলে ছবিটি শেষ করতে হবে, এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি হয়। অনুবাদে মূল গল্পের তারিখটি, পনেরোই জানুয়ারি, প্রথমে উল্লিখিত নয়। এমনকি, সেই বিরাট প্রদর্শনীতে যে, মূল গল্পে নানা বিষয়ের আর নানা মাধ্যমের ছবির জন্য আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে, সেটাও অনুবাদে গরহাজির রইল। সেখানে ‘মিডিয়াম বা মাধ্যম ব্যবহারের ব্যাপারেও কোনো বাধানিষেধ নেই’ সে কথাটা আছে, কিন্তু মূল গল্পের ‘এ ওয়াইড রেঞ্জ অফ সাবজেক্টস’ আবার উধাও। গল্প-বলার ভাষায় একটা অন্য রকম মজা এনেছিলেন সত্যজিৎ। ওই শিল্পী বেশ আবেগতাড়িত হয়ে ভাবছেন, ‘দেয়ার ইজ্ অলওয়েজ্ দ্য পসিবলিটি দ্যাট দ্য ক্রিটিকস উড জাস্ট হ্যাপেন টু মেনশন ইয়োর নেম ইন দ্য রিভিউ কলামস’। এখানে অনুবাদের ধরনটা হবে, ‘হয়ত চিত্রসমালোচক তোমার নাম উল্লেখ করবেন’- জাতীয়। ওই মজার মধ্যম পুরুষ তুমি অনুবাদে হয়ে গেছে প্রথম পুরুষ। গল্প-বলার মজাটাই মাটি! শিল্পীটি মনে করে, ‘Those horrible distortions of Nature which seemed to be the essence of Modern Art enraged his aesthetic sense.’ অদ্ভুতভাবে, বাংলা অনুবাদে ওই ‘হরিবল ডিশটর্শন’ শুধু ‘ভেঙেচুরে বিকৃত করা’ হল। মানে ‘হরিবল’-এর হরিবোল! আর ‘এনরেজড’--- মানে যা তাকে রাগিয়ে দেয়, ক্ষিপ্ত করে, তা কি না হয়ে গেল ‘পীড়িত করে’! গল্পকার নিজে অনুবাদক না হলে অন্য কোনো অনুবাদকের এই স্বাধীনতা গ্রহণ করা কি তাঁর সীমানার মধ্যে পড়ে? তা কি উচিত? তার ওপরে এখানে দেখি ‘সুররিয়ালিজম’-কে বাংলা যিনি করেছেন তিনি, সেখানে তাকে করেছেন ‘স্যারিয়ালিজম’! এমন কোনো শিল্প আন্দোলনের কথা পৃথিবীর শিল্প ইতিহাসে আছে কি? এ যেমন প্রতিবর্ণীকরণের ভুল, তেমনই ইংরাজি ‘সমন্যামবুলিস্ট’-এর বাংলা ‘স্বপনচারিণী’ শুনে ঘাবড়ে যাই আমরা! যে ছিল আমার স্বপনচারিণী-র মানে যদি সমন্যামবুলিস্টের উদ্দেশে হয়, তাহলে রবীন্দ্রগানের ঘুম ছুটবে যে!

আরও পড়ুন
সত্যজিতের গল্পে 'জাদু'

'বর্ণান্ধ' গল্পে সুব্রত গঙ্গোপাধ্যায়ের অলংকরণ

 

এইভাবে মন দিয়ে দেখতে দেখতে আরো কতবিধ তরিতফাত যে চোখে পড়ে। সবচেয়ে দুঃখ হয় একেবারে শেষ লাইনে পৌছে। গল্প পড়ার মজা নষ্ট করতে চাই না বলে, শেষ লাইনটা বলছি না। তবে, মূল গল্পে যেমন যথার্থ ছোটগল্পের মতো, ছোট্টো একটা দৈর্ঘ্যযুক্ত লাইনে ইংরাজি গল্পটা শেষ হয়, বাংলা অনুবাদে সেটা এত দীর্ঘ আর ব্যাখ্যাসঙ্কুল, যে, তাতে গল্পের শেষ চমকটাই মাটি হয়ে যায়। অনুবাদককে তো সেটাও লক্ষ রাখতে হয়।

আরও পড়ুন
সত্যজিতের সিনেমার ক্লাস-৩

গল্প ১০১-এর প্রকাশকের উদ্দেশে নিবেদন, অনুগ্রহ করে, অনুবাদটি মূল বইয়ের পরিশিষ্টে সরিয়ে মূল ইংরাজি গল্প দুটিকে প্রথমে বসিয়ে সত্যজিতের পাঠককে মূল সত্যজিতের গল্পটি উপহার দিন। গ্রন্থ সম্পাদনা আর পাঠ সম্পাদনা ভবিষ্যতে এই বিষয়টি ভালো ভাবে গ্রহণ করবে না।

স্বয়ং সত্যজিৎ এই অনুবাদ তাঁর লেখা বইতে পড়লে হয়ত, সেই শুণ্ডির রাজার মতো বলবেন, আমার বইতে এ কাহাদের কণ্ঠস্বর!

আরও পড়ুন
সত্যজিতের সিনেমার ক্লাস - ২

সত্যিই, সত্যজিৎ-এর পাঠই তো তাঁর গল্পসংকলনে থাকা উচিত। ‘প্রহর’-এর ‘রোববারান্দা’-র পাঠক কী বলেন, তা জানার অপেক্ষায় রইলাম।

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
সত্যজিতের সিনেমার ক্লাস - ১