সত্যজিতের সিনেমার ক্লাস - ১

মানিকলমকারি – ৪

আগের পর্বে

ফেলুদার গল্পের শুরুয়াত ১৯৬৫-৬৬ সালে সন্দেশ পত্রিকায়। ‘ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি’ দিয়ে। ১৯৯৫ সালে সন্দেশ পত্রিকাতেই সন্দীপ রায় এই পাণ্ডুলিপির ব্যাপারে লিখেছিলেন। লেখার সময় যে জবরদস্ত সিরিজের কথা ভাবেননি সত্যজিৎ, তাই সুস্পষ্ট। পান্ডুলিপিতেই ফেলুদার প্রথম পদবি রেখেছিলেন ‘দত্ত’। মিত্তির নয়। এছাড়াও বহু খুঁটি-নাটি পরিবর্তনও করেছিলেন তিনি। ছোটদের গল্পের কথা মাথায় রেখেই বাদ দিয়েছিলেন অনেক যৌক্তিক প্লট। বাদ দিয়েছিলেন তিনকড়িবাবুর মুখের একটি কথাও। পরে সেটাই ফিরে এসেছে সিধু জ্যাঠার সংলাপে। “আমি অনেক কিছু করলেই অনেকের পসার থাকত না ফেলু। তাই আমি কিছুই করিনি।”

কথাসাহিত্যকার সত্যজিতের কথা তো হয়। কিন্তু বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রধান একজন প্রবন্ধকারের পরিচয়টাও যে তাঁর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, সেটা কি আদৌ মনে থাকে আমাদের? এবারের মানিকলমকারির কথায় সে কথাটাই বা কেন না-ভাবি আমরা? কোন কোন দিক থেকে দেখা যেতে পারে বাংলা প্রবন্ধে সত্যজিতের ভূমিকাটি? আমাদের মনে হয়, ‘যখন ছোট ছিলাম’ বইয়ের লেখাতে এক সত্যজিৎ আছেন (তাঁকে নিয়ে আরেক কিস্তি লেখা হতেই হবে) আর অন্যদিকে আরেক সত্যজিতের প্রাবন্ধিক সত্তা যেন একজন যত্নশীল শিক্ষকের মতো রুচিমান বাঙালি পাঠকদের সিনেমা শেখানোর একটি বিরাট বড়ো আর লম্বা ক্লাস নিচ্ছিলেন। তাঁর সেই সিনেমার ক্লাস শুরু হয়েছিল সে-ই পথের পাঁচালী ছবি তৈরির আগে থেকে আর তা চলেছিল প্রায় তাঁর জীবনের শেষ পর্যায় পর্যন্ত। ঠিকই শুনেছেন, পথের পাঁচালী ছবির আগে থেকেই তাঁর সেই লেখালেখির শুরু। 

বলা যায়, ১৯৪১ সাল থেকে চিত্রশিল্পী সত্যজিতের কাজ শুরু আর ১৯৫৫-তে চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিতের জন্ম আর ১৯৬১ সালে সত্যজিৎ প্রথম সংগীত পরিচালনা শুরু করেন। এই হিসেবে সবচেয়ে পুরোনো চিত্রকর সত্যজিতের সূচনা। আর লেখক সত্যজিতের সূচনাও তার কাছাকাছি, ওই চারের দশকেই। আজ বস্তুত আমরা সত্যজিতের লেখা প্রবন্ধাবলি একটা বিশেষ ক্রমে বিন্যস্ত করে বোঝার চেষ্টা করব, কেন এ কথা বলাই যায় যে, পরিচালক সত্যজিৎ রায় যদি ছবি বানিয়ে বাঙালি দর্শকের রুচি তৈরি করে তোলেন, তাহলে প্রবন্ধকার সত্যজিৎ চেয়েছিলেন বাঙালির ছবি দেখার চোখটি তৈরি করতে। ছবি যারা করবেন আগামী সময়ে এই প্রবন্ধগুলি যেমন তাদের জন্য, তেমন ভাবেই এই প্রবন্ধগুলি যেন বাঙালি দর্শকের ছবি দেখার চোখ তৈরি করার একটা প্রকল্পও বটে। আসলে তিনি ক্রমশ বাংলাতে এক নতুন ধারার প্রবন্ধশিল্পের জন্ম দিচ্ছিলেন আর তা হল সিনেমা বিষয়ক প্রবন্ধ। সাধারণত সিনেমা দেখার ব্যাপার, তা নিয়ে লেখালেখি মানেও সেই দেখার আগুপিছুর কথা। মানে, হয় যে-ছবি তৈরি হতে চলেছে তার খবর, কিংবা যে-ছবি তৈরি হয়েছে তার সমালোচনা। সিনেমা শিল্প বাণিজ্যবদ্ধ, তা নিয়ে লেখাও তাই সাধারণত বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত। সেই একমাত্র বাণিজ্যিক পরিচয়ের বাইরে সিনেমার শিল্প- পরিচিতিতে (মানে কেবল ইন্ডাস্ট্রি অর্থে শিল্প নয়, আর্ট অর্থে শিল্প) একটা অ্যাকাডেমিক মাত্রা যোগ করলেন তিনি। সিনেমার চর্চা কীভাবে হতে পারে, সত্যজিতের প্রবন্ধ বুঝি একই সঙ্গে তার সিলেবাস আর অবশ্য-পাঠ্য টেক্সট বুক।

সত্যজিতের সিনেমা বিষয়ক প্রবন্ধগুলিকে আমার এইভাবে সাজাতে খুব ইচ্ছে করে।

ক) সিনেমার জন্য কাহিনি নির্বাচন কী ভাবে হতে পারে, তার কথা।
খ) কাহিনি থেকে কীভাবে তৈরি হবে চিত্রনাট্য আর সংলাপ, তার কথা।
গ) যে ছবি আমরা দেখি, তার পিছনে কতবিধ যন্ত্র আর যন্ত্রী আছেন, তাদের কথা।
ঘ) মুহূর্তে যে দৃশ্য আমরা দেখছি পর্দায়, তাকে কোন তামঝাম পুহিয়ে শুটিং করতে হয়, তার কথা।
ঙ) অভিনয় আর অভিনেতার কথা।
চ) ছবি তৈরির কাজে সম্পাদনার কাজটি ঠিক কী, তার কথা।
ছ) কোন ভাবনা থেকে একজন চিত্রপরিচালক ছবিতে যোগ করেন আবহসংগীত, তার কথা।
লক্ষণীয়, এই সাত কাণ্ডে ছবি তৈরির মহাকাব্য কিন্তু লেখা হয়ে গেছে!
এবার এই আলাপ থেকে সেই বিস্তারে এগোনো যাক।
*ক) সিনেমার জন্য কাহিনি নির্বাচন *

কী অদ্ভুত! ১৯৮২ সালে লেখা সত্যজিতের একটি প্রবন্ধের নামটাই ছিল 'ছবির জন্য গল্প'। সেই প্রবন্ধে তিনি একে একে বুঝিয়েছিলেন কেন "ছবির জন্য গল্প নির্বাচন একটা দুরূহ ব্যাপার।" পরিচালক কখনো নিজের জন্য গল্প বাছেন, কখনো প্রযোজনা সংস্থা গল্প বাছে, সেইমাফিক পরিচালক বাছেন। এখানে নিজে নিজের ছবির জন্য গল্প বাছতে গিয়ে কখন চরিত্রের কথা, কখন একটা বিশেষ পিরিয়ড আর কখন একটা বিশেষ অঞ্চল একজন পরিচালকের মনকে তাড়িত করে, তার এক বিশ্লেষণ নিজের অভিজ্ঞতা থেকে প্রস্তুত করে দেন। এই প্রসঙ্গে অবশ্যই এক্ষণ পত্রিকায় তাঁর ছবির চিত্রনাট্য প্রকাশের আগে যে মুখবন্ধ তিনি লিখতেন, তার চিন্তা অভিমুখটিও থাকত সেটাই। 

বিষয় চলচ্চিত্র অবলম্বনে প্রবন্ধ সংগ্রহের প্রচ্ছদ, এক অনন্য শ্রদ্ধার্ঘ্য

 

খ) চিত্রনাট্য আর সংলাপ
গল্প সাহিত্য থেকেই হোক আর সিনেমার জন্য লেখা মৌলিক কাহিনিই হোক, সেই বাছাইপর্বের পরে চিত্রনাট্য লেখার কাজ। এই বিষয়ে তাঁর লেখা দুটি প্রবন্ধ একটু তার তাত্ত্বিক দিক, দুটি তার সংলাপ লেখার দিক আর অন্তত তিনটি প্রবন্ধ ছিল তাঁর সেই চিত্রনাট্য-চিন্তার, পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের ভাষায়, উদাহরণসহ বিশ্লেষণ। ১৯৬৭-৬৮-তে লেখা 'চিত্রনাট্য' আর 'চিত্রনাট্যের শৈলী' যদি ওই দুই তাত্ত্বিক প্রবন্ধ হয়, তাহলে ১৯৬৩-তে লেখা 'চলচ্চিত্রের সংলাপ প্রসঙ্গে' আর ১৯৭৯-তে লেখা 'ছবিতে কথা' হল তাঁর সংলাপ ভাবনা। সংলাপের স্বাভাবিকতা কাকে বলে, চরিত্রের সামাজিক অবস্থানের সঙ্গে সংলাপের সম্পর্ক আর অতি অবশ্যই অতি নাটকীয় সংলাপের বর্জন-রীতি বিষয়ে তাঁর ভাবনা ধরা ছিল এই দুই লেখায়। তিনি সংলাপ সম্পর্কে বলতে গিয়ে যেমন বললেন, "নাটকে কথাই সব, ছবিতে তা নয়।" নাটকের পারিপার্শ্বিক যেহেতু নাট্যমঞ্চতে নির্মিত, তাই সেখানে সংলাপ সম্পর্কে দর্শক "বাস্তব জীবনের স্বাভাবিক কথোপকথন আশাই করে না।" অন্য দিকে ছবিতে পারিপার্শ্বিক যেহেতু স্বাভাবিক আর তাই "সংলাপ যদি স্বাভাবিক না হয়, তাহলে অভিনয় স্বাভাবিক হওয়া মুশকিল।" তারপর তাঁর সেই অসামান্য উদ্ধৃতি, প্রতি চিত্রনাট্যকার আর সংলাপ লেখকের কাছে যা মুখস্থ রাখা উচিত।লিখলেন: "বাস্তব জীবনে মানুষ একই বক্তব্য বিভিন্ন অবস্থায় বিভিন্ন ভাষায় ব্যক্ত করে। একই কথা অলস মুহূর্তে একভাবে, কর্মরত অবস্থায় আরেকভাবে, এমনকী গ্রীষ্মে ঘর্মাক্ত অবস্থায় একভাবে এবং শীতে কম্পমান অবস্থায় আরেকভাবে ব্যক্ত হয়। নিরুদ্বিগ্ন অবস্থায় মানুষের কথার লয় হয় বিলম্বিত, উত্তেজিত অবস্থায় মানুষের কথা কেটে যায়, বাক্য উত্থিত হয় নিশ্বাসের ফাঁকে ফাঁকে।" 

আরও পড়ুন
সত্যজিতের সিনেমার ক্লাস - ১

সংলাপ লেখার কথা বলতে বলতেই তিনি শেখালেন, নিস্তব্ধতা আর নৈঃশব্দ্যের ভাষাও। ছবি যেহেতু নিজেই অনেক কথা বলে, তাই সামান্য ইশারা আর শরীরীভাষা, চোখের সামান্য হেরফের যে সিনেমায় সংলাপের জায়গা নিতে পারে, সে কথাও শিখিয়ে দেন তিনি, চিত্রনাট্য আর সংলাপ শেখার ক্লাসে।

এবার আসা যাক, সেই উদাহরণসহ বিশ্লেষণের কথায়। 'অপুর সংসার' আর 'চারুলতা'-র কাহিনির সঙ্গে ছবির দুস্তর ফারাক আর তা সত্যজিতের অক্ষমতা, এই জাতীয় সমকালীন দুটি আপত্তি বিষয়ে কলম ধরলেন স্বয়ং পরিচালক। তিনি একটি একটি প্রসঙ্গ আর সূত্র কাহিনি অবলম্বনে বোঝালেন, কীভাবে একটা কাহিনি হয়ে ওঠে চিত্রনাট্য। এ এক অসামান্য শিক্ষকের ধর্ম, এ এক অসাধারণ ক্লাস-লেকচার। 

আরও পড়ুন
প্রদোষ ‘মিত্র’ নয়, ফেলুদা-র পদবি ‘দত্ত’ ভেবেছিলেন সত্যজিৎ!

পত্রিকায় একেই বলে শুটিং-এর দুটি লেখার হেডপিস।

 

আরও পড়ুন
শাসমলবাবু, সদানন্দ, সুজন এবং

গ) কতবিধ যন্ত্র আর যন্ত্রী
সিনেমায় যন্ত্র সভ্যতা আর তার সঙ্গে এই শিল্পের অন্তরের সম্পর্ক নিয়ে সত্যজিতের একটা অন্য গভীর ভাবনা ছিল, সে কথায় এই লেখার দ্বিতীয় স্তরে আসা যাবে। আপাতত এইটুকু বলা চলে, সিনেমার সঙ্গে যন্ত্র, মানে ক্যামেরা, শব্দগ্রহণ, তার পরিস্ফুটন আর শব্দ সংযোজন থেকে প্রেক্ষাগৃহে প্রক্ষেপণের গোটা যন্ত্রবদ্ধ আর কারিগরি উৎকর্ষের দিকটি সম্পর্কেও সচেতন করে চলেন প্রাবন্ধিক সত্যজিৎ তাঁর বেশ কিছু লেখাতে। লেখাগুলি ছিল, ছয়ের দশকে লেখা 'সিনেমার কথা', 'দর্শকের অগোচরে', 'বাংলা চলচ্চিত্রের আর্টের দিক' আর 'ছবি তৈরি' এই প্রবন্ধ চতুষ্টয় আর তার সঙ্গেই জুড়ে নিতে হবে, ১৯৮০-তে লেখা 'শতাব্দীর সিকি ভাগ' প্রবন্ধটি। এগুলিতে আছে ছবি তৈরির নেপথ্যকাহিনির পর্ব পর্বান্তর। এমনকি, সত্যজিতের প্রিয় বন্ধু আর তাঁর ছবির অবিস্মরণীয় শিল্প নির্দেশক বংশী চন্দ্রগুপ্তের প্রয়াণলেখটিও এই পর্যায়ে পড়ে নেওয়া দরকার। 

আরও পড়ুন
কেমন দেখতে ছিলেন ‘সত্যিকারের’ জটায়ু?

নিজের অভিজ্ঞতার কথা আর বিশ্ব সিনেমার ইতিহাসে এই কারিগরির পরিবর্তনের সঙ্গে আমাদের দেশীয় উদ্যোগপতিদের ও স্টুডিও মালিকদের মনোভাবের পরিবর্তন কেন দরকারি তাও সূনৃতভাষণে লিখে রাখলেন শিল্পসচেতন প্রাবন্ধিক। 

একেই বলে শুটিং-এর প্রচ্ছদ, শুটিংয়ের তামাম তামঝাম স্বাদুভাষায় ছোটদের জন্য, বড়োদের জন্যেও!

 

ঘ) একেই বলে শুটিং

একটা গোটা বই, তাও ছোটদের জন্য, লিখলেন তিনি সিনেমা তৈরির হরেক মজার হদিশ দিতে। ছোটরা, শুধু ছোটরা কেন, অনেক বড়ো বয়সীও, সিনেমা বলতে বোঝেন, অভিনয় আর অ্যাক্টিং। তার বাইরেও সিনেমার জগৎ যে কতখানি আর সামান্য একটি মুহূর্ত ছবির পর্দায় ফুটিয়ে তুলতে যে কত কাণ্ড আর কত মানুষের কত পরিশ্রম যে থাকে, তার এক মনোরম বিবরণী একটা গোটা বই, একেই বলে শুটিং। এমনিতে মনে হবে, শুটিংয়ের গপ্পোসপ্পো, বেশ মেজাজি ভাষাতে বলা, কিন্তু তাঁর সমগ্র প্রবন্ধের মানচিত্রে তাকে স্থাপন করলে আজ উঠে আসবেই তাঁর বড়ো প্রচ্ছন্ন পরিকল্পনার কথাটিও। সিনেমার দুনিয়ায় যা চোখে দেখছি, তার পশ্চাৎপটের সরস গল্প যেমন এই লেখাগুলি, তেমনই সিনেমার জাদুতে, সম্পাদনার জাদুতে কীভাবেই বা আপাত অবিশ্বাস্য দৃশ্য বিশ্বস্ত ভাবে সিনেমার পর্দায় দেখি আমরা, এই লেখাগুলি তার হদিশ তো বটেই। অভিকর্ষের উল্টো দিকে গুপিবাঘার এক জায়গা থেকে উড়ে এক লহমায় অন্য জায়গায় পৌঁছে যাওয়া থেকে বাঘের সঙ্গে কীভাবে কোন ম্যাজিকে শুটিং করা হয়, তার গল্প শুধু রোমাঞ্চকর নয়, তা ছবির প্রাথমিক টেকনিক শেখাবার এক প্র্যাকটিকাল ক্লাস যেন। 

আর চিত্রনাট্য অনুসারে চিত্রগ্রহণ আর তার সঙ্গে যন্ত্রের শিল্পিত সম্বন্ধ নিয়েও বেশ কিছু কথা বললেন তিনি। 

আজ এই অবধি থাক। 

এই চিত্রগ্রহণের বকেয়াটুকু আর ছবির শব্দকথা থেকে ছবি তৈরির সপ্তকাণ্ডের বাকি তিন পর্ব নিয়ে সামনের সপ্তাহে বসছি।

Powered by Froala Editor