দক্ষ শাসক হবেন সু-অভিনেতা, উপেক্ষা করতে হবে লোকনিন্দাও - মহাভারতের শিক্ষা এমনই

মহাভারতে রাজনীতি – ৯

আগের পর্বে

ব্যাসদেব ও মুদ্রিতনয়না অম্বিকার মিলন হল। কিন্তু চক্ষুবিহীন ক্ষেত্রে বীজ বপন করলে ফসলও যে চক্ষুবিহীন হবে। তাঁদের মিলনে তৈরি রাষ্ট্রের শাসক তবে কি দৃষ্টিহীন হবেন? এই সম্ভাবনার কথা ভেবেই তিনি অম্বিকার কাছে ছুটলেন। কিন্তু অম্বিকা অনুপস্থিত। বিচিত্রবীর্যের এক দাসী তাঁর সেবা করলেন। শূদ্রা দাসীর সঙ্গে সঙ্গমে যে রাজনীতিজ্ঞ জন্মাবে, তাঁর কি অধিকার থাকবে সিংহাসনে বসার? এই চিন্তা ভাবিয়ে তুলল ব্যাসদেবকে। কিন্তু পরক্ষণেই তিনি স্মরণ করলেন, দাসীপুত্র হওয়া সত্ত্বেও রাজা হতে পেরেছিলেন পুরু।

অম্বালিকা যে ব্যাসদেবের রূপ সহ্য করতে পারবেন না, তা দিব্য দৃষ্টিতে পূর্বেই বুঝেছিলেন ঋষিপ্রবর। শয্যাগৃহে প্রবেশ করা মাত্র অম্বালিকা ভীতা পাণ্ডুবর্ণা হয়ে গেলেন। সত্যবতী অম্বিকার কথা স্মরণ করে অম্বালিকাকে চোখ বন্ধ করতে বারণ করেছিলেন। অম্বালিকা চোখ মেলে থাকলেও ভয়কে জয় করতে পারেননি। ব্যাসের রূপ দেখে তিনি ভয়ে ফ্যাকাশে রঙের হয়ে গিয়েছিলেন। রমণের শেষে ব্যাসদেব অম্বালিকাকে বললেন,
যস্মাৎ পাণ্ডুত্বমাপন্না বিরূপং প্রেক্ষ্য মামসি।
তস্মাদেষ সুতস্তে বৈ পাণ্ডুরেব ভবিষ্যতি।।

রাজমাতা সত্যবতী ব্যাসদেবের কাছ থেকে জানতে পারলেন, অম্বালিকার পুত্রটিও সুস্থ হয়ে জন্মাবে না, সে হবে পাণ্ডুবর্ণ। পাণ্ডু হল শ্বেতপীতমিশ্র বর্ণ। এই বর্ণ হরিণের হয়—ফ্যাকাশে রং। পাণ্ডূস্তু পীতভাগার্দ্ধঃ কেতকীধূলিসন্নিভঃ। পণ্ডিতেরা বলেন, পাণ্ডু হল শ্বেতবর্ণ। আবার পাণ্ডু এক রকমের রোগ—ন্যাবা, যাকে জন্ডিস বলা হয়। বাত, পিত্ত, কফ, সন্নিপাত ও মৃত্তিকাভক্ষণ এই পাঁচটি নিদান আছে ওই রোগের। পাণ্ডু সন্তান উৎপাদনে অক্ষম হবেন, এমন কথাও বলতে লাগলেন বৈদ্যরা। এমন রুগিকে সিংহাসনে বসানো কতদূর শাস্ত্রসম্মত সে বিষয়ে সকলে সন্দেহ প্রকাশ করতে লাগলেন। পক্ষান্তরে, অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র শারীরিক ও মানসিকভাবে যথেষ্ট সবল, তার আর কোনও ব্যাধি বা আধি নেই।   

রাজমাতা পড়লেন মহা ফাঁপরে। দুই পৌত্রের একটিও শারিরিকভাবে সিংহাসনের যোগ্য নয়, তাহলে হস্তিনার রাজনৈতিক উত্তরাধিকারী হবে কে? ‘অম্বা’-র মতো ‘অম্বালিকা’-ও জন্মদাত্রী মাতার প্রতিশব্দ। সন্তানের অঙ্গবর্ধন করেন বলে তিনি অম্বালিকা। মজার কথা, ‘অম্বিকা’ শব্দ দিয়ে চক্ষু বোঝায় এবং ‘অম্বালিকা’ বোঝায় অঙ্গবর্ধনকারীকে অথচ তাঁদের সন্তানরা যথাক্রমে চক্ষুহীন এবং রোগগ্রস্ত। অম্বষ্ঠপুত্র ব্যাসদেবের সঙ্গে অম্বিকা-অম্বালিকার এই মিলনও রাজনৈতিকভাবে যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। কিন্তু কেন এমন হল?

এই রাজনৈতিক কৌশলের পেছনে আছে প্রাসাদের এক দাসীর সঙ্গে ব্যাসদেবের রমণের কাহিনি। সেই দাসী শূদ্রা। ঠিক যেমন মৎস্যগন্ধা অলৌকিক উপাখ্যানের পূর্বে শূদ্রকন্যা ছিলেন। অম্বিকাকে দ্বিতীয়বার সন্তান উৎপাদনের জন্য আহ্বান করা হল। ব্যাসদেব পুনরায় অম্বিকার শয্যাগৃহে প্রবেশ করলে অম্বিকাকে পান না। তিনি পাঠিয়ে দিয়েছেন একজন দাসীকে। সুসজ্জিতা সেই দাসীর সামীপ্য পেলেন ব্যাস এবং তাঁর সঙ্গে সঙ্গম করলেন। দাসী ঋষিপ্রবরকে সর্বপ্রকার রমণ দান করে তুষ্ট করেন। সেই মিলনের ফলে উৎপন্ন সন্তান হবে সুস্থ ও সবল। সে না হবে অন্ধ না পাণ্ডুবর্ণ। কিন্তু সে রাজত্ব পাবে না। কেন?

আরও পড়ুন
ঐশ্বরিকতা নয়, রাজ্য এবং রাজা সৃষ্টির পিছনে প্রধান নিয়ামক রাজনীতিই

তৎকালীন রাজনীতি ও সমাজনীতি বলছে, দাসী হল প্রভুর ক্ষেত্র। দাসীদের নিজস্ব শরীরের অধিকার নেই। তাঁদের শরীর হল প্রভুর সম্পত্তি। গর্ভও প্রভুর। কিন্তু দাসীদের সন্তান বা ক্ষেত্রের ফসল ক্ষেত্রাধিপতির উত্তরাধিকারী নয়, যদিও সেই সন্তান প্রভুর বীর্যসম্ভূত। 

দাসীর সর্বপ্রকার পরিচর্যায় তুষ্ট হয়ে ব্যাসদেব বললেন, পুরাণে এমন কাহিনি রয়েছে, যেখানে দাসীপুত্র রাজা হয়েছেন। এই যে কৌরব বংশ, যা পূর্বে ছিল পৌরব বংশ, সেই বংশের আদি পুরুষ ‘পুরু’ ছিলেন দাসীপুত্র এবং পুরুর মাতা দাসী শর্মিষ্ঠা ছিলেন অসুরকন্যা। কিন্তু শর্মিষ্ঠা যেহেতু রাজার কন্যা, ফলে তিনি ক্ষত্রিয়া, শূদ্রা নন। শর্মিষ্ঠার পুত্র পুরু যযাতির সিংহাসন পেয়েছিলেন তার মূলে ছিল অসুর ও দেবতাদের রাজনীতি। 

আরও পড়ুন
কোনো অবস্থাতেই সত্যের অপলাপ করতে পারবেন না শাসক, নির্দেশ মহাভারতকারের

অসুরগুরু শুক্র ছিলেন শিবের পরম অনুরক্ত। শুক্রের পিতা ভৃগু বিষ্ণুর বক্ষে পদচিহ্ন এঁকে দিয়েছিলেন। দেবতা ও অসুরদের যুদ্ধের চলাকালীন শুক্র একবার কৈলাসে গেলেন শিবের অনুগ্রহ পেতে। সেই অবসরে দেবতারা অসুরদের আক্রমণ করে। অসুররা ছিলেন শুক্রাচার্যের মাতা কাব্যমাতার আশ্রয়ে। কাব্যমাতা যোগক্ষমতায় দেবতাদের নিদ্রার দেশে পাঠিয়ে দিলেন এবং দেবরাজ ইন্দ্রকে করে দিলেন পঙ্গু। বিষ্ণু তখন ক্রুদ্ধ হয়ে সুদর্শন চক্র দিয়ে কাব্যমাতার মস্তক ছিন্ন করে দেন। ভৃগু প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত হয়ে বিষ্ণুকে মর্ত্যে সাত বার জন্মলাভ করার অভিশাপ দেন। নারীঘাতী হিসাবে বিষ্ণুকে তিরস্কার করার পর কমণ্ডলু থেকে মন্ত্রপূত জল ছিটিয়ে স্ত্রী কাব্যমাতার প্রাণ ফিরিয়ে দেন ভৃগু মুনি। একদা শুক্রাচার্য দেবতাদের গুরু বৃহস্পতির পিতা অঙ্গিরার কাছে শিক্ষালাভ করতে গিয়ে লক্ষ্য করেন, অঙ্গিরা নিজের পুত্র বৃহস্পতির প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট। তখন তিনি ন্যায় বা যুক্তিবিদ্যার জনক গৌতমের কাছে গিয়ে শিক্ষালাভ করতে থাকেন। তাছাড়া শুক্রাচার্য শিবের শরীরে দীর্ঘকাল বাস করার ফলে শিবের তেজের অংশীদার হন এবং পার্বতীকে মাতা হিসাবে গ্রহণ করেন। শুক্রের জন্য অসুররা অজেয় হয়ে ওঠে। ওদিকে শুক্রের ব্রহ্মচর্য ও ধ্যান ভাঙার জন্য ইন্দ্র নিজের কন্যা জয়ন্তীকে পাঠিয়ে দেন। জয়ন্তীর গর্ভে দেবযানী জন্মলাভ করেন। 

ক্ষত্রিয় যযাতির ঔরসে ব্রাহ্মণকন্যা দেবযানীর গর্ভে যদু ও তুর্বসু জন্মলাভ করে। যদু ও তুর্বসু আসলে ইন্দ্রের দৌহিত্রীর পুত্রদ্বয় আবার তারা শুক্রাচার্যের দৌহিত্র। দাসী শর্মিষ্ঠার তিন পুত্র—অনু, দ্রুহ্যু ও পুরু। তাঁরা অসুররাজ বৃষপর্বার দৌহিত্র। যযাতির রাজত্ব কে পাবে, সেই নিয়ে দেবাসুরের দ্বন্দ্ব তুঙ্গে ওঠে। দেবতারা চেয়েছিলেন, যদু রাজা হোক—কিন্তু শেষমেশ যযাতি তাঁকে সিংহাসন দিলেন না। তুর্বসুকেও না। অনু, দ্রুহ্যুও বাদ পড়লেন। শুক্রাচার্য যেমন সঞ্জীবনী মন্ত্র জানতেন, তেমনি পুরু জানতেন বৃদ্ধকে যৌবনদান করার মন্ত্র। সেই অর্থে, পুরু ছিলেন শুক্রাচার্যের যথার্থ অনুসারী। আবার তিনি অসুররাজ বৃষপর্বার নাতি। 

আরও পড়ুন
সিংহাসনে বসবেন না ভীষ্ম, রাজাহীন হস্তিনাপুরের ভার নিতে আহ্বান ‘কানীনপুত্র’ ব্যাসদেবকে

ব্যাসদেব বিচিত্রবীর্যের দাসীর সঙ্গে মিলিত হয়ে যে পুত্রের জন্ম দিলেন তিনি যথেষ্ট উত্তমাঙ্গ ও ধর্মানুসারী। মাতা সত্যবতী কিন্তু এই পৌত্রকে সিংহাসনের উত্তরাধিকারী করতে সম্মত হলেন না। ব্যাসদেব জানালেন, অম্বিকাপুত্র ধৃতরাষ্ট্র ও অম্বালিকাপুত্র পাণ্ডু কুটনীতি বিষয়ে সম্যক অবহিত নন। সফল রাজা কূটনীতি অবলম্বন করে আপনার প্রতিপাল্যকে অন্যের দ্বারা প্রতিপালন করিয়ে কোকিলের মতো ব্যবহার করবেন। ধৃতরাষ্ট্র ও পাণ্ডু শত্রু বিষয়ে, কঠোরতা বিষয়ে, সম্পদ কামনা প্রসঙ্গে দাসীপুত্র বিদুরের মতো নন। যথার্থ রাজা শূকরের ন্যায় মূল-উৎপাটনে বদ্ধপরিকর হবেন। সেই গুণ বিদুরের আছে। মেরুর মতো আপনার স্থৈর্য্য ও গাম্ভীর্য্য রক্ষা করবেন। প্রসাদ, ক্রুরতা ইত্যাদি নানা ভাবের সমাবেশে রাজা নটের অনুকরণ করবেন। একজন দক্ষ শাসককে সর্বাগ্রে পাকা অভিনেতা হতে হয়। তিনি দরিদ্রের মতো সতত সম্পদ কামনা করবেন। প্রজাদের প্রতি সদয় ব্যবহার প্রকাশ করবার জন্য ভক্তিমিত্রের চরিত্র অনুকরণ করবেন, অর্থাৎ অনাবশ্যক হলেও বাহ্যত স্নিগ্ধ ব্যবহার দেখাবেন। 

কোকিলস্য বরাহস্য মেরোঃ শূন্যস্য বেশ্মনঃ।

আরও পড়ুন
একে একে সাত পুত্রকে হত্যা করলেন গঙ্গা, দুঃখে শোকে অস্থির শান্তনু

নটস্য ভক্তিমিত্রস্য যচ্ছ্রেয়স্তৎ সমাচরেৎ।।

একজন দক্ষ রাজনীতিবিদ স্বতোপ্রবৃত্ত হয়ে রিপুকে কুশলপ্রশ্ন করবেন। অলস, ক্লীব, অভিমানী, লোকনিন্দাভীত ও দীর্ঘসূত্র শাসক কখনও শ্রেয়োলাভ করতে পারেন না। রাজনীতিবিদ তাঁর ছিদ্র কাউকে জানতে দেবেন না, কিন্তু সব সময় অন্যের ছিদ্র অনুসন্ধান করবেন। কুর্মের মতো আত্মগুপ্তি শাসকের অবশ্য শিক্ষণীয়। রাজনীতিবিদ শাসক বকের মতো অর্থচিন্তা করবেন, সিংহের ন্যায় পরাক্রম দেখাবেন, বৃকের মতো আত্মগোপন করবেন এবং শরের ন্যায় শত্রুভেদ করবেন। এই সকল গুণ শুধু বিদুরের আছে।

আরও পড়ুন
যৌথ মালিকানা থেকে পরিবার হয়ে ব্যক্তি মালিকানার সূচনা; সাক্ষী মহাভারত

শাসক সুরাপান করবেন পরিমিত। অক্ষক্রীড়া, মৃগয়া, স্ত্রীসম্ভোগ, গীতবাদিত্র সব কিছুই পরিমিতভাবে উপভোগ করবেন। যদি কেউ এই সকল বিষয়ের একটিতেও বেশি আসক্তি দেখায় তাহলে সে ঘোর অকল্যাণ ডেকে আনবে। শাসক মৃগের ন্যায় শয়ন করবেন। ঘুমন্ত অবস্থাতেও তিনি সাবধান থাকবেন। অবস্থা বিবেচনা করে তিনি অন্ধ বা বধিরের মতো ব্যবহার করবেন। বিচক্ষণ শাসক দেশকাল অনুযায়ী বিক্রম প্রকাশ করবেন। যে শত্রু দুর্বল তার উপর সদা পরাক্রম দেখাবেন কিন্তু সবল শত্রু পরাক্রম দেখালে মূক ও বধিরের ন্যায় আচরণ করবেন। যদি সবল শত্রুর পরাক্রম লাগামছাড়া হয় এবং শাসকের পক্ষে জীবনমরণ সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় তখন শাসক বিচক্ষণতার সঙ্গে দেশকাল-অনুসারে বিক্রম প্রকাশ করবেন। সম্যকভাবে আত্মবল পরীক্ষা করে কর্তব্য স্থির করবেন। যতক্ষণ ভয় উপস্থিত না হয় ততক্ষণ ভীত ব্যক্তির ন্যায় ব্যবহার করবেন। ভয়ের কারণ উপস্থিত হলে ধৈর্য সহকারে প্রতিকারের উপায় খুঁজবেন। রাজনীতিবিদকে সংশয়ের রাস্তায় হাঁটতে হবে, নইলে তিনি ঈপ্সিত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারবেন না। কল্যাণের অধিকারী হতে গেলে সংশয়িত পথই শ্রেয়।

অলংকরণ - প্রণবশ্রী হাজরা

Powered by Froala Editor

More From Author See More