জরাসন্ধকে একা পেলে তবেই হত্যা, পরিকল্পনা আঁটলেন কৃষ্ণ

মহাভারতে রাজনীতি - ৩১
আগের পর্বে

ভীষ্ম ও বিদূরের আপত্তি সত্ত্বেও হস্তিনাপুরে থেকে গেলেন একলব্য। ঠিক হল পাণ্ডবদের প্রাসাদ নির্মীত হলে তবেই খাণ্ডব বন নিয়ে আলোচনা করা হবে। এই চোদ্দ মাস দুর্যোধনের গুপ্তচরের কাজ করলেন তিনি। ওদিকে ইন্দ্রপ্রস্থ নির্মীত হলে সেখানে অতিথি হিসাবে এলেন নারদ। তিনি পাণ্ডবদের আপ্যায়নে তুষ্ট হলেন। তাঁদের কৃষিকাজের বিষয়ে আট নীতি মেনে চলার পরামর্শ দিলেন। অন্যদিকে যুধিষ্ঠিরকে রাজা করার জন্য রাজসূয় যজ্ঞ করার কথাও বললেন নারদ। তারপর…

নারদ চলে গেলেন। যুধিষ্ঠির প্রজাদের কাছে গিয়ে বললেন, যার যা দেয় আছে দিয়ে দাও; রাজত্ব চালাতে গেলে অনেক সম্পদ দরকার। প্রজারা সামর্থ্যবশত কিছু কিছু দিল, ইচ্ছায় এবং অনিচ্ছায়। যুধিষ্ঠির তাদের শাসন করতে লাগলেন। ভীম তাদের রক্ষা করবেন বললেন। অর্জুন শত্রু নিবারণের দায়িত্ব নিলেন, নকুল কর্তব্যাকর্তব্য পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন এবং সহদেব সব কাজে উপদেশ দিতে লাগলেন। 

তেজারতি ব্যবসায়, যজ্ঞের সামগ্রী, গোরক্ষা, কৃষিকার্য এবং বাণিজ্য—সমস্ত বিষয় যুধিষ্ঠিরের আনুকূল্যে ফুলেফেঁপে উঠল। তবু রাজসূয় যজ্ঞ নিয়ে যুধিষ্ঠিরের চিন্তা গেল না। তিনি সারা দিনরাত ভাবতে লাগলেন, কীভাবে ওই যজ্ঞ করা যায়, তাঁকে গোটা পৃথিবীর রাজা হতে হবে; নচেৎ পিতার অপমান হয়। ভাইদের সঙ্গে আলোচনা করেও কোনো পথ পেলেন না তিনি। তখন কৃষ্ণের কাছে দ্বারকায় দূত পাঠালেন, শীঘ্র জনার্দন এসে তাঁকে উদ্ধার করুন। 

কৃষ্ণ এলেন দ্বারকা থেকে। সব শুনে তিনি জানালেন, পৃথিবীতে যে সকল শ্রেণিবদ্ধ রাজা বা তদ্ভিন্ন ক্ষত্রিয় আছেন তাঁরা সকলেই পুরূরবা বা ইক্ষ্বাকুর সন্তান—তাঁরা বর্তমানে একশত বংশে বিভক্ত। প্রত্যেকেই পৈতৃক সম্পদ নিয়ে রয়েছেন। মগধাতিপতি প্রবল প্রাক্রান্ত জরাসন্ধ ওই নৃপতিদের রাজলক্ষ্মীকে অভিভূত করে তাঁদের দ্বারা এখন সাম্রাজ্যে অভিষিক্ত হয়েছেন। সব রাজা তাঁকে কর দেন এবং জরাসন্ধ আমাদের মধ্যে পরস্পর ভেদ তৈরি করে নিজের সাম্রাজ্য টিকিয়ে রেখেছেন। প্রভাবশালী শিশুপাল জরাসন্ধের অত্যন্ত অনুগত, করূষ দেশের রাজা কূটযোদ্ধা মহাবল বক্রও তাঁর শিষ্য। মহাবীর্য হংস ও মহাত্মা ডিম্ভক নামের দুই পরাক্রান্ত রাজাও তাঁর আশ্রিত ছিল। দন্তবক্র, করূষাধিপতি, করভ ও মেঘবাহন রাজা জরাসন্ধের ভক্ত। বরুণ যেমন পশ্চিম দিক শাসন করেন তেমন জরাসন্ধ মুর ও নরক দেশ শাসন করেন। তাঁর অগণিত সৈন্য। যবনাধিপতি ভগদত্ত জরাসন্ধের নিকট অবনত। একমাত্র পশ্চিম ও দক্ষিণ প্রান্তের রাজা পুরুজিৎ আপনার পক্ষে, তাও তিনি আপনার মামা হন বলে। বঙ্গ, পুণ্ড্রক ও কিরাত দেশের রাজা যিনি নিজেকে বাসুদেব পুরুষোত্তম বলে ঘোষণা করেছেন সেই পৌণ্ড্রকও জরাসন্ধের পক্ষে। ভারতবর্ষের এক চতুর্থাংশের অধিপতি ভোজবংশীয় রাজা ভীষ্মকও জরাসন্ধের অনুরক্ত। উত্তর ভারতে বাস করত যে ভোজবংশীয়রা তাদের আঠারোটি শাখা ভয়ে পশ্চিমে পালিয়েছে। উত্তর থেকে দক্ষিণে পালিয়ে গেছেন শূরসেন, ভদ্রকায়, বৌধ, শাল্ব, পটচ্চর, সুস্থল, সুকট্ট, কুলিন্দ, কুন্তি, শাল্বায়নদেশীয় নৃপতিগণ। দক্ষিণ পাঞ্চালের রাজারা, কোশল দেশের নৃপতি, মৎস্য দেশের রাজা সবাই জরাসন্ধের ভয়ে কম্পমান। বেশ কিছু কাল পূর্বে দুর্মতি কংস যিনি সম্পর্কে আমার মাতুল তিনি যাদবদের উপর অপরিসীম অত্যাচার করেছেন। যাদব শিশুদের হত্যা করেছেন। সেই কংস জরাসন্ধের কন্যা সহদেবের কনিষ্ঠা দুই ভগিনী অস্তি ও প্রাপ্তি নামের দুই সুন্দরী কন্যাকে বিবাহ করেছিলেন। কংস শ্বশুর জরাসন্ধের সাহায্যে শ্রেষ্ঠতা পেয়েছিলেন। আমি ও বলরাম তাঁকে বধ করি। তখন জরাসন্ধ আমাদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে উদ্যত হলেন। আমাদের আঠারোটি বংশ একত্রে বসে মন্ত্রণা করি যে সমস্ত শত্রুনাশক অস্ত্র দ্বারা অনবরত আক্রমণ করেও তিন শত বছরে জরাসন্ধের সৈন্য সংহার করতে পারব না। হংস নামের অখ্যাত এক নৃপতিকে আঠারো বারের চেষ্টায় বলরাম হত্যা করতে সফল হন। ডিম্ভকের কাছে খবর পাঠানো হয় হংস মৃত। সেই কথা শুনে মহাত্মা ডিম্ভক যমুনার জলে আত্মবিসর্জন দেয়। ডিম্ভক প্রাণবিসর্জন দিয়েছে এই কথা শুনে মহাবীর্য হংসও জলে নিমগ্ন হন।

জরাসন্ধতনয়া কংসপত্নী অস্তি একদিন পিতাকে বললেন, আমার পতিহন্তাকে বধ করুন। তখন আমি মথুরা থেকে পশ্চিম দিকে পালিয়ে গেলাম। রৈবতকপর্বতশোভিত মনোহর কুশস্থলী নগরীর এক গিরিদুর্গে নিরাপদে বাস করতে লাগলাম।    

আরও পড়ুন
যুধিষ্ঠিরকে কীভাবে রাজা বানানো যায়? নারদের কাছে পরামর্শ চাইলেন সহদেব

আমরা কংসকে হত্যা করে সর্বপ্রকারে জরাসন্ধের নিকট অপরাধ করেছিলাম—এবং বয়ং জরাসন্ধাদভিতঃ কৃতকিল্বিষাঃ। সামর্থ্যবন্তঃ সম্বন্ধাদ্গোমন্তং সমুপাশ্রিতাঃ।। তাই আমরা শক্তিশালী হয়েও জরাসন্ধের ভয়ে এইভাবে মথুরাদেশ থেকে রৈবতকপর্বতে আশ্রয় নিই। সেই রৈবতক পর্বতের একুশটি শৃঙ্গ আছে—পর্বতটি তিন যোজন দীর্ঘ, এক যোজন বিস্তৃত আর তার শত শত দ্বার। আমার বংশের আঠারো হাজার ভ্রাতা তাই পাহারা দিতে লাগল। আহুকের শত পুত্র দেবতাদের চেয়েও বলবান। চারুদেষ্ণ, তার ভ্রাতা, চক্রদেব, সাত্যকি, আমি, বলরাম এবং শাম্ব—এই সাত জনই যুদ্ধে বিষ্ণুর তুল্য। আমরা হলাম রথী; অন্যদিকে কৃতবর্মা, অনাধৃষ্টি, সমীক, সমিতিঞ্জয়, কঙ্ক, শঙ্কু এবং কুন্তী—এই সাত জন মহারথ। অন্ধকভোজের দুই পুত্র এবং বৃদ্ধ অন্ধকভোজ রাজা মহারথ। আমরা সব সময় মথুরার কথা ভাবি আর বিলাপ করি। 

হে যুধিষ্ঠির! আপনি সম্রাটের সব গুণে গুণবান, তাই সম্রাট হওয়ার যোগ্য ব্যক্তি। কিন্তু আপনাকে বলছি, জরাসন্ধ যত দিন জীবিত আছে ততদিন আপনি রাজসূয় যজ্ঞ করতে সমর্থ হবেন না। জরাসন্ধ ভয়ঙ্কর তপস্যার দেয়ারা উমাপতি মহাদেবের আরাধনা করে তাঁরই বলে বলীয়ান এবং সব জয় করেছেন। সকল দিক বিচরণ করে রাজাদের জয় করে আপন রাজধানীতে এনে তাঁদের আবদ্ধ রেখে মহাপুরুষের কাজ করেছেন—স বিনির্জিত্য তান্ সর্ব্বান্ পার্থিবান্ সর্ব্বতো দিশম্। পুরমানীয় বদ্ধা চ চকার পুরুষব্রতম।। 

আরও পড়ুন
ভস্মীভূত খাণ্ডব বনের অজস্র প্রাণ, ক্ষুব্ধ একলব্য

যুধিষ্ঠির সব শুনে বললেন, হে কৃষ্ণ! তুমি আমার মন। তুমি বুদ্ধিমান লোক, যা বললে খুবই ঠিক কথা বললে। এখন বুঝছি, শান্তিই পরম কাম্য। আমি রাজসূয় যজ্ঞ করব না, কেননা তা আরম্ভ করলেও শেষ করতে পারব না। 

ভীম উত্তেজিত হয়ে অগ্রজকে বললেন, আপনি দুর্বল তাই এই কথা বলছেন। সাম-দান-ভেদ-দণ্ড অবলম্বন করুন এবং পরাক্রান্তকে আক্রমণ করুন। কৃষ্ণের নীতি, আমার বল, অর্জুনের কৌশল রয়েছে। সুতরাং দক্ষিণাগ্নি, গার্হপত্য, আহবনীয়—এই তিন অগ্নি যেমন যজ্ঞ সম্পাদন করে, তেমনি আমরা তিন জন জরাসন্ধের জয় সম্পাদন করব। 

আরও পড়ুন
বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ হারানোর প্রতিশোধ নিতে, দুর্যোধনকে সমর্থন জানালেন একলব্য

কৃষ্ণ যুধিষ্ঠিরের উদ্দেশে জানালেন, মুর্খ লোক কাজ আরম্ভ করে কিন্তু শেষ করে না। বুদ্ধিমান মুর্খ শত্রুকে গ্রাহ্য করে না। মান্ধাতা শত্রু জয় করে, ভগীরথ প্রাজাপালন করে, কার্ত্তবীর্য্যার্জ্জুন তপস্যা করে, ভরত রাজা বলপ্রয়োগ করে এবং মরুত্ত রাজা সম্পদের বলে সম্রাট হয়েছিলেন। হে ভরতবংশীয়, সাম্রাজ্যলাভের এই পাঁচটি কারণই আপনার আছে। বৃহদ্রথনন্দন জরাসন্ধ ধর্ম, অর্থ, নীতি ও আচারের প্রয়োগ বেশি বেশি করেন বলে দমনীয় হয়ে পড়েছেন।

নিগ্রাহ্যলক্ষণং প্রাপ্তো ধর্ম্মার্থনয়লক্ষণৈঃ।

আরও পড়ুন
একলব্যকে হত্যার আদেশ দিলেন বিদুর, ভীত দ্রোণাচার্য

বার্হদ্রথো জরাসন্ধস্তদ্বিদ্ধি ভরতর্ষভ।।

এক শত রাজা ধর্ম-অর্থ-নীতি পালন করেন না বলে জরাসন্ধ তাঁদের উপর অধীনতা কায়েম করেছেন। প্রবল পরাক্রান্ত জরাসন্ধকে বশে আনা শক্ত। মিলিত হয়েও তাঁকে বধ করতে পারছি না। ছিয়াশি জন রাজাকে জরাসন্ধ ধরে এনেছেন, অবশিষ্ট চোদ্দো জনকে খুঁজছেন। শত পূর্ণ হলে তিনি সেই নিষ্ঠুর কার্য করবেন, পুরুষমেধ যজ্ঞ। জরাসন্ধকে জয় করতে পারলে সম্রাট হওয়া সম্ভব। 

যুধিষ্ঠির বললেন, হে কৃষ্ণ! আমি স্বার্থপরায়ণ লোকের ন্যায় ইচ্ছা করে কেবল সাহসের বলে কী করে তোমাদের জরাসন্ধ-বধ করতে পাঠাই? ভীম ও অর্জুন আমার দুই নয়ন এবং তুমি আমার মন। মন ও নয়নযুগল হারালে এই জীবনে আর কী রইল! স্বয়ং যম যার সঙ্গে যুদ্ধে জয়লাভ করতে পারেন না সেখানে তোমরা আর কী চেষ্টা করবে! তোমরা গেলে বিপদ ঘটবে, অতএব না যাওয়াই ভাল, এই আমার মত। 

অর্জুন জানালেন, জরাসন্ধকে বধ করতে যাওয়াই উচিত। আমার ধনু, বাণ ও উৎসাহ আছে। তাছাড়া আমরা ক্ষত্রিয়। ক্ষত্রিয় যদি যুদ্ধে না গিয়ে বিছানায় শুয়ে মরে তার চেয়ে পাপজনক আর কী হতে পারে! ভয় হল যোদ্ধার মৃত্যুস্বরূপ। ধর্ম অনুযায়ী আমরা ভয়কে জয় করে যাব।

কৃষ্ণ বললেন, অর্জুন ঠিক কথা বলেছেন। তবে প্রবল পরাক্রান্তের সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে না যাওয়াই ভালো। আমরা ছদ্মবেশে শত্রুভবনে প্রবেশ করে তাকে একা পেয়ে আক্রমণ করে অভীষ্ট লাভ করব।

Powered by Froala Editor

More From Author See More