ডাক পড়ল হস্তিনার রাজসভায়, দ্রোণের কাছে অস্ত্রশিক্ষা প্রার্থনা একলব্যের

মহাভারতে রাজনীতি - ২৫
আগের পর্বে

শিশুপালের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে একলব্য রওয়ানা হলেন হস্তিনার উদ্দেশ্যে। পথে বিশ্রাম নিলেন বিরাট রাজ্যে। সেখানে বিরাটরাজের শ্যালক ও সেনাপতি কীচকের সঙ্গে আলাপ জমে ওঠে। কীচক তাঁকে বিরাটরাজ্যের সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে বললেন। তবে একলব্য সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেন। এরপর খাণ্ডব বনে আশ্রয় নিলেন। সেখানেও তক্ষক ও অন্যান্য বাসিন্দারা একলব্যকে হস্তিনাপুরে যেতে নিষেধ করলেন। পথে এক বাজারে অস্ত্র বিক্রি করতে গেলেন। সেখানে আলাপ হল এক কামারের সঙ্গে। কামার এক গল্প বলতে শুরু করলেন। হস্তিনাপুরে নাকি খুব তাড়াতাড়ি ভাইয়ে ভাইয়ে যুদ্ধ শুরু হতে চলেছে। তারপর…

“মৎস্যগন্ধার নাম শুনেছিস?”
একলব্য জবাব দেয়, হ্যাঁ। দাশরাজ জেলের কন্যা।
“বাহ, অনেক জানিস দেখছি! তাহলে ঘুমো।”
একলব্য বলে, তুমি বলো। কিছুই জানি না তার পর। যুদ্ধের কথা বলছিলে না?
“শুনবি?”
“বলছি তো বলো। ঘুম আসছে না।”

কামার কাহিনি বলতে শুরু করে। শোন আমার নাম কানাহাইয়া কুমার, লোকে আদর করে ডাকে কামার। অবশ্য আমি ছুরি বানাই, শান দিয়ে এত তীক্ষ্ণ করে যে কুমড়ো কিংবা মানুষ ফালি করলে কেউ ধরতেই পারবে না মালটা গোটা না অর্ধেক করা! সে যাক গে! রাজবাড়ির অসি থেকে মসী সব ধার দেওয়ার জন্য রাজপেয়াদারা আমার কাছেই আসে। সেই আমি কানহাইয়া কুমার ওরফে কামার শুরু করছি।

মৎস্যগন্ধা আগে নৌকা বাইতো। সেই সময় একজন ঋষি বন থেক হস্তিনার রাজপ্রাসাদে আসতো রাজা শান্তনুকে পরামর্শ দিতে। সে বেশ কিছু কাল আগের কথা। মুনির সেই বন থেকে প্রাসাদে আসতে গেলে যমুনা নদী পার হতে হয়। মৎস্যগন্ধার নৌকাতেই আসত পরাশর। তার পর ভাব-ভালবাসা হয়ে পোয়াতী হয় মৎস্যগন্ধা। সেই ছেলের জন্ম হয় এক দ্বীপে। তার নাম কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন। সে থাকে বাপের সঙ্গে। পরাশর মৎস্যগন্ধাকে বলে, তুই রাজা শান্তনুকে বিয়ে কর। মৎস্যগন্ধা জানায়, তা কী করে হয়! অমন বুড়ো লোক। ওর ছেলে দেবব্রত তো আমার বয়সী। পরাশর বলে, যা বলছি শোন। রাণী হতে চাইলে রাজাকেই বিয়ে করতে হয়, তার পর তোর ছেলে রাজা হবে; গঙ্গাপুত্রকে সরিয়ে দেব।

মৎস্যগন্ধা বলে, রাজা কেন রাজি হবে!
“ঠিক হবে।”
তার পর পরাশর মুনি শান্তনুকে বলে, “অনেক দিন হল তোমার স্ত্রী পালিয়েছে। একটা বিয়ে করো, বুড়ো বয়সে নইলে কে দেখবে?
রাজা বলে, আরে রাম রাম! এই বয়সে বিবাহ! আমার পুত্র দেবব্রত এখন যুবক। তার বিয়ে দেব।
পরাশর বলে, সে দাও। কিন্তু তুমিও একখানা যুবতী মেয়ে দেখে বিয়ে করো।
রাজা জানায়, তাকে আর কোন যুবতী পছন্দ করবে!
অপরাহ্নে নদীর তীরে বেড়াতে যেও, মুনি এই কথা বলে চলে যায়।
রাজা শান্তনু বিকেলে মৎস্যগন্ধার দেখা পান। অপূর্ব সাজসজ্জায় ভূষিত সেই কন্যার সারা শরীরে বহিরাগত সুগন্ধের হাতছানি। এমন সুগন্ধী কোথায় পেল কন্যা? গঙ্গার গন্ধবণিক তো এত ভাল গন্ধদ্রব্য সরবরাহ করে না! 

আরও পড়ুন
হস্তিনানগরীর উদ্দেশে রওয়ানা দিলেন একলব্য, বিচিত্র অভিজ্ঞতার সাক্ষী হলেন পথে

শান্তনু ভাবতে লাগলেন, অনেক কাল থেকেই পরাশর মুনি বলছে যে তার মামাতো ভাই অনন্তমুখ নামকরা বৈশ্য, তাকেই হস্তিনার বাণিজ্যের ভার দিন রাজা। কিন্তু গঙ্গার বণিকরা খুব সৎ ও ভাল মানুষ। যমুনার ওই চিত্রমুখ বৈশ্যরা তেমন সুবিধার লোক নয়। কোনও জালে পড়তে চলেছেন কি রাজা শান্তনু?

কিন্তু ওই সুগন্ধ টেনে নিয়ে গেল রাজাকে মৎস্যগন্ধার কাছে। শান্তনু জালে ধরা পড়লেন। মৎস্যগন্ধার বিবাহ হল শান্তনুর সঙ্গে। শান্তনু-গঙ্গার পুত্র দেবব্রত বুদ্ধিমান, তিনি বিবাহ না করার সিদ্ধান্ত নিলেন, তাতে মানও বাঁচে, সংঘাতও এড়ানো যায়। সেই থেকে অস্ত্রবাজার থেকে কাঁচাবাজার সব অনন্তমুখের দখলে। অনন্তর পুত্র দুর্মুখ এখন সব কিছুর দেখভাল করে। সে চাইছে বড় একটা যুদ্ধ হোক। 

আরও পড়ুন
দ্রোণাচার্যকে রাজকুমারদের অস্ত্রশিক্ষার ভার দিলেন ভীষ্ম, দ্বিধাগ্রস্ত দ্রোণ

মৎস্যগন্ধার দুটি পুত্র হয়েছিল শান্তনু রাজার ঔরসে। বড়টির নাম চিত্রাঙ্গদ। সে এক গন্ধর্বের হাতে খুন হয়। ছোটো বিচিত্রবীর্য অনিয়ম করে মারা যায়, রেখে যায় দুই বিধবা স্ত্রীকে। মৎস্যগন্ধার আগের পক্ষের ছেলে কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন ওই বিধবাদের দেবর। সে পুত্র উৎপাদন করে বিধবাদের গর্ভে। তাদের একজন অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র, সেই এখন রাজা। কিছুই দেখে না চোখে। তার ১০১ জন ছেলে আর একটি মেয়ে। ধৃতরাষ্ট্রের ছোটো ভাই পাণ্ডু মারা গিয়েছে কিছু দিন আগে। পাণ্ডুর স্ত্রীদের গর্ভে দেবতারা পাঁটি পুত্রসন্তান উৎপাদন করেছে। এখন লড়াই হবে রাজা ধৃতরাষ্ট্রের ছেলেদের সঙ্গে পাণ্ডুর ক্ষেত্রজ পুত্রদের। সেই জন্য নতুন অস্ত্রগুরু এসেছে, তার নাম দ্রোণাচার্য।

একলব্য বলে, আচার্য দ্রোণের সঙ্গে দেখা করা যায়?
কামার উত্তর দেয়, কী হবে সাক্ষাতে! তীরধনুক বেচবে?
“আজ্ঞে!”
“তুমি কি ভেবেছো, নতুন একটা ছেলে বাজারে অস্ত্র বেচছে সে কথা ওদের কানে যায়নি! দেবব্রত ভীষ্ম থেকে দ্রোণ সকলের কাছে খবর পৌঁছে গেছে। নাও এখন ঘুমোও দেখি।!”
একলব্যের ঘুম আসতে চায় না। কামারের নাসিকা গর্জন শুনতে শুনতে এক সময় কখন নিদ্রাদেবী তার উপর ভর করেছেন সে কথা একলব্য জানে না। ঘুম ভাঙলো মোরগের আওয়াজে। 

আরও পড়ুন
গুরুপত্নীতে আসক্ত চন্দ্র, ক্রুদ্ধ বৃহস্পতি হাজির ইন্দ্রের দরবারে

কামারের বউ অনিন্দ্যা এবং কন্যা সুগন্ধা দুজনেই বড় ভাল মানুষ। তারা একলব্যের প্রাতঃরাশের ব্যবস্থা করল। ঘোড়াকে জাবনা দিল। তার পর কামারের দিকে তাকিয়ে বলল, আজ আর কাজে যেও না। ছেলেটাকে প্রাসাদ দেখিয়ে আনো। ফেরার সময় একটু মাংস কিনে এনো।

একলব্য বেশ অবাক হল। কেননা সে জানে, দুধ-মাংস-তেল এইসব জিনিস বিক্রি হয় না। যদি কোনও দেশে এই সব বস্তুর কেনাবেচা হয় তাহলে জানতে হবে সেই রাজ্য পতিত। সে কামারকে জিজ্ঞাসা করল, কী গো খুড়ো, তোমাদের দেশে মাংস খোলা বাজারে বিক্রি হয়? 

আরও পড়ুন
ব্রাহ্মণ হয়েও অর্থনীতির চর্চা, সামাজিক সব গণ্ডি ভেঙে দিয়েছিলেন ভরদ্বাজ

কামার জবাব দিল, হ্যাঁ হয়। ব্যাধেরা করে না। মাংস বেচে বৈশ্যরা। এখন তাদের নতুন নাম মাংসবণিক। শোনো ভাইপো, এককালে নদী পারাপার করতে পারানির কড়িও লাগতো না। মৎস্যগন্ধা সে সব চালু করেছেন। রাজা শান্তনুর পিতা প্রতীপ যখন নৃপতি ছিলেন, তখন হস্তিনা ছিল স্বর্ণনগরী। বণিকরা এসে সব লণ্ডভণ্ড করে দিল। আগে বিদেশি বণিকদের আয়ের পরে কর নেওয়া হত। এখন ঢুকতে না ঢুকতে গলায় গামছা দিয়ে সব কেড়েকুড়ে নিচ্ছে। এই দেখো না, তোমার তীরধনুকের অর্ধেক তো নিয়েই নিয়েছে। দু একটা পাঠাবে রাজার অস্ত্রশালায়, বাকিটা নিজেরা বেচে দেবে। যাক গে, প্রস্তুত হয়ে নাও। হস্তিনানগর দেখে আসি চলো।

এমন সময় দরজায় করাঘাত শোনা গেল। কে?
রাজপেয়াদা।
কী সংবাদ?
অতিথির ডাক পড়েছে রাজদরবারে।
‘যাচ্ছি’ বলে কামার একলব্যকে জানালেন, দেরি করা ঠিক নয়; এক্ষুনি বের হও।
রাজসভায় পৌঁছে একলব্য যে রাজপুরুষকে দেখলেন তিনি টকটকে ফর্সা। উচ্চতাও চোখে পড়ার মতো। কৃশও নন আবার স্থূলও নন। জলদগম্ভীর কন্ঠে সেই পুরুষ একলব্যকে বললেন, তুমি হস্তিনায় কেন এসেছো?
একলব্য ভাবলো, সত্য কথা বলা ভাল। তাতে ধর্ম রক্ষা পাবে আবার কোনও ঝামেলায় পড়তে হবে না। সে উত্তর দিল, আচার্য দ্রোণের কাছে ধনুর্বিদ্যা শিক্ষা করতে।
রাজপুরুষ মৃদু হাসলেন। তার পর বললেন, আচার্যের কাছে না গিয়ে অস্ত্রবাজারে গেলে কেন?
“আজ্ঞে, ভাবলাম বাজারটা একবার দেখে নিই। নতুন জায়গা কিনা!”
“কোথা থেকে এসেছো?”
“দণ্ডকারণ্য।”
“সেখানে তো জরসন্ধের এক সেনানায়ক হিরণ্যধনু রাজত্ব করেন!”
একলব্য জানায়, সে হিরণ্যধনুর পুত্র, নিষাদ রাজকুমার।

রাজপুরুষ দ্রোণাচার্যকে ডেকে পাঠালেন।

কৃশকায় দাড়িওয়ালা এক প্রৌঢ় এসে দূর থেকে রাজপুরুষকে নমস্কার করে বললেন, আমাকে ডেকেছেন হে গঙ্গাপুত্র ভীষ্ম?
“এই বালক আপনার কাছে অস্ত্রশিক্ষা করতে চায়। জাতিতে নিষাদ, জরাসন্ধের সেনানায়ক হিরণ্যধনুর পুত্র। এর সঙ্গে কথা বলে নিন।”
দ্রোণাচার্য একলব্যকে নিয়ে রাজসভা থেকে বেরিয়ে অস্ত্রশালার কাছাকাছি এলেন। তার পর বললেন, ভালোই তো ঘোঁট পাকিয়েছো বাপু! জরাসন্ধের লোক এসেছে হস্তিনায় অস্ত্রশিক্ষা করতে। কচের অসুরপুরীতে আসার মতো ঘটনা। 

একলব্য তাঁর কথার কিছুই বুঝতে পারলেন না। প্রণাম করলেন দূর থেকে। তার পর বললেন, অনেক আশা নিয়ে এসেছি গুরুদেব, আমাকে নিরাশ করবেন না।
দ্রোণ প্রশ্ন করলেন, তুমি নিষাদ?
একলব্য জবাব দেয়, আজ্ঞে।
“জানো, নিষাদ কারা?”
“ওই যারা শিকার করে তারা।”
দ্রোণ বলেন, শিকার তো ক্ষত্র পুরুষরাও করে থাকেন। আমার মতো ব্রাহ্মণও মৃগয়ায় যান।
“তবে আপনিই বলে দিন গুরুদেব, নিষাদ কারা?”

Powered by Froala Editor

More From Author See More