বরং ইন্দ্রের ঔরসে গর্ভবতী হোন কুন্তী, পরামর্শ দিলেন স্বামী পাণ্ডু

মহাভারতে রাজনীতি - ১৭

আগের পর্বে

রাজা হয়ে প্রজাপালনেই মন দিলেন ধৃতরাষ্ট্র। অন্যদিকে মুনাফাবাজির পথ হারাল বণিকরা। বিদুর ধৃতরাষ্ট্রকে বললেন, প্রজারা যেন ধর্মসংকর না হয়ে পড়ে সেদিকে নজর দিতে। উত্তরে ধৃতরাষ্ট্র বললেন; তিনি, বিদুর এবং পাণ্ডু তিনজনেই ধর্মসংকর। গান্ধারীর সন্তানরাও ধর্মসংকর হবে। প্রজাপালনই রাজধর্ম, মনে করেন ধৃতরাষ্ট্র। বললেন সূর্য বংশের রাজা অসমঞ্জের কথাও। বিদুর তখন চাইলেন, পাণ্ডুর ক্ষেত্রজ পুত্র যেন ভবিষ্যতে রাজত্ব পায়। অন্যদিকে কিমিন্দম মুনির অভিশাপে পাণ্ডুর মৈথুন-ক্রিয়ায় নিষেধাজ্ঞা নেমে এল। কুন্তীকে তিনি নিয়োগ প্রক্রিয়ার কথা বললেন। হস্তিনাপুরের ধর্মরক্ষার জন্য স্বয়ং ধর্মরাজকেই আহ্বান জানালেন কুন্তী। 

ধৃতরাষ্ট্রের ঔরসে গান্ধারী গর্ভবতী হয়েছেন জেনে সন্তান-উৎপাদনে অক্ষম পাণ্ডু চঞ্চল হয়ে পড়লেন। তবে কি সেই পুত্র হস্তিনার পরবর্তী রাজা হবে? বিষণ্ন পাণ্ডু জ্যেষ্ঠ পত্নী কুন্তীকে অন্য পুরুষের দ্বারা পুত্র উৎপাদন করতে অনুরোধ করলেন। কুন্তী দুর্বাসার শেখানো মন্ত্র আওড়ে ধর্ম অর্থাৎ যমকে আহ্বান করলেন। পর্বতশ্রেষ্ঠ শতশৃঙ্গের উপরে বহুতর পশু-সমাকীর্ণ বনের ভিতরে মহাভাগা কুন্তীদেবী ধর্মের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন। সুন্দরনিতম্বা যশস্বিনী কুন্তী ঋতুস্নান করে পবিত্র হয়ে নির্মল বস্ত্র পরিধান করে ধর্মের সঙ্গে শয্যাগ্রহণ করলেন। 

কে এই ধর্ম? তিনি কি রাজধর্ম?

দেবতাদের মধ্যে ধর্ম লোকধারক। তিনি যম নামে প্রসিদ্ধ। দক্ষিণ দিকের দিকপাল তিনি। তাঁর আবাস হল নরক। তিনি জীবকুলের প্রাণ হরণ করেন। সেই হিসাবে তিনিই হলেন ‘জীব’ নামক রাষ্ট্রের অধিপতি। যমের পিতা সূর্য। সেই সম্পর্কে যম হলেন কর্ণের ভ্রাতা। অন্য দিকে তিনি আবার মর্ত্যে এসেছেন বিদুর রূপে। ফলে এখানে ধর্ম বা যমের রাজধর্মের বিষয়টি কিঞ্চিৎ গোলমেলে। কুন্তীর সঙ্গে মিলনের ফলে তাঁর যে পুত্র জন্মায় তাঁর নাম যুধিষ্ঠির। জ্যেষ্ঠ মাসে, চন্দ্রযুক্ত জ্যেষ্ঠা নক্ষত্রে, দিবাভাগে, ‘অভিজিৎ’ নামক অষ্টম মুহূর্তে, সূর্য আকাশের মধ্যস্থানগত হলে এবং অতিপ্রশস্ত পূর্ণিমা তিথিতে কুন্তীদেবী অত্যন্ত সমৃদ্ধ ‘জ্যেষ্ঠ’পুত্র যুধিষ্ঠিরকে প্রসব করেন। যুধিষ্ঠির কুন্তীর দ্বিতীয় পুত্র, কর্ণ জ্যেষ্ঠ। ওদিকে গান্ধারী কুন্তীর পূর্বে গর্ভবতী হলেও তিনি পুত্র প্রসব করেননি। ভূমিষ্ঠ হওয়ার নিরিখে যুধিষ্ঠির তাই এই প্রজন্মের জ্যেষ্ঠ (কর্ণের কথা উঠছে না)। কিন্তু মাতৃগর্ভে জন্মলাভের নিরিখে যুধিষ্ঠির গান্ধারী-সন্তানের চেয়ে বড়ো নন। কিছু দিন পরে ধৃতরাষ্ট্র-তনয় দুর্যোধনাদি জন্মলাভ করেন। মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র এবং হস্তিনার অন্যান্য রাজপুরুষরা জানতেন না যে কুন্তীর গর্ভে পাণ্ডুর ক্ষেত্রজ পুত্র উৎপন্ন হয়েছে। তা ছাড়া পাণ্ডুর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা রাজা ধৃতরাষ্ট্রের জ্যেষ্ঠ পুত্র দুর্যোধন সিংহাসনের দাবিদার, বিভিন্ন সংহিতা অনুযায়ী তাইই ন্যায় ও গ্রাহ্য। ওদিকে বিদুর ধর্মরাজ ওরফে যম, পাণ্ডু ও কুন্তী মিলে আলোচনা করতে লাগলেন, যেহেতু পাণ্ডু একদা হস্তিনার নৃপতি ছিলেন, কিছু দিনের জন্য; তাই পাণ্ডুর ক্ষেত্রজ পুত্র যুধিষ্ঠির হস্তিনার সিংহাসনের প্রকৃত উত্তরাধিকারী। 

বিদুর ও পাণ্ডু মন্ত্রণা করলেন, এক পুত্র থাকা আর পুত্র না থাকা দুইই সমান। ওদিকে ধৃতরাষ্ট্রের এক শত পুত্র জন্মেছেন। ফলে কুন্তীকে আরও ক্ষেত্রজ পুত্রের জন্ম দিতে হবে। কুন্তী তখন বায়ুর শরণ নিলেন। বায়ুকে স্মরণ করা মাত্র তিনি উপস্থিত হলেন। বায়ু উত্তর-পশ্চিম কোণের দিকপাল। এই বায়ুকে সেই সময় সংবাদ প্রেরণের মূল শক্তি বলে মনে করা হত। ‘বায়ু’ শব্দের মূলীভূত ধাতু ‘বা’-এর অর্থ বিকল্প গতি। যে বয় বা প্রবাহিত হয় এবং বয়ে নিয়ে যায় সেই পবন বা বায়ু। এই অর্থে বায়ু খবর ছাড়ায় বাতাসে। বায়ু বা পবন হল আদি গণমাধ্যম। তাঁর এক পুত্র আগেই জন্মেছেন, যাঁর নাম হনুমান। হনুমানের আছে পুচ্ছ বা লাঙ্গুল যাকে লেজ বলা হয়। এ হল পাণ্ডিত্যের লেজ। রামায়ণের বানর ও হনুমান আসলে পাণ্ডিত্যের অধিকারী। হনুমান যদি বলে দেন যে বায়ু যে সংবাদ প্রেরণ করছে তা সঠিক, আমজনতা তা সহজেই মেনে নেয়। এ হেন হনুপিতা বায়ুকে আহ্বান করলেন কুন্তী। অত্যন্ত বলবান বায়ু মৃগে আরোহণ করে উপস্থিত হলেন। তিনি বললেন, কুন্তী তোমাকে আমাকে কী দিতে পারি, তোমার অভীষ্ট কী? কুন্তী হেসে ফেললেন। ছদ্ম লজ্জায় বায়ুকে বললেন, ‘হে দেবশ্রেষ্ঠ, বিশাল দেহ এবং সব বীরের দর্প চূর্ণ করতে পারে এমন একটি বলবান পুত্র আমার গর্ভে উৎপন্ন করুন।’ বায়ু কুন্তীর সঙ্গে রমণ করলেন। আদিম গণমাধ্যম এবং কুন্ত অর্থাৎ কুৎসিতের অন্য লিঙ্গের মিলনের ফলে চৈত্রমাসে, শুক্লপক্ষে, ত্রয়োদশী তিথিতে, বৃহস্পতিবার উদয়কালে, মঘানক্ষত্রে, সিংহস্থ চন্দ্রে, দিনে, সূর্য আকাশের মধ্যবর্তী হলে এবং অষ্টম মুহূর্ত সময়ে কুন্তীদেবী ভীমকে প্রসব করেছিলেন। 

আরও পড়ুন
যে শাসক প্রজাকে সর্বদা প্যাঁচে ফেলতে চায়, তাকে হত্যা করা উচিৎ; মত ব্যাসদেবের

পাণ্ডু ভাবলেন, ধৃতরাষ্ট্রের শত পুত্রের সঙ্গে কীভাবে তাঁদের দুটি পুত্র লড়াই করবেন! অতএব আর একটি শক্তিশালী দেবতার ঔরসে কুন্তীর আর এক পুত্র জন্মালে ভাল হয়। দেবতাদের রাজা হলেন ইন্দ্র। তিনিই সবচেয়ে শক্তিশালী। তাঁকে আহ্বান করে কুন্তীর গর্ভে পুত্র উৎপন্ন হলে মঙ্গল হয়। সেই কথা পাণ্ডু কুন্তীকে জানালেন। যিনি প্রভুত্ব করেন তিনি ইন্দ্র, তিনিই দেবরাজ। অসুরদের সঙ্গে যুদ্ধে জয়লাভ করার উদ্দেশে তাঁর জন্ম। অমৃত নিয়ে দেবাসুরের যুদ্ধে তাঁর ভূমিকা ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ইন্দ্রের শত্রুরা হল রাক্ষস, অসুর, দৈত্য, ওহি, বৃত্র, উরণ, বিশ্বরূপ, অর্বুদ, বল প্রমুখ। তবে তাঁর সঙ্গে কৃষ্ণের বিরোধিতা সুবিদিত। ব্রজবাসীরা এক সময়ে ইন্দ্রের উপাসক ছিল। শ্রীকৃষ্ণের প্রচেষ্টায় তারা ইন্দ্রের উপাসনা ত্যাগ করলে ইন্দ্র অতিশয় ক্রুদ্ধ হন। প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টি সৃষ্টি করে তাদের দেশকে প্লাবিত করেন। কৃষ্ণ আঙ্গুলে গোবর্ধন পর্বত ধারণ করে ব্রজবাসীদের রক্ষা করেন। একবার কৃষ্ণ তাঁর স্ত্রী সত্যভামার অনুরোধে ইন্দ্রের পারিজাত বৃক্ষ হরণ করেন। এতে ইন্দ্রের পত্নী শচীদেবী ক্রুদ্ধ হলে ইন্দ্রের সঙ্গে কৃষ্ণের যুদ্ধ বাধে। সেই যুদ্ধে ইন্দ্র পরাজিত হন। পরে কৃষ্ণের সঙ্গে তাঁর সখ্য স্থাপিত হয়।

পাণ্ডু কুন্তীকে বললেন, ইন্দ্রের ঔরসে পুত্র জন্মালে খুব শীঘ্র সেই পুত্র হস্তিনার সিংহাসন দখল করতে পারবে। কৃষ্ণ সম্পর্কে কুন্তীর ভ্রাতুষ্পুত্র। এই দুই মিলিত শক্তি এক হলে জগতে কেউ তাঁদের পরাজিত করতে পারবে না। এই জগত দৈব ও পুরুষকারের উপর দাঁড়িয়ে। দেবরাজ ইন্দ্রের বল ও উৎসাহের সীমা নেই। সেই তেজি পুরুষ যদি কুন্তীর গর্ভসঞ্চার করে তবে হস্তিনা দখল করতে বেগ পেতে হবে না। কুন্তী ইন্দ্রকে আহ্বান করলেন।

আরও পড়ুন
প্রবল বিতর্কের মধ্যে দিয়েই হস্তিনাপুরের রাজা হলেন ধৃতরাষ্ট্র

যথা সময়ে ইন্দ্র এসে কুন্তীর সঙ্গে মিলিত হলেন। তার কিছু কাল পরে ফাল্গুন মাসে, দিনের বেলায়, পূর্ব ফাল্গুনি ও উত্তর ফাল্গুনি নক্ষত্রের সন্ধিক্ষণে একটি শিশু জন্মগ্রহণ করে। ফাল্গুন মাস ও ফাল্গুনি নক্ষত্রে জন্মেছিল বলে ওই শিশুপুত্রের নামকরণ হয় ‘ফাল্গুনি’। তাঁর জন্মের সময় আকাশবাণী হল— কুন্তীর এই পুত্র কার্ত্তবীর্যার্জুনের তুল্য তেজস্বী হবে। তাঁর রাজনীতির জ্ঞান হবে প্রখর। বামনরূপী নারায়ণ যেমন অদিতির আনন্দ বৃদ্ধি করেছিলেন তেমনই এই পুত্র কুন্তীর আনন্দ বর্ধন করবেন। তাঁর নাম অর্জুন।

পাণ্ডুর পুত্রাকাঙ্ক্ষা মিটল না। তিনি পুনরায় কুন্তীকে অনুরোধ করলেন পুত্র উৎপাদন করার জন্য। কুন্তী প্রাচীন ‘কথা’ অর্থাৎ স্ত্রীসংহিতার প্রসঙ্গ টেনে বললেন, মহারাজ! রাজনীতির প্রয়োজনেও আমি আর পুত্র উৎপন্ন করতে পারব না। কারণ প্রাচীন স্ত্রী-আইনশাস্ত্র বলে, বিপৎকালেও পরপুরুষের দ্বারা চতুর্থ পুত্র উৎপাদন করা সঙ্গত নয়। কেননা তৃতীয় পরপুরুষের পরে চতুর্থ পুরুষের সংসর্গ করলে সেই নারী স্বৈরিণী বলে বিবেচিত হন। স্বৈরিণী হল কুলটা বা স্বেচ্ছাচারিণী। এমনটি হলে সমাজে এবং পরিবারে তিনি ব্রাত্য হবেন। আর পঞ্চম পুরুষের সংসর্গ করলে সেই নারী হয় বন্ধকী বা বেশ্যা—নাতশ্চতুর্থং প্রসবমাপৎস্বপি বদন্ত্যুতে। অতঃপরং স্বৈরিণী স্যাৎ পঞ্চমে বন্ধকী ভবেৎ। 

আরও পড়ুন
অধম মানুষের রাজধর্মে অংশগ্রহণ জগতের পক্ষে প্রতিকূল, জানায় মহাভারত

এই কথা বলার পর কুন্তীর কুমারী জীবনের কথা মনে পড়ল। রাজা কুন্তিভোজের রাজনীতির শিকার হয়ে তাঁকে দুর্বাসার সেবা করতে হয়েছিল এবং সেই কুমারী অবস্থায় তিনি পুত্রের জন্ম দিয়েছিলেন প্রথম পুরুষের সংসর্গ করে। তার পর স্বামী পাণ্ডুর সঙ্গে সহবাস করেন। এর পর তিন দেবতার ঔরসে তিন পুত্রের জন্ম দিয়েছেন। অতএব তাঁর পাঁচ পুরুষের সঙ্গে রমণ করা হয়ে গিয়েছে। রাজনীতি যে পথে যায় যাক, তিনি আর নতুন পুরুষের সঙ্গে মিলিত হতে পারবেন না। 

বিষণ্ণ পাণ্ডু ভাবলেন যদি তাঁর সন্তান-উৎপাদনে বাধা না থাকত, তা হলে তিনি অগ্রজ ধৃতরাষ্ট্রের মতো বহু পুত্রের জন্ম দিতে পারতেন। স্ত্রী-সহবাস করলেই তাঁর মৃত্যু হবে, এমন ভয়াবহ অভিশাপ বা অসুখ রয়েছে তাঁর। স্বর্গবৈদ্যরা কি এই অসুখ সারাতে পারেন না? যদি তাঁরা সেই অসুখ সারাতে পারেন তাহলে হস্তিনার রাজনীতিতে তিনি না হলেও তাঁর পুত্ররা রাজত্ব করতে পারবে।

আরও পড়ুন
আদর্শ রাজা তিনিই, যাঁর কাছে রাষ্ট্র ও শাসকের ফারাক থাকে না কোনো

অলংকরণ - প্রণবশ্রী হাজরা

Powered by Froala Editor

More From Author See More