‘আমি ভালো নেই, তোমরা ভালো থেকো’, পরেরদিনই চুল্লিতে জ্বলে উঠলেন রাজাদা

সেইসব পাড়া টারা – ১৭

আগের পর্বে

পার্ক স্ট্রিটে সেসময় অসংখ্যা সোনার দোকানে চলত বন্দকির ব্যবসা। আর সে কারবারে বেশ নাম ছিল বিষ্টু পোদ্দারের। বাপ্পার সেই ‘খাস বিদেশি’ ক্যামেরা নিয়ে তাঁর কাছেই হাজির হয়েছিল রাজাদা। তারপর ১৪০ টাকায় বন্দক রেখেছিল সেই ক্যামেরা। বলাই বাহুল্য, তা আর ছাড়ায়নি রাজাদা। পরে বিষ্টু পোদ্দারও বুঝতে পারে ঘায়েল হয়েছে সে। তবে কংগ্রেসি জমানা শেষ হওয়ার পর রাজাদার অর্থনৈতিক অবস্থা বিপাকে পড়েছিল। ডিভোর্স দিয়ে একমাত্র সন্তানকে নিয়েই বাপের বাড়ি চলে যায় স্ত্রী। আর রাজাদারও হঠাৎ অন্তর্ধান। ৯৪-৯৫ সাল নাগাদ ঝাড়খণ্ডের এক কিন্ডার গার্ডেন স্কুলের প্রিন্সিপাল হয়ে ফিরেছিল রাজাদা। চেহারায় সেই পুরনো জেল্লা। তবে ছেলে কিনা বৌদির চলে যাওয়াটা মেনে নিতে পারেনি কখনই। বেড়ে গিয়েছিল সিগারেট, মদের নেশা। তারপর...

২০০০-এর গোড়ার দিক হবে। ফের একবার কোলকাতায় ফিরেছিল রাজাদা। তবে ব্রাইট স্ট্রিটের বাড়িতে নয়। ঠাকুরপুকুর ক্যানসার হসপিটালের বেডে। খবর পেয়েই ছুটেছিলাম দেখতে। নাকে অক্সিজেনের নল নিয়ে বিছানায় শায়িত রাজাধিরাজ। অ্যাকিউট লাং ক্যানসার। লাস্ট স্টেজ। কথা বন্ধ হয়ে গেছে। বেডের দুপাশে বসা বোন আর ভগ্নীপতি। ভর্তিটর্তির ব্যবস্থা ওরাই করেছে। আমাকে দেখেই ঝিলিক দিয়ে উঠেছিল অর্ধনিমীলিত চোখজোড়া। ঠোঁটের কোনে সেই ‘কাট কপি পেস্ট’ উত্তমকুমার মার্কা হাসি। হাতের ইশারায় জানতে চেয়েছিলাম - ‘ক্যামন আছো?’ জবাবে বেডের পাশে টুলে রাখা নোটপ্যাড আর পেনটা টেনে নিয়ে অতি কষ্টে কাঁপা কাঁপা অক্ষরে দুচার শব্দ লিখে পাতাটা ছিঁড়ে এগিয়ে দিয়েছিল আমার দিকে। সেখানে লেখা - “আমি ভালো নেই। তোমরা ভালো থেকো।” এরপর ২৪ ঘণ্টাও কাটেনি। সেদিন ভোররাতেই অতীত হয়ে গেছিল ব্রাইট স্ট্রিটের মুকুটহীন রাজার রাজপাট। ক্যাওড়াতলা শ্মশানে ইলেকট্রিক চুল্লির দাউ দাউ আগুন যখন মহাকাল হয়ে গিলে নিল আমার চোখে দেখা ‘মোস্ট আনপ্রেডিক্টেবল অ্যান্ড মিস্টিরিয়াস’, কোনো নির্দিষ্ট ছকে ফেলতে না পারা মানুষটাকে, তখনো আমার শার্টের পকেটে কাঁপা কাঁপা হাতে লেখা সেই চিরকুট - ‘আমি ভালো নেই। তোমরা ভালো থেকো!’         

এই পর্বের একদম প্রথম দিকেই বলেছিলাম, পার্ক সার্কাস এলাকা আক্ষরিক অর্থেই যাকে বলে পুরোপুরি ‘কসমোপলিটান’। এর উদহারণ অজস্র। এর মধ্যে দুয়েকটির কথা বলি। পার্ক সার্কাস ময়দানের ঠিক উল্টোদিকে ছোট পার্কটার গায়ে একটা ক্লাব ছিল সেসময়। ক্লাবের নামটি অদ্ভুত - ‘ব্যাং ব্যাং’। এই ক্লাবটাকে আক্ষরিক অর্থেই আদিকালে সেই বাগবাজারে রুপচাঁদ পক্ষীদের আড্ডার সঙ্গে তুলনা টানা যেতে পারে। সন্ধে নামলেই শুকনো নেশা সহযোগে তুমুল আড্ডা ক্লাবঘরে। সঙ্গে গিটারের ঝোড়ো স্ট্রোকে কেনি রজার্স, উডি গাথারি, বিটলস। অ্যাংলো ইন্ডিয়ান, চিনা, বাঙালি হিন্দু-মুসলিম... কে নেই ক্লাব সদস্যের তালিকায়। এহেন ব্যাং ব্যাং ক্লাবের একটা নগর সংকীর্তন মিছিল বেরোত দোলের দিন সকালে। গিটার, খোল-কর্তাল সহযোগে গোটা এলাকা প্রদক্ষিণ করত সেই শোভাযাত্রা। মিছিলের একদম অগ্রভাগে কৃষ্ণ সেজে বাঁশি বাজাতে বাজাতে যেত ক্লাবের অন্যতম সদস্য এবং শোভাযাত্রার অন্যতম উদ্যোক্তা স্বপন আলি। ওরিয়েন্ট রো এলাকায় অত্যন্ত অভিজাত এক মুসলমান পরিবারের সন্তান। পাশেই ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট হস্টেলের এশিয়ান, আফ্রিকান, পৃথিবীর নানা দেশ থেকে পড়তে আসা সব ছেলেপুলেরা এসে যোগ দিত সেই শোভাযাত্রায়। আবিরে আবিরে লাল আকাশ বাতাস, ভাঙের ফোয়ারা, খোল, কর্তাল, গিটার, লালন আর লেননের একটাই ধর্মমুক্ত পৃথিবীর মহড়া চলতো যেন সেই মিছিলে। 

এবার আসি রহমান সাহেবের কথায়। আসলে নাম দিলাওয়ার হোসেন। কী করে যেন রহমান সাহেব হয়ে গেছিলেন নরেনদার দোকানের আড্ডায়। রয়েড স্ট্রিটে একটি মোটর গ্যারেজের মালিক। দুর্দান্ত রসিক মানুষ। একইসঙ্গে ফিল্মপাগল এবং বইপোকা। বাঙলা ক্লাসিক থেকে ইংরিজি পেপারব্যাক - সব গিলতেন গোগ্রাসে। ভিক্তর দ্য সিকা আর সত্যজিত রায়ের অন্ধ ভক্ত। কখনো রায় বলতেন না, সর্বদা  বলতেন - রে। বলার সময় ভীষণ একটা গর্বের ভাব ফুটে বেরোত গলায়। এহেন রহমান সাহেবের ক্লায়েন্ট ছিলেন স্টক এক্সচেঞ্জের এক মাড়োয়ারি শেয়ারব্রোকার। বিপুল ধনী এই শ্রেষ্ঠী রয়েড স্ট্রিটের গ্যারেজে গাড়ি সারাতে আসতেন নিয়মিত। ব্যবসায়িক সম্পর্কের বাইরেও রীতিমত আড্ডার সম্পর্ক দুজনের মধ্যে। কিন্তু গণ্ডগোলটা বেধে গেল একদিন। কি কুক্ষনে ওই শেয়ারব্রোকার ব্যবসায়ীটি রহমান সাহেবের সামনে ফস করে বলে বসলেন যে তিনি সত্যজিত রায়ের ‘শতরঞ্জ কি খিলাড়ি’ সিনেমাটি দেখেছেন এবং কিছুতেই এটা বুঝে উঠতে পারছেন না, যেখানে দুটো বেজায় কামচোর কুঁড়িয়া আদমী কুছু কামধান্দা, বেওসাপাতি না করে সারাদিন খালি শতরঞ্জ খেলে দিন কাটায়, সেটা কি করে একঠো ভাল সনিমা হতে পারে? “আপনি শেয়ারবাজারের দালাল। ওই ধান্দাটাই করুন গিয়ে মন দিয়ে। রে ইজ নট ইয়োর কাপ অফ টি।” তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে জবাব দিয়েছিলেন রহমান সাহেব। “মানিকবাবুর জন্য ঝগড়া করে এরকম শাঁসালো একটা মক্কেল ছেড়ে দিলেন আপনি!” প্রশ্ন করেছিল বিস্মিত রাজাদা। “বলো কি রাজা! আমাদের এখানে থাকবে। পয়সা কামাবে। তারপরও হি উইল ইনসাল্ট ওয়ান অফ আওয়ার লেজেন্ড?” কাঁপতে কাঁপতে বলে উঠেছিলেন রহমান সাহেব। বলার সময় ক্রোধে, অপমানে থমথম করছিল মুখখানা।         

সারাবছরে কোনোদিন মসজিদে যেতে দেখিনি মানুষটাকে। শুধু ঈদের দিনটা ছাড়া। ওইদিন পাটভাঙা ফতুয়া আর লুঙ্গি পড়ে মসজিদে নামাজের জমায়েতে গিয়ে বসতেন। ঈদ মানেই রহমান সাহেবের বাড়িতে কবজি ডুবিয়ে বিরিয়ানি, টিকিয়া, ভুনা, শাম্মি কাবাব, চাঁপ, আর শেষপাতে ফিরনি। স্টার্টার হিসেবে প্রথমেই মাস্ট পেস্তা আর জাফরানগন্ধী লাচ্ছা সিমুই। ওইদিন কোলাকুলির পর মানুষটার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতাম আমি আর রাজাদা। এই তো সেই পার্ক সার্কাস, যেখানে একদা বাঁকুড়ার জমিদার পরিবারের সন্তান ইমতিয়াজ চৌধুরীর বাড়িতে মহালয়া শুনতে যেত বেবুরা।   আসলে তখন সময় অনেক সিধেসাধা ছিল। ‘ধর্মনিরপেক্ষতার নজির’, ‘সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত’ বলে চ্যাঁচাতে চ্যাঁচাতে অন্দরমহল ছাড়িয়ে হেঁসেল অবধি সেঁধিয়ে যেত না ভিশন মিডিয়ার ক্যামেরা জুম। ফলে আজকের ভাষায় ‘ডকুমেন্টেড’ করে রাখা যায়নি দৃশ্যগুলো। 

আরও পড়ুন
হঠাৎ একদিন রাজাদা বেপাত্তা, ফিরে এল কিন্ডারগার্ডেন স্কুলের প্রিন্সিপাল হয়ে!

অতঃপর ফিরে আসি আমাদের বাড়ির সামনে সেই দুগ্যি ময়দানে। মনে আছে ৮০-৯০এর দশক জুড়ে দুর্গাপুজোর মণ্ডপে প্রতি অষ্টমীর দিন বাগবাজারের দুর্গাপ্রতিমার মত সুন্দরী বেগম আর তিন পুত্র ডিউক, ফিলিপ এবং রবার্টকে নিয়ে হাজির হতেন শাহজাদা গাজিউদ্দিন। টাইগার অফ মাইসোর টিপু সুলতানের বংশধর। এলাকায় পরিচিত ছিলেন ‘প্রিন্স’ নামে। দুর্ধর্ষ অভিজাত চেহারা। স্বামী-স্ত্রী, তিন পুত্র, সবার গাত্রবর্ণ যে কোন ইয়রোপিয়ানকে বেবাক লজ্জায় ফেলে দেবে। তসরের ধুতি পানাজাবী আর জামদানি পড়ে মন্ডপ আলো করে বসে থাকতেন শাহজাদা আর তার বেগম। অঞ্জলি দিতেন না কিন্তু অঞ্জলির পর খিচুড়ি লাবড়া চাটনি পায়েসের ভোগটা খেতেন চেটেপুটে। ঘণ্টাদুয়েক তুমুল আড্ডা মেরে যাবার সময় একটা ব্রাউন কালারের খাম তুলে দিতেন পুজো কমিটির কোন কর্মকর্তার হাতে। দুর্গামাঈকে শাহজাদার নজরানা। আসতেন সুপ্রিম কোর্টের জজসাহেব, হুমায়ুন কবীর পুত্র জনাব আলতামাজ কবীর সাহেব। অষ্টমীর ভোগে তারও ছিল তীব্র আসক্তি। উল্টোফুটের বসুবাটি মঞ্জিল থেকে আসতেন উস্তাদ উমর খান। পাম অ্যাভেন্যু থেকে উস্তাদ বাহাদুর খান। ষষ্টির সন্ধেয় পুজোর উদ্বোধন বাহাদুর পুত্র বিদ্যুৎ অথবা কিরীটের বাজনা দিয়ে। 

এই তো সেই পার্ক সার্কাস যেখানে শামসুল হুদা রোডে চর্ম ব্যবসায়ী রাজকুমার আহুজা আর রফিক আলমদের অফিসে ট্যাংরা থেকে এসে চিনা নববর্ষের দিন বিশাল বিশাল ড্রাম আর কর্তাল বাজিয়ে ড্রাগন ডান্স দেখিয়ে যেত চিনা যুবকরা। কালীপুজোর দিনও চায়না টাউন থেকে চিনা কালীবাড়ির ভোগের প্রসাদ আসত ওদের দুজনের অফিসে। উল্টোদিকে ওদের অফিস থেকেও ঈদ-দিওয়ালির লাড্ডু, লাচ্ছা সিমুই আর মিঠাইয়ের রসগোল্লা যেত চিনেপাড়ায়। দিওয়ালির ‘পরসাদি’  সেই লাড্ডু আর রসগুল্লা খেতে পাড়ার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ভিড় উপচে পড়ত আহুজাদের অফিসে। ইদানিং রবীন্দ্র-নজরুল-সুকান্তের এই শহরে অধুনা যে সব বঙ্গবাবুরা চোখে গেরুয়া ঠুলি এঁটে সবকিছু কিঞ্চিৎ নয়া নজরে দেখছেন তাদের জ্ঞাতার্থে এখানে জানিয়ে রাখা দরকার বিভিন্ন সময়ে পার্ক সার্কাসে বিভিন্ন পুজো কমিটির সম্পাদক এবং গুরুত্বপূর্ণ পদাধিকারীদের নাম যথাক্রমে বিজলি রহমান, বাচ্চু রহমান, নানহা ওয়ারিয়া। দুগ্যি ময়দানে কালীপুজোর সভাপতি মায়া ঘোষের পাশাপাশি সহ সভাপতি সাজিদ কাদরির নামটাও বোল্ড লেটারে লেখা থাকে সুভ্যেনিরে। কোনো লুকোছাপার ব্যাপার নেই। প্রত্যেকটা নামই আসল। এ পাড়ায় এসে একটু খোঁজখবর নিলেই জানা যাবে এসব তথ্য। নইলে এই অধম প্রতিবেদক তো রইলই। 

আরও পড়ুন
উত্তমকুমারের ডামি হিসেবে রাজাদাকে খুঁজে পাননি চলচ্চিত্র-নির্মাতারা

তবে এক্ষেত্রে সবচাইতে উল্লেখযোগ্য বোধহয় এলাকায় ৬৮ পল্লীর দুর্গাপুজো। বেকবাগান মোড়ে মিঠাইয়ের উল্টোদিকে কোয়েস্ট মলের গা ঘেঁষে। অর্থবল এবং জনবল দুটোরই অভাবে প্রাচীন এই পুজো যখন প্রায় বন্ধ হবার মুখে, তখন এগিয়ে এসছিল ওই এলাকার মুসলিম যুবকরা। কর্মকর্তাদের অনুরোধ করেছিল করজোড়ে - “পুজা বন্ধ কিজিয়ে মত! হামলোগ হায় না।” আর এদিকে আমাদের এই দুগ্যি ময়দানে? পুজোর আগে প্যান্ডেলের বাঁশ পড়তে একটু দেরি হলে “ক্যা দাদা ? আভি তক বাঁশ নহি গিরহিস, দুগ্যি নহি আবেগি (আয়েগি) ক্যা?” এধরণের প্রশ্নবাণ সামলাতে সামলতে জেরবার হয়ে যেতে হয় কাঠনাস্তিক এই আমাকে। আবার বলছি, বিশ্বাস না হলে একদিন পুজোর সময় চলে আসুন না এ পাড়ায়। চক্ষুকর্ণের বিবাদভঞ্জনের পাশাপাশি সম্পূর্ণ নতুন ধরনের এক অভিজ্ঞতা হবে, হলফ করে বলতে পারি কথাটা। 

পার্ক সার্কাসের এই আপাদমস্তক কসমোপলিটান পরিমণ্ডলে হালকা হালকা ধাক্কা লাগতে শুরু করেছিল ৮০-র দশকের শেষভাগ থেকেই। স্বাধীন ভারতে ব্রিটিশ আমলের মতো অতটা আর সমাদৃত নন তাঁরা - অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের অনেকের মনেই এই ধারণাটা গেড়ে বসে গিয়েছিল। সবার ক্ষেত্রে না হলেও এক বৃহদাংশের মধ্যে তো বটেই। স্বাধীনতা পরবর্তী এই নয়া জমানায় আগেকার সমস্তরকম সুযোগসুবিধা থেকে বঞ্চিত তাদের সম্প্রদায় - পরিচিতদের কথাবার্তাতেই ফুটে বেরোত সেটা। ফলে অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, কানাডার মতো উন্নত পশ্চিমী দেশগুলিতে সচ্ছল সমৃদ্ধ জীবনের হাতছানি দলে দলে দেশান্তরী করতে শুরু করল তাদের। দেখতে দেখতে প্রায় অ্যাংলো ইন্ডিয়ানশুন্য হয়ে গেল পার্ক সার্কাস সহ রিপন স্ট্রিট, এলিয়ট রোড, বেনিয়াপুকুর, পার্ক লেন, মারকুইস স্ট্রিট, তালতলা, এন্টালির মত মহল্লাগুলো। অন্যদিকে নিজেদের একাধিক প্রতিষ্ঠান এবং কাজকর্মের নজির থাকা সত্ত্বেও সংখ্যায় ইহুদি, পার্শি বা আর্মানিরা কোনদিনই তেমন বহুল পরিমাণে ছিলেন না এ শহরে। অন্তত মুম্বাইয়ের তুলনায় তো নয়ই। সেই তাদের মধ্যেও লাগল দেশত্যাগের হিড়িক। বিখ্যাত কেক বিপণি নাহুমের কর্ণধার ডেভিড নাহুম ছাড়া আমার চোখে দেখা একমাত্র ইহুদি, ১১৪ নং নিউ পার্ক স্ট্রিটের বাসিন্দা বৃদ্ধ জেকবসায়েব সপরিবারে পাড়ি দিলেন ইজরায়েল। প্রতিদিন ভোরবেলা নিজের প্রিয় পোষ্য শেপার্ড প্রজাতির কলি কুকুরটিকে নিয়ে পায়চারি করতে আসতেন পার্ক সার্কাস ময়দানে। আমাদের পরিবারের চারপেয়ে ফার্স্ট সিটিজেন এবং চরম প্যাম্পার্ড লাইকাকে নিয়ে আমিও যেতাম মাঝেমধ্যে। “কেন চলে যাচ্ছেন?” একদিন ফাঁকায় পেয়ে প্রশ্নটা করেই ফেলেছিলাম সায়েবকে। “মাই সন, আফটার অল ইটস মাই ওন কান্ট্রি, আওয়ার ড্রিমল্যান্ড!” বলার সময় জ্বলজ্বল করছিল বৃদ্ধের চোখজোড়া। যে দেশে অ্যাতোদিন রইলেন, রুটি, জীবিকা, প্রতিষ্ঠা সব পেলেন, সেই দেশ কোনো স্বপ্ন দেখায়নি আপনাকে? তাহলে এটা কি আপনার ‘ওন কান্ট্রি’ নয়? যদি হয় তাহলে কোন কুহকিনী আশায় এতদিনের স্বভূম এই দেশ, এই শহরটাকে ছেড়ে বিভুঁই অজানা পরবাসে চললেন? - বুক তোলপাড় করা প্রশ্নগুলো এসে গেছিল ঠোঁটের ডগায়। করতে পারিনি স্রেফ উজ্জ্বল চোখদুটোর দিকে তাকিয়ে। 

আরও পড়ুন
আকণ্ঠ মদ্যপান করে, জ্বলন্ত সিগারেট নিয়ে মশারির ভেতর ঢুকে পড়ল বাপ্পা

পার্ক সার্কাস লাগোয়া ট্যাংরা, ধাপা আর কিছুটা দূরে বেন্টিঙ্ক স্ট্রিট, টেরিটিবাজারের চিনাদের নিষ্ক্রমণ শুরু হয়েছিল ৬২-র ভারত-চিন যুদ্ধের পর থেকেই। তাতে শেষ কুঠারাঘাতটা হোল ট্যাংরার চামড়া কারখানাগুলো সরকারি নির্দেশে বানতলায় স্থানান্তরিত হওয়ায়। যার নিট ফল – অবাঙালি শ্রেষ্ঠীদের হাতে নিজেদের যুগ যুগ পুরনো ব্যবসা বেচে দিয়ে হংকং, কানাডা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমাতে শুরু করলেন চিনারা। হাতে গোনা কিছু রেস্তোরাঁ মালিক ও তাদের পরিবার ছাড়া বলতে গেলে প্রায় চিনাশূন্যই হয়ে গেল ট্যাংরার চায়না টাউন।

অলংকরণ - প্রণবশ্রী হাজরা

আরও পড়ুন
বাংলার তাবড় সেলিব্রিটির বাড়িতে মাছ যেত খালেকের দোকান থেকেই

Powered by Froala Editor

More From Author See More