কুন্তীর উপস্থিতি সত্ত্বেও, কেন মাদ্রীর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলেন পাণ্ডু?

মহাভারতে রাজনীতি – ১২

আগের পর্বে

কুন্তিদেশে একসময় কিছুদিনের জন্য থাকতে এলেন দুর্বাসা মুনি। তবে তাঁর কোপনস্বভাবের জন্য কেউই এগিয়ে এলেন না সেবার জন্য। শেষ অবধি কুন্তিভোজ রাজা পালিতা কন্যা কুন্তীকে পাঠালেন পরিচর্যার জন্য। কুন্তীর সেবায় খুশি হয়েই দুর্বাসা তাঁকে মন্ত্র দিয়েছিলেন কোনো দেবতাকে বশীভূত করার। সেই মন্ত্রবলেই সাড়া দিলেন সূর্যদেব। সতী থাকলেও রমনে পুত্রসন্তান হল কুন্তীর। পুত্র বসুষেণ বা কর্ণকে মঞ্জুষায় ভরে নদীতে ভাসিয়ে দিলেন কুন্তী। সেই মঞ্জুষা ভাসতে ভাসতে গিয়ে উঠল হস্তিনার চম্পানগরে। সেখানেই এক সূত পরিবারে বড় হতে লাগলেন কর্ণ। যার বহু পরে নববধূ হয়ে সেই রাজ্যেই আসবেন তাঁর গর্ভধারিণী।

কুন্তীর সঙ্গে ধুমধাম করে বিবাহ হল পাণ্ডুর। কুন্তিভোজ রাজা ও যাদবশ্রেষ্ঠ শূরসেন (কুন্তীর জৈবিক পিতা) পাণ্ডুর তথা হস্তিনার মিত্র হলেন। বন্ধুত্ব হল শূরসেনের পুত্র বসুদেবের সঙ্গেও। কিন্তু সেখানেই থেমে গেল না পাণ্ডুর রাজনৈতিক বিবাহ। কেবল যাদব ও ভোজদের সঙ্গে পেলেই হবে না। প্রয়োজন আরও বড় রাজনৈতিক মিত্রের। দেবব্রত-ভীষ্ম ভাবলেন, মদ্র দেশের রাজা শল্য অনেক বড় রাজা। তাঁর সঙ্গে কুরু বংশের একটা রাজনৈতিক যোগাযোগ হওয়া প্রয়োজন। সেই রকম ভাবনা থেকে মদ্র দেশে দূত পাঠানো হল। এমনিতে হস্তিনার চেয়ে মদ্র দেশ অনেক বেশি শক্তিশালী, তাঁদের রাষ্ট্রের সপ্তাঙ্গ অনেক মজবুত। বিশেষ করে দুর্গ ও কোশ। কিন্তু মদ্র দেশের বাসিন্দারা হস্তিনাবাসীর থেকে সাংস্কৃতিক ও সামাজিক দিক থেকে অনেক বেশি অনুন্নত, সেখানকার মানুষজন উলঙ্গ হয়ে ঘুরে বেড়ায়। রমণের সময়েও তারা গোপনীয়তা অবলম্বন করে না। অনেকে প্রকাশ্যে দাঁড়িয়ে সঙ্গম করে। কিন্তু মদ্র দেশ রাজনৈতিক শক্তির সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার মতো রাজা ভূভারতে আর নেই বললেই চলে। হস্তিনার সিংহাসন সুরক্ষিত রাখতে শুধু যাদব আর ভোজদের সঙ্গে মিত্রতাই যথেষ্ট নয়, মদ্র দেশের সঙ্গে সখ্য অত্যন্ত দরকারি। এই কথাটা ভীষ্ম যেমন বুঝলেন, তেমনি পাণ্ডুকেও বোঝাতে সক্ষম হলেন। 

মদ্র দেশ বা বাহ্লীক যা পঞ্জাব নামে খ্যাত, পঞ্চ নদের কল্যাণে সেই দেশে সোনার ফসল ফলে। সেই রাষ্ট্রের অধিপতি হলেন অতিরথ শল্য। শল্য অতিশয় রাজনৈতিক বুদ্ধিসম্পন্ন নৃপতি। তাঁর পিতার নাম অর্তায়ন। প্রহ্রাদের কনিষ্ঠ ভ্রাতার নাম ছিল সংহ্রাদ। তিনিই পরজন্মে শল্য হিসাবে জন্ম নেন। ‘শল্য’ শব্দের অর্থ তীক্ষ্ম অস্ত্র, শল্য সুন্দরী ও যোদ্ধা মাদ্রীর অগ্রজ। শল্য নিজেও খুব বড় যোদ্ধা ছিলেন। তিনি আচার্য দ্রোণের কাছে অস্ত্রশিক্ষা লাভ করেছিলেন। শল্যের সঙ্গে একবার পাণ্ডুর মুখোমুখি দেখা হয় এবং দুজনের মধ্যে বাকবিতণ্ডাও হয়। পাণ্ডু তখন কোনও স্থান থেকে হস্তিনাপুরে ফিরছিলেন। সেই মুখোমুখি আলাপ-বিলাপে দুজনের মধ্যে কোনও জয়-পরাজয় নিশ্চিত হয় না। তখন মদ্ররাজ শল্য হস্তিনাধিপতি পাণ্ডুকে প্রস্তাব দেন যে হয় তাঁরা যুদ্ধ করে বিজয়ী বা বিজিত নির্ধারণ করতে পারেন অথবা বৈবাহিক সম্পর্কের মাধ্যমে তাঁদের মধ্যে নতুন বন্ধুত্ব রচিত হতে পারে। শল্যের যিনি সেনাপতি ছিলেন, তিনি আর কেউ নন, তাঁর নিজের ভগ্নী মাদ্রী। পাণ্ডু মাদ্রীর রূপে ও গুণে বিমোহিত হলেন। তিনি বিবাহ-প্রস্তাবে সম্মত হলেন। পিতামহ ভীষ্মের অনুমতি নেওয়ার জন্য তিনি উদগ্রীব হয়ে উঠলেন। এই বিবাহ পাণ্ডুকে রাজনৈতিক দিক থেকে অনেক কদম এগিয়ে রাখবে। ভারতবর্ষের পশ্চিম দেশ মদ্র যদি হস্তিনার মিত্র হয় তাহলে পাণ্ডু দিগ্বিজয়ে সক্ষম হবেন।  

হস্তিনাপুরে ফিরে পাণ্ডু সব কিছু খুলে বললেন পিতামহ ভীষ্মকে। ভীষ্ম মদ্ররাজের কাছে দূত মারফত বিবাহ-প্রস্তাব পাঠালেন। মদ্ররাজ শল্য জানালেন, তিনি এই বিবাহে সম্মত রয়েছেন কিন্তু তাঁর একটি শর্ত আছে। পাণ্ডু জন্ম অসুস্থ হলেও তিনি হস্তিনাধিপতি। তাঁরর সঙ্গে মাদ্রীর বিবাহের প্রস্তাব অতি উত্তম কিন্তু মদ্রদেশে একটি নিয়ম আছে যা তাঁদের পূর্বপুরুষেরা স্থাপন করে গিয়েছেন। উপযুক্ত কন্যাপণ না পেলে তিনি মাদ্রীর বিবাহ পাণ্ডুর সঙ্গে দিতে আগ্রহী নন। ভীষ্মকে তিনি বার্তা পাঠালেন, হে সত্তম্, আপনাকে পণ দেওয়ার কথা বাধ্য হয়ে বলছি কারণ সেটাই মদ্র রাজবংশের কুলধর্ম। পিতৃপিতামহের আচরিত ধর্মই কুলধর্ম। জাতিধর্ম ও কুলধর্ম এক নয়। জাতিধর্ম হল বর্ণাশ্রমিক স্বধর্ম, অন্যদিকে কুলধর্ম হচ্ছে অপরিত্যজ্য পারিবারিক ধর্ম। জাতিশ্রেণ্যধিবাসানাং কুলধর্ম্মাশ্চ সর্ব্বতঃ।/বর্জ্জয়ন্তি চ যে ধর্ম্মং তেষাং ধর্ম্মো ন বিদ্যতে।।

বরকর্তা ভীষ্ম ও বর পাণ্ডু অসংখ্য রত্নরাজি কন্যাপণ হিসাবে মদ্ররাজকে দান করার কথা অঙ্গীকার করলেন। মদ্ররাজ শল্য ভীষ্মের হাতে কন্যাকে তুলে দিলেন। দেবব্রত-ভীষ্ম মাদ্রীকে সঙ্গে করে হস্তিনার রাজপ্রাসাদে নিয়ে এলেন, তখনও পাণ্ডুর সঙ্গে মাদ্রীর বিবাহ হয়নি। হস্তিনার প্রাসাদে এসে পুরোহিত ডেকে সেই বিবাহ সম্পন্ন হয়। ভীষ্ম মদ্রকন্যার সঙ্গে পাণ্ডুর বিবাহ দিলেন এই কথা চিন্তা করে যে, হস্তিনার সিংহাসন যেহেতু সুরক্ষিত নয়, তাই কোনও বিপদ এলে কুন্তি দেশের ভোজেরা এবং মদ্রদেশের ক্ষত্রিয়রা এসে হস্তিনার পাশে দাঁড়াবেন। বিবাহের পর পাণ্ডুও নিজেকে অধিকতর ক্ষমতাবান ভাবতে লাগলেন। মাদ্রীর সঙ্গে বিবাহের এক মাস পর পাণ্ডু বের হলেন দিগ্বিজয়ে। দিগ্বিজয়ে বের হওয়ার অর্থ সব সময় যুদ্ধ করা, এমন নয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আলাপ-আলোচনা ইত্যাদির মাধ্যমে বিভিন্ন রাজ্যের কাছ থেকে কর নেওয়া বা বশ্যতা স্বীকার করানো, নিদেনপক্ষে বন্ধুত্ব তৈরি করা দিগ্বিজয়ের লক্ষ্য। বহু দেশ ঘুরে পাণ্ডু অবশেষে হস্তিনায় ফিরে এলেন। দিগ্বিজয়ে তিনি যে খুব একটা সফল হয়েছিলেন, তা বলা যায় না। বরং অসুস্থ পাণ্ডু আরও বেশি হতাশ হলেন। শারীরিক ব্যাধির সঙ্গে সঙ্গে মানসিক আধি তাঁকে গ্রাস করল। কুন্তি দেশ ও মদ্র দেশের লোকজনের সাহায্য তিনি বিশেষ পাননি। দশার্ণ, মগধ, মিথিলা, কাশী, সুহ্ম, পুণ্ড্র এই সব দেশ জয় করতে তাঁকে বেগ পেতে হল প্রচণ্ড। তাঁরা পাণ্ডুর চেয়ে অনেক বলশালী রাজা। ওদিকে যাদবরাও পাণ্ডুকে কোনও সহায়তা করেননি। মনের দুঃখে পাণ্ডু ঠিক করলেন, তিনি আর রাজা থাকবেন না, ত্যাগ করবেন হস্তিনার সিংহাসন। কিন্তু যাবেন কোথায়? একবার ভাবলেন, বাণপ্রস্থে যাবেন, কিন্তু তাঁর সেই বয়স এখনও হয়নি। কুন্তী বা মাদ্রীর গর্ভে পাণ্ডু কোনও সন্তান উৎপাদন করতে পারলেন না। কুন্তী জানেন, পাণ্ডুর জৈবিক গোলমালের কথা। পাণ্ডু তপস্যা করার কথা ভাবলেন। কিন্তু দুই স্ত্রীর কথায় পিছিয়ে এলেন। মূলত কুন্তীর পরামর্শে পাণ্ডু দুই স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে বনে গেলেন। সেখানে মৃগয়া করে দিন কাটাতে লাগলেন। কিন্তু কোন উদ্দেশ্যে বনে গেলেন পাণ্ডু? হঠাৎ রাজপ্রাসাদের সুখ-ঐশ্বর্য ছেড়ে বনে চলে যাওয়ার কারণই বা কী? 

আরও পড়ুন
ব্যক্তিগত নয়, যৌথ মালিকানার জন্যই আজীবন লড়াই চালিয়েছেন কর্ণ

ধৃতরাষ্ট্র অন্ধ হলেও তিনি বিচিত্রবীর্যের জ্যেষ্ঠ ক্ষেত্রজ পুত্র। হিসেব মতো তাঁরই রাজ্যে অধিকার ছিল। কিন্তু জন্মান্ধ বলে তাঁকে সিংহাসন দেওয়া হয়নি। কিন্তু পাণ্ডুও জন্ম থেকে রক্তাল্পতায় ভুগছিলেন। তাঁর রক্তে উপযুক্ত লৌহ না থাকার দরুন তিনি ছিলেন চিররুগ্ন। ত্রিধাতুর মধ্যে পিত্তের পরিমাণ তাঁর শরীরে ছিল অধিক, তাই তাঁর শরীরের বর্ণ, বল, স্নেহ, ওজো কোনওটাই স্বাভাবিক ছিল না। উপরন্তু তিনি ছিলেন পুরুষত্বহীন। ধৃতরাষ্ট্র রাজা না হলেও অর্ধেক রাজত্ব তাঁর নামেই ছিল। ধৃতরাষ্ট্রের সঙ্গে পাণ্ডুর এই নিয়ে মন কষাকষি ছিল যথেষ্ট পরিমাণে। কালক্রমে পাণ্ডু যখন বুঝলেন কুলধর্ম অনুযায়ী ধৃতরাষ্ট্রের সিংহাসন পাওয়া উচিত, তখন তিনি বনে চলে গেলেন। শুরুতে তিনি দুই স্ত্রীকে নিয়ে যাওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন না। কিন্তু কুন্তী যখন বললেন বনে গিয়ে ঋষি বা ক্ষত্রিয় পুরুষের দ্বারা তাঁরা দু জন—কুন্তী ও মাদ্রী—পাণ্ডুর ক্ষেত্রজ সন্তান উৎপাদন করতে পারেন, তখন পাণ্ডু সম্মত হলেন তাঁদের নিয়ে যেতে। হিমালয়ে দক্ষিণ পাশে গিরিপৃষ্ঠে এবং সংলগ্ন প্রকাণ্ড বনে তিনি মৃগয়া করেই দিন কাটাতে লাগলেন। পাণ্ডু, কুন্তী ও মাদ্রী আশ্রম নির্মাণ করে কখনও বনে আবার কখনও গিরিপৃষ্ঠে বাস করতে লাগলেন। পাণ্ডুর এই মৃগয়া এবং পর্বত ও বনবাস শুধু বিলাসিতা ছিল না, তিনি ভাবছিলেন কী উপায়ে সুস্থ সন্তান উৎপাদন করে তাঁকে বা তাঁদের হস্তিনার রাজসিংহাসনের দাবিদার করে তোলা যায় । মাঝেমধ্যে অগ্রজ ধৃতরাষ্ট্র অনুজ পাণ্ডু ও তাঁর দুই স্ত্রীর জন্য দূত মারফত নানা ভোগ্যবস্তু পাঠাতে লাগালেন। এতে করে বোঝা যায় যে, নিবৃত্তিমার্গ অবলম্বন করে পাণ্ডু বনে গমন করেননি। 

আরও পড়ুন
দরিদ্র প্রজার ব্যয় বহন করতে শাসক বাধ্য, এমনই নীতিশিক্ষা মহাভারতের

রাজনীতির ঝামেলায় বা বলা ভালো, ক্ষমতার দ্বন্দ্বে নাজেহাল হয়ে, নিজের জন্মদুর্বল শরীর নিয়ে জর্জরিত হয়ে পাণ্ডু বনে এসে মহা বিপদে পড়লেন। সেই বনে ছিলেন কিমিন্দম নামের এক মুনি। সেই মুনির ছিল হরিণের মতো চেহারা। তাঁর যে সঙ্গিনী তিনিও হরিণীর মতো। তাঁরা সন্তান লাভের আশায় বনের মধ্যে মৈথুনক্রিয়ায় রত ছিলেন।

আরও পড়ুন
দক্ষ শাসক হবেন সু-অভিনেতা, উপেক্ষা করতে হবে লোকনিন্দাও - মহাভারতের শিক্ষা এমনই

অলংকরণ – প্রণবশ্রী হাজরা

আরও পড়ুন
ঐশ্বরিকতা নয়, রাজ্য এবং রাজা সৃষ্টির পিছনে প্রধান নিয়ামক রাজনীতিই

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
কোনো অবস্থাতেই সত্যের অপলাপ করতে পারবেন না শাসক, নির্দেশ মহাভারতকারের

More From Author See More