ব্যক্তিগত নয়, যৌথ মালিকানার জন্যই আজীবন লড়াই চালিয়েছেন কর্ণ

মহাভারতে রাজনীতি – ১১

আগের পর্বে

ব্যাসদেব তাঁর তিনপুত্র পাণ্ডু, ধৃতরাষ্ট্র এবং বিদুরকে অনেকটা পুংকোকিলের মতোই রেখে এলেন ভীষ্মের কাছে। পাণ্ডু জন্মান্ধ এবং বিদুর শুদ্র বলে সিংহাসনে বসলেন পাণ্ডু। তবে রাজধর্মপরায়ণ ছিলেন বিদুরই। তবে পাণ্ডু রাজনীতির অন্যতম তত্ত্ব জনপদে মন দিলেন না। এই অবস্থায় তাঁর বিবাহ হল সূর্যের ক্ষেত্র কুন্তীর সঙ্গে। প্রথমত কুন্তী শূরের কন্যা এবং সূর্যের পুত্রের জননী, এই দুই রাজনৈতিক কারণেই সম্পন্ন হয়েছিল সেই বিবাহ।

কুন্তি দেশটি ছিল মথুরা-শূরসেন অঞ্চলের কাছে। যদু-বৃষ্ণি বংশের অন্যতম শাখা ছিল কুন্তিগণ বা কুন্তি দেশের জনগণ। তাঁরা জরাসন্ধের আক্রমণের ভয়ে উত্তর থেকে ক্রমাগত কোণঠাসা হতে হতে দক্ষিণে গিয়ে বাস করছিলেন। বহুকাল আগে পরশুরাম ক্ষত্রিয়-নিধনের সময় কুন্তির সমস্ত ক্ষত্রিয়দের বধ করেছিলেন। দ্বাপরে কুন্তি দেশের ক্ষত্রিয়রা হলেন সঙ্কর জাতি, চতুর্বর্ণের কেউ নন। ওই দেশে এক সময় দুর্বাসা মুনি এলেন। ঋষি দুর্বাসার কোপনস্বভাব সম্পর্কে সকলে ওয়াকিবহাল। তিনি আবার ওই রাজ্যে বেশ কিছু কাল থাকবেনও বললেন। কিন্তু কে তাঁর সেবা করবে? একটু অনর্থ হলেই তিনি গোটা রাজ্য ছারখার করে দেবেন। তিনি নিজেই তেজের আধার, অন্যের তেজে ভাস্বর নন। দুর্বাসা ছিলেন নামকরা রাজনীতিবিদ এবং তাঁর রাজনীতি ছিল সূর্যবংশীয়দের অনুরূপ। তাঁর শাপে চন্দ্রবংশীয় রাজা দুষ্মন্ত শকুন্তলাকে ভুলে গিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে পাণ্ডবদের বিপন্ন করার জন্য তিনি নানা কৌশল অবলম্বন করেছিলেন। কৃষ্ণের শরীরে গরম পায়েস লেপন করার আদেশ দেন, কৃষ্ণপত্নী রুক্মিণীর দেহে দেহে উষ্ণ পায়েস লেপন করে তাঁকে রথে যোজনা করে কশাঘাত করেছিলেন। দুর্বাসার শাপে কৃষ্ণের পদতল সুরক্ষিত ছিল না এবং সেই কারণে তাঁর মৃত্যু হয়। দুর্বাসার অভিশাপে যদু বংশ ধ্বংস হয়।

এমন মুনিকে সন্তুষ্ট করার জন্য, পরিচর্যা ও সেবা করার নিমিত্ত কুন্তিভোজ রাজা পালিতা কন্যা কুন্তীকে পাঠালেন। ‘দুর্বাসা’ শব্দের অর্থ ঋগ্বেদে রয়েছে মন্দবস্ত্রযুক্ত। এই ‘বস্ত্র’ কী? তা হল আচ্ছাদক বা পরিচ্ছদ। ‘বস্ত্র’ বস্-ধাতু থেকে নির্গত, যার একটি অর্থ অপহরণ। এই বস্ত্র আবার মন্দ বা মন্থর, কিন্তু বস্ত্র তো মন্থর হতে পারে না, তার মূলীভূত ধাতু ‘মন্দ্’ হল দীপ্তি। দুর্বাসা মুনি রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সূর্যবংশীয়দের মতাবলম্বী। মহাভারতে আছে, দুর্বাসার জন্ম শঙ্কর বা শিবের অংশে। শিবের আর এক অংশাবতার হলেন বৃহস্পতির ধর্ষণজাত পুত্র ভরদ্বাজের পৌত্র অশ্বত্থামা। দুর্যোধনকেও কেউ কেউ শিবের অবতার বলে থাকেন। রাজনীতি-অর্থনীতির প্রশ্নে দুর্বাসা মুনি ছিলেন যৌথ মালিকানার পক্ষে। পক্ষান্তরে যদু-বৃষ্ণি বংশ ঠিক এর বিপরীত ধারায় রয়েছে। এ হেন মুনির পরিচর্যার ভার দেওয়া হল কুন্তিভোজ রাজার পালিতা কন্যা যুবতী সুন্দরী কুন্তী বা পৃথাকে। পৃথা বলেছেন, দুর্বাসা তাঁর সঙ্গে যা করেছেন সে সব কথা লোকসমক্ষে প্রকাশ করা যাবে না। তাতে রাগ করার মতো অনেক বড়ো বিষয় ছিল। 

কোপস্থানেষ্বপি মহৎস্বকুপ্যন্ন কদাচন।

তবে কুন্তীর সমর্পিত সেবায় দুর্বাসা সম্পূর্ণ সন্তুষ্ট হলেন-- তস্যাস্তু শীলবৃত্তেন তুতোষ মুনিসত্তমঃ। কুন্তীর পরিচর্যায় তুষ্ট দুর্বাসা মুনি বর প্রার্থনা করতে বললেন পৃথাকে। কুন্তী বললেন, আপনি খুশি হয়েছেন, পিতা প্রসন্ন হয়েছেন, আমার আর বর চাওয়ার দরকার নেই-- ত্বং প্রসন্নঃ পিতা চৈব কৃতং বিপ্র বরৈর্মম। দুর্বাসা কুন্তীকে বললেন, তোমাকে মন্ত্র দিচ্ছি, সকামভাবে অথবা নিষ্কামভাবে, যেমনভাবে চাইবে, সেই বরে যে দেবতাকে ডাকবে তিনি তোমার কাছে এসে ভৃত্যের মতো বাঁধা পড়বেন-- বিবুধো মন্ত্রসংশান্তো ভবেদ্ ভৃত্য ইবানতঃ। মন্দ বস্ত্র যাঁর তিনি পরিতুষ্ট হয়ে চলে গেলেন। দুর্বাসা জানতেন, যুবতী কুন্তী সকামভাবে দেবতাকে ডাকবেনই, আর সেই দেবতা সূর্য ছাড়া আর কেউই হবে না। সত্যিই তাই হল। একলা ঘরে শুয়েছিলেন, কুন্তীর গায়ে সূর্যের নরম আলো এসে পড়ল, তিনি সূর্যদেবকে মন্ত্র পড়ে ডাকলেন। পূর্ব দিগন্তের সূর্য কানে সোনার দুল আর বুকে পিঠে বর্ম পরে কুন্তীর সামনে এসে হাজির হলেন। সূর্য কুন্তীকে বললেন, কিং করোমি বশো রাজ্ঞি! আমি তোমার বশীভূত, বলো আমি কী করব? 

আরও পড়ুন
দরিদ্র প্রজার ব্যয় বহন করতে শাসক বাধ্য, এমনই নীতিশিক্ষা মহাভারতের

সূর্যের সঙ্গে কুন্তীর অনেক আলাপ, তর্ক হল। শেষমেশ কুন্তী বলে ফেললেন, ঋতে প্রদানাদ্ বন্ধুভ্যস্তব কামং করোম্যহম্। আত্মীয়স্বজনের দুশ্চিন্তা বাদ দিয়ে আমি তোমার ইচ্ছে পূর্ণ করব। কিন্তু হে দুর্ধর্ষ, আমি সতী থাকতে চাই। সূর্য কথা দিলেন, কুন্তী সতী থাকবেন এবং তাঁর পুত্র হবে অনন্ত খ্যাতির অধিকারী। কুন্তী উত্তর করলেন, যদি তাই হয়—আমাদের পুত্র যদি অমৃতময় কবচ ও কুণ্ডলের অধিকারী হয়, তবে হোক আমাদের ঈপ্সিত সঙ্গম—অস্তু মে সঙ্গমো দেব যথোক্তং ভগবংস্ত্বয়া। তোমার শক্তি, অধ্যাবসায়, রূপ, তেজ, ধর্মের দীপ্তি নিয়ে সে জন্মাক। সূর্য কুন্তীর সঙ্গে সর্বপ্রকারের রমণ করলেন। যথা সময়ে কুন্তীর গর্ভলক্ষণ প্রকাশ পেল, তিনি ধাত্রীর সাহায্যে সে সব গোপন করে প্রসব করলেন এক পুত্র—যথাস্য পিতরং তথা। ঠিক সূর্যের মতো দেখতে, গাত্রবর্ম ও কর্ণকুণ্ডল সহজাত। সেই পুত্রকে মঞ্জুষায় ভরে ভাসিয়ে দিলেন বাড়ির কাছের নদীতে, সেই নদীর নাম ‘অশ্ব’। পুত্রের নাম?   

আরও পড়ুন
দক্ষ শাসক হবেন সু-অভিনেতা, উপেক্ষা করতে হবে লোকনিন্দাও - মহাভারতের শিক্ষা এমনই

বসুষেণ—সোনার ছেলে। ভাসতে ভাসতে অশ্ব নদী থেকে চর্মণ্বতী নদী, সেখান থেকে যমুনা, তার পর গঙ্গায় এলেন সদ্যোজাত কর্ণ। অঙ্গ রাজ্যের রাজধানী চম্পানগরীতে। অঙ্গ তখন ছিল হস্তিনার অন্তর্গত। কুন্তী হস্তিনায় বধূ হিসাবে আসার আগেই সেখানে পৌঁছে গেলেন তাঁর পুত্র। বসুষেণ মহাভারতে ‘কর্ণ’ নামে বেশি পরিচিত। কর্ণ হল ত্রিকোণাদিক্ষেত্রে কোটি ও ভুজের সংযোজকরেখা। বৃত্তের ব্যাস বা সূর্যশতককেও ‘কর্ণ’ বলা হয়। 

আরও পড়ুন
ঐশ্বরিকতা নয়, রাজ্য এবং রাজা সৃষ্টির পিছনে প্রধান নিয়ামক রাজনীতিই

অশ্ব হল সেই পণ্যপ্রবাহের স্রোতধারা যা পথ ব্যাপ্ত করে। সূর্যের সপ্তাশ্বের অন্যতম অশ্বতে চড়ে বসুষেণ এলেন চর্মণ্বতীতে, যে নদীর উৎপত্তি গোরক্তে। রন্তিদেবের যজ্ঞে নিহত গরুর চর্মের রক্তে উৎপন্না। তার পর যমুনা—যম্ ধাতু থেকে উৎপন্না, যার অর্থ নিবৃত্তি। যমুনা গঙ্গায় নিবৃত্তা। অবশেষে গঙ্গা—শুভ্র পণ্যপ্রবাহে এসে পড়লেন সেই শিশু। আলো থেকে রক্ত, সেখান থেকে কালো, অতঃপর শাদা—এই ছিল সদ্যজাতের ভ্রমণবৃত্তান্ত। গঙ্গা-যমুনার মধ্যে যে রাজনৈতিক লড়াই-- শুভ্র পণ্যপ্রবাহ বনাম কৃষ্ণপ্রবাহ, গঙ্গাদেবী বনাম যমুনার খেয়ানী মৎস্যগন্ধা, সূর্য বনাম চন্দ্র, অঙ্গাত্মবাদ বনাম অধ্যাত্মবাদ—সেখানে এক নতুন পুরুষের আবির্ভাব হল। সেই রাজনৈতিক পুরুষের নাম কর্ণ বা বসুষেণ। বসুষেণ বড় হতে লাগলেন সূত পরিবারে। সূত জাতি সঙ্কর, চতুর্বর্ণের বাইরে তাঁদের অবস্থান। সূত হল ব্রাহ্মণীতে জাত ক্ষত্রিয়পুত্র। যদু, তুর্বসু সকলেই সেই অর্থে সূত। তাঁদের কাজ হল সারথিবৃত্তি করা কিংবা পুরাণের গল্প বলা। কর্ণ সূর্যবংশের রাজনীতিতে এক উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব। যৌথ মালিকানার সপক্ষে তিনি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত লড়াই করে গিয়েছেন। তাঁকে সঙ্গ দিয়েছিলেন শিবের অনুগামীরা—দুর্যোধন প্রমুখ কৌরবেরা এবং অশ্বত্থামা। পক্ষান্তরে বিষ্ণুর অনুগামীরা ব্যক্তিমালিকানার পক্ষে লড়াই করে গিয়েছেন আজীবন। কর্ণ বড় হতে লাগলেন সূত অধিরথের গৃহে, অধিরথ ধৃতরাষ্ট্রের সখা। কর্ণের নতুন জননীর নাম ‘রাধা’। হস্তিনা হল কর্ণের গৃহ, কিছু দিন পর যেখানে তাঁর গর্ভধারিণী আসবেন নববধূ হয়ে।           

আরও পড়ুন
কোনো অবস্থাতেই সত্যের অপলাপ করতে পারবেন না শাসক, নির্দেশ মহাভারতকারের

এ দিকে পাণ্ডু হস্তিনার রাজা হয়েছেন, তাঁর জন্মদোষ থাকা সত্ত্বেও। জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা ধৃতরাষ্ট্র অন্ধ হওয়ার জন্য তিনিই সিংহাসন পেয়েছেন। দাসীপুত্র ও শূদ্রযোনিজ বলে কনিষ্ঠ কুরুরত্ন বিদুর হলেন ব্রাত্য। 

আরও পড়ুন
সিংহাসনে বসবেন না ভীষ্ম, রাজাহীন হস্তিনাপুরের ভার নিতে আহ্বান ‘কানীনপুত্র’ ব্যাসদেবকে

ধৃতরাষ্ট্রস্ত্বচক্ষুষ্টাদ্ রাজ্যং ন প্রত্যপদ্যত।

আরও পড়ুন
একে একে সাত পুত্রকে হত্যা করলেন গঙ্গা, দুঃখে শোকে অস্থির শান্তনু

পারশবত্বার্দ্বিদুরো রাজা পাণ্ডুর্বভূব হ।।

আরও পড়ুন
যৌথ মালিকানা থেকে পরিবার হয়ে ব্যক্তি মালিকানার সূচনা; সাক্ষী মহাভারত

পুত্রাদিক্রমে রাজনৈতিক উত্তরসূরী হওয়ার অধিকার মহাভারতে প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু বহু ক্ষেত্রে উত্তরাধিকারীদের স্বাভাবিক অধিকার লোপের উদাহরণও আছে। ধৃতরাষ্ট্র ও বিদুর তার জ্বলন্ত উদাহরণ। রাজা না হওয়া সত্ত্বেও ধৃতরাষ্ট্রের অর্ধেক রাজত্বে অধিকার ছিল, এ কথা মহাভারতে বিধৃত আছে—ধৃতরাষ্ট্রশ্চ পাণ্ডুশ্চ সুতাবেকস্য বিশ্রুতো/ তয়োঃ সমানং দ্রবিণং পৈতৃক্রং নাত্র সংশয়ঃ।। এখানে সঙ্গতভাবে দুটি প্রশ্ন ওঠে। এক, জ্যেষ্ঠ পুত্র সিংহাসনের প্রকৃত অধিকারী অর্থাৎ গোটা রাজ্য তাঁর অধীনে থাকবে। পাণ্ডুও রাজপদের যোগ্য ছিলেন না, সে কথা ব্যাসদেব নিজেই বলেছেন। দুই, যদি সম্পত্তি ভাগ করে দেওয়াই হয়, তাহলে বিদুর কেন সম্পত্তির ভাগ পেলেন না? এই দ্বিতীয় প্রশ্নটি যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। অন্ধত্ব, পাণ্ডুত্ব, পারশবত্ব যদি রাজপদের প্রতিবন্ধকতা হয়, তাহলে সম্পত্তি ভাগের ক্ষেত্রে শুধু প্রথম দুটিকে বেছে নেওয়ার মধ্যে এক ধরণের চালাকি আছে। এবং সেই চাতুর্যের প্রধান কাণ্ডারী ছিলেন ‘দ্যু’ নামক বসু—যাঁর এখনকার নাম ভীষ্মদেব। তিনি রাষ্ট্রের অধিপতি না হয়েও মনুর বিধানমতে রাজনীতিকে প্রভাবিত করে চলেছেন। প্রাক্তন পরাশরপত্নী সত্যবতী কিংবা সত্যবতীপুত্র ব্যাসদেব এখানে গাঙ্গেয়-র নিকটে সম্পূর্ণ পরাস্ত হলেন।

আরও পড়ুন
কর্ণ ও অর্জুনের বিবাদ নেমে এসেছিল সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িক সংঘাতেও

অলংকরণ – প্রণবশ্রী হাজরা

আরও পড়ুন
রাজনৈতিক নেতা হবেন সংকীর্ণ ধর্মগুণের ঊর্ধ্বে, এমনই শিক্ষা দেয় মহাভারত

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
বাগ-দেবী সরস্বতীর হাত ধরেই সৃষ্টি দণ্ডনীতি বা রাজনীতির

More From Author See More