ঘড়িক্কে 'ঘোড়া' ছোটে

মুছে যায়? – ১১

আগের পর্বে

শরীরচর্চা আর ব্যায়ামাগারের প্রচলন বহু আগে থেকে। সেই ১৯০৪-০৫ এর সময়ে। কিন্তু বডি বিল্ডিং আর ওয়েট লিফটিংয়ের ফারাক বোঝা হয়েছিল অনেক পরে। শরীরচর্চার আরেকটি ধারা হল কুস্তি। কুস্তির চল ছিল ঠাকুর পরিবারেও। এই মল্লযুদ্ধ ভারতে বহু প্রাচীন। মহাভারতেও ভীম, জরাসন্ধ, কৃষ্ণ, বলরাম-- সকলেই ছিলেন মল্লযোদ্ধা। কলকাতা, বালি, উত্তরপাড়া সবজায়গাতেই পাড়ায় পাড়ায় গড়ে উঠেছিল বহু ব্যায়ামাগার। উঠে এসেছিল মনোহর আইচ, মনোতোষ রায়ের মতো বহু নাম। তাঁরা অনেকেই হারিয়ে গেছে ইতিহাস থেকে।

ঘড়ি, ঘোড়া আর ঘুড়ি এই তিনটি শব্দের মধ্যে কোথায় যেন একটা উচ্চারণ গত যোগ আছে। অবশ্য এমনটা মনে হয়েছে আমার কানে শুনতে শুনতে। কারণ আমি না ব্যাকরণবিদ, না ভাষাবিদ, কোনোটাই নয়।

ঘড়ি মানে হাতঘড়ি, দেওয়াল ঘড়ি, ওয়াল ক্লক। অ্যাংলো সুইস- ক্যাভালরি, ফেবার লুবা, টি শট, ওমেগা, ওয়েস্ট এন্ড ওয়াচ, হেনরি স্যান্ডোজ। তারপর এল রিকো, সিকো। 

ঘড়ি তৈরিতে সুইস সাহেবরা মাস্টার। তারপর জার্মানরা। এরপর জাপান, ব্রিটিশ, ফরাসি, আমেরিকানরা ঘড়ি বানায়। তবে দুনিয়া জুড়ে সুইৎজারল্যান্ডের হাতঘড়ি বিশ্বজোড়া নাম তার। সুইস মেড। 

নব্বই দশকের  সস্তার সাদা ডায়ালের ঘড়ি অ্যাংলো সুইস ক্যাভালরি৷ সস্তা মানে পঞ্চাশের দশকে পঁচানব্বই  টাকা। তার দাম ও  তো তখন অনেক।

আরও পড়ুন
ব্যা-ব্যা-ব্যায়ামাগার – আখড়া

সাদা ডায়াল এর তুলনায় ব্ল্যাক ডায়ালের দাম একটু বেশি। 

আরও পড়ুন
মুড়ো, মুন্ডু, কল্লা

ঘড়ি পরা হাতে ঘড়ি বাধার কেতা বিশেষ তখন। সাহেবদের তৈরি ঘড়ি, সাহেবরাই নিয়ম বেঁধে দিল বোধহয়, মেয়েরা লেডিস ঘড়ি পরবে ডান হাতের কব্জিতে। পুরুষেরা ঘড়ি বাঁধবে বাঁ হাতের কব্জিতে। কিন্তু কেই বা নিয়ম কানুন নিত্যদিন ফলো করে। ফলে লেডিস ঘড়ি ললনাদের বাঁ হাতে এলো। আবার ছেলেরা ষাট-সত্তরে ডান হাতে ঘড়ি পরা শুরু করলেন কেউ কেউ সিনেমা ফ্যাশনে। হিরোর অনুকরণে, ভিলেনকে কপি করে। 

আরও পড়ুন
টোকাটুকি, টুকলি, চোতামারা

রুপো রংয়ের স্টিল ব্যান্ডের ঢলঢলে ঘড়ি। প্রায় কবজি ছুঁয়ে আছে।

আরও পড়ুন
ছিটকিনি পাইপগান ক্রমশ ক্রমশ...

মারামারির সময় হাতাহাতি, গুঁতোগুঁতি, ঠেলাঠেলি করতে করতে দাঁতে করে টিপে আটকানো ঘড়ির ব্যান্ডকে খুলতেও দেখেছি অনেককে। অথবা স্প্রিং দেওয়া ব্যান্ড খুলতে দাঁতের ব্যবহার হত বেশি। ঘড়িটা ধর তো বলে, ঘড়ি খুলে কারোর হাতে দিয়ে মুহূর্তে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন মারামারিতে, সেটা ষাটের শেষে, সত্তর দশকে কখনো।

আরও পড়ুন
চান্দ্রায়ণ

ঘড়ির কাচ তখন ভাঙত ধাক্কাধাক্কিতে। তার বদলও হত অতি দ্রুত। আবার কম পয়সা যাদের তাঁরা চালাতেন ফাটা কাচেই। তখন থেকে নিচে পড়লে ঘড়ির... ঘড়ির দম দেওয়া অয়েলিং। সত্তর দশকে অয়েলিং চার্জ ত্রিশ টাকা। 

আরও পড়ুন
পান-বিড়ির গুমটি

ঘড়ি বিক্রির বড়ো বড়ো দোকান কলকাতার রাধাবাজারে। লালবাজারের লাগোয়া রাধা বাজারে সার সার ঘড়ির দোকান। সেখানে ঘড়ির দোকানের ওয়াচ সেক্টরের দেওয়ালে দেওয়ালে ওয়ালক্লক। বেশির ভাগ ওয়ালক্লকের ডায়াল হত সাদা আর তাদের অপর সময় সংখ্যা ওয়ান টু থ্রি ফোর। বেশিরভাগই এইসব ঘড়ির ডায়ালে প্রধাণত ইংরেজির এক দুই তিন। কিন্তু তার বাইরে রোমানও আছে - সংখ্যাচিহ্ন হিসেবে। 

আরও পড়ুন
ঋতু, ঋতুবন্ধ – ঋতুসংহার

'বিগবেন' নামক ঘড়িটির কথা তো জানেন অনেকেই। কাশীতে - ঠিক কাশীতে নয়, রামনগর বা ব্যাস কাশীতে দেখি কাশী নরেশের - কাশীরাজের ঘড়ি। তার মধ্যে দিন-মাস-বছর তারিখ, কি নেই। বছর কয়েক আগে বারাণসী গিয়ে কাশীর রাজার সেই ঘড়িটিতে আবার দেখি, চালুই আছে। যদিও সেই জাদুঘর-- মিউজিয়াম এর অবস্থা বেশ খারাপ। ঢুকতে হয় টিকিট কেটে কিন্তু ভিতরে অধিকাংশ জিনিসই ধূলিমলিন। দেখভাল-- ঝাড়পোঁছ একেবারেই হয়না প্রায়। গাড়ি, ঘোড়ার গাড়ি, ঝাড়লন্ঠন, তরবারি, বন্দুক, রাইফেল সবেরই সমদশা। 

আরও পড়ুন
শুকুত – জিহ্বান্তরে আড়-বেগুন

হায়দ্রাবাদের সালারজং মিউজিয়াম এ কাছে হায়দ্রাবাদের একদা শাসক নিজামদের ঘড়ি সংগ্রহ। দেখার মতো সেই কালেকশন। 

আরও পড়ুন
বর্মা বার্মা বার্মিজ

ঘড়ি এবং রাইফেল দুটি বস্তুরই সাহেবদের অভিধানেই রিপিটার বলে স্বীকৃত। আর বাঙালিরা অনেকেই ঘড়ি সময় দিতে বেগড়বাই করলেই বলতেন, তোর ঘড়ি ঘোড়া হয়ে গেছে। ওটাকে জলে ডুবিয়ে আন। 

আরও পড়ুন
কাতান ব্লেড হয়ে গেলে

ঘড়ি স্লো ফাস্ট হওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। দম দেওয়া রিস্ট ওয়াচ স্লো হয়ে থাকলে, তখন তার অয়েলিং ক্লিনিং প্রয়োজন হয়ে পড়তো। বছরে একবার অয়েলিং তো বিধেয়ই।

সোনার ঘড়ি পরতেন বাবু রইস আদমিরা। এইসঙ্গে আমাদের অতি পরিচিত কবিতার লাইনটি মনে পড়ে গেল সঙ্গে সঙ্গে- 'বলিছে সোনার ঘড়ি টিক টিক টিক'। 

সময় চলিয়া যায় নদীর স্রোতের প্রায়

যেজন না বোঝে তারে ধিক শত ধিক

বলিছে সোনার ঘড়ি টিক টিক টিক।

পকেট ঘড়ি - অর্ডিনারি পকেট ওয়াচ দশটাকায় বিক্রি হতে দেখেছি পঞ্চাশের দশকে। পকেট ঘড়ি রাখার জন্য পাঞ্জাবির বুক পকেটে পাশে কেটে ঘড়ি-পকেট করানো হতো। ঘড়ি-পকেট হয় ফতুয়ারও। সেই ফতুয়ার পকেটে ঘড়ি না রেখে কেউ কেউ দুই পাঁচ দশ  টাকার নোট, কখনো একশো টাকার কারেন্সি নোট ও ছুপিয়ে লুকিয়ে রাখতেন। 

ঘড়ি রাখার পকেট হত কোট আর শেরওয়ানিতেও। সোনা নয়ত রুপোর চেনের পকেট ওয়াচ ফিট করা। রুপোর চেন ঝোলে বাইরে। রুপোর চেনে অনেক সময় সোনার জলও করানো হত - যাকে সহজ-সরল ভাষায় তখন বলা হতো গিলটি করা। সোনার জল করা গহনা, ছেলেদের পাঞ্জাবিতে লাগানোর সোনার বোতাম এর চেন এসব তো ছিলই, এখনো আছে।

ছিল রোল্ড গোল্ডের গয়না, যার বর্ণ সোনার। কিন্তু আসলেই স্বর্ণ আবরণ, সোনার আস্তরণ। মেয়েকে সোনার বদলে কখনো কখনো গিলটি করা গয়না দেবার কথাও শোনা যেত। আর পরে তা নিয়ে যথারীতি বিপুল হাঙ্গামা।

হ্যামিলটনের গহনা ছিল অতি বিখ্যাত। তাছাড়াও ছিলেন স্বর্ণকারেরা। দক্ষিণ কলকাতায় বহুধা বিভক্ত লক্ষ্মীবাবুর সোনা-চাঁদির দোকান যেমন ছিল, তেমনই ষাটের দশকে দক্ষিণ কলকাতার রাসবিহারী অ্যাভিনিউতে নিমাই চাঁদ-এর গহনার দোকান ছিল বেশ বিখ্যাত। এছাড়া এমপি জুয়েলার্স, বি সরকার তো ছিলই। সম্ভবত একটু পরে পিসি চন্দ্র, সেনকো জুয়েলার্স। উত্তর কলকাতার বউবাজার জুড়ে এইসব স্বর্ণবিপণি সোনার দোকানে সারাবছর যে ধুলো জমে, সেই স্বর্ণগুলো মিশ্রিত ধূলি বিক্রি হয় চড়া দামে, বাংলা বছরের একেবারে শেষে চৈত্র মাসে। 

বউবাজারের অতি বিখ্যাত, বিখ্যাত, কম বিখ্যাত যেসব গয়নার দোকান, তাদের সামনে নর্দমায় যে কাদা-কালি-পাঁক, সেই সব নোংরা লোহার সরু শিকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে স্বর্ণ বিন্দু খোঁজার চেষ্টা করেন একদল মানুষ। নারীরাও আছেন এর মধ্যে।

সোনার হার বলে তামার হার অতি সস্তায় বিক্রির একটি চক্র কলকাতায় আছে বহুদিন। ইদানীং তাদের প্রকোপ কিছু কম। কারণ প্রতারণার নতুন নতুন পথ ও পদ্ধতি আবিষ্কার হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের বাইরে ওই ধরনের চিটিং গ্যাং খুবই সক্রিয় ছিল। ইলাহাবাদে, কাশীতে। তামার হারের সঙ্গে খানিকটা - খুব সামান্য সোনার মায়া।

দেওয়ালঘড়ির ডায়ালে বাংলা সংখ্যা। এও তো চোখে পড়েছে আমার। গোলাকার,কাঠের ফ্রেমবন্দি সেই সময় খাদক,দিব্যি বাংলা সংখ্যা, ১,২, ৩,৪, ৫ ইত্যাদি প্রভৃতিতেও একদম বারো পর্যন্ত। 

বড় বড় বাড়ি, রইস পরিবার, রাজা-রাজড়ার প্রাসাদ, জমিদার বাড়িতে, অনেক ঘড়ি। সবই তো বিদেশি, স্বাভাবিকভাবেই। সেইসব ঘড়িয়াল-বাবুদের ঘড়ি-বাবু থাকতেন। মাইনে করা। তারা নিয়মিত দম বা চাবি দিতেন সমস্ত ঘড়িতে। 

বিমল মিত্রের গত জব্দ উপন্যাস 'সাহেব বিবি গোলাম'-এ পাই ঘড়ি-বাবুর কথা। যিনি ঘড়ি ঘড়িতে দম দিতেন। 

ঘড়িয়াল এর আরেক অর্থ হল মেছো কুমির। মুক্ত এইসব কুমিরেরা ভারত, বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটানে যথেষ্ট। ঘড়িয়ালরা মাছ খেয়ে বাঁচে। ঘড়িয়াল খোকা বা খুকুর মাংস অতীব চমৎকার। 'শাদা-মাংস' নরম বা সুস্বাদু। ফ্যাট লেস। 

ঘড়িয়াল মাংসের স্বাদের কথা আমায় প্রথম শোনান পক্ষী-প্রেমিক অজয় হোম। কলেজ স্ট্রিটের কিশোর জ্ঞান বিজ্ঞান দপ্তরে বসে অজয় হোমের মুখে এই কুম্ভীর মাংস আস্বাদনের কাহিনি শুনি। অজয় হোমের অতি বিখ্যাত গ্রন্থ 'বাংলার পাখি'। আশির দশকে তিনি নিয়মিত কলম লিখতেন মাসিক 'কিশোর জ্ঞান - বিজ্ঞান 'পত্রিকায়। কিশোর জ্ঞান বিজ্ঞান তখন দারুণ পত্রিকা। ভালো বিক্রি। বেরোয় প্রতি ইংরেজি মাসের ১ তারিখে, একদম নিয়ম করে। 

'ঘড়িবাবু' বা 'ঘড়িয়াল'দের কথায় আবার ফিরি। 'ঘড়িবাবু'দের হিন্দী বলয়ে কোথাও কোথাও ডাকা হয় 'ঘড়িয়াল' নামেও। একটি দুলাইনের শায়েরি মনে পড়ল এ-প্রসঙ্গে -

‘ঘড়ি ঘড়ি ঘড়িয়াল বাজাওয়ে
যো দিন যায়ে সো কাভি না আওয়ে।'

অর্থাৎ, 

'মুহূর্তে মুহূর্তে বাজছে সময়ের ঘড়ি
যে দিন যায়, তা আর ফেরে না।'

ষাটের দশকের শেষে ইলাহাবাদ এর পুরানা কাঠড়ায়, গলির ভেতর আমার বড় মাসি রেণু ভট্টাচার্যের বাড়ি। সেই গলি থেকে বেরোলে বড় রাস্তার ওপর 'মনিকা স্টোরস', মিশ্রা কম্পানি।

মিশ্রা কম্পানি ওষুধের দোকান - আংরেজি দাওয়াখানা। সেই মিশ্রা কোম্পানির মালিকের বড়ো কন্যাটি মাথা নিচু করে রাস্তা পেরনোর সময় ঘাড় সামান্য নাড়াত বলেই হয়ত তার নাম ঘড়ি। ঘড়ির ছোট বোন সবিতা। সবিতা মিশ্রা। যে আমার বড় মাসির কনিষ্ঠা কন্যা কুক্কু-- লীনা ভট্টাচার্যের সঙ্গে পড়ত লেডি ওয়ারনামেকার স্কুলে। দুজনেরই তখন ক্লাস ফাইভ।

ইলাহাবাদে এরকম নাম দিয়ে দেওয়ার একটা প্রবণতা ছিল। যেমন বড় মাসির বাড়ির সামনের গলিতে খারেবাবু যেখানে থাকতেন চুন্নু, মুন্নু, বেবিদের মায়ের সঙ্গে, সেখানে কট্টন বলে মুন্নির যে আদমি তাদের মধ্যে অতি রোগা সরু লম্বা মেয়েটিকে সবাই ডাকত 'সারস' বলে। আসলে তার স্ল্যাক্সস পরা লম্বা লম্বা পা সারস হেন এমন যুক্তিতে তারা নামকরণ করলেন কল্পনা অনুযায়ী।

সেই অতি কৃশ কন্যাটি বাইরে বেরোলেই তার জন্য হালকা ফুলকা মোটর বসানো সাইকেল চেহারার বাহন। এম এইটটি নয়, অন্য কোনো বাহন, বলতে বলতে মনে পড়ে অতি হালকা- নাম 'লুনা'। সেই যান এখন আর তৈরিই হয় না।

ঘড়ির কথা বলতে বলতে স্পোর্টসউওম্যান, ম্যান বা রাস্তা হাঁটিয়েদের জন্য স্টপওয়াচ। এছাড়াও আছে জল বিরোধী ঘড়ি। গভীর জলেও থেকে যায় যা চলন অস্তিত্ব। ব্রিটিশ সিক্রেট সার্ভিস এমআই সিক্স এর কল্পনা নায়ক জেমস বন্ডের ঘড়ির কথা আমাদের  অনেকেরই মনে আছে। আমরা যারা বন্ড মুভি দেখেছি। এই ঘড়ি মাল্টিটাস্কার। তা যেমন কথা বলার মাধ্যম হিসেবে কাজ করে, তেমনি গাড়ি আটকাত।

স্প্যানিশ চিত্রকর সালভাদোর দালি ঘড়িকে ব্যবহার করেছেন তার নানা চিত্র ভাবনায়। দালির গলে যাওয়া ঘড়িও আমরা দেখেছি বিশাল ক্যানভাসে। সেই সঙ্গে আরও নানা ধরনের কল্প ঘড়ি।

কলকাতার ঘড়ি সংগ্রাহক ছিলেন বেশ কয়েকজন। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির সুভো ঠাকুর, তিনি আবার বিশিষ্ট শিল্প সংগ্রাহকও, তাঁর সঙ্গে অ্যান্টিক ঘড়ি সেভাবে দেখিনি।  মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের তৃতীয় পুত্র হেমেন্দ্র নাথ ঠাকুরের নাতি সুভো সুভগেন্দ্র নাথ ঠাকুর ছিলেন কবি, চিত্রকর ও শিল্প সংগ্রাহক। তাঁর সংগ্রহে হুঁকো, বিচিত্র ধরনের হুক্কা, গ্লাস পেইন্টিং, কালীঘাটের পট, অ্যান্টিক দোয়াত, পারফিউমের বোতল-সব  দেখেছি। দেখেছি কলসি, নানা ধরনের ঘট,ঘটি, ছোট-বড় মূর্তি, আখরোট ভাঙার জাঁতি, সুপুরি কাটার জাঁতি। কিন্তু নাহ, ঘড়ি দেখিনি। কেবল তিনি নিজে একটি সোনার চেন সমেত, স্বর্ণময় পকেট ওয়াচ ব্যবহার করতেন। 

গান্ধীজি - মহাত্মা গান্ধীর ট্যাঁক ঘড়ি ছিল দেশ বিখ্যাত। বিদেশে গোলটেবিল বৈঠকের সময়ও ট্যাঁক ঘড়ি। সেই ছবি স্কেচ,  কার্টুন হয়ে খবরের কাগজেও - বাংলা, ইংরেজি দৈনিকে। 

টেবিল ঘড়ি - টাইমপিস বলতে 'ফেবার লুবা'। দশ টাকায় টাইমপিস পাওয়া যায় ষাটের দশকে।  টিক টিক টিক টিক করে চলে ঘড়ি। অ্যালার্ম দিলে বেজে ওঠে ঘড়াং ঘড়াং ঘড়াং। ঘুম ভাঙাতে, ট্রেন ধরাতে সেই অ্যালার্ম অব্যর্থ।  ব্ল্যাক ডায়াল টাইমপিস আরেকটু বেশি দাম। 

এইটা টাইমপিসেরও স্প্রিং কাটে।  সারাতে হয়। অয়েলিং ক্লিনিং। চল্লিশ-পঞ্চাশের দশকের অ্যালার্ম ঘড়িটি থাকে বাইরে। পরে তা ভেতরে চলে আসে ইনবিল্ট। সত্তর দশকে 'ফেবার লুবা জ্যাজ' চল্লিশ টাকায় পাওয়া যায়। পরে বেড়ে যায় ষাট, তারপরে আশি আরো পরে একশো।

মনে পড়ে গেল ষাটের দশকে ঘড়ির কাঁটায়  ক্ষুদে এরোপ্লেন লাগানোর ফ্যাশন চালু হয়।  

তখনই চৌকো ডায়ালের ঘড়ি বাজারে আছে।

জাপানের সঙ্গে কোলাবোরেশন এ তৈরি এইচ এম টির 'জনতা' তখন নব্বই - পঁচানব্বই টাকা। 'জওয়ান' সেটা ছিল ব্ল্যাকডায়ালের, আরও একটু দাম বেশি।

'জনতা' বা 'জওয়ান' মিলিটারি আউটলেট থেকে কিনলে আরেকটু কম। 'জনতা' ঘড়ি প্রথম প্রথম বিক্রি হত লাইন দিয়ে।  ষাটের দশকের সোনালী ডায়ালের হেনরি স্যান্ডোজ একশ পঁচিশ টাকা। 

ঘড়ির কাঁটায় - ছোট্ট কাঁটায় ছোট্ট, রঙিন প্লেন ফিট করানোর খরচ দশ টাকা। বালিতে আমাদের বন্ধু জনার ঘড়ি সারানোর দোকান ছিল জিটি রোডের ওপর। জনাকে আমার ঘড়ির কাঁটায় প্লেন লাগিয়ে দিতে বললে এক চোখে ঠুলি লাগানো জনা চাপা গলায় বলল, খবরদার লাগাস না।

আমি জানতে চাইলাম, কেন? 

জনা- ব্যালেন্স ভোগে চলে যাবে, প্লেন লাগালে।

প্লেন লাগালে ঘড়ি নষ্ট হয়ে যাবে। শুনেই ঘড়িকে প্লেনায়িত করার চিন্তা মাথার ভেতর থেকে বার করে দি। ঘড়ির কাঁটায় আর বিমান অবতরণ করান হয়ে ওঠে না। 

এইচ এম টি - হিন্দুস্তান মেশিন টুলস এর তৈরি ঘড়ি 'জনতা' ও 'জওয়ান' এর পরে এল 'জহর'।

বিপ্লবী কমিউনিস্ট, সি পি আই (এম-এল) নেতা কবি ও সাংবাদিক সরোজ দত্ত বাঁ-হাতেই ঘড়ি পড়তেন, কিন্তু কব্জির ওপর দিকে নয়, কব্জির উল্টোদিকে ঘোরানো ডায়াল থাকত সেই ঘড়ির। 

পুলিশ যখন সরোজ দত্তকে গ্রেফতার করে, তখন এই ঘড়ি পরার ব্যাপারটা ও পুলিশের নজরে পড়ে। 

হাতে ঘড়ি পরতেন শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ সহ পঞ্চাশের সব লেখকরাই ঘড়ি পরতেন। ব্যাতিক্রম সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। তার হাতে ঘড়ি নেই। সমরেশ বসু, আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, প্রেমেন্দ্র মিত্র-- সকলে ঘড়ি পরতেন। মহাশ্বেতাদি - মহাশ্বেতা দেবীও।

পুরনো কলকাতার একটি প্রচলিত কহাবত ছিল 'ঘড়িক্কে ঘোড়া ছোটে' মানে কাজ দ্রুত হয়ে চলেছে।

ঘড়ির পুরনো বেল্ট বলতে 'বেনটেক্স'। স্টিলের ব্যান্ড, পোক্ত। দাম দশ টাকা থেকে শুরু। এটা ষাট দশকের কথা বলছি। স্টিল ছাড়া চামড়া, নকল চামড়ার ব্যানডও ছিল, এখনও আছে। স্টিল বলতে গিল্টি করে সোনা রঙ, গোল্ডেন কালার। 

চামড়ার ব্যান্ড স্টিল ব্যান্ডের চেয়ে একটি কস্টলি। তাছাড়া চলেও না বেশিদিন। ঘামে নষ্ট হয়। কেটে যায়। 

ঘড়ি ছিনতাইয়ের একটা ব্যাপার ছিল ষাট, সত্তর দশকে। ছিনতাইবাজরা ঘড়িকে বলত, চরকি। চামড়ার ব্যানড কাটতে সুবিধে। ট্রেনে হাত সামান্য বাইরে বার করে রাখলে সুযোগ পেলেই রানিং ট্রেন থেকে ঘড়ি টেনে নিয়ে যাবে ছিনতাইবাজ,  যারা স্টেশনে তালে থাকে ছিনতাইয়ের।

ট্রেন চললেই তাদের দৌড় শুরু। লম্বাটে চেহারার দেওয়াল ঘড়ি কলকাতা কর্পোরেশন নির্বাচনে প্রতীক ছিল জাতীয় কংগ্রেসের। বামপন্থীদের নির্বাচনী প্রতীক ছিল পাকা বাড়ি এবং কুঠার। সেটা ষাটের দশক। পরে নির্দল প্রার্থী কংগ্রেসের একটা অংশ টিএন সাংমার নেতৃত্বে আলাদা দল করে ঘড়ি চিহ্ন দিয়ে নির্বাচনে দাঁড়ায়। সুব্রত মুখোপাধ্যায়ও এই ঘড়ি চিহ্ন নিয়েই সাংমার দলের প্রার্থী হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। 

চামড়ার ব্যান্ডে বাটিকের কাজ এর চলন হলো এক সময়। চওড়া ব্যান্ডের ঘড়ি। ঘাম লাগে না। 

এই ব্যানড একটু চওড়া, বাহারি।

ঘড়িকে ঘামমুক্ত রাখার জন্য প্লাস্টিকের প্রোটেক্টর দেওয়া হতো একসময়। দক্ষিণ কলকাতার হাজরা অঞ্চলে এবং উত্তর কলকাতার কলেজস্ট্রীটের ফুটপাতের ওপর জ্বলন্ত মোমবাতি আর সরু সরু চৌকো প্লাস্টিক শিট দিয়ে এই ঘর্ম নিরোধী ব্যবস্থা।

আশির দশক থেকেই ব্যাটারি দেওয়া হাত ঘড়ির রমরমা। দম দেওয়া ঘড়ি ক্রমশ কমের দিকে। দেওয়াল ঘড়িও ব্যাটারির। টাইম পিসও তাই। চিনা ঘড়িতে ছেয়ে গেল বাজার আস্তে আস্তে। সঙ্গে সস্তার, অতি খেলো চিনা ব্যাটারি। প্রায় উঠে গেল ঘড়ি সারানোত দোকান। কারণ এই সব ঘড়িই প্রায় ইউজ অ্যান্ড থ্রো। পড়ে গিয়ে হাত ঘড়ির, ব্যালেন্স ভাঙা, কাচ ভাঙা, বাৎসরিক অয়েলিং অ্যান্ড ক্লিনিং দূর নক্ষত্র মাত্র। টাটার তৈরি, ব্যাটারিতে চলা 'টাইটান' 'টাইমেক্স' সবই উঠে আসছে প্রবল ভাবে। 

সে আর এক গপপো। বারান্তরে কখনও বলা যাবে।

অলংকরণ - প্রণবশ্রী হাজরা

Powered by Froala Editor