ঋতু, ঋতুবন্ধ – ঋতুসংহার

মুছে যায়? – ৪

আগের পর্বে

খড়দা নিবাসী কাকিমা রেণুকা রায়ের বাপের বাড়ি ছিল অবিভক্ত বাংলার পাবনা জেলায়। এই পাবনা জেলার বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ পরিবারের একটি নিজস্ব রান্নার পদ হল শুকুত। এই শুকুত কিন্তু সুক্তো নয়। উচ্ছে বা করোলা, কাঁচকলা, বেগুন, সজনে ডাঁটা, রাঙালু, গোল আলু, বিউলি, ডালের বড়ি সবই দেওয়া হয় শুক্তোয়। তবে শুকুতের ক্ষেত্রে বেগুণ এবং আড়মাছের টুকরো বাধ্যতামূলক। শুকুতের সেই গন্ধ তোলপাড় তুলত পাড়ায়। পাবনার লালমনিহাটের সেই বাড়ি, রন্ধনশালা কেমন আছে কেউ জানে না। তবে খড়দায় শৈলবালা সান্যাল কিংবা মধ্যপাড়ায় রেণুকা রায়ের মাধ্যমে এখনও চলছে শুকুতের সমারোহ।

শহর কলকাতা, তার গা লাগোয়া মফঃস্বলের রাস্তার ধারে ধারে যে ল্যাম্পপোস্ট, তাতে একটা ছোট, চৌকো হ্যান্ডবিল সেঁটে দিয়ে যান যাঁরা, তাঁরা পেয়ে যান নিজেদের প্রাপ্ত পয়সাটুকু, ঘাড়ে মই, আঠার বালতি নিয়ে হাঁটেন তাঁরা, যেমন ষাট-সত্তরে সিনেমার পোস্টার দেওয়ালে দেওয়ালে মেরে দিয়ে যাওয়া লোকজন, কারণ মফস্বলে কোনো কিয়স্ক হয় না।

'ঋতু বন্ধে অশোকা', 'ঋতুবন্ধে অশোকা' - ছোট চৌকো-ঠিক চারচৌকো নয়ও, খানিকটা আয়তাকার, তারই লেগে থাকা ল্যাম্পপোস্টে-ল্যাম্পপোস্টে৷ পাশাপাশি 'জালিম লোশান - দাদের নতুন ঔষধ'। একই সাইজ সেই হ্যান্ডবিলেরও।

তখন তো ফোঁড়া, কার্বঙ্কল মারতে তেলতেলে 'অ্যানটি ব্যাকট্রিন', ট্রেন কামরায় হঠাৎ হঠাৎ হেঁকে যাওয়া 'বিষহরি তেল।' পেটের সমস্ত সমস্যায় ভাস্কর লবণ। ছোটদের পেটের কুচো কৃমি মারার জন্য 'তড়িৎ' পাশাপাশি 'তানসেনগুলি'।

তখনও 'হাতকাটা তেল' পাওয়া যায়। বন্দুক, রাইফেল, রিভলবার, পিস্তল সাফ-সুতরো করার তেল দিয়ে বাতের ব্যথার মালিশ - কাজ সারেন অনেকে। ব্যথা মুক্তির মালিশ।

তখনও বাজারে অতি বিখ্যাত 'ঢোল কোম্পানি'র দাদের মলম, গায়ের হাজা, হাতের আঙুলের ফাঁকে জেগে ওঠা হাজা মারার নীলচে ওষুধ-পাওয়া যায় স্ট্যান্ডার্ড ফার্মেসিতে। যার সাইনবোর্ডে হয়তো বা লেখা থাকে- 'সজনী ফার্মেসি, কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট- পরীক্ষা প্রার্থনীয়'। অথবা 'সুরেশ কিংরণ ফার্মেসি', নয়ত 'রেমিডি'... বাকি সব একই কথা। যেমন হয়, কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট- পরীক্ষা প্রার্থনীয়। 

এই যে যাঁরা আঠার বালতি নিয়ে 'ঋতুবন্ধে অশোকা' বা 'জালিম লোশন- দাদের নতুন ওষুধ' মারতে মারতে - ল্যাম্প পোস্টে চিপকে দিতে দিতে হেঁটে যান, তাঁরা অধিকাংশ সময়ই নগ্নপদ, সেটা ষাটের দশক, নয়ত সত্তর- 'সদর দপ্তরে কামান দাগার' দিন।

আরও পড়ুন
ঋতু, ঋতুবন্ধ – ঋতুসংহার

তখনও 'সাধনা ঔষধালয় ঢাকা' - তার দোকান নিয়ে জেগে আছে শহর কলকাতার নানা কোণে।  সেখানে 'অশোকা রিস্ট', 'সারিবাদী সালসা', 'মূলারিস্ট',  'মৃতসঞ্জিবনী সুরা' - সবই পাওয়া যায়।

কাচের বোতলবন্দি এই সব 'রিস্ট' ইত্যাদিতে নাকি রক্ত বাড়ে। 'সারিবাদী' সালসায় কাটে রক্তের দোষ - খোস, পাঁচড়া, চুলকানি ইত্যাদি। সত্তর দশকে বারবার জেলে যাওয়া ও বাড়ি আসার যেটুকু বিরতি, তার মধ্যে জেলবাসে খোস,পাঁচড়া, চুলকানি অবধারিত, তা মারতেই 'সারিবাদী সালসা' - 'সাধনা ঔষধালয়, ঢাকার' - যার বিভিন্ন বিক্রয় কেন্দ্র কলকাতার নানা কোণে। কালীঘাটে  রাস্তার ওপর ফুটপাতের গা ঘেঁষে এমনই একটি দোকান, যেখানে চাকরি করতেন রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য - তিনি আমার পিতৃদেব অমরনাথ রায়ের 'রামকৃষ্ণদা'। বাবার জ্যাঠামশাই ভারতবিখ্যাত নব্য ন্যায়ের পণ্ডিত তারানাথ ন্যায়তর্কতীর্থর চতুঃষ্পাঠী- 'দর্শন' চতুষ্পাঠীর তিনি ছিলেন ছাত্র। 

রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য টাকমাথা, গালে বড়ো-কালো দাড়ি। চোখে কালো ফ্রেমের চশমা। ধুতি, হ্যান্ডলুমের পাঞ্জাবি। চেহারায় অনেকটা যেন ব্রাহ্ম  প্রস্তাবক। রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্যর কথায় পরে নয় কখনও আসা যাবে, আপাতত 'সারিবাদী সালসা'য় ফিরু। স্থানীয় জিভে যা কখনও কখনও - 'সারিবাদ্য সা লসা'।

আরও পড়ুন
শুকুত – জিহ্বান্তরে আড়-বেগুন

এই প্রসঙ্গে মনে পড়ল চালমুগরা বা চালমুগরোর তেলের কথা। খোস-পাঁচড়া-চুলকানি হলে লাগানো হত এই তেল। পাওয়া যেত স্ট্যান্ডার্ড অ্যালোপাথি ওষুধের দোকানে।

'ঋতুবন্ধে অশোকা' যাঁরা ল্যাম্পপোস্টে লাগাতেন, তাঁদের হাতে ঝোলানো আংটাদার লোহার বালতিতে আটা-ময়দার লেই। নয়ত কাঁইবিচির আঠা।

উনোনে বসানো পাত্রে জলে আটা অথবা ময়দা গোলা ফোটালেই লেই। পাশাপাশি পাকা তেঁতুল বীজ সংগ্রহ করে জ্বাল দিয়ে নিলেই আঠা। 

আরও পড়ুন
বর্মা বার্মা বার্মিজ

একটু পয়সাঅলা মধ্যবিত্ত বাড়ির মেয়েদের রক্তাল্পতায়, উত্তর প্রসব শারীরিক অসুবিধায় 'অশোকারিস্ট', 'মূলারিস্ট', 'মৃতসঞ্জীবনী সুধা' অথবা 'মৃতসঞ্জীবনী সুরা'।

তখন বহু-বিয়োনি নারীদের সূতিকা, সূতিকা জ্বর। মৃত্যু। মেয়েদের ঋতুবন্ধ উত্তর সমস্যা সেভাবে তীব্র হয়নি। ফলে মেনাপোজ সিনড্রোম প্রায় অনুপস্থিত। 

হঠাৎ হঠাৎ বেঁচে যাওয়া - তখনকার আয়ু গোনাগুনতির হিসাবে জীবিত থাকা 'অতিজীবিত' ষাট বা সত্তর অতিক্রান্ত বিধবাদের মূলত হিন্দু বিধবাদের এই সমস্যা কাঁটাবাজি করার সুযোগই পেত না, কারণ তাদের বৈধব্যেরই নানা নিতকিত, মানা না মানা বিস্তর, তার ওপর আবার 'বন্ধ' আর 'না-বন্ধ' হওয়া।

আরও পড়ুন
কাতান ব্লেড হয়ে গেলে

তথাকথিত 'উচ্চবর্ণ' ব্রাহ্মণ বিধবাদের জন্য নানা নিয়ম নিগড়। মাসে দুটি একাদশী - শুক্ল ও কৃষ্ণপক্ষে। আষাঢ় মাসের সাত তারিখ থেকে তিন দিনের অম্বুবাচী, থাক সে সব কথা পরে বলব।

'সাধনা ঔষধালয় - ঢাকা'র বড় বড় হোর্ডিং কলকাতা শহরের তখন বহু জায়গায়। পাশাপাশি আরও দু-একটি  ঔষধালয়ও আছে। তাদেরও সালসা আছে। কিন্তু 'সাধনা ঔষধালয়- ঢাকা'র যেমন রমরমানি,  তা তাদের নেই। এই সময়ই 'কে হোড়ের ময়ূর মার্কা তিল তেলের' বিজ্ঞাপন খুব চোখে পড়ত খবরের কাগজের পাতায় পাতায়।

বোতলবন্দি তিল তেল আসত কোনো কোনো বাড়িতে, ষাট সত্তরেও। তিল তেল রান্নায় ব্যবহার করেন দক্ষিণ ভারতীয়রা, বেশি পরিমাণে, সঙ্গে নারকেল তেল।

তিল তেল মাথায় মাখতে মাখতে  মাখতে তালুতে ঠাসতে ঠাসতে ঠান্ডা ঠান্ডা। 'ঠান্ডা ঠান্ডা- কুল কুল' শব্দটি তখনও আসেনি বিজ্ঞাপন -কথা হয়ে।

আসলে রজঃদর্শন, ঋতুকাল, ঋতু নিবৃত্তি - এই যে দীর্ঘ চক্র, তার মধ্যে আমাদের সামাজিক নানা আলো-অন্ধকার চোখে পড়ে।

ঋতুদর্শনকে হিন্দু বাঙালি বলত 'নোংরা হওয়া'। এই শব্দবন্ধ থেকেই বোঝা যায় 'মাসিক' হওয়া - মাসিক দর্শন বালিকা কিশোরীর নারী হয়ে ওঠার একটা পদক্ষেপ মাত্র। তাকে অস্বীকার করার, এই শারীরবৃত্তীয় 'স্বাভাবিকতা'কে পুংতন্ত্র ঠেলে দেয় অন্ধকার ঘরের কোণে, বলপূর্বক আত্মগোপনের বাধ্য-বাধকতায়। 

এক মাসে, স্বাভাবিক ঋতুকালে - 'মাসিক' দর্শনে তুমি - অর্থাৎ যার ঋতুস্রাব হচ্ছে সে 'অশুচি'। 'অপবিত্র'। ভূমি শয্যায় শয়ন, এক বস্ত্র - একটি কাপড় গায়ে জড়িয়ে থাকা, মাথার চুলে তেল না দেওয়া - এ সবই তার সামনে  - চতুর্দিকে বেড় দিয়ে রাখা নিষেধতন্ত্র। মন্দির, দেবদর্শন, পূজার পুষ্পচয়ন - সবই বারণ রেখা বেষ্টিত। হিন্দি বলয়ে 'মাসিক'-কে বলে 'মাহিনা'। তিন চারদিন রজঃস্রাবের পর ঋতুস্নান সেরে সেই নারী আবার পুরনো 'স্বাভাবিকতায়' শরীর-শরীরে। আমরা জানি রজঃস্বলা পাঞ্চালীকে কুরু সভাগৃহে নিয়ে এসেছিল দুঃশাসন - দ্রৌপদীর কেশাকর্ষণ করে৷ ষাট-সত্তরেও সেভাবে স্যানিটারি ন্যাপকিন কোথায়? পুরনো ন্যাকড়া, সঙ্গে শাড়ির পাড়। এই 'ন্যাকড়া' কাচা অতি সঙ্গোপনে। শুকানো আরও গোপনীয়তার সঙ্গে। 

তারপর 'ন্যাকড়া' শুকানো হলে রোল পাকিয়ে কখনও কখনও খুব আড়ালে- জুতোর খাকি পিচবোর্ডের বাক্সর ভেতর রাখা। আবার - আবার পুনরায় সাতাশ-আঠাশ দিনের প্রতীক্ষা। হায় নারীজন্ম!

'মাসিক' - পর্বে অনেক সময়ই তলপেটে কুনকুনে ব্যথা স্বাভাবিক৷ তখব কাচের বোতলে গরম জল দিয়ে তল্পেটে -সেঁকা। 

তিন-চার দিনের রজঃ ধারা মাসিক মুক্তির পর 'স্বামী' নামক ক্ষুৎকাতর শার্দূলটি শরীর অভিযানে৷ তিন-চার দিন তিনি ছিলেন না স্বামী-সন্নিধানে, তাই....।

বর্ষাকালে রজঃকালীন বস্ত্রখণ্ড না শুকোলে, সমস্যা। রক্ত ও রজঃ মিশ্রিত শরীরী ধারা ও জল ঠিকঠাক না শুকোলে তার থেকেই সংক্রমণ। পুনরায়- পুনরায় সংক্রমণ। 

ল্যাম্পপোস্টে সাঁটা 'ঋতুবন্ধে অশোকা' ছাপা হ্যান্ডবিলটি ভেসে ওঠে চোখের সামনে। ঋতুবন্ধ কেন? সেটি কি গর্ভপাতের কোনো ওষুধ? হাতুড়ে দাওয়া?

গর্ভ হলে তো ঋতুবন্ধ হয়, স্বাভাবিকতায়। এই প্রশ্ন অনেক পরের৷ ঋতু- ঋতুকাল, ঋতু সঙ্গম, ঋতু সংহার, ঋতুবন্ধ-  কত কত শব্দ বন্ধ। ঋতু মানেই ছয় ঋতু, অন্তত আমাদের এই উপমহাদেশে। ছিল এক সময় - ছয় ঋতু, এখন আর নেই। হেমন্তকালটি কবেই যেন পালিয়েচগে আমাদের জীবন-ক্যালেন্ডার থেকে। মনে পড়ে যায়, বসন্ত ঋতুরাজ - এই নামেই আমরা ডেকে থাকি তাকে। 

ইউরোপে হেমন্ত নেই৷ ওদের তো সামার, রেইনি সিজন, অটাম আর উইন্টার আর স্প্রিং। 

হেমন্ত ঋতুটি চিরবন্ধ ইউরোপে। আমাদের জীবনেও বহুবছর বন্ধ হয়ে গেছে হেমন্ত উপস্থিতি - ঋতুবন্ধ।

অলংকরণ - প্রণবশ্রী হাজরা

Powered by Froala Editor