টোকাটুকি, টুকলি, চোতামারা

মুছে যায় – ৮

আগের পর্বে

বাংলার সত্তরের দশকের ফসল হল পাইপগান। চেনা জানা লেদ মেশিনে মাইল্ড স্টিল দিয়ে তৈরি হত এই আগ্নেয়াস্ত্র। খরচ পড়ত ১৬ থেকে ১৮ টাকা। ব্যবহৃত হয় শক্ত মোটা লোহার স্প্রিং এবং ছিটকিনি চেহারার ট্রিগার। পুলিশ বা আর্মির থ্রি নট থ্রি ছাড়াও তৈরি হয় বিশেষ দানা বা বুলেট। তবে অনেক সমস্যা ছিল এই বন্দুকের। তৎকালীন নকশালপন্থী নেতা চারু মজুমদার স্বপ্ন দেখেছিলেন পাইপগান এবং রাইফেলের ওপর ভর করেই তৈরি করবেন ‘পিপলস আর্মি’। তবে ভেদনক্ষমতা কম হওয়ায় মৃত্যু নিশ্চিত করতে দা, কাঠারি, ছুরির ব্যবহারের কথাও বলেছিলেন তিনি।

টোকা, টুকলি, টুকলিফাইং, চোতা, এসবই সত্তরের পরীক্ষার গায়ে গায়ে লেগে থাকা কিছু শব্দমাত্র নয়, এর প্রভাব ও প্রচার আজও প্রাসঙ্গিক। ফলে তাকে অনায়াসে সুদূরপ্রসারী তো বলা যায়, তাই না? ইংলিশ মিডিয়ামের দিকে টুকলি হল 'চিটিং', 'কপি করা'৷ বহু পরে জেনেছি।

এই সব অমোঘ শব্দ মালার পাশাপাশি 'নকল', 'নকল করা' এই কথাটিও চালু ছিল একটু 'শিক্ষিত জন', 'শিক্ষিত' না বলে তাঁদের 'লেখা-পড়া' জানা বলাই ভালো, এই সব কম কম সাব-অলটার্নদের কাছে 'টুকলি' বা 'টুকলিফাইংয়ের' অর্থ 'নকল', 'নকল করা'। সাদা বাংলায় বই দেখে দেখে, বইয়ের পাতা ছিঁড়ে তার থেকে, অথবা বাড়ি থেকে সরু সরু কাগজে খুদি খুদি লেখা লিখে 'পুরিয়া' তৈরি করে, পুরিয়াই বলা হত এদের, হোমিওপ্যাথি বা বায়োকেমিক। ওষুধের গুঁড়ো বা গ্লোবিউল দেওয়ার জন্য শাদা কাগজের ভাঁজ করা ছোট ছোট মোড়ক, চোতার চেহারাও অনেকটা সেরকম।

ইনভিজিলেটর, ফ্লাইংগার্ড, বোর্ডের গার্ড, মাস্টারমশাইরা অবশ্য অনায়াসে এই সব 'পুরিয়া'দের বলতেন, 'কাগজ'।

ষাট-সত্তরে এম সেন-এর নোট খুব চলে। সেইসঙ্গে মেডইজি। এইসব মেডইজি হল 'চোতা'র-- চোতা মারার আদি বীজ। এম সেনের পাশাপাশি সেন অ্যান্ড সেন। মেড ইজি, নোটবই পুরোটা মেলে না এক সঙ্গে, থাকে ডিউ স্লিপ যা দেখিয়ে বাকিটা সংগ্রহ করতে হয় পরে। পি আচার্য - ফণীভূষণ আচার্যর 'রচনা বিচিন্তা'। একটু পরে, ১৯৭০-৭১ এ। ১৯৬৯ এর মার্চে হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষায় বসি। সে বছরই শেষ আনসিন ইংরেজির ফার্স্ট পেপার, সেকেন্ড পেপার৷ কোনো টেক্সট বই নেই। পরের বছর থেকেই 'পারিজাত রিডার', টেক্সট - ইংরেজি টেক্সট বই, সেটা ১৯৭০। ফণীভূষণ আচার্য - পি আচার্য কবি ছিলেন,  উপন্যাস, গল্প, কবিতা সব লিখতেন। 

নকল করা একটি রীতিমত শিক্ষা। খুব ছোট ছোট অক্ষরে প্রশ্নের উত্তর। এমনকি ইতিহাসও। যার উত্তর বেশ দীর্ঘ - লেনদি।

আমি বালি জোড়া অশ্বত্থতলা বিদ্যালয়ে ক্লাস থ্রি থেকে ইলেভেন। ১৯৬০ থেকে ১৯৬৯। তার আগে কোনো স্কুলে পড়িনি৷ ভর্তি হই ১৯৬০-এ। হায়ার সেকেন্ডারি, ১৯৬৯, মার্চ।

আরও পড়ুন
ছিটকিনি পাইপগান ক্রমশ ক্রমশ...

স্কুলে ক্লাস পরীক্ষা - হাফ ইয়ারলি, অ্যানুয়াল - সবেতেই দেখেছি 'টুকলি' করা  টুকলি ধরার সাহসী অভিযান। পরের দিকে কিছু কিছু উইকলি টেস্ট, সাপ্তাহিক পরীক্ষা৷  ক্লাস এইটে,  নাইনেও দেখেছি কয়েকজন অতি কুশল টুকলিবাজকে। তার মধ্যে একজন দীপক। ক্লাস এইটে পরীক্ষা দিতে আসত ধুতি-শার্ট বা ধুতি-পাঞ্জাবি পরে। বাঁ পকেটে রূপোর তৈরি নস্যির ডিবে। নস্যি - স্নাফ ভারাক্রান্ত, বহু দাগ সমৃদ্ধ নস্যির রুমাল।

তখন বাজারে সব চেয়ে দামি নস্য বা নস্যি 'পরিমল'। ডান হাতের দু আঙুলের টিপ ধরলেই ভুরভুরে সুগন্ধ। 'পরিমল' নস্যি সামান্য দামি, অন্য অন্য নস্যদের তুলনায়। প্রেমেন্দ্র মিত্র লেখার সময়ে ডান হাতের বুড়ো আঙুল ও তর্জনীতে টিপে ধরে থাকতেন 'পরিমল' নস্যি। নাকে ঠুসতেন না। নস্যি নিতেন কথাকার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়,  ঘন ঘন৷ এছাড়াও ছিল 'দীপক' নস্য। ছিল 'এন সি নস্য', 'টি এস নস্য'। এক নস্য নয় - মায় এক টিপ। ছোট্ট, চন্নামেত্ত, চরণামৃত দেওয়ার গভীর চামচ চেহারার বস্তুটিতে এক চামচ, এক নয়া পয়সা। নস্যির ডিবে তখন পেতল, ভরণ, জার্মান সিলভার, এমন কি রূপোরও। সোনার নস্যির ডিবে, তার কথা শুনেছি। দেখিনি। তবে সোনার জল - গিলটি করা নস্যির 'দানি' - নস্য দান দেখেছি। পরে স্টিলের নস্য ডিবে, প্লাস্টিকের - সবই এসেছে কমে ক্রমে।

নাকে নস্যি দেওয়ার আগে তর্জনীতে তিনবার বন্ধ নস্যির প্যাঁচ মেরে ডিবেতে কেন, কেন যে টোকা দেওয়া হত,  তা আমার কাছে আজ ও বড়ো জিজ্ঞাসা। নস্যি সঙ্গে সম্পর্ক আছে রুমালেরও। প্রেমেনদা, প্রেমেন্দ্র মিত্র-কেও দেখেছি সুগন্ধময় পরিমল  নস্য ডান হাতের তর্জনী আর বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠতে চেপে পায়চারি করছেন। পরনে সাদা লুঙ্গি, গায়ে সাদা গেঞ্জি, কনুই পর্যন্ত হাত ওয়ালা সেইসঙ্গে দামি সিল্কের রুমাল। এইসব সিল্ক রুমালে দু-একটি হয়তো লীলা মজুমদারের বানিয়ে দেওয়া। ফুল তোলা, কাজ করা। 

আরও পড়ুন
চান্দ্রায়ণ

মুদির দোকানে চাল ডাল নুন ঘি ডালডা, মশলাপাতি, সরষের তেল, নারকেল তেল-এর সঙ্গেই পাওয়া যেত নস্য। যাকে আদর করে কেউ কেউ ডাকতেন 'ব্রহ্মচূর্ণ' নামে। নস্যির কথা টুকলি বা নকল প্রসঙ্গে কেন এল সে ব্যাপারে বলছি। 

তার আগে বলি নস্যি নাকে টেনে পরীক্ষার আগের রাত জাগত পরীক্ষার্থীরা কেউ কেউ। সর্দি কাটাতেও নস্যি আর ঝাল ঝাল কচি পাঁঠার মাংসের ব্যবহার ছিল সে সময়। এবার নকল-- টুকলি, টোকাটুকি বা চোতা মারা ধরার প্রসঙ্গে আসি। তখন স্কুল টিচার - শিক্ষকরা বেশিরভাগই ধুতি-শার্ট ফুলহাতা অথবা ধুতি-পাঞ্জাবি। প্যান্ট-শার্ট পরত দু'চারজন। 

মাস্টারমশাই বা স্যারদের দাদা ডাকা শুরু হয়েছে সবে। সেটা ১৯৬৫, ৬৬ কিংবা ৬৭ সাল। 

আরও পড়ুন
পান-বিড়ির গুমটি

অমিয় বন্দ্যোপাধ্যায় কিংবা অমিয় স্যার খুব রাশভারী। কড়া মাড় দিয়ে ইস্ত্রি করা কালো পাড় মিলের  ধুতি।  তার ওপর হ্যান্ডলুমের রঙিন পাঞ্জাবি। ফুলহাতা সব সময় পুরো হাতা। পায়ে অতি চকচকে কালো পাম্প শ্যু অথবা অ্যালবার্ট। চোখের চশমা এতটাই পাওয়ার, দেখলে মনে হবে কাচের গ্লাস ভাঙার পর তার তলা টুকু লাগানো রয়েছে চশমায়। 

অমিয়দা, অমিয় স্যার অমিয়বাবু টুকলি ধরার মাস্টার। পরীক্ষা হলে তিনি ঢুকলেই চোতাবাজরা তটস্থ। তিনি ঘুরে ঘুরে টহল কমই দিতেন। একখানা পাটভাঙা স্টেটসম্যান মুখের কাছে ঝুলিয়ে, চোখকে সম্পূর্ণ সজাগ রেখে নির্বিকারভাবে বসে থাকতেন। 

আগেই বলেছি দীপক পরীক্ষার সময় ধুতি-পাঞ্জাবি। কারণ ধুতির লুজনেস, ঢিলেঢালাভাবের জন্যই পেটে বই, কাগজ রাখতে সুবিধে হয়। প্রতি পরীক্ষাতেই অমিয় বাবু বনাম দীপক। 

আরও পড়ুন
ঋতু, ঋতুবন্ধ – ঋতুসংহার

টম এন্ড জেরি তখনও আমাদের দেখা ভুবন এর বাইরে।

আমরা বিষয়টাকে স্বপনকুমার সৃষ্ট চরিত্র গোয়েন্দা দীপক চ্যাটার্জি, তার সহকারি রতনলাল,  বনাম 'নিয়তি', 'বাজপাখি' ইত্যাদি প্রভৃতি খেলা মনে করে নিতাম। কিংবা কিরীটি রায়, সুব্রত বনাম 'কালো ভ্রমর'। ব্যোমকেশ বক্সীর কথা অতটা জানি না। বেতারে তখন নিয়মিত ধারাবাহিক 'কালো ভ্রমর'। রাতের সম্প্রচারে।

টুকলি করতে, কাগজ সাজাতে, বারবার পেচ্ছাপখানায় যেতে হয়। কিন্তু পরীক্ষার সময় তো এক ঘণ্টার আগে পেচ্ছাপ করতে - 'ছোট বাইরে' যাওয়া যাবে না। বড় বাইরে বলতে পায়খানা। না না, পায়খানাকে 'পটি' বলার রেওয়াজ তখনও চালু হয়নি। খুব ইংরেজিবাজরা 'স্টুল' বা 'নাইট সয়েল' বলেই ছেড়ে দেন।

আরও পড়ুন
শুকুত – জিহ্বান্তরে আড়-বেগুন

প্রত্যেক মফঃস্বলী স্কুলের ইউরিনাল যেমন হয়, বালি জোড়া অশ্বত্থতলা বিদ্যালয় প্রস্রাবাগার বা প্রস্রাবখানাটি তার বাইরে ছিল না। অপরিচ্ছন্ন, দুর্গন্ধময়, শেওলাযুক্ত। দেওয়ালে ছেলে ও মেয়েদের গোপন অঙ্গ আঁকা এবং সেখানে তাদের ঘিরে নানা মন্তব্য - কাঁচা খোলাখুলি৷  শৌচাগারের দেওয়ালে দেওয়ালে কারা এসব মন দিয়ে আঁকতেন ও লিখতেন, সেই সব শিল্পীদের নাম জানতে ইচ্ছে করে। কী প্রতিভা!

স্কুলে স্কুলে পরীক্ষা লগ্নে 'জল খেতে' বাইরে যাওয়াটাও একটা ব্যাপার ছিল৷ তো সে যাই হোক, অমিয় স্যার দীপককে ধরবেনই৷ সেই যে অনিশ্চিত সাপলুডো, অথবা বার্গম্যানের ছবিতে মৃত্যুর সঙ্গে দাবা খেলা, বার্গম্যান অবশ্য অনেক পরে দেখি, রেট্রোস্পেকটিভ, বারবার ইঙ্গমার বার্গম্যান, 'সেভেনথ সিল', ওহ কি ছবি, কি ছবি। তো অমিয়িদা দীপককে ধরার জন্য আচমকা চেয়ার ছেড়ে নেমে এসে বললেন,  কাগজ দে। কাগজ দে৷ 

দীপক - কাগজ কোথায় স্যার?
অমিয়স্যার - বার কর, বার কর৷ আমার চোখকে ফাঁকি দিতে পারবি না।
দীপক - নেই স্যার।
অমিয়স্যার - দে দে। ভালো কথায় চাইছি, দিয়ে দে।
দীপক - আপনি সার্চ করুন স্যার। সার্চ করুন।
অমিয় স্যার - তোর গায়ে হাত দিতে আমার ঘেন্না করে।
দীপক - না স্যার, আমার কাছে কাগজ নেই 

আরও পড়ুন
বর্মা বার্মা বার্মিজ

এরপর অমিয় ব্যানার্জি অথবা বন্দ্যোপাধ্যায় ধীরে ধীরে নেমে আসেন চেয়ার, কাঠের প্ল্যাটফর্ম থেকে। তাঁর মসমসান গ্লেজ কিড জুতোয় বালি জোড়া অশ্বত্থতলা বিদ্যালয়ের হাফ ইয়ারলি অথবা অ্যানুয়াল দিনের আলো।

স্যার দীপকের সামনে আসেন।
দীপক উঠে দাঁড়ায়।
অমিয় স্যার পুনরায় বলে ওঠেন, কাগজ দে।
দীপক চুপ, তবে মাথা নিচু নয়।
অমিয়বাবু বলেন, নে পকেটে কী আছে, বার কর।
দীপক চুপ। স্যার নিঃশব্দ।
তারপর - নে নে, বার কর, বার কর। এই সশব্দ গর্জনে সমস্ত ক্লাস রুম শ্রেণীকক্ষ ভয়ে কাঁটা হতে হতে পিন ড্রপ সাইলেন্স হয়ে গেলে দীপক তার ডান দিকের পাশ পকেট থেকে ডান হাত দিয়েই বার করে আনে একে একে, নস্যির রুমাল, সোনার নস্যির ডিবে, একটি পকেট সংস্করণে শ্রী কৃষ্ণের অষ্টোত্তর শতনাম।

সমস্ত শ্রেণীকক্ষ পিন ড্রপ সাইলেন্স। বাংলায় বললে পিন পতন স্তব্ধতা।
অমিয় বন্দ্যোপাধ্যায় নিশ্চুপ।
ভারী চশমার কাচের ওপারে স্থির দুটো চোখ।
এবার দীপকের বাঁ পকেট। সেখানে কাজ করে দীপকের বাঁ হাত। এবার হলুদ হলুদ 'চারমিনার' - এর প্যাকেট। এক প্যাকেট চারমিনার তখন তিরিশ নয়া পয়সা,  দশটায় এক প্যাকেট। একটা তিন নয়া পয়সা, দুটো পাঁচ নয়া পয়সা।

ভাজির বা উজির সুলতান লিমিটেডের এই সিগারেট প্যাকেট শাদা কাগজ কেবল, রাংতা নেই।
দীপকের ফুল শার্টের বুক পকেটে আরও দুটো কালির পেন। ফাউনটেন পেন - ঝরনা কলম। যদি কালি ফুরোয়।
দীপক জানে তার ঢিলে ধুতির কোমরে টাইম বোমা যেন এভাবে সাজান, ফিট করা আছে থাক থাক মেডইজি, মানে বইয়ের পাতা।
ঊরুতে দড়ি দিয়ে শক্ত করে বাঁধা আছে চোতার কাগজ। 

পরীক্ষা হলে প্রহার, থাপ্পড় হয়তো বারণ। তাই অমিয়বাবু সিটে ফিরে যান আবার, চেয়ারে।
দীপক আস্তে আস্তে, নির্বিকার মুখে সব এক এক করে তোলে, গুছিয়ে রাখে। দু পকেটে।
ভাঁজ করা রুমালের ভেতর সাজানো টুকলি৷ রুমাল অল্প তুলে তুলে টুকলি দেখা। অতি ক্ষুদ্র অক্ষর, পিঁপড়ের পায়ে কালি দিয়ে ছেড়ে দিলে যেমন হয়। কি করে লেখে, কি করে বোঝে তারা, কে জানে।
একটি চালের ওপর আমাদের জাতীয় সঙ্গীত 'জনগণমন অধিনায়ক' অথবা 'বন্দেমাতরম' লেখার থেকেও যা অতি দুরূহ। একটার সঙ্গে আরেকটা জড়ায় না।

সত্তর দশকে সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের জমানায় কারা কারা যেন দেওয়ালে দেওয়ালে নিজেদের বিশ্বাস আর রক্ত দিয়ে লিখেছে - 'সত্তর দশককে মুক্তির দশকে পরিণত করুন।' তার নিচে আবার কেউ কেউ লিখল - 'সত্তর দশককে টোকার দশকে পরিণত করুন'। এরা কারা আমরা অনেকে জানি, অনেকে জানি না। 

তখন, সেই সময়কার এগজাম হলে কেউ কেউ 'নেতা-ফেতা' সামনের হাইবেঞ্চে ছুরি গেঁথে নাকি পরীক্ষা দিয়ে ল-আইন পাশ করেছেন, বা পাশ দিয়েছেন। শুনেছি এসব তথ্য, সত্যি মিথ্যা জানি না, তাঁরা কেউ কেউ মন্ত্রীও হয়েছেন কেন্দ্রে বা রাজ্যে।

ফাঁকা চারমিনার-এর প্যাকেট ভাঁজ ভাঁজ করা 'চোতা' - 'চোতা'র 'কাগজ' - 'সাপ্লাই' উড়ে আসে আসে জানলা দিয়ে। এই সাপ্লাই লাইন তৈরি হয় স্কুল লাগোয়া পাশের কোনো বাড়িতে।

সেখানে অঙ্ক এক্সপার্ট, বাংলা এক্সপার্ট, ইংরেজি এক্সপার্ট - ব্যাকরণ ও গ্রামার বিশারদ। ইতিহাসের লেনদি উত্তরও আসে 'সাপ্লাই' লাইন থেকে।
তারা কেউ পেশাদার, অর্থের বিনিময় কেউ লাভস লেবার- স্বেচ্ছাশ্রম। এক সঙ্গে আড্ডায় রকবাজিতে বসা বন্ধুকে ঠেকের অমুককে স্কুল ফাইনাল ইউনিভার্সিটি অথবা হায়ার সেকেন্ডারি পাস করাতেই হবে সাপ্লাই দিয়ে। লক্ষ্য রাখতে হবে কম্পার্টমেন্টাল পাওয়া ক্যান্ডিডেটটির উপর।

ফলে সাপ্লাই কারখানা দক্ষিণ কলকাতায় চেতলা পোল লাগোয়া একটি হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলে হামেশা এই দৃশ্য - পরীক্ষার সময়। গার্ড, ইনভিজিলেটর, ফ্লাইংগার্ড সবাইকে অনায়াসে তুচ্ছ করে আর রাসটিকেটের ভয় অবলীলায় অগ্রাহ্য করে এই নকল অভিযান।
পুলিশ দর্শকমাত্র। ১৯৭০, ৭১, ৭২ এই ছবির সমস্ত পশ্চিমবাংলা জুড়ে। অখণ্ড বিহারে মুদির দোকানে নাকি পাওয়া যেত স্কুল ফাইনাল, ম্যাট্রিক-এর সার্টিফিকেট। 

উত্তর প্রদেশের সমান্তরাল - 'বিদ্যাবিনোদিনী' সার্টিফিকেট পাওয়া যেত কিছু অর্থ খরচ করলেই। স্কুল ফাইনাল, টেস্ট পাশের এমন কথা শুনেছি। 

হাতঘড়ির ব্যান্ডের নিচে 'চোতা'র কাগজ, সরু সরু পুরিয়া, খুদে খুদে অক্ষর। এছাড়াও জাঙ্গিয়ার ভেতর, ছেলেদের। মেয়েদের ব্লাউজের ভেতর, শাড়ির পাটে পাটে সেফটিপিন দিয়ে আটকানো সাজানো 'কাগজ' আর 'কাগজ'-- 'টুকলি'। 

ডট পেনের পরীক্ষা দেওয়া নিষেধ নিশ্চয়ই সকলের নয়, কিন্তু আছে তো। ব্লটিং পেপার-এ পেন্সিল দিয়ে লিখে আনা অঙ্ক, সেও ছিল। তখন তো এত ব্যাপক নয় ডটপেন, ডটপেনে পরীক্ষা দেওয়া নিষেধ। কালির পেনে পরীক্ষা দিতে হত। ফলে কালির দোয়াত, ব্লটিং পেপার, ছোট ছোট চৌকো সাদা। ইঙ্ক-- কালির পেলে পরীক্ষা দিতে হলে ব্লটিং পেপার লাগে।

পরীক্ষা হলে পাওয়া যায় ব্লটিং পেপার।  মানে স্কুল কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দেয়। আমি তো ১৯৬২-৬৩ পর্যন্ত হালকা নিব ওলা হ্যান্ডেল কলম আর সেই সঙ্গে কালির দোয়াত, শক্ত বোর্ড নিয়ে পরীক্ষা দিতে গেছি। বোর্ডের মাথার উপর রুপো রংয়ের মজবুত লোহার ক্লিপ। কখনো কখনো তা কালো। 

শাড়ির আঁচলে উত্তর লিখে আনতে কোনো কোনো মহিলা পরীক্ষার্থী। এছাড়া পুরুষের ফিতে বাঁধা শ্যুয়ের ভিতরে চোতা নকল পুরিয়া রাখার চল ছিল। কিন্তু মোজা বেশি ঘামলে অসুবিধা। চোতা ধেবড়ে যাবে। 

নানা কথা প্রসঙ্গে শুনেছি ঘড়ির কাটার সঙ্গে টুকলির কাগজ ফিট করার গল্প, বিশ্বাস করিনি। তবু কথা কানে হেঁটেছে। শুনেছি সায়েন্স গ্রুপের টুকলি করা অনেক সোজা, আর্টসে শক্ত। কারণ সংস্কৃত আর লজিক ছাড়া ইতিহাস বড্ড লেংদি। মানে প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার ব্যাপারটা। প্রকাশ্য বই খুলে টোকাটুকি শুরু হয় ১৯৭১-৭২ সালে। শিক্ষাক্ষেত্রে অসম্ভব নৈরাজ্য তখন।  নৈরাজ্য দেশ আর রাজ্য জুড়ে। টুকলি ধরা কোন কোন স্যারকে টুকলি বাজদের উদ্দেশ্যে আক্ষেপ করতে শুনেছি, রাতভর বাড়িতে না খেটে সারাবছর যদি পড়ত, তাহলে আর...। টুকলির ছবি বহমান এখনো।

মনে আছে ১৯৬৯ সালের মার্চে হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষা দিয়ে আগেই বলেছি তখন আমাদের ইংরেজি দুশো নম্বরই আনসিন। ইংরাজির সেকেন্ড পেপারে রচনা এসেছিল 'এ জার্নি বাই বোট'। একজন চোতাবাজ মেডইজিতে 'জার্নি বাই বাস', এই রচনাটি বাথরুমে গিয়ে ঝেড়ে এনে প্রত্যেকটি বাসের জায়াগায় বোট লিখে পরীক্ষার খাতায় রচনা লেখা শেষ করল। এবং পরীক্ষার পর বাইরে এসে সবাই যখন হাহুতাশ করছে, 'এসে' কমন পড়েনি। তখন সেই চোতাবাজ অনায়াসেই পড়ছে, "আমার তো কমন পড়ল'।

বাকিরা চোখ কপালে তুলে বলল, "কমন মানে?"। সেই টুকলিবাজ জবাব দিল-- "কেন! আমি তো ছিঁড়ে নিয়ে গেলাম আর বাসগুলো কেটে বোট করে দিলাম"। বাকিরা সবাই তার উত্তর শুনে হাসবে না কাঁদবে ভেবে পেল না। আরেকটা কথা বলা দরকার, সেইসময় হাইবেঞ্চের নীচে খাঁজের ভেতর বই এবং খাতা রাখত টুকলিবাজরা। অবশ্য তা সহজেই ধরা পড়ে যেত ইনভিজিলেটরদের হাতে। 

পরীক্ষার পুরো উত্তরপত্র বাইরে থেকে লিখিয়ে আনিয়ে জমা দিতে দেখেছি আমাদের সময়ে কাউকে কাউকে। তাদের জন্য ফিট করা উত্তরলিখিয়ে থাকত। যা ইদানীংকালে পশ্চিম বাংলাতে স্কুল-কলেজে তো বটেই, মেডিক্যাল পরীক্ষাতেও হয়েছে।

অলংকরণ - প্রণবশ্রী হাজরা

Powered by Froala Editor