মংপু, সুরেল ও ‘পাহাড়ী’ রবীন্দ্রনাথ

সময়ভ্রমণ – ৮

আগের পর্বে

তাকদা থেকে ছ’মিলের দিকে এগোলেই ঘিঞ্জি বসতি চোখে পড়ে। তবে এই জায়গাগুলি বন বিভাগের খাতায় ‘অরণ্যাঞ্চল’ বলেই চিহ্নিত। একসময় এই জমির মালিক ছিল সাহেবরা, ব্রিটিশ রাজ। তারাই এখানে বসিয়েছিল স্থায়ী, অস্থায়ী টাঙিয়া গ্রাম। পাহাড় থেকে তাড়িয়ে দেওয়া লেপচা-ভোটেদের জায়গা করে দিয়েছিল। পয়তিসে পারমেন এমনই একটা গ্রাম। যা পেরলেই কাঞ্চনজঙ্ঘার ছায়ায়,ধুপিগাড়ির ঠিক মাঝখানে একটা ছোটোমতো মাঠ। সেখানে খেলা করে বুনো স্ট্রবেরীরা। দাওয়াইপানির পথেও ধুপির মধ্যে বেঁচে আছে একটুকরো পুরনো বন। যা বাঁচিয়ে রেখেছে পাহাড়ি ঝোরাকে।

জোড়বাংলো যেতে পেশক পথের ওপর তিন মাইল বস্তি থেকে বাঁহাতি দুটো রাস্তা বেরিয়েছে। একটা পথ জঙ্গুলে, সেঞ্চলের অভয়ারণ্যের মধ্য দিয়ে রাম্বি টঙিয়া বস্তি হয়ে চলে যাচ্ছে ওল্ড কার্ট রোড বা ওল্ড মিলিটারি রোডের দিকে, সেখান থেকে চটকপুর, সোনাদা, বাগোড়া, ডাউহিল। অন্য পথটা বড়ো, রাজপথ। সেটা চলে যাচ্ছে মংপু হয়ে তিস্তার উপত্যকায়, যেটা এখন জাতীয় সড়ক ১০, আগের ৩১এ রাজমার্গ, তারও আগে তিস্তা ভ্যালি রোড, সেই পথে গিয়ে পড়ছে রাম্বি বাজারে। রাম্বি থেকে মংপু, এবং মংপু থেকে তিন মাইল জোড়বাংলো হয়ে দার্জিলিং যাবার মোটরপথ বেশ পুরনো। সায়েবি আমলে মংপু ছিল পাহাড়জোড়া সিনকোনা বাগানের কেন্দ্রবিন্দু, সেখানে বিশাল এলাকা জুড়ে সারি সারি কাঠের তাকে সিনকোনা গাছের লালচে-হলুদ ছাল শুকোনো হত। শুকনো ছাল চলে যেত কারখানায়, সেখানে ছাল গুঁড়ো করে, পরিষ্কার করে, ছেঁকে, এটা ওটা মিশিয়ে কুইনাইন ওষুধ তৈরি হত, যা খেলে কালান্তক পালাজ্বর সেরে যায়। 

নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা চারমূর্তির নানান কাহিনী যারা পড়েছে তারা সবাই জানে পালাজ্বর কী। সেকালে ম্যালেরিয়া নামের অসুখটাকে ডাকা হত পালাজ্বর বলে, পালা করে জ্বর আসত বলে পালাজ্বর। পটলডাঙার প্যালার পালাজ্বর ছিল, আরো অনেকের ছিল। পাহাড়ের ঠিক নিচের বনজঙ্গল ঘাসঝোপে জলাজমিতে ভর্তি যে এলাকাটাকে বলা হতো টেরাই বা তরাই, সেখানে পালাজ্বরের ভয়ে লোকে আসতে চাইত না, দীর্ঘদিন পর্যন্ত সে অঞ্চলে সরকারি কাজে আসা লোকজনকে একটা বিশেষ টেরাই য়্যালাউন্স কিম্বা ম্যালেরিয়া ভাতা দেওয়া হত। ম্যালেরিয়া কথাটার উৎসে ছিল ম্যাল এয়ার বা খারাপ বাতাস। সাগরপাড়ি দিয়ে দেশ থেকে বহুদূরে এসে যে সব সায়েবরা এশিয়া আফ্রিকা আমেরিকার জমিজঙ্গল দখল করে উপনিবেশ বানাতেন, তাদের অনেকেরই জীবন যেত ম্যালেরিয়ায় ভুগে। মূলত নিচের খারাপ বাতাস আর কুটকুটে গরম থেকে বাঁচতেই সায়েবরা পাহাড়ে উঠে ঘরবাড়ি বানান, শহর বসান। 

মংপুকে অবশ্য ঠিক শহর বলা যায় না। জায়গাটা নিচের ম্যালেরিয়াকীর্ণ সমতল থেকে খুব যে উঁচু, তাও নয়। না হোক, মংপু গেলেই চোখে পড়তো পুরোনো সায়েবি ঘরবাড়ি, কোনটা কাঠের, কোনটা পাথরের। সিনকোনা বাগানের সায়েবদের থাকবার জায়গা, ল্যাবরেটরি, কারখানা, ছাল জমা করবার গুদাম। এই সবের কোনো-কোনোটা এখনো থেকে গেছে। 

থেকে যাওয়া এইরকম একটা বাড়ির সঙ্গে বাঙালির প্রাণের যোগাযোগ বহুকালের। ১৯৩৪ থেকে ১৯৫৬ অবধি ওই বাড়িটায় থাকতেন মৈত্রেয়ী দেবী এবং তাঁর স্বামী ডঃ মনমোহন সেন। বাড়ির লাগোয়া সিনকোনা কারখানাটাও থেকে গেছে। সে কারখানার অধ্যক্ষ ছিলেন ডঃ সেন। মংপু গেছেন যাঁরা বা না গিয়েও মৈত্রেয়ী দেবীর লেখার সঙ্গে পরিচিত, তাঁরা সবাই জানেন, মংপুর সিনকোনা কারখানার ঠিক উল্টোদিকে, পাহাড়ের খাঁজে যে সুদৃশ্য একতলা কাঠ-পাথরের চিমনিওলা বাংলোবাড়ি, সেখানে রবীন্দ্রনাথ এসে থেকে গিয়েছিলেন নয় নয় করে বার চারেক। 

আরও পড়ুন
বনের মধ্যে আরো : টঙিয়া, এফ ডি হোল্ডিং আর ইয়েসলু

সে বাড়ি এখন পর্যটক দ্রষ্টব্য, মংপু ঢোকার মুখেই পেল্লায় একটা সাইনবোর্ড, তাতে বেগনি আর নীল রং, গোদা গোদা করে লেখা আছে রবীন্দ্র ভবন। বাড়ির সামনের মাঠে রবীন্দ্রনাথের আবক্ষ মূর্তি, যাতে ভুল করার বিন্দুমাত্র অবকাশ না থাকে। পর্যটকদের মধ্যে যাঁরা ভাগ্যবান, তাঁরা বাড়ির ভিতরে ঢোকার সুযোগ পান। অনেক বছর ধরে দেখছি শিশির নামের এক স্থানীয় যুবা বাড়িটার দেখভাল করেন, অন্তত কিছু দিন আগে পর্যন্ত অবস্থাটা সেরকমই ছিলো। যাঁরা বাইরে থেকে আসেন, বড়ো যত্ন করে তিনি বাড়িটা ঘুরিয়ে দেখান, এইখানে গুরুদেব বসে লিখতেন, এইখানে বসে আঁকতেন, এইখানে ওনার ওষুধের শিশি, এই স্নানের জায়গা, এই শোবার ঘর। দেখাতে দেখাতে তিনি গুনগুন করে গান করেন, দাঁড়িয়ে আছি আমি তোমার গানের ওপারে। বা রবীন্দ্রনাথের কবিতা আবৃত্তি করেন। প্রথম প্রথম এই মানুষটিকে যখন দেখছি, সে সময় বাড়ির জীর্ণ দশা। জানলা দরজা আলগা হয়ে আসছে, মেঝের কাঠ পচে গিয়ে গর্ত হয়ে গিয়েছে বহু জায়গায়, ছাদ ফুটো হয়ে ঘরে জল পড়ে। 

শিশির এখন মধ্যবয়সী। মংপুতে থাকার সময় পাহাড়ি পথে হাঁটাচলা করার মতো শারীরিক সক্ষমতা রবীন্দ্রনাথের ছিল না, একটা ডান্ডাওলা চেয়ারে করে তাঁকে বয়ে নিয়ে যাওয়া হত। শিশির বলেন, সেই চেয়ারবাহকদের একজন তাঁর পিতামহ। মৈত্রেয়ী দেবীর বাসভবন, শিশির এবং বেগনি-নীল সরকারি সাইনবোর্ডগুলোকে বাদ দিলে, আজকের মংপু দেখে বোঝার উপায় নেই, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে এই জায়গাটার কোনো যোগাযোগ কোনোকালে ছিল। প্রত্যেক পঁচিশে বৈশাখে একটা সরকারি অনুষ্ঠান হয়, এই পর্যন্ত। বাকিটা হেরিটেজ নামক গোলমেলে ট্যুরিজম-পণ্য হয়ে গেছে, ইতিহাস বা বিভিন্ন জ্যান্তমরা কথাকাহিনির সঙ্গে তার সম্পর্ক সচরাচর থাকে না, অন্তত এদেশে তো বটেই। ফলে যাঁরা সত্যিই দেখতে আসছেন, তাঁরা কিভাবে জায়গাটা দেখবেন বুঝবেন তার কোনো ব্যবস্থা নেই। খুব সম্প্রতি গিয়ে দেখলাম, রবীন্দ্র ভবনের বাইরের গেটে তালা, নো এন্ট্রি বলে লালচোখ সরকারি বিজ্ঞপ্তি। শিশিরের দেখা পাওয়া গেল না। উল্টোদিকের কারখানার গেটে বসে থাকা প্রহরী বললেন, নট অ্যালাউড। ফলে বাড়ির চৌহদ্দিতেও ঢোকা গেল না। রবীন্দ্র ভবন থেকে মংপু বাজার অবধি পুরো এলাকা, এবং তার সামনে পিছনে দু তিন কিলোমিটার পথের ধারে, সিনকোনা বাগানের মধ্যে, একের পর এক বাক্সবাড়ি উঠছে তো উঠছেই। পুরনো বাড়িগুলোকে খুঁজে পাওয়াই ভার। 

আরও পড়ুন
নীলপাহাড়ি অঞ্চলের টঙিয়ায়

মংপু বাজার থেকে জোড়বাংলোর পথে কিলোমিটার ছয় চড়াই ভাঙলে পুরনো সুরেল বাংলো। বাংলোটা এখন নেই, কিন্তু প্রায় চল্লিশ বছর আগে প্রথম যেবার মংপু আসি, তখনো ছিল। বাংলোর সামনের মাঠ থেকে চোখ চলে যেত কালিম্পং পাহাড় আর বহু নিচের তিস্তা উপত্যকা হয়ে ডুয়ার্সের সমতলে। পিছনের ধুপিবন আর সিনকোনা বাগান ভেজা সাদায় ডুবিয়ে দিয়ে উড়ে আসত মেঘ। ১৯৩৮ এর মে মাসে প্রথম যখন মংপু আসেন, রবীন্দ্রনাথ এসে উঠেছিলেন সুরেলের এই বাংলোয়, ছিলেন পনেরো-ষোলো দিন। বাংলোর দোতলায় পশ্চিমদিকের যে ঘরে তিনি থাকতেন, তার জানলা দিয়ে দেখা যেত ঝুরি নামানো একটা পাম গাছ। মৈত্রেয়ী দেবী বলছেন ওই 'বিশাল ছায়াময় বনস্পতির' দিকে তাকিয়ে থাকতেন কবি। তার ঠিক নিচেই একটা ক্যামেলিয়া গাছ ছিল, তা সাদা ফুলে ভরে থাকত। রবীন্দ্রনাথ ক্যামেলিয়াকে বলতেন মোমের ফুল। 

সুরেল আসার পথের দুধারে, সুরেলেও, সে সময় ঘন বন ছিল। বড় বড় গাছের নিচে ছায়াময় কালো অন্ধকার, রবীন্দ্রনাথের বড় ভালো লেগেছিল। এই হচ্ছে অরণ্য, তিনি বলেছিলেন। এই এলাকার পাহাড়, বন, কুয়াশা তাঁর শেষজীবনের লেখায় ফিরে এসেছে একাধিকবার। অথচ পাহাড় যে রবীন্দ্রনাথের খুব ভালো লাগত তা নয়। দার্জিলিং সম্বন্ধে তিনি উচ্ছসিত হতে পারেননি। এক সেই শিশুবয়সের ডালহৌসিবাস বাদ দিলে পাহাড় নিয়ে তিনি খুব ভালো কিছু যে বলছেন, এমন নজির নেই। বালিকা রানু অধিকারী আলমোড়া আর সিমলা থেকে তাঁকে চিঠি লিখে পাহাড়ের চিত্রময় বর্ণনা পাঠাচ্ছেন, তার উত্তরে তিনি বলছেন, আমার পাহাড় ভালো লাগে না, দৈত্যের মতো অস্তিত্ব নিয়ে পাহাড় থেমে আছে অনন্তকাল থেকে, ভালো লাগে না। সেই মানুষ তাঁর শেষ জীবনে ডাক্তারের এবং আত্মীয় পরিজনদের নিষেধ অগ্রাহ্য করে পাহাড়ে আসছেন বারবার। মৈত্রেয়ীর সঙ্গ এর একটা কারণ হতে পারে। কিন্তু পাহাড় বিষয়েও কি তাঁর ভাবনা বদলাচ্ছিল না? মৃত্যুর মাত্রই কয়েক মাস আগে, মৈত্রেয়ীকে লেখা একটি অসামান্য চিঠি-কবিতায় যিনি লিখতে পারেন, 'অরণ্য যেতেছে নেমে উপত্যকা বেয়ে/নিশ্চল সবুজ বন্যা, নিবিড় নৈশব্দ রাখে ছেয়ে/ছায়াপুঞ্জ তার',  অথবা, যাঁর চিন্তা ভেসে যায় 'শুভ্র-হিম রেখাঙ্কিত মহা-নিরুদ্দেশে', তিনি পাহাড় ভালবাসতেন না কি করে মেনে নেওয়া যায়? 

আরও পড়ুন
নীলপাহাড়ির খোঁজে

মংপুতে থাকাকালীনই সুরেলের বনের একটা জলরঙের ছবি আঁকেন রবীন্দ্রনাথ। সেই ছবিটার একটা ছাপারুপ বা প্রিন্ট সম্ভবত দেখেছি। কালচে-বাদামি গাছের মাথাগুলো দলা পাকিয়ে আছে, নিচের দিকে কালচে ছোপ। কালচে-বাদামি নাকি হলদে-লাল? নাকি সবজে-হলুদ? ওই ছবিটাই নাকি অন্য ছবি, যা নষ্ট হয়ে গেছে, যেভাবে নষ্ট হয়েছে সুরেলের বনও? ছবি আঁকার সময় রবীন্দ্রনাথ তো গাছের মধ্যে, বনের মধ্যে নিছক গাছ আর বন দেখতেন না, দেখতেন তাদের রং, রং ছাপিয়ে গিয়ে তাদের ভিতরের, গভীরের দুর্জ্ঞেয় নড়াচড়া, যা নিশ্চল সবুজ বন্যাকে চলমান করে। মৈত্রেয়ী দেবীর বয়ান অনুযায়ী, এই ছবিটা আঁকা হয়েছিল ১৯৩৯ এর সেপ্টেম্বরে। হাতের সামনে রবীন্দ্রনাথের ছবির সংগ্রহ নিয়ে প্রতিক্ষণ প্রকাশনী থেকে ছাপা যে বইটা আছে, সেখানে দেখা গেলো ১৯৩৯এর নিসর্গছবি বলতে গুটি কয়েক, তাদের প্রায় প্রতিটিতেই হলুদের সঙ্গে মিশে আছে ঘন, কালচে-সবুজ। সে ছবি থেকে সুরেলের বনকে খুঁজে পাওয়া মুশকিল, একরকম অসম্ভব। ফলে রবীন্দ্রনাথের ছবি নিয়ে মৈত্রেয়ী দেবীর কথাটা থেকে গেল। সেই সঙ্গে সেই কথাটা ধরেই পাঠকের মনের মধ্যে সেই ছবির কথার যে ছবি তৈরি হল, থেকে গেল সেটাও। রবীন্দ্রনাথের ছবির সঙ্গে মিলিয়ে দেখলে সবটা মিলিয়ে একটা দেখা/পড়া হয়। বাকিটা ধাঁধা, বা চিত্র-ইতিহাসের গবেষণার বিষয়। 

সুরেলের বন, যা খালি চোখে এখন দেখা যায় না। সুরেলের বাংলো, যেটাকে আমি দেখবার বছর কয় পরপরই পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল, প্রথম গোর্খা আন্দোলনের সময়। কয়েকটা শ্যাওলা-পড়া দেওয়াল দাঁড়িয়ে আছে এখন। সামনের মাঠে স্তূপীকৃত পাথর বালি। পুরোনো পাম গাছটা থেকে গিয়েছে। ক্যামেলিয়া গাছটাকে পাওয়া গেল না, পাবার কথাও না, মোমের ফুল আগুনে গলে যায়।

আরও পড়ুন
পেশকের পথ ধরে

অলংকরণ - বিপিন খুজুর ওঁরাও

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
লেপচা-দুনিয়ায়