মধুর রাজ্য

ছায়াছবি-কথা – ৫

আগের পর্বে

বাস্তবের দলিলচিত্রের কথা উঠলেই উচ্চারিত হবে দুটি নাম। এমাদ বার্নাত এবং আরভি রামানি। প্যালেস্তিনীয় এই কৃষকের সঙ্গেই ফিল্ম স্কুল থেকে পাস করা ভারতীয় যেন জড়িয়ে গেছেন সূক্ষ্ম বন্ধনে। দু’জনকেই মৃত্যুর মুখ থেকে জীবনের দিকে ফিরিয়ে এনেছে ক্যামেরা। সঙ্গী হয়েছে বন্দুকের হত্যালীলার। কিংবা সুনামির। বার্নাতের হয়ে শেল, গুলিও খেয়েছে তাঁর পাঁচ পাঁচটি ক্যামেরা। ‘মাই ক্যামেরা এন্ড সুনামি’ বা ‘ফাইভ ব্রোকেন ক্যামেরাস’-এর মত তথ্যচিত্র বাস্তব ইতিহাসকে জানলা করে তোলে দর্শকদের কাছে।

মৌমাছির রাজ্যও বলা চলে হয়তো। এটা ছিল সেই পরাক্রমশালী সম্রাট অ্যালেকজান্ডারের সাম্রাজ্য। সেই ম্যাসিডোনিয়ার (এখন উত্তর ম্যাসিডোনিয়া) বেকিরলিজা নামক এক গ্রামে থাকেন হাতিজা মুরাতোভা আর তার অশীতিপর প্রায়ান্ধ বৃদ্ধা মা। সেই গ্রামে বিদ্যুৎ নেই। রেডিও তরঙ্গ ধরাও অতি দুষ্কর।

লং শটে আমরা দেখি কুসুম-হলুদ জামা পরিহিতা হাতিজা হেঁটে আসছেন পাহাড়ের সানুতল ঘেঁষে খয়েরি উপত্যকার নয়নাভিরাম নিসর্গের মধ্যে দিয়ে। বহু পথ হেঁটে এসে তিনি পৌঁছোন পাহাড়ের এক বিপজ্জনক খাঁজে। গন্তব্য, চলার পথ স্বাভাবতই তাঁর নখদর্পণে। সেই খাঁজের একটা পাথরের টুকরো সরাতেই ভোঁ ভোঁ শব্দে শয়ে শয়ে বুনো মৌমাছি। স্বাভাবিক ছন্দে সেই মৌমাছির সাম্রাজ্যে অবলীলায় হাত ঢুকিয়ে তিনি সংগ্রহ করে নেন মধু। গায়ে, হাতে বসা মৌমাছিদের; গল্প করার ঢঙে উড়িয়ে দেন। এরপর তাঁর একটা ঈষৎ লম্বা ক্লোজ আপ শট। অদ্ভুত এক প্রশান্তিমাখা মুখ তাঁর। মুখে ছোট্ট একটা লাজুক হাসি ঝিলিক দেয়, ডানদিকে তাকিয়ে। হাসিতে একটা রহস্য-মেশানো থাকে। কারণ তার পরের বা তারও পরের শট দেখে আমরা বুঝিনা কার দিকে তাকিয়ে হাসলেন তিনি; আদৌ ওটা হাসি ছিল কিনা। তারপর ছবি চলতে চলতে সে প্রশ্ন হারিয়েও যায়।

ছবি দেখা শেষ হলে, আবেশ কাটলে, যখন ছবি তৈরির গপ্পোটা জানার ইচ্ছায় ইতিউতি ঝাঁক মারতে থাকি, তখন ভেদ হয় রহস্য। হানিল্যান্ড(২০১৯) এই প্রথম এমন এক ছবি যা একইসঙ্গে শ্রেষ্ঠ তথ্যচিত্র এবং কাহিনীচিত্রের মনোনয়ন পেয়েছিল ২০২০-র ৯২-তম অস্কার পুরস্কারের জন্য। অর্থাৎ সেই হাসিতেই লেখা ছিল ছবিটার গোত্রনাম; কোন অভিমুখে পড়তে হবে ছবিটা, তার ইঙ্গিত। দেড় ঘণ্টার এই ছবির পরিচালনা করেছেন দু’জন। তামারা কটেভ্স্কা এবং জুবোমির স্তেফানভ। সঙ্গে একজোড়া সিনেম্যাটোগ্রাফার-- ফেজমি দাওত আর সামির জুমা। ফিল্ম-স্কুল প্রশিক্ষিত তামারা সামলেছেন ছবিটার চরিত্রদের সম্পর্কের দিক আর নিসর্গ-নৈতিকতার দিকটা সামলেছেন জুবোমির। ২০১৫-য় শুরু হয়ে ৩ বছর ধরে ছবি তোলার কাজ হয়েছিল, ৬ জনের দল নিয়ে। সম্পাদনার জন্য ছিল ৪০০ ঘণ্টার ফুটেজ। 

হাতিজা মাঝেসাঝে একবেলার জন্যে স্কোপজে শহরে যান মধু বিক্রি করতে। ফেরার সময়ে মায়ের জন্যে, নিজের জন্যে এটাসেটা নিয়ে আসেন। এঁদের সংসারে অবশ্য কতকগুলি মার্জার আর একটা কুকুরও আছে। 

আরও পড়ুন
ক্যামেরার মৃত্যু, ছবির জন্ম

 

গোটা ছবিটা হ্যান্ডহেল্ড আর স্টেডি শটের মিশেলে তৈরি। কিন্তু তার কোনো নির্দিষ্ট প্যাটার্ন, যেমন বহির্দৃশ্য অন্তর্দৃশ্যের (আউটডোর ইনডোর) জন্য ভিন্ন প্যাটার্ন বা অন্য কোনো সূত্র মেনে কোনো প্যাটার্ন, চোখে পড়ে না। অর্থাৎ প্রো-ফিল্মিককে ঘেঁটে পুনর্নির্মান করতে না চেয়ে, যে অবস্থায় যেভাবে যে শট নেওয়া ‘সম্ভব’ হচ্ছে সেভাবেই ছবি তোলা হয়েছে, এমনই মনে হয়।

আরও পড়ুন
নৈঃশব্দ্যের বৈধব্য

কিন্তু গোল বাঁধে অন্য জায়গায়। যাদের দেখতে পাওয়া যায় তাদের কি ছবির চরিত্র বলব নাকি ছবিতে দেখতে পাওয়া বাস্তব মানুষ বলব? তাদের মুখনিঃসৃত ধ্বনিকে সংলাপ বলব না কথাবার্তা? হাতিজা কি তার মাকে ওভাবেই রোজ খাইয়ে দেন, ওখানে ওভাবে বসে নাকি আজ ক্যামেরার জন্য এটা ‘অভিনয়’ করছেন? যদিও জুম লেন্স ব্যবহার ক’রে ম্যাগনিফিকেশন বদলানো হচ্ছে শটের মধ্যেই, বাস্তবানুগতার প্রভাব দিতে। কিন্তু এটাকে গঠনশৈলী হিসেবে তো যে কোনো ছবিতেই ব্যবহার করা যেতে পারে। ছবির শুরুর তিন বা চার নম্বর শটটা ড্রোন থেকে তোলা হলে চারপাশটাকে ‘সুন্দর’ করে তোলার, একজটিসাইজড গতি আরোপ করার চেষ্টা বলে মনে হয়। সেদিক থেকেই হয়তো, মৌমাছির ম্যাক্রো শট শুধুই অবস্থান্তরপ্রাপ্তিকালীন (ট্রানজিশনাল) শট হিসেবে থেকে যায়। কাব্যময় সে-শট একমাত্র প্যারাডিগম্যাটিক ইলাস্ট্রেশন হিসেবে মূল আখ্যানের সঙ্গে আলগাভাবে লেগে থাকে।

হাতিজাদের সেই একলা ঘরের পাশে এক বাসভর্তি একটা পরিবার আসে হঠাৎ একদিন। তাদের প্রচুর মুরগি, প্রভূত গরু, অনেক ছেলেপুলে নিয়ে বিরাট সংসার। উপত্যকাটা ভরে ওঠে হাসি-কান্নার শব্দে, শিশুদের দৌরাত্ম্যে।

আরও পড়ুন
ঈব আল্ল ঊউ

 

এবারে ক্যামেরাকে বেশ চঞ্চল হয়ে উঠতেই হয়। দৌড়োতে হয় শিশু, বাছুর, মুরগির পেছনে পেছনে। ক্যামেরার ছায়া, শব্দযন্ত্রীর ছায়া পড়ে শিশুদের গায়ে, মাটিতে; কিন্তু আখ্যান মিথষ্ক্রিয় (ইন্টরঅ্যাক্টিভ) হয়ে ওঠেনা। কেউই ক্যামেরার দিকে না তাকিয়ে ক্যামেরাকে অদৃশ্য করে রাখে। এখানে পশুপাখিদের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের এমন কিছু মুহূর্ত দেখা যায়, যা এমন বিশ্বাসযোগ্যভাবে যে কোনও কাহিনিচিত্রেও তৈরি করা প্রায় অসম্ভব। বিশেষ করে বাছুরের জন্মের দৃশ্যটা। মুহুর্তগুলো তথ্যচিত্রের উপাদান হিসেবে যে কোনো ছবি-করিয়ের কাছে ঈর্ষণীয়। ‘সিনেমা ভেরিতে’র আঙ্গিকে ক্যামেরা শুধু নিখুঁতভাবে লক্ষ্য করতে থাকে ঘটমান বর্তমান। চলচ্চিত্রতাত্ত্বিক বিল নিকলস ক্যামেরার এই অপলক চেয়ে থাকাকে দেওয়ালের প্রজাপতি যেভাবে আমাদের বিন্দুমাত্র দৃষ্টি আকর্ষণ না করে, প্রায় অদৃশ্যভাবে আমাদের সমস্ত ক্রিয়াকলাপ দেখতে থাকে, তার সঙ্গে তুলনা করেন।

আরও পড়ুন
৪ মাস ৩ সপ্তাহ ২ দিন

নতুন প্রতিবেশীদের সঙ্গে বন্ধুত্ব জমে ওঠে হাতিজার। হাতিজা তাদের শিখিয়ে দেন মৌমাছি চাষের কৃৎকৌশল আর চাক রক্ষণাবেক্ষণের পদ্ধতি, যার মূল মন্ত্র-- সবসময় অর্ধেক মধু নিয়ে অর্ধেক মধু মৌমাছিদের জন্য রেখে দেওয়া। তুর্ক প্রতিবেশী হুসেন স্যাম তার এক খদ্দেরের চাপে অগ্রাহ্য করে বসেন এই মূলমন্ত্র। ফল পাওয়া যায় হাতেনাতে। প্রকৃতির জটিল বিন্যাস বিগড়ে গিয়ে নষ্ট হয় মৌমাছিদের মধু-সাম্রাজ্য।

বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে তৈরি হওয়া জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব রাষ্ট্রনীতি থেকে শুরু করে সমাজ-সংস্কৃতি, এমনকি পরিবারের অন্দরমহলে পড়তে বাধ্য। নিসর্গনৈতিকতার পাঠ ছাড়া এই গ্রহকে বাঁচানো এখন আক্ষরিক অর্থেই অসম্ভব। নৈতিকতার এই পাঠে যেমন আছে দূষণ কমানোর নীতি, একইসঙ্গে আছে প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে প্রকৃতির সসীম ঐশ্বর্যকে মানুষের লাভ ও ভোগের প্রয়োজনে ব্যবহৃত হওয়ার হাত থেকে বাঁচানোর কথা। পণ্ডিতরা বলছেন-- চলচ্চিত্রকে এ কথা প্রচারের হাতিয়ার করলেই শুধু হবে না, চলচ্চিত্র নির্মাণের প্র্যাক্টিসকেও হয়ে উঠতে হবে প্রকৃতি-সংবেদী। প্রাকৃতিক সম্পদ ধ্বংসকে যতটা সম্ভব এড়িয়ে বানাতে হবে ছবি। যদিও বিশ্বজুড়ে ‘ইকোসিনেমা’র ধারণাকে কেন্দ্র করে যে তত্ত্বায়নের কাজ চলছে তাতে ‘ইকোসিনেমা’র কোনো সর্বজনগ্রাহ্য সংজ্ঞা এখনও নেই বটে, কিন্তু হানিল্যান্ড সেই তালিকায় নাম লিখিয়ে অবশ্যই হয়ে উঠতে পারে সেই জঁরের অন্যতম সার্থক উদাহরণ। হানিল্যান্ড আর একবার মনে করিয়ে দেয় যে মানুষ প্রকৃতিরই অংশ। নিজেদের স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য প্রকৃতিকে নিঙড়ে নেওয়া মানুষের কাজ হতে পারে না।

 

হাতিজার মা, নাফিজা, হাতিজাকে সেই জনশূন্য গ্রামে সম্পূর্ণ একলা রেখে মারা যান। তখন শীতকাল। চতুর্দিকে বরফ আর বরফ। এখানে ছবিটা তথ্যচিত্রধর্মিতা থেকে সরে যায়। হাতিজাকে দেখা যায় তার মায়ের কবরের কাছে বসে থাকতে। প্রশ্ন জাগে সম্পূর্ণ একা হাতিজাই কি তার মাকে কবর অব্দি নিয়ে যান? যদি যান, তাহলে তা দেখানো হয় না কেন? আর যদি অন্য কেউ সাহায্য করেই থাকেন তা না দেখিয়ে কাহিনিচিত্রের যুক্তিতে কবরের দৃশ্যটা থেকে যাওয়ার কারণ হয়তো এটা যে, মানুষের কৌম বা সমষ্টি জীবনবোধকে ছুঁতে না পারার গূঢ় নিসর্গনৈতিক মূল্যবোধ, ব্যক্তি-বিষয়ী পরিচালকদের তরফে পেড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না। ছবির শেষে আবার একটা ক্লোজ আপ, হাতিজার। এবার বাঁদিকে, আলোর দিকে।

পরিচালকেরা এই ছবির প্রাপ্ত পুরস্কারের খানিক অর্থ দিয়ে হাতিজার জন্য একটা বাড়ি কিনে দিয়েছেন স্কোপজে শহরের কাছে। কারণ, চিত্রনাট্য অনুযায়ী তাঁর মায়ের মৃত্যু হয়নি। মায়ের মৃত্যুর পর যে তিনি বাস্তবিকই একা।

Powered by Froala Editor