ক্যামেরার মৃত্যু, ছবির জন্ম

ছায়াছবি-কথা – ৭

আগের পর্বে

২০১৮ সালে কাশ্মীরের ‘অর্ধবিধবা’দের সত্য ঘটনা অবলম্বনে তৈরি হয়েছিল ‘উইডো অফ সাইলেন্স’। প্রবীণ মোর্চালে লিখিত এবং পরিচালিত এই সিনেমা তাঁর তৈরি তৃতীয় ছবি। দৈর্ঘ্য ৮৫ মিনিট। প্রতীকী শটের ব্যবহার প্রায় নেই বললেই চলে। ছবির মূলচরিত্র শিক্ষানবীশ নার্স আসিয়ার চরিত্রে অভিনয় করেছেন শিল্পী মারওয়াহা। স্বামী ফিরবে, এমনটাই বিশ্বাস চরিত্রটির। কিন্তু গত ৩০ বছরে এমনটা ঘটতে দেখেনি সে। এর মধ্যেই আসিয়ার রেজিস্টার যৌনহেনস্থা করতে উদ্যত হয়। প্রতিক্রিয়ায় সপাটে চড়। ধর্ষকামী পিতৃতন্ত্রের রূপ এভাবেই তুলে ধরেন পরিচালক। এই সিনেমায় নেই ডাল লেক, ছদ্ম-রাজনৈতিকতা, বরফ-কুচি, মিলিটারির টহল। বরং আঁকা থাকে উপত্যকার অপরিচিত অন্দরমহল। উচ্চকিত রাজনৈতিক সাধারণীকরণ না করার বোধ।

ক্যামেরার সামনে অভূতপূর্ব কিছু ঘটতে দেখলে যে কেউ তার ছবি তুলে রাখার চেষ্টা যে করবেন, এ তো স্বতঃসিদ্ধ। কিন্তু সেই ঘটনা তাকে প্রভাবিত করবে কতটা, সেটা প্রশ্ন। প্রশ্ন এটাও যে সেই প্রক্রিয়াটা কীভাবে দর্শকের ওপর প্রভাব ফেলবে। বিশেষতঃ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে শুরু করে সভ্যতা এমন সব সংবাদচিত্র (নিউজরিল) দেখেছে, যে তার পর্দায়, তার পর্দার অভিধানে ‘অভূতপূর্ব’ শব্দের অস্তিত্বই সঙ্কটে। ‘সিনেমা অফ স্পেক্ট্যাকল’ বা ‘মন্তাজ অফ অ্যাট্রাকশনস’-এর ধারণা পেরিয়ে এসেছে সভ্যতা। স্পেক্ট্যাকুলারিটি সমাজের অঙ্গীভূত হয়ে পড়েছে, আজ।

চতুর্থ সন্তানের (জন্মদিনের অনুষ্ঠানের) ছবি তুলবেন বলে ২০০৫ সালে একটা ক্যামেরা কিনেছিলেন জর্ডন নদীর পশ্চিম তীরের (ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক) প্যালেস্তিনীয় কৃষক এমাদ বার্নাত। কিন্তু সেই ক্যামেরাই যে রাজনৈতিক ইতিহাসের দলিল ধরে রাখবে কেই বা জানত! প্যালেস্তাইন শব্দটা চোখে পড়তেই ইজরায়েল, মিলিটারি, হত্যা মনে পড়ে যেতে বাধ্য। সেভাবেই বার্নাতের ক্যামেরায় পরিবার, পাড়া, উদযাপনের পাশাপাশি ধরা পড়তে থাকে ইজরায়েলি দখলদারি, নির্মম অত্যাচার আর প্রতিরোধের একের পর এক ঘটনা। কিন্তু সে ক্যামেরা টিকতে পারেনি গোটা একটা বছরও। ধুঁকতে থাকা মানুষের মতো হাঁফ টানতে টানতে শেষ হয়ে গেছে। সেসব ছিন্নবিচ্ছিন্ন ঘটনাই জুড়ে জুড়ে ছবিকরিয়ে গায় দাভিদির সহায়তায় ২০১১-য় তৈরি হয় ফাইভ ব্রোকেন ক্যামেরাজ নামক দলিলচিত্র। দাভিদি নিজে কিন্তু ইজরায়েলি (পরে ফ্রান্সে থাকেন)।

 

ফিল্ম স্কুল পাশ করা আর ভি রামানি কন্যাকুমারীর কাছে সোথাভালাই সমুদ্রতটে ২০০৪ সালে যখন গিয়েছিলেন তখন ৩/৪ তলা বাড়ির সমান ঢেউ আছড়ে পড়ে তাদের ওপর। উপকূলের ভেতর দিকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। ফিরতি পথে কোনোক্রমে একটা গাছকে জড়িয়ে বাঁচেন রামানি। তিনি তাঁর হাতের ক্যামেরাটাকে বাঁচাতে চাইছিলেন। সম্ভবত সেটা করতে গিয়েই নিজেকেও বাঁচিয়ে ফেলেন কোনোক্রমে। ক্যামেরাটা বেঁচেও গিয়েছিল, বাঁচানো যায়নি টেপটাকে। শেষ তোলা গর্জনী সমুদ্রের সামান্য ফুটেজ নষ্ট হয়ে গিয়েছিল জলে-বালিতে। দক্ষিণ ভারতের ছায়াপুতুল-নাটকের ওপর তথ্যচিত্র বানাবেন বলে ২০০০ সালে পি ডি ১০০ ক্যামেরাটা কিনেছিলেন রামানি। তারপর থেকে তার প্রায় সমস্তরকম অভিজ্ঞতার সাক্ষী ছিল সেই ক্যামেরা। এই আত্মার মৃত্যুর পর, আগের চার বছরে তোলা ছবিগুলোকে জোড়া দিয়ে দিয়ে ২০১৭-য় প্রকাশ পেয়েছিল তাঁর প্রতীতিমূলক (ইম্প্রেশনিস্ট) তথ্যচিত্র-- মাই ক্যামেরা অ্যান্ড সুনামি। ছবির গঠন, চলন, ছন্দ-- সবই তিনি পেয়েছিলেন সেই ফুটেজগুলো থেকে, বাইরে থেকে প্রায় কিছুই প্রযুক্ত না করে। ভারতবর্ষের নিরীক্ষামূলক তথ্যচিত্রের জগতে রামানি অন্যতম উল্লেখযোগ্য একটা নাম।

আরও পড়ুন
নৈঃশব্দ্যের বৈধব্য

বার্নাত বা রামানি দু’জনেই তাঁদের ক্যামেরা দিয়ে দেখে চলেন, লিখে চলেন তাঁদের দৈনন্দিন। সেই দৈনন্দিনে অন্য সবকিছুর সঙ্গে বার্নাতের  ছেলেদের বড়ো হয়ে ওঠার ছবি ধরা ছিল যেমন, রামানির ছেলেকেও একইরকমভাবে ধরা ছিল ছবিতে; ভিন্ন প্রেক্ষাপটে ভিন্ন প্রেক্ষিতে। যার ছবিতে এত প্রত্যক্ষতায় ধরা পড়ে চারপাশ, তার তোলা উত্তাল সমুদ্রকে দেখা যায় অভূতপূর্ব সমুদ্র ঢেউয়ের শটের অনুপস্থিতির মধ্যে। অতীতের আধৃত স্মৃতি জুড়ে জুড়ে রামানি রচনা করেন বর্তমানকে। অতীতের সাধারণ চলন বলে দেয় ভয়ানক বর্তমানকে। আর বার্নাতের ভয়ানক ঘটমান বর্তমান বুঝিয়ে দেয় শান্তির অতীতের কথা, অতীতের অনুপস্থিতি দিয়ে। দু’জনেই সম্ভবত ছবি তোলেন না, অভিজ্ঞতা করেন। হ্যাঁ, ক্যামেরাকে সঙ্গী করেই। রামানি বলেন-- “ক্যামেরার খোলটা ক্যামেরার শরীর, আর টেপটা বা চিপটা, যাতে ধরা থাকে মুহুর্তগুলো, তার আত্মা।” অর্থাৎ একটা শরীরকে জ্যান্ত রাখতে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন আত্মার উপস্থিতি সম্ভব। বার্নাতের সেই শরীরের চোখে সরাসরি এসে লাগে ইজরায়েলের কার্তুজ। আত্মা সাড়া দিতে থাকে, তবু। তাই চিড়-ধরা লেন্স দিয়েই প্রাণ দেখতে থাকে সামনের জগতটাকে-- গুলি চালানো মানুষটাকে, গুলি খেয়ে লুটিয়ে পড়া মানুষটাকে। একটা জলজ্যান্ত প্রাণচঞ্চল প্রতিরোধী মানুষ আর সাড়া দেয় না। মানুষটা মুহূর্তের মধ্যে ফাঁকা খোলে পরিণত হয়ে পড়ে থাকে শুধু, আমরা দেখি। এতদূর আমাদের দেখায় বার্নাতের ক্যামেরা। মৃত্যুর এমন উপস্থিতি আর কোন তথ্যচিত্রে দেখেছি আমরা!

 

আরও পড়ুন
ঈব আল্ল ঊউ

ঝিগা ভের্তভের ‘কিনো আই’ (ক্যামেরা চোখ) হোক বা আস্ত্রুকের ‘ক্যামেরা স্টাইলো’ (ক্যামেরা কলম), যে দিক থেকেই দেখি-- ছবির প্রচলিত শৃঙ্খল থেকে বেরিয়ে আসে এঁদের ছবি। বাস্তবের সঙ্কেতলিপির পাঠোদ্ধার করে, নিষ্ক্রিয়-পর্যবেক্ষক হয়ে না থেকে। এঁদের ছবি হয়ে ওঠে অংশগ্রহণমূলক। এঁদের উপস্থিতি বাস্তবকে নিরপেক্ষ থাকতে না দিয়ে একটা দূর পর্যন্ত প্রভাবিতও করে। কিন্তু সেই সীমাটা যেই পেড়িয়ে যায় বা আবছা হয়ে যায়, সঙ্গেসঙ্গে কিছু অকপট মুহূর্তও (ক্যান্ডিড মোমেন্ট) মূর্ত হয়ে উঠতে শুরু করে ক্যামেরার সামনে। এঁদের অংশগ্রহণ কি ‘ইভেন্ট’-ও হয়ে ওঠে না! কেউ এঁদের ছবি তুলতে এলেও, এঁরা ক্যামেরা বন্ধ করেন না। দেখা এবং দেখানোর বিষয়টা একসঙ্গে চলতে থাকে।

বার্নাতের ক্যামেরা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সটান দেখে জ্বলন্ত জলপাই গাছ, মুড়ি-মুড়কির মতো কাঁদানে গ্যাসের শেল, রক্তাক্ত নিরস্ত্র প্রতিরোধ। রামানির মতোই বার্নাতেরও মনে হয়-- ক্যামেরাটাই যেন তাকে বাঁচায়। নিজের শরীরটাকে মনে হতে থাকে ক্যামেরা। ক্যামেরাটাই তার নিঃশ্বাসের কাজ করে। ক্যামেরা তার হয়ে বুক পেতে গুলি খেয়ে মনে করায় জীবনের ভঙ্গুরতা। ছবি তোলাই হয়ে ওঠে বার্নাতের  কাছে সেরে ওঠার অন্য নাম। উত্তম পুরুষ-কন্ঠে বার্নাতের ক্যামেরা একটা পরিণতির দিকে এগোয়। সংবাদচিত্রে এই অন্দরমহল কখনো দেখেছি কি আমরা! নিজের জীবন নিয়ে নৃকুলবিদ্যা (এথনোগ্রাফি) করা যায়! অথবা ক্যামেরার মধ্যস্থতায় নিজের বিষয় দিয়ে নিজেকে করে তোলা যায় বিপন্ন নৈর্ব্যক্তিক লক্ষ্যবস্তু কিম্বা প্রো-ফিল্মিক! আসলে নিজেকে বিপন্নতায় ঠেলে দিয়ে যে ‘দেখা’, সেটাই এখানে আন্তরিক ও অত্যন্ত প্রয়োজনীয় সক্রিয়তা (অ্যাক্টিভিজম)। এই সক্রিয় অংশগ্রহণের জন্যেই বার্নাতের  কখনো জেলে, কখনো হাসপাতালে পর্যন্ত যেতে হয়। এই সক্রিয় অংশগ্রহণের জন্যেই একে একে বার্নাতের পাঁচ-পাঁচটি ক্যামেরা বুলেট কি কাঁদানে গ্যাসের শেল হজম করে। কিন্তু হার মানে না কেউই-- না বার্নাত, না বার্নাতের ক্যামেরা। 

আরও পড়ুন
৪ মাস ৩ সপ্তাহ ২ দিন

 

রামানির ক্যামেরায় মামুলি প্রাত্যহিকতার একটা মোজাইক তৈরি হয়। কিন্তু তার কোনো কেন্দ্র থাকে না। জানলার গ্রিল দিয়ে যেভাবে চোখ গলাই আমরা, সবসময় সটান না দেখে, রামানির ক্যামেরা সেভাবেও দেখে কখনো। খুঁজতে চায় নানা দেখার দর্শনকে। অন্যের হাতে নিজের ক্যামেরা দিয়ে নিজেও প্রো-ফিল্মিক হয়ে ওঠেন। স্লো শাটারে, শট পুনরাবৃত্তিতে অর্থাৎ ছবি তোলা এবং তা সাজানোর মধ্যে দিয়ে ইমেজের নিজস্ব রাজনীতি, ইমেজ তৈরির রাজনীতি আবিষ্কারে মগ্ন থাকেন তিনি। মৃত্যুর শাব্দিক তথ্যের মধ্যে দিয়ে সুনামির স্মৃতি যখন ফিরে আসে তখন রামানিই জানান-- ঐ ঢেউ-এর ছবি তোলা যায় না হয়তো। ছবি তোলার অসম্ভাব্যতার ছবি তুলতে চেয়েছিলেন তিনি-- কোন অবস্থায় ছবি আর তোলা যায় না, তিনি সেই অভিজ্ঞতা পেতে চাইছিলেন। নিজেকেই ঠেলতে ঠেলতে খাদের প্রান্তে নিয়ে গিয়ে পরীক্ষার চেষ্টা বলা যায় হয়ত এই পদ্ধতিকে। সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটাই ক্যামেরা দ্বারা মধ্যস্থতাকৃত।

এটা কোনো তুলনামূলক পাঠ নয়। এই দুটো ছবিকে একই আনুভূমিক তলে রেখে পড়া যায় কিনা তাও নিশ্চিত নই। তবে এটুকু নিশ্চিত বলা যায়, অভিজ্ঞতার সত্যকে খুঁজতে গিয়ে ক্যামেরার কাছে আত্মসমর্পণের কাহিনি এই ছবি দুটো। দুটো ছবিতেই জীবনকে মৃত্যুর হাত থেকে ছিনিয়ে আনে ক্যামেরা; ক্যামেরার অস্ত্বিত্ব।

Powered by Froala Editor