চম্বলের ডাকাতদের খপ্পরে পড়েছিলেন হিউয়েন সাং; খুন হন আকবরের জীবনীকার আবুল ফজলও

দুর্ধর্ষ দুশমন – ৭

আগের পর্বে

মানসিং-এর স্ত্রী রুক্মিণীদেবী মুখোমুখি হয়েছিল বহু সর্বভারতীয় নেতা-মন্ত্রীদের। তাঁর ব্যক্তিত্বের সামনে স্তম্ভিত হয়েছিলেন তাঁরা। মানসিং-এর আত্মসমর্পণের প্রস্তাব নিয়ে আসা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীও হার মেনেছিলেন তাঁর সামনে। মানসিং-এর মৃত্যুর পর পুলিশের থেকে তিনিই ছাড়িয়ে এনেছিলেন ১৫০ বিঘা জমি। তবে সে সময় একটু একটু করে ভাঙতেও হয়েছিল তাঁকে। গাড়ি ভাড়া যেমন ছিল না। তেমন গাড়ি থেকে তাঁকে নামিয়ে দেওয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছিল চম্বলে। তবে মানসিং চম্বলের রবিন হুড। তাই এতবছর পরেও অজ-পাড়া গাঁয়ের ছোট্ট এই জনপদে মন্দিরে তাঁর পুজো হয় সন্ধে নামলেই। হাজির হন বহু বহু মানুষ...

পরদিন সকালেই আমি রওনা হই ভিন্ডর উদ্দেশ্যে। জিপে করে খেড়া রাঠোর থেকে নদ গাঁও হয়ে চম্বল নদী। নদী পার করলেই ওপাশে মধ্যপ্রদেশ। চারপাশে সুদৃশ্য বেহড়, তার মাঝে ভারত সরকারের বাঁধানো রাস্তা। আগে এসব ছিল না। এই বেহড়ের মধ্যে দিয়েই পায়ে হেঁটে যাতায়াত করতে হত মানুষকে। এত যে বেহড় বেহড় করছি, এই বেহড় আসলে কী? একটু বলে নেওয়া যাক। আপনারা যারা কলকাতা থেকে ট্রেনে উত্তর ভারত বিশেষ করে দিল্লি আগ্রা এইসব অঞ্চলে ট্রেনে করে করে গেছেন, তাদের চোখে পড়েই থাকবে জানলা দিয়ে দূরে দূরে মাটির টিলা, এবড়ো খেবড়ো। টুন্ডলার দিকে ট্রেন ঢুকলে তা আরও জানলার কাছাকাছি চলে আসে। এই হচ্ছে বেহড়।

সোজা বাংলায় এর মানে দাঁড়ায় নদীর অববাহিকায় সৃষ্টি উঁচু-নিচু অসমতল জমি। চম্বল নদীর আববাহিকাজুড়ে এই বেহড়ের অবস্থান। যেখানে যেখানে চম্বল নদী বয়ে গিয়েছে, তার আশেপাশের এলাকায় নদীর ভাঙনে কোথাও সৃষ্টি হয়েছে গর্ত, কোথাওবা উঁচু-নিচু টিলা। যার কোনোটার উচ্চতা চার-পাঁচতলা বাড়ির সমান, আবার কোনোটা একমানুষ সমান। এর ভেতর কখনো তৈরি হয়েছে প্রাকৃতিক সুড়ঙ্গ, কখনো বা তৈরি হয়েছে দুই টিলার মাঝখানে অপ্রশস্ত পায়ে চলার পথ। এই পতিত জমিতে একমাত্র কিছু কাঁটা গাছ এবং লবণাক্ত জমিতে উৎপন্ন গাছ ছাড়া আর কোনো গাছ-গাছালিই দেখতে পাওয়া যায় না।

ইতিহাস অনুযায়ী রাজস্থানের বৎস-গোত্রীয় সামন্ত মহাসেন ছিলেন চম্বলের বেহড়ের প্রথম নথিভুক্ত বাগী। যিনি অধিকার ছিনিয়ে নেওয়ার কারণে রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে হয়েছিলেন বাগী। রাজা ভোজ তাঁর হাত থেকে সামন্তের অধিকার কেড়ে নিয়েছিলেন অন্যায়ভাবে। ফলে মহাসেন রাজা ভোজের রাজ্যের ব্যবসায়ীদের গুজরাত থেকে ব্যবসা করে ফিরে আসার সময় চম্বলের ঘাটিতে আটকে রেখে লুঠ করতেন। বেহড়ে ছোটো ছোটো কেল্লা বানিয়েছিলেন তিনি, যেখানে থাকত তার সেনারা। নিজের অধিকার ছিনিয়ে নেওয়ার পাগলামিই মহাসেনকে নিষ্ঠুর খুনি বানিয়ে তুলেছিল। আর তা এতটাই যে তার নামের আগে বসে যায় ‘চণ্ড’ উপাধি।

এভাবেই ব্যর্থ প্রচেষ্টা চলে বেহড়কে সমান করার

 

আরও পড়ুন
মানসিং-এর আত্মসমর্পণের প্রস্তাব নিয়ে হাজির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, তাড়িয়ে দিলেন স্ত্রী রুক্মিণীদেবী

রাজা ভোজ তাঁকে ধরার জন্য বেশ কয়েকবার সেনা অভিযানও চালিয়েছিলেন, কিন্তু বেহড়ের অদ্ভুত প্রাকৃতিক গঠনের জন্য চণ্ড মহাসেনের কোনো ক্ষতিই তিনি করতে পারেননি। শেষ পর্যন্ত রাজা ভোজ দিল্লি থেকে চম্বলে এসে বসতি স্থাপন করা তোমর জাতিকে চণ্ডর অত্যাচার থেকে মুক্ত করার আগ্রহ প্রকাশ করেন। তার বদলে তোমরদের শাসক বজ্রট তোমরকে চম্বল অঞ্চলে কর আদায় করার অধিকার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন তিনি। বেহড়ে অভ্যস্ত তোমর সৈনিকরা পনেরো দিন পর্যন্ত চণ্ডকে বেহড়ের মধ্যেই ঘিরে ফেলেন চতুর্দিক থেকে। জল না থাকার সমস্যার কারণে চণ্ডর সমস্ত সঙ্গীরাই তৃষ্ণার কারণে মৃত্যুমুখে পতিত হন এবং তোমরা সৈনিকরা চণ্ডকে হত্যা করে।

এই তোমার-বংশীয়রাই দিল্লির আদি শাসক ছিলেন চৌহান বংশের শাসনের আগে পর্যন্ত।  চম্বলের আধুনিক ডাকাতদের বা বলা ভালো বাগীদের ইতিহাসের শুরু দ্বাদশ শতাব্দী থেকে। সেই সময় দিল্লির দরবারে রাজত্ব করছেন রাজপুত রাজা পৃথ্বীরাজ চৌহান। কিন্তু রাজপুতদের নিজেদের মধ্যেই শুরু হল বিবাদ গৃহযুদ্ধ। শেষমেষ পৃথ্বীরাজ তোমর বংশীয় রাজপুতদের দিল্লি থেকে বিতাড়িত করেন। দিল্লি থেকে প্রাণভয়ে পালিয়ে এসে তোমররা আশ্রয় নিলেন চম্বলের বেহড়ে। বসতি স্থাপন করলেন ভিন্ড, মোরেনা, দাতিয়া এলাকায়। কিন্তু তোমর রাজপুতরা নিজেদের এই অপমান মেনে নিতে পারেননি। অন্যদিকে পৃথ্বীরাজ নিজেও রাজপুত।

আরও পড়ুন
পুলিশের ‘বিশ্বাসঘাতকতায়’ গুলিবিদ্ধ রূপা সিং, আনন্দে লাফিয়ে উঠলেন কুইন

আজ থেকে ২০ বছর আগে এমনই ছিল রাস্তা, এখনো আছে গ্রামের লোকের যাতায়াত করার জন্য

 

তোমররা বারেবারে দিল্লি আক্রমণ করেছেন, কিন্তু তা ছিল তাদের ব্যর্থ অভিযান। বারেবারে তারা আক্রমণ করেছেন পৃথ্বীরাজের সেনাবাহিনীকে, আর যতবার বেঁধেছে লড়াই ততবারই লাল হয়ে উঠেছে চম্বলের জল। এই রক্তাক্ষয়ী সংগ্রাম জারি ছিল পৃথ্বীরাজের জীবিতকাল পর্যন্ত। তারপর পৃথ্বীরাজও মারা যান আর শেষ হয় তোমররাও। কিন্তু দু-পক্ষের মাথারা বেঁচে না থাকলেও তাদের বংশধররা বেঁচেছিলেন, ফলে চোরাগোপ্তা লড়াই কিন্তু লেগেই ছিল। সেই শুরু চম্বলের নিজস্ব আইন, খুন কা বদলা খুন। বাদশার পর বাদশা দিল্লিতে রাজত্ব করেছে কিন্তু তোমরদের আক্রমণ থামেনি।

আরও পড়ুন
চম্বলের দুর্ধর্ষ লাখন সিং-এর চরিত্রে সুশান্ত, মনোজ বাজপেয়ী ছিলেন মানসিং-এর ভূমিকায়

শেষ দিকে এই দিল্লি জয়ের আক্রমণই পরিণত হয়েছে দস্যুবৃত্তিতে। কারণ, বেহড়েই এই পার্বত্য এলাকায় দরকার বাঁচার জন্য অর্থ। আর অর্থ যোগানের সহজ উপায় ডাকাতি আর লুঠ। ফলে লড়াই শুরু হল ছোটো ছোটো গোষ্ঠীর মধ্যে। রাজপুতদের সঙ্গে ব্রাক্ষ্মণদের, ঠাকুরদের সঙ্গে জাঠেদের, গুজ্জরদের সঙ্গে আহিরদের, আর মাল্লাহ জাতের। আর এভাবেই ধীরে ধীরে শুরু হল ডাকাতি। বেঁচে থাকার জন্য। রাজা-রাজড়া থেকে শুরু করে বাদশা এমনকি ইংরেজ শাসকরাও এই ডাকাতদের প্রতিহত করতে ব্যর্থ হয়েছেন। তার কারণ বেহড়ের প্রাকৃতিক গঠন। ডাকাতরা এই বেহড়ের অলিগলির সঙ্গে পরিচিত, কিন্তু বাদশা এবং ইংরেজদের সৈন্যরা নন।  পাঁচ হাজার সৈন্যের এক ব্যাটালিয়ন যদি বেহড়ে হারিয়ে যায় তাহলে কেউ টের পর্যন্ত পাবে না এমনই গোলকধাঁধা। এখানে না চলে ঘোড়া, না চলে গাড়ি। ফলে বুঝতে পারা যায় কতটা কষ্টসাধ্য এখানকার জীবনযাপন। এই বেহড়ে হারিয়ে যাওয়ার অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে।

এই রাস্তা দিয়েই জিপে করে চম্বল নদীর তীরে গিয়েছিলাম

 

আরও পড়ুন
কলকাতায় হাজির চম্বলের মাধো সিং, আত্মসমর্পণে সাহায্য চাইলেন জ্যোতি বসুর কাছে

প্রায় এক ঘণ্টা তেষ্টায় ক্লান্তিতে আমি ঘুরে মরেছি এই প্রাকৃতিক ভুলভুলাইয়ায়। সে গল্প পরে। জানলে অনেকেই অবাক হবেন, আইন-ই-আকবরির রচনাকার তথা মুঘল সম্রাট আবুল ফজলের হত্যাও হয়েছিল এই চম্বলেই। কারণ সেই সময় আবুল ফজল শাহজাদা সেলিমের বিরোধিতা করেছিলেন। আকবরকে জানিয়েছিলেন যে সেলিম সিংহাসনের অযোগ্য। যে কারণে আবুল ফজলের হত্যার ষড়যন্ত্র করেন সেলিম। রাজপুতদের মধ্যে সেলিম প্রচার করতে শুরু করেন যে আবুল ফজল হিন্দুদের কৌশলে ধর্মান্তরিত করছেন মুসলমান ধর্মে। এবং বিশেষ করে সেই সময় চম্বল অঞ্চলে বুন্দেলখণ্ডীয় রাজপুত রাজা বীরসিংহ বুন্দেলাকে খেপিয়ে তোলেন সেলিম। সেলিমের ঘনিষ্ঠ বন্ধু বীরসিং বুন্দেলা কৌশলে আবুল ফজলকে মধ্যপ্রদেশের কাছে নরওয়ার জেলায় হত্যা করেন ১৬০৩ খ্রিস্টাব্দে। আজও এই চম্বলেই মধ্যপ্রদশের আন্তরি গ্রামে রয়েছে আবুল ফজলের অবহেলিত সমাধি। চম্বলের ডাকাতদের আতঙ্কের কাহিনি যে কত পুরোনো, তার জলজ্যান্ত উদাহরণ হিউয়েন সাং। এই চিনা পর্যটকও রেহাই পাননি চম্বলের ডাকাতদের হাত থেকে।

চিনা পর্যটক হিউয়েন সাং হর্ষবর্ধনের রাজত্বকালে ভারতে এসেছিলেন। চিন থেকে ২৯ বছর বয়েসে তিনি ৬২৯ খ্রিস্টাব্দে যাত্রা শুরু করে তাশখন্দ, সমরখন্দ হয়ে ৬৩০ খ্রিস্টাব্দে তিনি গান্ধার রাজ্যে পৌঁছোন। সেখান থেকে তিনি কাশ্মীর, পাঞ্জাব, কপিলবস্তু, বেনারস, গয়া এবং কুশীনগরের যাত্রা করেন। চম্বলের ডাকাতদের গল্প সম্পর্কে খোঁজ খবর রাখা বেশির ভাগ মানুষের কাছেই চম্বলের ইতিহাস মান সিং, মালখান সিং, ফুলনদেবী, এবং সাম্প্রতিককালের কিছু জনপ্রিয় ডাকাতদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী, চম্বলের লুটতরাজের প্রবৃত্তি শতশত বছর আগে থেকেই ছিল। এই ডাকাতেরা সপ্তম শতাব্দীতে হর্ষবর্ধনের সময়কালে ভারতে আসা বিখ্যাত চৈনিক পর্যটক হিউয়েন সাং-কেও মুরেনা-ধৌলপুরের কাছে বেহড়ে অপহরণ করে লুঠপাট করেছিল। হিউয়েন সাং হর্ষবর্ধনের কনৌজ থেকে গঙ্গা আর চম্বল নদীর রাস্তা ধরে মালওয়া রাজ্যে গিয়েছিলেন। সেই সময় বর্তমান রাজস্থানের ধৌলপুরের কাছে চম্বলের বেহড়ে তার রাস্তা আটকায় ডাকাতরা। গঙ্গা যমুনা পেরিয়ে চম্বল নদী ধরে নৌকো করে মালওয়া রাজ্যের যাওয়ার পথে হঠাৎ করেই হিউয়েন সাঙের নৌকোকে ঘিরে ধরে ডাকাতরা।

আরও পড়ুন
‘নয়া পঞ্ছি মালুম হোতা হ্যায়’ - শ্যেনদৃষ্টিতে তাকিয়ে রূপা ডাকাতের নাতি

চম্বল নদী আর তার অববাহিকা জুড়ে বেহড়

 

তারপর হিউয়েন সাঙের কাছে গিয়ে একমাত্র তার বইপত্র বাদ দিয়ে বাকি সবকিছু কেড়ে নেয় তারা। স্বয়ং হিউয়েন সাঙের রচনাতেও পাওয়া যায় যে, বিদেশি বেশভূষা দেখে ডাকাতরা তাকে ধরে নিয়ে যায় জঙ্গলের এক মন্দিরে। সেখানে তাকে বলি দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই ধূলোর ঝড় শুরু হয়। আর সেই ঝড়কে দেবীর ক্রোধ মনে করে ডাকাতরা হিউয়েন সাং-কে ছেড়ে দেয় (অরিয়েন্টাল মেমরিস: আ ন্যারেটিভ অফ সেভেনটিন ইয়ার্স রেসিডেন্স ইন ইন্ডিয়া – জেমস ফোর্বস, প্রকাশকাল ১৮৩৪,  ঠগি – ব্যান্ডিট্রি অ্যান্ড দ্য বৃটিশ ইন আর্লি নাইনটিন্থ সেঞ্চুরি ইন্ডিয়া – কিম এ ওয়াগনার, দুটি বইয়েই এই ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায়। এছাড়াও দ্য ইম্পেরিয়াল গেজেটার অফ ইন্ডিয়া ভলিউম ওয়ান সেকেন্ড এডিশনে এর উল্লেখ রয়েছে)।

অনেকটা আমেরিকার গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন বা আমাদের মেদিনীপুরের গড়বেতার গুনগুনি এলাকার মতোই। তবে আরো ব্যপক হারে। আর এই বেহড়ের কারণেই চম্বল এলাকার অর্থনীতির দৈন্যদশা। বেহড়ই এখানকার অর্থনীতি ঠিক করে দিয়েছে। কেবল চম্বল নদী নয়, চম্বলের খ্যাতি মূলত পাঁচের দশক থেকে শুরু করে ২০১৫ পর্যন্ত তার বাগী বা ডাকাতদের জন্য। কালের নিয়মে শুরু থেকেই এই চম্বল অববাহিকজুড়ে ছিল ডাকাতদের আগ্রাসন। ভুল হল, ডাকাত নয় বাগী। প্রচলিত অর্থে বাগী মানে বিদ্রোহী। অন্যায় অবিচারের প্রতিবাদে যারা হাতে তুলে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন অস্ত্র, আশ্রয় নিয়েছিলেন কাঁটাঝোপ-ভর্তি অসমতল পার্বত্য চম্বল উপত্যকায়।

Powered by Froala Editor

More From Author See More