চম্বলের দুর্ধর্ষ লাখন সিং-এর চরিত্রে সুশান্ত, মনোজ বাজপেয়ী ছিলেন মানসিং-এর ভূমিকায়

দুর্ধর্ষ দুশমন – ৪

আগের পর্বে

মানসিংয়ের ছেলে তহসিলদার তখন জেলবন্দি। ফাঁসি থেকে তাঁর প্রাণ বাঁচাতেই মানসিং শুরু করেছিল খুনের পর খুন। এরই মধ্যে পুলিশের সঙ্গে মুঠভেরে পড়ে তাঁর দল। সেই এনকাউন্টারে মারা যান তাঁর আরেক ছেলে সুবেদার সিং। নিজেও গুলিবিদ্ধ হন মানসিং। তবে তাঁর দেহ ফেলে আসতে চাননি রূপা। কাঁধে নিয়ে ছুটেছিলেন দু’ কিলোমিটার। শেষে বাধ্য হয়ে রেখে আসতে হয়েছিল তাঁর দেহ। রূপা প্রতিজ্ঞা করেছিল ‘খুন কা বদলা খুন’। নতুন সর্দার হয়েছিলেন রূপাই। সারা চম্বলে রক্ত ঝরেছিল অজস্র। আর রূপার শত্রু হয়ে উঠেছিল তাঁরই একসময়ের বন্ধু লাখন সিং। এসব গল্পের মাঝেই নরেশ বলেন, রূপা এসেছিল কলকাতাতেও! মাধো সিংয়ের সঙ্গে কলকাতার সম্পর্ক ছিল তা জানা। কিন্তু রূপা মহারাজ?

নরেশের কথায় সত্যিই অবাক হই। কোথায় এই উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ আর রাজস্থানের মতো তিনটে রাজ্য মিলিয়ে চম্বল আর কোথায় আমার কলকাতা। অথচ নরেশ বলছেন রূপা কলকাতায় এসেছিলেন। কৌতূহলী হয়ে উঠি। এর মধ্যেই আরেক রাউন্ড চা এসে গিয়েছিল। চা খেতে খেতেই নরেশ শুরু করে তার গল্প। রূপার পছন্দ ছিল রাজত্ব করা। তিনি কাউকে মেরে ফেলতে এক মুহূর্তের বেশি সময় নিতেন না। চম্বলের কাহিনির মধ্যে একটা জনপ্রিয় কাহিনি হল, ১৯৪৬ সালে রূপা নিজের সর্দার মানসিংকে বলে চম্বলের বাইরে কলকাতায় এসেছিলেন। বেশ কয়েকমাস পরে ফিরে আসা রূপাকে মানসিং যখন প্রশ্ন করেন যে তুমি কলকাতায় কী করলে? এর জবাবে তিনি বলেছিলেন ‘এক ডর্জন সে জাদা লোগো কা সাফায়।” অর্থাৎ এক ডজনের বেশি মানুষকে শেষ করেছেন কলকাতায়। 

ফিরে আসার পর ইতিমধ্যেই রূপা চম্বলে বিভিন্ন ঘটনা ঘটিয়ে চলেছেন। চম্বলে ফিরে আসার পর তিনি কয়েকশো অপহরণ করেছিলেন, আর সেই সঙ্গে কয়েকশো ডাকাতি। যার ফলে বেশ কয়েক লক্ষ টাকা হাতে আসে তার। এছাড়াও গায়ের লোকেরাও জিনিসপত্র পৌঁছে দিতেন তাঁর দলের কাছে। ফলে এত টাকা দিয়ে রূপা কী করবেন সেই প্রশ্নও পুরনো পুলিশ অফিসারদের ডায়েরিতে পাওয়া যায়। শুধু ডায়েরিতে কেন, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশের এই দুই রাজ্যের পুলিশের মহাফেজ খানাতেও আমি রূপার কেস ডায়েরিতে এই প্রশ্ন পেয়েছি পরে। সেই সময়কার পুলিশ ফাইলে উল্লেখ দেখেছি যে বাবাকে খুন করে ছেলের হাতে টাকা ধরিয়ে দেওয়ার মতো পাগলামির শিকার হয়েছিলেন রূপা। আর কারও উপর খুশি হয়ে তাকে টাকা দান করার ঘটনাতো নিত্যদিনের কাজ ছিল তাঁর। এর মধ্যে ১৯৫৮ সালে মধ্যপ্রদেশ পুলিশ বলে দেয় যে এই বছরের শেষ পর্যন্ত রূপাকে নিকেশ করে ফেলবেন তারা। পুলিশের এই বয়ানের জবাব রূপা তার নিজের  শৈলীতেই দিয়েছিলেন।

ছবি: পুলিশের মহাফেজ খানা থেকে উদ্ধার করা সেই সময় চম্বলে পুলিশ ক্যাম্পের ম্যাপ

 

১৯৫৮-র ৩১ ডিসেম্বর রাতে রূপা মধ্যপ্রদেশ আর রাজস্থানের মধ্যে একটি ছোটো গ্রাম থেকে চারজন মানুষকে অপহরণ করে তাদের খুন করে দেন। তার কিছুক্ষণ বাদেই মধ্যপ্রদেশের মুরেনা জেলার একটি গ্রাম থেকে রূপা আরও চারজন নিরাপরাধ মানুষকে অপহরণ করে তাদেরও খুন করেন। রূপা মধ্যপ্রদেশ পুলিশের ঘোষণার জবাব এইভাবে নিরাপরাধ মানুষকে খুন করে দিয়েছিলেন। স্বভাবতই পুলিশ দিশেহারা হয়ে পড়ে। তাদের শত্রুদের র্যা ঙ্কিংয়ের তালিকায় উপরে উঠতে উঠতে রূপা আর লাখনের দল জি-১ আর জি-২ গ্যাং হিসেবে শীর্ষে পৌঁছে গিয়েছিল। অর্থাৎ যে কোনো মূল্যেই এদের শেষ করা লক্ষ্য হয়ে ওঠে পুলিশের। এর মধ্যেই। কিন্তু এর মধ্যেই নিজের শত্রুর হাভেলি পুড়িয়ে লাখন পুলিশকে একটি বড়ো চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দেন। এর ফলে সরকার সবার আগে লাখনকে শেষ করার জন্য এসএএফ-এর একটা পুরো ব্যাটালিয়ন পুলিশ আধিকারিক টি কুইনের নেতৃত্বে লাখনের গ্রাম নাগরায় মোতায়েন করে দেয়। টি কুইন যে কোনো মূল্যে লাখনকে নিকেশ করতে চাইছিলেন। প্রথমে তো সোজাসুজি এনকাউন্টার হয়, কিন্তু লাখন সিং সহজেই পুলিশের জাল কেটে পালিয়ে যান। এর ফলে কুইন চম্বলে প্রথমবার এমন চাল চাললেন যা এর আগে চম্বলে না কখনো শোনা গিয়েছিল আর না দেখা। টি কুইন নাগরার আশেপাশের গ্রামে রাতদিন চষে বেড়াচ্ছিলেন। প্রত্যেকটি গ্রামে তিনি নিজের শক্তিশালী চরের দল তৈরি করে ফেলেছিলেন। কিন্তু তিনি না তো লাখনের কোনো ক্লু পাচ্ছিলেন আর না রূপার। এর মধ্যেই কুইন রূপার গ্যাং ছেড়ে পুলিশের সামনে আত্মসমর্পণ করা একজন বাগীকে নিজের বিশ্বাসভাজন করে ফেললেন। তার কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে কুইন একের পর এক রূপার লোকজনের ধরতে আর শেষ করতে শুরু করে দেন। রূপাও বদলা নেওয়ার পরিকল্পনা করে।

আরও পড়ুন
চম্বলের দুর্ধর্ষ লাখন সিং-এর চরিত্রে সুশান্ত, মনোজ বাজপেয়ী ছিলেন মানসিং-এর ভূমিকায়

 

ছবি: রূপা-লাখনদের খোঁজে এভাবে বেহড়ে বেহড়ে পায়ে হেঁটে মার্চ করত পুলিশ বাহিনী 1959

আরও পড়ুন
কলকাতায় হাজির চম্বলের মাধো সিং, আত্মসমর্পণে সাহায্য চাইলেন জ্যোতি বসুর কাছে

 

রূপা ভিন্ডে পুলিশের ঘেরাটোপে থাকা মুখবীরের (চর) আত্মীয়দের উপর অত্যাচার শুরু করেন আর তাদের বাধ্য করেন যে তারা ওই মুখবীরকে যে কোনো বাহানায় তাদের বাড়িতে ডাকার জন্য। আর একদিন যখন সেই মুখবীর সেই চালে ফেঁসে নিজের আত্মীয়দের বাড়ীতে পৌঁছয় তো সেখানে তার জন্য তখন অপেক্ষা করছিলেন স্বয়ং রূপা। মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে ওই চরটিকে অত্যাচারের পর অত্যাচার করে তাকে শেষ করে ফেলেন তিনি। এরপর রূপা পরিকল্পনা করেন টি কুইনকে শেষ করার। কুইন বেশ কয়েকবার রূপাকে দৌড় করিয়েছিলেন আর এদিকে রূপা অ্যাম্বুশ করা শুরু করে দেন। এর মধ্যেই একদিন মুরেনার জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানো কুইনের উপর রূপা নিশানাও সাঁধেন কিন্তু কুইনের ড্রাইভার নিজের জীবন বিপন্ন করে তাকে বের করে নিয়ে যান। এই ঘটনায় কুইনের সঙ্গে কথা বলা ৯ জনকে রূপা গুলিতে ছিন্নভিন্ন করে দেন। কিন্তু কুইনও হারার পাত্র নন। একের পর এক চরের সাহায্যে তিনি দুই গ্যাংকে শেষ করার চেষ্টা করতে থাকেন। কিন্তু দুই গ্যাংই আলাদা আলাদা দিকে কাজ করত। এই অবস্থায় একদিন কুইনকে এক মুখবীর পরামর্শ দেন কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার। কাঁটা দিয়ে কাঁটা অর্থাৎ লাখনের কাঁটা রূপার কাঁটা দিয়ে তুলে ফেলা যাক। আর তারপর রূপাকে পরে দেখা যাবে। পরামর্শ পছন্দ হয় কুইনের। এরপরই রূপার উপর জাল বেছাতে শুরু করেন তিনি। রূপার এক আত্মীয়ের সাহায্য কুইন তার কাছে পৌঁছে যান।

আরও পড়ুন
‘নয়া পঞ্ছি মালুম হোতা হ্যায়’ - শ্যেনদৃষ্টিতে তাকিয়ে রূপা ডাকাতের নাতি

ছবি: পুলিশ চিফ খুসরো ফারামুর্জ রুস্তম জি, রূপা থেকে গব্বরকে নিকেশ করার হোতা, একমাত্র পুলিশ অফিসার যিনি পেয়েছেন পদ্মবিভূষণ

 

কুইন রূপাকে লোভ দেখান যে যদি সে লাখন সিংকে রাস্তা থেকে সরিয়ে দেয় তো তিনি তাকে আইনের হাত থেকে বাঁচতে সাহায্য করবেন। এটা তো আজও পরিষ্কার হয়নি যে সত্যিই কী রূপা কুইনের এই কথায় বিশ্বাস করেছিলেন? কিন্তু এটা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল যে তিনি লাখন সিংকে সরিয়ে দিতে চান। ফলে কুইনের সঙ্গে হাত মেলান রূপা। এরপর থেকেই লাখনের খবর পৌঁছতে শুরু করে কুইনের কাছে। এর মধ্যেই একদিন পোরসা এলাকায় লাখন সিং-এর সঠিক খবর পৌঁছে যায় পুলিশের কাছে। কয়েকশো পুলিশ দ্রুত পোরসার জঙ্গলে চুপিসারে পৌঁছে যায়। কিন্ত ভাগ্য লাখনের সহায় হয়। তার লোকেশনের খানিকটা আগেই চম্বলের প্রথম মহিলা ডাকাত পুতলিবাঈয়ের গ্যাং শিবির করে খাবার বানাচ্ছিল (পুতলীর এই ঘটনা সবিস্তারে তরুণ ভাদুড়ির অভিশপ্ত চম্বল, বেহড়বাগীবন্ধু বা আমার বই আবার চম্বলে রয়েছে)। ফলে পুলিশ আর পুতলীর গ্যাং মুখোমুখি পড়ে যায়। এই ঘটানায় পুতলি আর তার পুরো গ্যাং পুলিশের গুলির শিকার হয়। সেই সঙ্গে পুলিশের এক নারকীয় এবং কলঙ্কজনক অধ্যায়ের সাক্ষী হয় চম্বল। সে কাহিনি উল্লেখিত বই তিনটিতে রয়েছে।  কিন্তু পুলিশ আর পুতলির গ্যাং-এর মধ্যে এনকাউন্টারের ফায়দা তুলে লাখন পালিয়ে যায়।

আরও পড়ুন
‘খুন কা বদলা স্রেফ খুন’; মানসিং-হত্যার পর, শপথ নিলেন চম্বলের নয়া ডাকাত সর্দার

ছবি: পুতলিবাঈ, এনকাউন্টারের পর পুলিশের তোলা পুতলির একমাত্র ছবি

 

যদিও প্রসঙ্গান্তরে চলে যাওয়া হবে তবু জানিয়ে রাখি সম্প্রতি বলিউড অভিনেতা সুশান্ত সিং রাজপুতের মৃত্যু ঘিরে পুরো দেশ উত্তাল হয়েছে। গত বছর অর্থাৎ ২০১৯ এর ২০ ফেব্রুয়ারি বলিউড পরিচালক অভিষেক চৌবের ডেবিউ ফিল্ম সোনচিড়িয়া রিলিজ করেছিল। এই ফিল্মটি ছিল মানসিং-এর জীবন নির্ভর ফিল্ম। মানসিং-এর চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন মনোজ বাজপেয়ী, এবং লাখন সিং-এর চরিত্রটিতে রূপদান করেছিলেন সুশান্ত সিং রাজপুত। যদিও ছবিটিতে আশ্চর্যজনকভাবে মানসিং-এর দলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য রূপা পণ্ডিতকে রাখা হয়নি। যদিও এই সিনেমায় রণবীর শোরে অভিনীত ভাকিল সিং চরিত্রটি অনেকটাই রূপার আদলে তৈরি। 

যাক সে কথা। পুলিশের মনে লাখনের পালানো কাঁটার মতো বিঁধছিল। এর চেয়েও বেশি সমস্যা কুইন আর রূপা পণ্ডিতের মধ্যেকার সম্পর্ক নিয়ে দেখা দিতে শুরু করে। পুলিশের বড়ো অফিসার টি কুইন আর চম্বলের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ডাকাতের সঙ্গে বন্ধুত্বের নানা গল্প সরকারের কাছে পৌঁছতে থাকে। এদিকে এসব কথা মিডিয়াতেই লীক হওয়ায় মিডিয়াও পুলিশের উপর চাপ বাড়িয়ে দেয়। সেই সময় চম্বলে টি কুইনকে জেড ও-১ অর্থাৎ জোনাল অফিসার ওয়ান বলা হত। কিন্তু রূপা আর তার মধ্যেকার সম্পর্কের কারণে পুরো চম্বল এলাকায় রূপাকে জেড ও-১ আর টি কুইনকে জেড ও টু বলা শুরু হয়ে যায়। উত্তরপ্রদেশ এবং মধ্যপ্রদেশ পুলিশের দুই মহাফেজখানারই রেকর্ডে সেই সময়কার একটি ঘটনার উল্লেখ পাই আমি। দুই রাজ্যের পুলিশ রেকর্ডের মোতাবেক ১৯৫৯ সালের ২৬ অক্টোবর ছিল দিনটি। টি কুইন গোয়ালিয়র থেকে ফেরার রাস্তায় মহুয়া গ্রামে থামেন। সেখানেই মহুয়া থানার রেকর্ড অনুযায়ী কুইন খবর পান জি-১ গ্যাং অর্থাৎ লাখন সিং-এর গ্যাং আমদ এলাকায় ডাকাতি করতে যাবে। আর রূপার গ্যাং কোনো অ্যাকশন করতে লাখনের গ্রাম নাগরার দিকে যাবে। টি কুইন কিছুক্ষণের মধ্যেই ৯ ব্যাটালিয়ন পুলিশের ব্যবস্থা করে ফেলেন। পুরো এলাকা ঘিরে ফেলা হয়।

Powered by Froala Editor

More From Author See More