‘বাগীসম্রাট দদ্দা মালখান সিং’, এখনও বাড়ির নেমপ্লেটে লেখা এই পরিচয়

দুর্ধর্ষ দুশমন - ৩০
আগের পর্বে

বাগী সম্রাট মালখান সিংয়ের বাড়ি পৌঁছেও দেখা মিলল না তাঁর। স্থানীয় কিছু ছেলে জানাল মাঝেমধ্যে এখানে আসেন তিনি। তারাই আশ্বস্ত করে ঘুরিয়ে দেখাবে মালখানের বাড়ির পিছনের অংশ ও পালিয়ে যাওয়ার রাস্তা। বেহড়ের মধ্যে দিয়ে সেই পথ গেছে ভিণ্ড পর্যন্ত। কাঁটাঝোপে ভরা সেই পথ দিয়ে কোনো মতে যেতে পারে একজন। খানিকটা অতিক্রম করার পরেই চোখে পড়ে একটি সুরঙ্গ। তার ভেতরে বিশাল হল ঘর। অন্তত পাঁচশো জনের জায়গা। খানিকটা ঘুরে দেখার পর খেয়াল হয় সঙ্গে নেই আর কেউ-ই। অন্যদিকে এই সুরঙ্গ যেন সাক্ষাৎ গোলকধাঁধা। বার বার ফেরার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়ে শেষে বসে পড়ি সুরঙ্গের সামনে। কতক্ষণ সেভাবে কেটেছে জানা নেই। তারপর...

আবারও সেই মালখানের বাড়ির সামনে। সকলে মিলে আমাকে নিয়ে যায় সেই মন্দিরে। যে মন্দিরের জমি নিয়েই মালখানের লড়াই শুরু হয়েছিল। মন্দিরের সামনে একটা চাতালে বসে আছি। মন্দিরের ঢুকতে দেওয়া হয়নি আমাকে। আমি নীচু জাতের ঘরে জল খেয়েছি। আপতত মন্দিরের বাইরে একটা বাঁধানো জায়গায় বসে আছি। জল খেতে দিয়েছে গ্রামের লোক। তবে একটা মাটির পাত্রে। তাদের ঘরের বাসন আমাকে দেওয়া হবে না। ছুটে এসেছে সেই মহিলাও। যার বাড়িতে জল খেয়েছিলাম। সে এসে বলল, ‘চলো আমার ঘরে, সেখানে বসে একটু বিশ্রাম নেবে। এই রোদে বসে থাকলে আরো কষ্ট হবে। এরা তোমাকে না তো মন্দিরে ঢুকতে দেবে, না তো কারো বাড়িতে। তার চেয়ে আমার বাড়িতে চলো।’

মহিলার সঙ্গে তার বাড়িতে যাই। একটা গামছা দিয়ে তিনি আমার সারা শরীরের ধুলোবালি ঝেড়ে দেন। বিছানায় বসান। মিনিট পনেরো বিশ্রাম নিই। আমাকে একটা বোতলে খানিকটা জল দিয়ে দেন। বলেন, সঙ্গে রাখো, রাস্তায় দরকার হবে। এরপর গ্রাম ঘুরতে শুরু করি। কিন্তু সেভাবে কেউই আমার সঙ্গে কথা বলেন না। নিচু জাতের বাড়ির জল খেয়েছি আমি। সেই থানায় যাই, যে থানা মালখানকে ধরতে তৈরি হয়েছিল এই গ্রামে। একটা বেহড়ের মাথায় পোড়ো বাড়িটা পড়ে রয়েছে শুধু। থানাটা যেহেতু বেহড়ের মাথায়, সেখানে উঠেই ছবি নেওয়ার চেষ্টা করি, কিন্তু খুব একটা ভালো ছবি আসে না। কারণ একে তো আমার সামান্য ডিজিটাল ক্যামেরা। তার উপর বেহড়টাও খুব উঁচু নয়। দু-একটা বাড়িতে বলি, তোমাদের ছাদে উঠতে দেবে? কেউ দেয় না। আমি তাদের বাড়িতে ঢুকলে অপবিত্র হয়ে যাবে ঘরদোর। একজন তো গ্রামের মধ্যে একটা টাওয়ার দেখিয়ে বলল, উঁচু জায়গা চাই, উঠে পড়ো ওখানে। এখানে আর কোনো কাজ হবে না ভেবে ফেরার রাস্তা ধরি। মালখানের গ্রামকে বিদায় জানিয়ে ফিরছি। মালখান সিং, বাগীসম্রাট দদ্দা মালখান সিং। যার নামে একসময় চম্বল কাঁপত। মন্দিরের জমি বাঁচাতে যিনি লড়ে গিয়েছিলেন গ্রামের মাথাদের সঙ্গে। সেই মালখানের গ্রামের রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলেছি।

ছবি তোলার জন্য এই টাওয়ারেই উঠতে হয়েছিল বাধ্য হয়ে

 

ছ-ফুট লম্বা চেহারা। মুখ ছাপিয়ে বেরিয়ে থাকা গোঁফ আর খাকি ইউনিফর্ম। একহাতে আমেরিকান সেলফ লোডিং রাইফেল, অন্য হাতে লাউড স্পিকার। বহু বছর ধরে মালখান সিং-এর এই চেহারা ছিল চম্বল এলাকার আতঙ্ক। অপহরণ, লুঠ, ডাকাতি আর হত্যার কয়েকশো মামলা ছিল এই বাগীর মাথায়। কিন্তু তিনি নির্ভয়ে ঘুরে বেড়াতেন চম্বলে। বিনোবা ভাবে, জয়প্রকাশ নারায়ণের সামনে মোহর সিং, মাধো সিং, পঞ্চম সিং-এর মতো ডাকাতদের আত্মসমর্পণের পর, চম্বল শান্ত হয়ে গেছে বলে যাদের ধারণা ছিল, অচিরেই তাদের মোহভঙ্গ হয়। একের পর এক ডাকাতদল ধরাশায়ী হওয়ার পর চম্বলের বেহড়ও বোধহয় নিজের জন্য এক হিরো খুঁজছিল। গ্রামে শত্রুতার ধারাবাহিকতা, পুলিশ এবং পাটোয়ারীর মধ্যে পিষে চলা সাধারণ মানুষকে চিরকালই নিজের কোলে আশ্রয় দিয়েছে বেহড়।

আরও পড়ুন
সুড়ঙ্গের গোলোকধাঁধায় প্রাণসংকট, প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে আসছে প্রত্যেকটা ডাক

মালখানের বেহড় জীবনও শুরু হয়েছিল গ্রামের শত্রুতা থেকে বাঁচতেই। একবার বেহড়ে ঝাঁপ দেওয়ার পর দ্রুত চম্বলের মানুষের মনে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে তার আতঙ্ক। পুলিশের সঙ্গে আধ-ডজন এনকাউন্টারে বেঁচে যাওয়ার মালখান চম্বলের হিরোর শিরোপা পেয়ে গিয়েছিলেন। পুলিশ তার পিছনে পড়ে থাকে, কিন্তু মালখান তো দূর, তার ছায়াও কখনো ছুঁতে পারেনি পুলিশ। তার নামে কয়েকশো মামলা পুলিশের খাতায় নথিভুক্ত তো ছিলই, কিন্তু এমন মামলার সংখ্যাও নেহাত কম ছিল না, যেখানে মালখানের আতঙ্কের কারণে বহু মানুষ পুলিশে মামলা করার প্রয়োজনই অনুভব করেননি। কীভাবেই বা শুরু হল চম্বলের এক ছোটো চাষির ছেলের গ্রাম থেকে চম্বলের দস্যুসম্রাট হওয়ার এই সফর?

আরও পড়ুন
থিকথিক করছে পোকা, দূষিত জলেই তেষ্টা মেটান চম্বলের ‘নিচু জাতে’র মানুষরা!

টাওয়ারের মাথায় চড়ে আমার তোলা আমাকে বাঁচানো সেই মহিলার বাড়ি

 

আরও পড়ুন
নিজের স্ত্রী এবং মেয়েকেও খুন করে নদীর জলে ভাসিয়ে দেন চম্বলের এই ডাকু!

চম্বলের হাজার হাজার গ্রামের বাড়ির পেছনের দরজা বেহড়ের দিকে খোলে। চম্বলে সম্ভবত এমনই নিয়ম যে বাড়ির পিছনে বেহড়ের দিকেও একটা দরজা সবসময় খুলে রাখা হয়। চম্বল এলাকার অন্যান্য হাজারো গ্রামের মতোই আরো একটা গ্রাম, উমরি থানার বিলাও। গ্রামের মধ্যে সাদা রঙের একটা বাড়ির দেওয়ালে পাথরের নেমপ্লেটে আজও লেখা আছে ‘বাগীসম্রাট দদ্দা মালখান সিং’। কিন্তু মালখানের পৈত্রিক বাড়ি এই নতুন বাড়িটার সামান্য একটু আগে রয়েছে। ওই নেমপ্লেট লাগা দরজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করার পরেই সেই পৈত্রিক বাড়িতে ঢোকার ছাড়পত্র মেলে। প্রায় পঞ্চাশ বছর পরে আজো এই বাড়ির সেই ঘরটা দেখতে পাওয়া যাবে, যে ভাঙাচোরা ঘর আর চম্বল একে ওপরের সঙ্গে মিলেমিশে গিয়েছে। যেন একে অপরকে আলাদা করাই মুশকিল। পঞ্চাশ বছর আগে এই বাড়িতেই থাকা এক সতেরো বছরের ছেলে মালখান গ্রামের জমিদারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন। এই বিলাও গ্রামে প্রভাব ছিল কৈলাস পণ্ডিতের। খাঙ্গার ঠাকুরদের কুলপুরোহিত কৈলাসে পণ্ডিতের কাছে ছিল গ্রামের বেশিরভাগ জমিজমা। বছরের পর বছর ধরে গ্রামের সরপঞ্চ (গ্রামপ্রধান)-এর পদও ছিল এর দখলে।

আরও পড়ুন
অ্যান্টিক মূর্তির টোপ দিয়ে স্মাগলারকে অপরহণ, চম্বলের ঘটনায় কেঁপে উঠেছিল দিল্লিও

মালখানকে ধরতে তার গ্রামে বানানো হয়েছিল এই স্পেশাল থানা, আজ পরিত্যক্ত

 

মালখানও গ্রামের বেশিরভাগ ছেলেদের মতোই কৈলাসের সঙ্গে ওঠাবসা করতেন। কিন্তু মাঝে মাঝে তিনি সকলের সামনে কৈলাসের বিরোধিতাও করতেন। আর এটাই কোথাও না কোথাও কৈলাস পণ্ডিতের মনে কাঁটার মতো বিঁধছিল। সম্পর্কের ভাঙন শুরু হয়ে যায় তখন থেকেই। মালখান জানতেন না তার এই সামান্য একটা পদক্ষেপ তার জীবনে বড়ো পরিবর্তন এনে দেবে। কৈলাসের সঙ্গে পুলিশের ছিল গভীর আঁতাত। কৈলাস পুলিশের সঙ্গে কলকাঠি নাড়ে আর পুলিশ একটা মিথ্যা মামলায় মালখানকে গ্রেপ্তার করে। মালখানের কথায়, পুলিশ মিথ্যে মামলা সাজিয়েছিল। কয়েকদিন পর তিনি জামিনে ছাড়া পান। কিন্তু জামিনে ছাড়া পাওয়া মালখানের মধ্যে ততদিনে অনেক পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে। এখন তিনি ভরা পঞ্চায়েতে কৈলাস পণ্ডিতের উপর প্রশ্ন তুলতে শুরু করেন। মালখান আর কৈলাসের মধ্যে প্রধান লড়াই শুরু হয় একটা মন্দিরের জমি অবৈধভাবে দখল করা নিয়ে। 

ছবি তোলার জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এভাবেই বেহড়ের মাথায় চড়তে হয়েছিল

 

চম্বলের শাখা নদী সিন্ধের ধারে তৈরি এই মন্দিরের একশো বিঘা জমিতে কৈলাসের লোকেরা চাষ করত। কিন্তু মালখান পঞ্চায়েতে মন্দিরের জমি মন্দিরকেই ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি জানান। যা নিয়ে দুজনের সম্পর্কের ভাঙন পরিবর্তিত হতে থাকে শত্রুতায়। এই জমি ফিরিয়ে দেওয়ার কথা কৈলাস পণ্ডিতের আরো তেতো লাগতে শুরু করেছিল। সে পুলিশের দারোগাকে জানায় যে মালখান কুখ্যাত ডাকাত গিরদারিয়া গ্যাং-এর সঙ্গে যুক্ত। মালখানের মাধ্যমেই পুলিশ এই ডাকাতদলকে শেষ করতে পারবে। পুলিশ আবারো মালখানকে গ্রেপ্তার করে। অসহায় মালখান বাঁচার জন্য দারোগাকে সত্যি-মিথ্যে মিলিয়ে একটা ঠিকানা বলে দেন। কিন্তু গিরদারিয়া দলের নাগাল পায়নি পুলিশ। কৈলাসের কথায় দারোগা মালখানকে উচিত শিক্ষা দেওয়ার কথা ভাবেন। এখান থেকেই মালখানের জীবন আরো বিপন্ন হতে শুরু করে।

Powered by Froala Editor

More From Author See More