কলমকারিতে শব্দ শোনা

মানিকলমকারি - ৩১
আগের পর্বে

ফেলুদার গল্পে যেমন নানা স্থানের ঘটনা উঠে এসেছে, তেমনই তার অলঙ্করণেও সেইসব জায়গার দৃশ্যকে তুলে ধরেছেন সত্যজিৎ। নিজের ভঙ্গিতে তুলে ধরেছেন প্রত্যেক জায়গার বিশেষত্বকে। দার্জিলিং, গ্যাংটক বা কাশ্মীরের কুয়াশার দৃশ্যেও দেখা গিয়েছে পার্থক্যের ইঙ্গিত। আবার রাজস্থানের ঝলমলে চেহারাকে তুলে ধরেছেন শুধুই সাদা আর কালোতে। ছবির প্রেক্ষাপটেও ভূগোলকে চিনিয়েছেন সত্যজিৎ। তাই কাঠমান্ডুর ছবিতে উঠে এসেছে কালভৈরবের দেয়ালচিত্র অথবা প্যাগোডা। আবার উঠে এসেছে কাশী শহরের চেহারাও। ‘গোরস্থানে সাবধান’ গল্পের অলঙ্করণে একইভাবে উঠে এসেছে নানা কবর ও স্মৃতিস্তম্ভের প্রেক্ষাপট।

সত্যজিৎ রায়ের ক্যালিগ্রাফির সঙ্গে যাঁদের পরিচয় আছে, তাঁরা জানেন, শুধু লেখার রেখা থেকে কীভাবে ছবি আঁকা যায়, সেই শিল্পকৃতিতে অনন্য তাঁর অবদান। কখনো একটি রেখার টান থেকে, কখনো একটি রেখার রং থেকে, কখনো একটি রেখার মধ্যে বিভিন্ন বর্ণগুলিকে বসানোর গুণপনায় তিনি তৈরি করতে পারেন ছবি। নাহলে, জীবনানন্দ দাশের লেখা ধূসর পাণ্ডুলিপির প্রচ্ছদ তিনি কেন করেন নিরলংকৃত। মনে পড়বে, এই প্রচ্ছদশিল্পে তিনি জমিতে রেখেছিলেন সাদা মলিন পাতা। যে পাতার ওপর ছাপা হচ্ছে সেই কভার, সেই পাতাতেই একটা হালকা সাদা রংয়ের আভাস ছড়িয়ে তার ওপরে এক্কেবারে যে নেভি ব্লু রংয়ের কালি দিয়ে লেখালেখির কাজ হয়, সেই রং ব্যবহার করে বইয়ের নাম লেখা। পুরো প্রচ্ছদ যেন নিজেই একটি ধূসর পাণ্ডুলিপির প্রতিচ্ছবি। 

ঠিক এমন ধরনে আরেকটি লেখা সুধীন্দ্রনাথ দত্তের লেখা স্বগত গ্রন্থের প্রচ্ছদ। পুরো বইয়ের কভারে ওপর থেকে নীচ পর্যন্ত কোনো রেখা কোথাও নেই। একেবারে নীচের দিকে বাঁদিক থেকে এগিয়ে আসছে দীর্ঘ একটি রেখা--- সেই রেখাটি থেকেই শান্ত ভাবে লেখা হল স্বগত নামটি। পুরো প্রচ্ছদটির দিকে চোখ রাখলেই বোঝা যাবে, স্বগত বা নিজের মনে নিজের সঙ্গে কথা বলার ছবিটি কী অসামান্য শিল্পকৃতিতে মূর্ত হয়ে ওঠে এখানে। দীর্ঘ নীরবতার প্রতীক যেন ওই দীর্ঘ উচ্চাবচতাহীন রেখাটি। তারপরে ছোট্টো করে এক কোণে লেখা স্বগত শব্দ। সেই লেখার আবার প্রতিটি রেখা অন্তর্মুখী, স্বগত নাম বলেই বুঝি। কেমন ছিল জানেন সেই বইয়ের ভেতরের চেহারাটি? এমনিতে কী হয়, একটি বইতে ছোটো বড়ো মাঝারি হরফের বৈচিত্র্য তো থাকবেই। বইয়ের নাম একমাপের হরফে, লেখকের নাম আরেক মাপে, প্রবন্ধের নামে ব্যবহার করা হয় আরেক মাপ এবং মূল লেখার বয়ানে থাকে সবচেয় ছোটো হরফ। তাই তো? সেটাই স্বাভাবিক তো? কিন্তু ওই নামের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে, প্রচ্ছদের শিল্পসুষমার সঙ্গে ছন্দ বেঁধে জানেন কি, এই বইয়ের গোটাটাই একটিমাত্র মাপের হরফ ব্যবহার করে তৈরি। গ্রন্থনাম স্বগত বলেই কোথাও কোনো উঁচু নিচু স্বর নেই, সবটা একটাই মাপে বাঁধা। 

এবার সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কবিতার বই অর্কেস্ট্রা র নামলিখনটি কল্পনা করুন। অর্কেস্ট্রা তো বৃন্দবাদন। মানে নানা যন্ত্র একসঙ্গে বেজে উঠছে একসুরে। এই বৃন্দবাদনের রূপ কী এক অসামান্যতা দিয়ে শিল্পিত করে তোলেন তিনি। এ এক হরফদারির শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। সত্যজিতের শিল্পভাবনাতে দেখা গেল, অর্কেস্ট্রা র তিনটি বর্ণ হয়ে উঠল তিনটি যন্ত্র। তিনটি যন্ত্র তিন রকম, এখানে তিনটি হরফ তিন রকম। হরফের দিকে তাকালে দেখবেন, কোনো হরফের চেহারা হয় স্বাভাবিক, কোনোটা একটু লম্বাটে আর কোনো হরফ চওড়া ধরনের। এই অর্কেস্ট্রা শব্দের অ-টি নিলেন স্বাভাবিক। ক-এ রেফ বা র্কে- বর্ণটিকে নিলেন চওড়া ধরনের আর দন্ত্য-স-এ ট-এ র-ফলা দেওয়া স্ট্রা- হল লম্বাটে। তিনটি তিন ধরনের হলেও, এমনভাবে তাদের পরপর সাজালেন সত্যজিৎ যে, আপনার দেখে কোথাও এতটুকু খটকা লাগবে না। না জানলে বা না বলে দিলে চোখেও পড়বে না এই তিন রকম হরফদারির খেলা। আর বলা বাহুল্য তা চোখে পড়ার কথাও তো নয়। কারণ, অর্কেস্ট্রাতে নানা যন্ত্র বাজে এমনভাবে যাতে তারা আলাদা হলেও, তাদের তো আলাদা করে কানে ধরা পড়ার কথা নয়। 

আরও পড়ুন
গল্প-ছবির স্বল্প-ভূগোল

এই হরফ সাজানোর আরেকটি চমৎকার নমুনা ছিল অশোক সেন সম্পাদিত বারোমাস পত্রিকার নামাঙ্কনে। চারদিকে চারটি মুখে বা-রো-মা-স শব্দের চারটি বর্ণ বসানো। একটি চক্রাকারে ঘোরাতে হবে আপনার চোখ, তাহলেই পড়তে পারবেন এই পত্রিকার নাম। ঘড়ির কাঁটার বিপরীতে ঘুরবে আপনার চোখ। পত্রিকার বিষয় স্বাতন্ত্র্য যেমন সময়ের উল্টো পথে চলতে চায়, তার নামাঙ্কনেও সেই প্রতিস্পর্ধী স্বরের চিহ্ন। 

আরও পড়ুন
অল্প রেখার গল্প

হরফ মানে কি শুধু, ছাপার হরফ? সুভো ঠাকুরের লেখা ব্লু ব্লাড টার্নড রেড- এর নাম লেখার সময় সত্যজিৎ কী আশ্চর্য শিল্পিত বুদ্ধিমত্তায় ব্যবহার করলেন টাইপ রাইটারের হরফ। লেখকের আত্মজীবনীর নাম নীল রক্ত লাল হয়ে গেছে কথাটি একদিকে যেমন একটি নির্মোহ ঋজু উচ্চারণ, তেমনই আরেকভাবে তা যেন একটি ডাক্তারি রক্ত পরীক্ষার রিপোর্ট। ডাক্তারি রক্ত- পরীক্ষার রিপোর্ট তো লেখা হয় ওই টাইপরাইটারের হরফেই। তাই সেই হরফেই লেখা হল, BLUE BLOOD TURNED RED. 

আরও পড়ুন
জটায়ুর দাদারা

ঠিক এমন করেই ছাপার হরফের খেলা দিয়ে, পিতা সুকুমার রায়ের লেখা জীবৎকালে অপ্রকাশিত, বর্ণমালা তত্ত্ব ও অন্যান্য প্রবন্ধ গ্রন্থের কভার আর ভেতরের পাতা সাজালেন সত্যজিৎ। গ্রন্থনাম যেহেতু বর্ণমালাতত্ত্ব, তাই নানান মাপের বর্ণ দিয়ে বইয়ের নাম লেখা। তবে গ্রন্থনামে তত্ত্ব শব্দ আছে বলেই, পাশে একটি নির্দিষ্ট মাপের মোটা রেখা বসানো। যতই বড়ো ছোটো হরফ হোক, সবটাই ওই মাপের ভেতর আছে। কী অসামান্য ভাবনা একটি। আর এই বইতে বর্ণমালা নিয়ে দ্বিতীয় আরেকটি পরীক্ষা আছে। সাধারণত কভারের লেখাটি হয় হাতের লেখাতে আর ভেতরের টাইটেল পেজে বইয়ের নাম, লেখকের নাম, প্রকাশনা সংস্থার নাম থাকে ছাপার হরফে। এখানে তিনি ঘটালেন উল্টোটা। আগেই বললাম, কভারে আছে নানা মাপের হরফ উঁচু আর নিচু হয়ে। এবার দেখা গেল, ভেতরে গ্রন্থনাম লেখকনাম আছে হাতের লেখাতে। পুথির ধরনে লেখা সেখানে গ্রন্থনাম আর লেখকনাম। যে বইয়ের লেখক আবোল তাবোল-এর কবি তাঁর লেখা বর্ণমালাতত্ত্বের প্রচ্ছদ আর আখ্যাপত্রেও এ এক অভিনব যুক্তিপূর্ণ আবোল তাবোল কাণ্ড। 

আরও পড়ুন
না-হিরোর গল্প

কলমকারির আর হরফদারির যুগলবন্দি দেখা যাবে সত্যজিতের অন্য শিল্পকৃতিতেও। এটি যেন তাঁর নিজস্ব একটা স্টাইল। 

বইয়ের নাম হুক্কা হুয়া, লেখক শান্তা দেবী। প্রচ্ছদে একটি ঊর্ধ্বমুখী শেয়ালের ছবি। কাগজ কেটে করা সেই শেয়ালের ছবির ধারটা করাতের মতো কাটা। দেখলেই চোখে পড়বে, কানে শুনবেন, শেয়ালের ডাকের মতোই একটা কর্কশতার ধ্বনিরূপ। পাতা জুড়ে নানা দিকে ছড়ানো হুক্কা হুয়া শব্দ। কে না জানে হুক্কা হুয়া শব্দ মানেই তা ছড়িয়ে পড়ে দিকবিদিকে। তাই বুঝি পাতা জোড়া নানা দিকে ছড়িয়ে পড়া হুক্কা হুয়া শব্দের ছবি। 

আর এই শব্দের ছবিটাই আরেকভাবে আছে বইয়ের ভেতরে। সেখানে দেখা যাচ্ছে এই হুক্কা হুয়া শব্দ দুটির চারটি বর্ণ চার রকম উচ্চতায় বসানো। হু থেকে একটু নীচে লেখা ক্কা। তারপরের হু আবার একটু ওপরে উঠল আর শেষের য়া অনেকটা উপরে উঠল। পাঠক, একটু নিজের কানে হুক্কা হুয়া ধ্বনির প্রচলিত স্বরভঙ্গিটি মনে করুন। ঠিক যেভাবে উপর থেকে নীচে আপনার স্বর ওঠানামা করে, এই বর্ণমালাও যেন ঠিক সেই সুরে বসানো। তার ওপর আবার হুক্কা শব্দের শেষের মাত্রাটা লক্ষ করলেই বিষয়টা আরো সহজ হবে। লক্ষণীয়, হুক্কা শব্দের শেষের মাত্রাটা ছোটো আর হুয়া শব্দের শেষ মাত্রাটা অনেক বেশি। বলার অপেক্ষা রাখে না, এই মাত্রাভেদটিও একটি মজাদার খেলা। আবার মনে মনে উচ্চারণ করে দেখুন, হুক্কাআআ হুয়াআআআআ---- সুরটা এই রকম। প্রথমে কম মাত্রা পরে বেশি মাত্রা। সত্যজিতের পক্ষেই বোধ করি সম্ভব এই কানে শোনার মাত্রাকে বর্ণের মাত্রাতে বাড়িয়ে কমিয়ে শ্রুতিযোগ্য করে তোলা!

Powered by Froala Editor