জটায়ুর দাদারা

মানিকলমকারি - ২৮
আগের পর্বে

সত্যজিতের গল্পে বারবার দেখা গিয়েছে ছা-পোষা মানুষদের। প্রথম দুটি ইংরেজি গল্পেই যেমন দেখা গিয়েছিল দুই শিল্পীকে। বঙ্কুবাবু চরিত্রটিকেও একইভাবে তৈরি করেছেন তিনি। নানা অপমান ও বিদ্রূপ সহ্য করেও তিনি রেগে যান না। এমনই দুই চরিত্র বদনবাবু এবং পটলবাবু। বদনবাবু সামান্য কেরানির চাকরি করলেও গল্প তৈরির অদ্ভুত নেশা তাঁর। আর সেইসব গল্প কাজে লাগান পঙ্গু ছেলের মনোরঞ্জনে। পটলবাবুও তেমনই অভাবে জর্জরিত হয়েও অভিনয়ের শখ ছাড়তে পারেননি। তাঁর চেহারাও নায়কসুলভ নয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনিও সিনেমায় ডাক পেলেন। সত্যজিতের গল্পের সমস্ত না-হিরোদের মধ্যেই লুকিয়ে আছে এমন এক একটি প্যাশান।

ফেলুদার গল্পমালাতে লালমোহন গঙ্গোপাধ্যায় বা জটায়ু-র আবির্ভাব সোনার কেল্লা-য়। তার আগেও ফেলুদাকে নিয়ে সত্যজিৎ লিখেছেন পাঁচটি গল্প। বা আরো ঠিক করে বললে, তিনটি গল্প আর দুটি উপন্যাস। বলা বাহুল্য, সেখানে লালমোহন গঙ্গোপাধ্যায় নেই। তবে, কেমন যেন মনে হয়, লালমোহন নিজে না থাকুন, তাঁর চরিত্রের ধরন-ধারনের টুকরো-টাকরা কিন্তু টুকটাক করে ছড়িয়ে আছে সোনার কেল্লার পূর্ববর্তী কাহিনিমালায়। তাদেরকেই বলা যাক জটায়ুর দাদারা।

ফেলুদার প্রথম গল্প 'ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি'-র মূল মক্কেল রাজেনবাবুকে মনে আছে? কিংবা সবচেয়ে বড়ো কথা, গ্যাংটকে গণ্ডগোল-এর নিশিকান্ত সরকারকে? এমনকি, ফেলুদার প্রথম গল্প ওই 'ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি'-তেই স্বয়ং ফেলুদার কিছু সংলাপ। সর্বত্রই নানা ভাবে ছড়িয়ে ছিল জটায়ুর পূর্বসূত্র। শুধু বলার ধরন উনিশ-বিশ বদলে দেওয়া। 

রাজেনবাবু, মানে ফেলুদার প্রথম গল্পে ফেলুদার মক্কেল, রাজেন মজুমদারকে দিয়ে গল্প বলা শুরু। তাঁর "মাথার চুল সব পাকা, গায়ের রং ফর্সা, মুখের ভাব হাসিখুশি"। কলকাতাতে ওকালতি করতেন, অবসর নিয়ে আছেন দার্জিলিংয়ে। এই মানুষটি যেমন হাসিখুশি, তেমনি হাসিখুশি আর মজার মানুষ এই গল্পের তিনকড়ি মুখোপাধ্যায়। তিনকড়ি আবার গল্প উপন্যাস লেখেন, কোচের পকেট থেকে নিজের লেখা বই বের করে বলেন, "এই নাও, একটা এক্সট্রা কপি ছিল, আমার লেটেস্ট বই।" সোনার কেল্লার সেই দৃশ্য মনে আছে? তিনকড়ি বাবুর বলা, "আমার লেটেস্ট বই" সেখানে হয়েছে "মেরা সাম্প্রতিকতম্ উপোনিয়্যাস"। জটায়ুর সময় হাঁ হয়েছিল তোপসের মুখ। এখানে খোদ ফেলুদাকেই দেখা গেল, "বইয়ের মলাটটা দেখে ফেলুদার মুখ হাঁ হয়ে গেল।" অপার বিস্ময় নিয়ে ফেলুদাই বলল, "আপনার বই মানে? আপনার লেখা? আপনিই গুপ্তচর নাম নিয়ে লেখেন?" ফেলুদাই বলে, "বাংলায় আপনার ছাড়া আর কারুর রহস্য উপন্যাস আমার ভালো লাগে না।" 

এই তিনকড়ি বাবুও গল্পের খোঁজ পেতে আর ঠাণ্ডা মাথায় গল্প লেখার জন্য এখানে ওখানে যান। বলেন, "এখানে একটা প্লট মাথায় নিয়ে লেখার জন্যই এসেছিলাম।" 

আরও পড়ুন
না-হিরোর গল্প

এমনকি, এখানে ফেলুদার একটা ছোট্টো সংলাপ বেশ মনে পড়ে যাবে সবার। ফেলুদা তোপসের জন্য একটা মুখোশ কিনে দেওয়ার সময় মুখোশের পরিচয় দিতে গিয়ে বলে, "এইটেই সবচেয়ে হরেনডাস--- কী বলিস?" এই ধরনের শব্দ লালমোহনবাবু বলেন তাড়াহুড়ো করে বলতে গিয়ে ভুলে, আর ফেলুদা তাকে বলে ইচ্ছে করেই। সে আবার তার ব্যাখ্যা করে বলে, "ফেলুদা বলে, হরেনডাস বলে আসলে কোনো কথা নেই। ট্রিমেনডাস মানে সাংঘাতিক আর হরিবল মানে বীভৎস। এই দুটো একসঙ্গে বোঝাতে নাকি কেউ কেউ হরেনডাস ব্যবহার করে।" 

এক ধরনের উপাদান ব্যবহার করার গুণে এখানে ফেলুদার কথায় একরকম আর হত্যাপুরী গল্পে জটায়ুর সংলাপে আরেক রকম। সেখানে হকচকিয়ে যাওয়ার সঙ্গে হিচকক-এর নাম মিশিয়ে জটায়ু বলেন, "হকচক"!! আর লালমোহনের এমন সব সংলাপ তো প্রায় প্রবাদপ্রতিম। 

আরও পড়ুন
শঙ্কুর গল্প শুরুতে কি কল্পবিজ্ঞানের?

এইবার ধরা যাক, গ্যাংটকে গণ্ডগোল-এর নিশিকান্ত সরকারের কথা। ইনি সত্যিই ফেলু সিরিজের কাহিনিমালায় জটায়ুর পূর্বসূরি। চেহারাটি একটু অন্যরকম। অবশ্য জটায়ুর চেহারাও তো প্রথমে এখনকার মতো ছিল না। মানে সোনার কেল্লার জটায়ুর ছবির সঙ্গে এই নিশিকান্তবাবুর চেহারাতে আলগা একটা মিল আছে বৈ কী! নিশিকান্তবাবুর চেহারা, "ভদ্রলোক একটা স্টিলের ফ্রেমে হালকা সবুজ রঙের কাচওয়ালা চশমা পরেছিলেন। বয়স বোধহয় ত্রিশ পঁয়তিরিশের বেশি নয়। ঠোঁট আর নাকের মাঝখানে একটা ছোট্টো চারকোণা গোঁফ আছে, যেটাকে বোধ হয় বাটারফ্লাই বলা হয়। আজকাল এ রকম গোঁফ খুব বেশি দেখা যায় না।" সোনার কেল্লার লালমোহন-ও ছিলেন বছর পঁয়তিরিশের। তার ছবিতে দেখা যাচ্ছে তাঁরও ছিল সরু প্রেমের চশমা। প্রসঙ্গত, জটায়ুর বিখ্যাত মোটা ফ্রেমের চশমা তাঁর মুখে পরবর্তী সংযোজন। 

গ্যাংটকে গণ্ডগোলের নিশিকান্ত সরকার

 

আরও পড়ুন
তিনি কি চেয়েছিলেন বিজ্ঞানভিত্তিক গল্প লিখতেই?

আর ওই নিশিকান্তবাবুর বাড়ি দার্জিলিং। তবে কখনো আসেননি গ্যাংটক। এঁর খাবার টেবিলে কাঁটা চামচ দিয়ে সুবিধা করতে না পারলে মুখ দিয়ে বেরিয়ে যায়, "ধুত্তেরি"। আবার একটু বড়ো ইংরাজি শব্দ বলার সময় ইনি একটু আধটু হোঁচট খান। যেমন নেগলিজেন্স বলার সময় নেগ নেগ করে থমকে পুরো কথাটা বলেন। আরেকটি মোক্ষম জটায়ু-গন্ধী শব্দ তিনি বলার আগেই এই নিশিকান্তবাবুর মুখে বসিয়েছিলেন সত্যজিৎ। সেটা হল, "হাইলি সাসপিশাশ"। আর সেখানেও সাসপিশাশ বলতে গিয়ে নিশিকান্ত সাস সাস করে হোঁচট খেতে ভোলে না! এমনকি তাঁর ঘরে হুমকি চিরকুটের কথা বলার সময় "স্বচ্ছন্দে" বলতে গিয়েও "স্বছ" বলে থমকান তিনি। আর এঁর ইংরাজি বলার ধরনটিকে বলা যেতেই পারে, ওই জটায়ুর ভাষারীতি মাফিক। আমি কারো সাতে পাঁচে থাকি না বলতে গিয়ে নিশিকান্ত বলে, "আমি মশাই যাকে বলে, নট ইন সেভেন, নট ইন ফাইভ।" এই ধরনের কত শব্দ গোটা গল্পের ভেতরে ছড়ানো নিশিকান্তবাবুর মুখে। তবে নিশিকান্তবাবুর সঙ্গে লালমোহনবাবুর মূল তফাত তাঁদের সাহসিকতায়। লালমোহন আর যাই হোন ভিতু নন আর নিশিকান্ত বেশ ভিতু। আর তার সেই 'ভিতুমি' দেখে ফেলুদা সম্পর্কে একটা কথা বলে তোপসে। তোপসে বলে, "আমি জানি কাঁদুনে ভিতু লোকেদের ফেলুদা বরদাস্ত করতে পারে না। নিশিকান্তবাবু যদি ওর সিমপ্যাথি পেতে চান, তাহলে ওঁকে কাঁদুনি বন্ধ করতেই হবে।" এই সাহসিকতা ছিল বলেই, লালমোহনকে মগনলাল অর্জুনের সেই ছোরার খেলার কেরামতি দেখালে, ফেলুদা বন্ধুর প্রতি ভালোবাসা থেকে বলে তার সেই বিখ্যাত সংলাপ, "হয় আমি এর প্রতিশোধ নেবো, নয়ত গোয়েন্দাগিরি ছেড়ে দেবো।" 

মজার ব্যাপার হল, ওই তিনকড়ি বা এই নিশিকান্ত, দুজনেরই অন্য একটা গল্প আছে। দুজনেই দুই ভাবে অন্য রকম অপরাধী। অবশ্যই তাদের অপরাধের অ্যাঙ্গেলে একটা টুইস্ট বা মজাদার মোচড় আছে। আর তা কেন আর কীভাবে, সেটা না হয়, পাঠকদের গল্প পড়ার জন্য তোলা রাখাই ভালো। 

আরও পড়ুন
গল্পের শিল্পীরা

শেষমেশ, আচ্ছা, সত্যজিতের গল্পের নামে আর লালমোহনের গল্পের নামেও তো এক আশ্চর্য মিল। জটায়ুর সাহারায় শিহরন, বোর্মিওর বিভীষিকা থেকে সত্যজিতের গ্যাংটকে গণ্ডগোল বা কৈলাসে কেলেঙ্কারি বা বোম্বাইয়ের বোম্বেটে তো নামকরণে সহধর্মী। এক ধরনের অনুপ্রাসে বাঁধা নাম। তাহলে কি, লালমোহনের মজা নিয়েই ফেলুদার গল্পগুলিও তৈরি নয়? শুধু প্রয়োগের তারতম্যে কোনোটা মজার আর কোনোটা জমজমাট!

Powered by Froala Editor

Latest News See More