তিনি কি চেয়েছিলেন বিজ্ঞানভিত্তিক গল্প লিখতেই?

মানিকলমকারি - ২৫
আগের পর্বে

সত্যজিৎ রায়ের গল্পে বারবার ফিরে ফিরে এসেছে শিল্পীদের কথা। প্রথম প্রকাশিত ইংরেজি গল্প ‘অ্যাবস্ট্রাকশন’-এও আছে একজন শিল্পীর কথা। প্রথম দুই গল্পে আধুনিক শিল্পের ধারা সম্পর্কে সত্যজিতের একধরণের কঠোর মনোভাব দেখা যায়। এছাড়াও তাঁর গল্পে উঠে এসেছে ব্যবহারিক শিল্পীদের কথা। ‘সহদেববাবুর পোট্রেট’ গল্পে যেমন পেয়েছি, তেমনই পেয়েছি গগন চৌধুরী, সুখময় সেনের মতো পোট্রেট আঁকিয়েদের। সত্যজিৎ নিজেও ছিলেন একজন ব্যবহারিক শিল্পী। গল্পের মধ্যে দিয়ে যেন খুঁজতে চেয়েছিলেন নিজেকেই।

একটা হিসেব। একটা সজ্জাক্রম। একটু পরপর তথ্যগুলি সাজানো হলেই একটা অন্য ভাবনা পাঠক হিসেবে আপনার মনে না এসে পারবে না। আগে সেই হিসেবটা দাখিল করি, তারপরে তার থেকে যে ভাবনাসূত্রে পৌঁছতে পারি, সেই কথাতে এগোনো যাবে। 

সুভাষ মুখোপাধ্যায়-এর সঙ্গে সত্যজিৎ রায় ১৩৬৮-র বৈশাখে বা ১৯৬১-র এপ্রিলে শুরু করলেন 'সন্দেশ' পত্রিকার নতুন পর্যায়। এই বছরেই তিনি কী কী লিখলেন, তার হিসেবটা বেশ কৌতূহলপ্রদ।
• ১৩৬৮-র আশ্বিন, কার্তিক আর অগ্রহায়ণে তিন কিস্তিতে ধারাবাহিক হল "ব্যোমযাত্রীর ডায়রি"। মানে যেটি প্রফেসর শঙ্কুর প্রথম গল্প।
• ১৩৬৮-র মাঘ মাসে প্রকাশিত হল "বঙ্কুবাবুর বন্ধু"।
• ১৩৬৮-র ফাল্গুন মাসে বের হল "টেরোড্যাকটিলের ডিম"।
• ১৩৬৯-এর বৈশাখ মাসে প্রকাশিত "সেপ্টোপাসের খিদে"।

সত্যজিতের গল্পের নিবিড় পাঠকেপাঠকেরর কাছে অঙ্কটা পরিষ্কার হয়ে গেছে এর মধ্যেই। তার মানে ১৯৬১ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৬২-র এপ্রিল, এই আট মাসের ভেতর মাত্র দুই মাস সত্যজিতের গল্প প্রকাশিত হল না এবং বাকি ছয় মাসেই প্রকাশিত হল তাঁর বিজ্ঞানভিত্তিক গল্পমালা। 

কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যের মুখ্য কয়েকটি উপাদান এই গল্প-চতুষ্টয়ে মিশে আছে। ভিন গ্রহের প্রাণীর সঙ্গে এই পৃথিবীর সম্পর্ক নিয়ে লেখা প্রথম দুটি কাহিনি আর প্রাগৈতিহাসিক সময়কালের গল্পের আভাস তৃতীয় কাহিনিতে এবং চতুর্থ গল্পের বিষয় যেন এই পৃথিবীর-ই না-জানা এক হিংস্র মাংশাসী গাছের উদ্ভিদবিজ্ঞান। 

আরও পড়ুন
গল্পের শিল্পীরা

প্রফেসর শঙ্কু মঙ্গলগ্রহে

 

প্রতিটি গল্পের ভেতরে আছে অন্যতর এক জগতের সঙ্গে পৃথিবীর মানুষের সংঘাতের একটা দিক যেমন, তেমনই আছে তার সঙ্গে যোগাযোগের গল্প। শঙ্কুর প্রথম কাহিনিতে পৃথিবীর মানুষ পৌঁছে যাচ্ছে মঙ্গলগ্রহে আর "বঙ্কুবাবুর বন্ধু" গল্পে পৃথিবীতে এসে পৌঁছচ্ছে ভিন গ্রহের প্রাণী। মঙ্গলগ্রহের প্রাণী সম্পর্কে শঙ্কুর ভাবনা ছিল: "মঙ্গলগ্রহে যে প্রাণী আছে, সে বিষয়ে আমার সন্দেহ নেই। তবে তারা যে কী রকম, ছোটো কি বড়ো, হিংস্র না অহিংস, তা জানি না। একেবারে মানুষের মতো কিছু হবে, সেটাও অসম্ভব বলে মনে হয়। যদি বিদঘুটে কোনো প্রাণী হয়, তাহলে প্রথমটা ভয়ের কারণ হতে পারে।" শেষমেশ, সেখানে যে ধরনের প্রাণী দেখতে পায় শঙ্কু, তার চেহারাটি এই রকম: "সেটা মানুষও নয়, জন্তুও নয়, মাছও নয় কিন্তু তিনের সঙ্গেই কিছু কিছু মিল আছে। লম্বায় তিন হাতের বেশি নয়, পা আছে, কিন্তু হাতের বদলে মাছের মতো ডানা, বিরাট মাথায় মুখজোড়া দন্তহীন হাঁ। ঠিক মাঝখানে প্রকাণ্ড একটা সবুজ চোখ আর সর্বাঙ্গে মাছের মতো আঁশ সকালের রোদে চিকচিক করছে।" এই গল্পে ই আছে আরেক গ্রহের কথা। প্রথমে মঙ্গলগ্রহ ছিল চেনা সৌরজগতের একটি গ্রহ এবার সেখান থেকে চেনা আমাদের সৌর সংসারের বাইরে আমাদের না-জানা টাফা গ্রহে পৌঁছে যায় শঙ্কুর অভিযান। সেখানকার প্রাণীদের চেহারা হল অতিকায় পিঁপড়ের মতো। এবার এখানে এসে পৌঁছয় যে প্রাণী তারা কেমন আর তাদের চেহারাটি কেমন? তারা এসেছে ক্রেনিয়াস গ্রহ থেকে, নাম তাদের অ্যাং, বয়স নাকি তার ৮৩৩। এরা আবার জানায় যে, তারা এখন নিরামিশাষী বলেই তার সামনে উপস্থিত বঙ্কুবাবু বেশ নিরাপদ আর তার চেহারাটি হল: "লিকলিকে শরীরের মাথা বাদে সমস্তটাই গোলাপি পোশাকে ঢাকা"। এই ভিন গ্রহের প্রাণী মনের দিক থেকে আত্মবিশ্বাসী করে দিয়ে যায় স্বভাবের দিক থেকে ভীরু আর কুণ্ঠিত বঙ্কুবাবুকে। এরপরে, বদনবাবুর সঙ্গে যে ভদ্রলোকের দেখা হয়েছিল তিনি সত্যি কথা বললেন, নাকি মিথ্যা বলে চলে গেলেন, সেটা বোঝার উপায় নেই। তবে, তাঁর বলা গল্প আশ্চর্যভাবে বিশ্বাসযোগ্য। বদনবাবুকে ওই আগন্তুক বলে চলে সময়ে ভ্রমণ করার কাহিনি। তিনি প্রাচীন আর আসন্ন যুগে ঘুরে বেড়ান। 

আরও পড়ুন
চারুলতার সময় কথা

বদনবাবুর টাইম ট্রাভেল

 

তাই ভারি অদ্ভুত তাঁর কথা। তাঁকে যখন বলা হয়, তিনি ওইসব জায়গায় গেছেন কিনা, তার উত্তরে তিনি বলেন, ওই জায়গা বলে কোনো কথা হয় না তো। এই জায়গাটরাই ওই সময়ে চলে যাওয়ার ব্যাপারকে কি অন্য জায়গায় যাওয়া বলা চলে!! 

আরও পড়ুন
চারুলতার খেরোর খাতা-৩

নিরীহতম জীব গাছ-ই যে কত ভয়ংকর হয়ে ওঠে তার কাহিনি সেপ্টোপাসের খিদে। গল্প বলার আসল মজাটা হল, প্রকৃতিতে মাংশাসী নানা গাছের কথা বলতে বলতে সেপ্টোপাসের কথায় পৌঁছোনো আর তার আক্রমণের কথা বলায়। বিজ্ঞানভিত্তিক গল্পে তাহলে বিপদের ভয়, শুধু ভীনগ্রহী থেকে নয়, এই গ্রহের নিরীহতম জীব, গাছও, বিপদ ঘটাতে পারে। আবার উল্টোদিকে বঙ্কুবাবুর মতো মানুষকে সাহায্য করতে পারে, তাঁকে তাঁর মনের জোর ফিরিয়েও দিতে পারে কোনো এক ভিনগ্রহী প্রাণীও। 

ভয়ংকর গাছ সপ্তপাশ

 

আরও পড়ুন
চারুলতার খেরোর খাতা-২

এই ধরনের কাহিনিতে আবার এটাও দেখার যে, প্রতিটি গল্পেরই মূল চরিত্রেও বেশ মিল আছে। সকলেই বেশ শান্তশিষ্ট নিরীহ মানুষ। "বঙ্কুবাবুর বন্ধু" গল্পের বঙ্কুবাবু, "টেরোড্যাকটিলের ডিম" গল্পের বদনবাবু আর "সেপ্টোপাসের খিদে" গল্পের অধ্যাপক কান্তিবাবু--- সকলেই একেবারে সাতে-পাঁচে না-থাকা বাঙালি। আর প্রফেসর শঙ্কুর প্রথম চেহারাটিও তো বেশ সাদাসিধেই ছিল। তাঁর সেই অর্থে সপ্রতিভ ধরনটিকে তো লেখক সত্যজিৎ পরে যুক্ত করেন। 

আসলে সত্যজিতের গল্পলেখার ওই প্রথম অধ্যায়ে তিনি বোধ করি, বিজ্ঞান আর কল্পবিজ্ঞান ভিত্তিক গল্পের ব্যাপারেই বেশি আগ্রহী ছিলেন। তারপর আস্তে আস্তে তিনি নানা রকম গল্প বলার নতুন এক পর্ব শুরু করলেন এবং সেই ধারার শুরু হল, "অনাথবাবুর ভয়" গল্প থেকে। এই নানা ধরনের গল্পমালাতেই পরে যুক্ত হবে আরেকটি নাম, কারণ,
সেখান থেকেই পরে জন্ম নেবে ফেলুদার গল্প। 

একেবারে শেষে লক্ষণীয় আরেকটি বিষয়। এইসমস্ত গল্পমালার বেশ কিছু পরে ১৩৬৯-এর পুজোর সময় তিনি লিখেছেন "সদানন্দের খুদে জগৎ"। ভেবে দেখুন এটাও কি আরেকভাবে বিজ্ঞানভিত্তিক এক গল্পের আদলটাই নয়? কারণ, এ যেন খুদে সদানন্দের দৃষ্টিকোণে প্রাণিবিদ্যা চর্চার এক নতুন পাঠ। পিঁপড়ের জীবন ও তাদের সমস্ত ধরনের কারিগরি সক্ষমতার না-জানা কাহিনি নিয়েই তো লেখা এক আখ্যান।

Powered by Froala Editor