গল্প-ছবির স্বল্প-ভূগোল

মানিকলমকারি - ৩০
আগের পর্বে

অলঙ্করণশিল্পী সত্যজিৎ রায় যেন নিজেই তৈরি করে নিয়েছিলেন একটি ঘরানা। আর সেই ঘরানা হল অল্প রেখায় ছবির পরিবেশ রচনা করা। প্রথমদিকে অবশ্য সমস্ত পরিবেশ খুঁটিয়েই আঁকতেন তিনি। ঠিক যেমন এঁকেছেন ‘বঙ্কুবাবুর বন্ধু’ গল্পের বিখ্যাত ছবিতে। তবে এরপর সেই ধরণ বদলে যায়। ‘টেরোড্যাকটিলের ডিম’ গল্পে যেমন একটি বেঞ্চ এঁকেই বুঝিয়ে দিয়েছেন সেটি পার্কের দৃশ্য। কোথাও কোনো গাছ আঁকেননি। আবার ‘দুই ম্যাজিশিয়ান’ এবং ‘ফার্স্টক্লাস কামরা’ গল্পের দুটি অলঙ্করণে সামান্য রেখাতেই বুঝিয়ে দিয়েছেন প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর কামরার পার্থক্য। একইভাবে তিনি এঁকেছেন নিজের শৈশবের প্রতিকৃতিও।

কে না জানে, ফেলুদার গোয়েন্দাগিরির সঙ্গে যুক্ত নানা জায়গার মানচিত্র আর সেই এক এক জায়গার এক এক গল্পের সঙ্গেই যুক্ত হয়ে থাকে সেই-সেই গল্পের ছবি। এক একটা গল্প সরে যায় এক এক জায়গা থেকে আরো এক-এক জায়গাতে। গল্প তো সরে যায়, কিন্তু ছবির কলমকারিতে কীভাবে আর কতভাবে তৈরি হয়ে যায় এক একটা জায়গার ছবি সেটা কি চোখে পড়ে আমাদের? ধরা যাক, ‘ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি’ আর ‘ভূস্বর্গ ভয়ংকর’ গল্পের অলংকরণ। ছবির পটভূমি দার্জিলিং আর কাশ্মীর বলে, তার সঙ্গে আঁকা ছবিগুলিতে রয়েছে অসংখ্য বিন্দু-বিন্দুর সমাহার। এমনভাবে সেই বিন্দুগুলি বসানো যে, দেখলেই বোঝা যাবে, সেটা দিয়ে শিল্পী তৈরি করে দিয়েছেন দার্জিলিঙের কুয়াশার ছায়াচ্ছন্নতার ইমেজারি। কুয়াশার ছবি আঁকার এই রকম তিনটে ধরন লক্ষ করা যাবে ফেলুদার তিনটে গল্পে। কাহিনির পটভূমি গ্যাংটক হলে, সেখানে ঘন কুয়াশা আঁকা হয় ধূসর একটা বর্ণলেপ দিয়ে আবার বেশ অনেকদিন পরে, আবার ‘দার্জিলিং জমজমাট’ কাহিনিতে পুরো ছবি এঁকে মাঝখানের কিছুটা অংশ মুছে দিয়ে শিল্পী সত্যজিৎ তৈরি করেন কুয়াশার ছবি। এই ছায়াচ্ছন্ন কুয়াশার ছবির ঠিক উল্টো হল চোখ-ধাঁধানো আলো-আঁধারির খেলা। সেই চোখ-ধাঁধানো আলো-আঁধারি দেখা যায় রাজস্থানে। তাই সেই পটভূমিতে আঁকা ‘সোনার কেল্লা’র সব ছবিতেই শুধু গাঢ় কালোর পাশে উজ্জ্বল সাদাতে আঁকা সব ছবি। কোথাও কোনো ধূসর অংশ যেন নেই। সবটাই কালো আর সাদা, যেন ছবিটাই রাজস্থানের মতো। শুধু ঝলমলে চোখ-ঝলসানো রোদ আর তার ছায়া।

 সেই পটভূমি জঙ্গলের আর হয়ে গেল যখন আর যখন সেই গল্পের মাঝখানে থাকে বাঘের আঁচড়ের কথা? তখন সেই গল্পের ছবি জুড়ে শুধু অসংখ্য বাঘের আঁচড়ের রেখা। ফেলুদা-ফ্যানকুলকে বলা বাহুল্য, গল্পের নাম ‘রয়েল বেঙ্গল রহস্য’। কার না মনে আছে, সেখানে আঁকা সব ছবিতেই ছিল কলমে টানা সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম প্রচুর ছোটো ছোটো আঁচড়ের দাগ। সেই দাগের ভেতর থেকেই যেন আঁকা হচ্ছে ছবি।

এইবার ধরা যাক, গল্পের সঙ্গে যেমন ঠিক জুড়ে থাকে সেই গল্পের পটভূমি, ছবিতেও তা-ই। ধরা যাক, ‘বাদশাহী আংটি’-র কথা। এই গল্পের মূল পটভূমি লখনউ বলেই সেখানকার ছবিতে থাকে টাঙ্গার ছবি আর মূল পটভূমি লখনউ হলেও, মাঝে একটু সময়ের জন্য ফেলুদা তোপসে হরিদ্বার যেতেই গল্পের বইতে নবম পরিচ্ছেদের প্রথমেই আঁকা হল হরিদ্বারের ঘাটের ছবি। ঠিক সেইভাবেই কাহিনি যখন কাঠমাণ্ডুতে, তখন কোথাও থাকে বিখ্যাত কালভৈরবের দেওয়ালচিত্র আর কোথাও থাকে গলিঘুঁজির ফাঁক থেকেও দেখতে-পাওয়া প্যাগোডা-র কোণা। ওই যুক্তিতেই ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ গল্পের তিনটে ছবিতে তিনভাবে ধরা আছে কাশীর ভূগোলচিত্র। এক, মছলিবাবার গঙ্গার ঘাটে উঠে আসার ছবিতে গঙ্গার শান-বাঁধানো ঘাট আর সেখান থেকে দেখতে-পাওয়া কাশীর ঘাটের বিখ্যাত ছাতার ছবি। দুই, মগনলালের ঘাটে আসার ছবিতে বিখ্যাত বজরার ছবি আর তিন নম্বর হল, সেই যে ছবিতে আছে বাড়ির ছাদ থেকে রুকুর ঝুলতে থাকার প্রসঙ্গ, সেখানেও দর্শকের চোখ এড়িয়ে যায় না, অনেক দূরে যেন দেখা যাচ্ছে বিশ্বনাথের মন্দিরের চুড়ো। বারানসির পটভূমিকাতে ফেলুদার আরেকটা গল্প ছিল ‘গোলাপী মুক্তা রহস্য’। সেখানেও একটি বিশেষ অভিযান-ওয়ালা রাতের দৃশ্যে ফেলুদা-ত্রয়ীর ছবির ঠিক পিছনে সত্যজিৎ এঁকেছিলেন কাশীর বিশ্বনাথ মন্দিরের ছবি। কিংবা ‘এবার কাণ্ড কেদারনাথ’-এর একটি ছবিতে এই বিশেষ আঁকার ধরনটি মেনেই ঠিক একধারে শিল্পীর রেখায় সত্যজিৎ রেখেছেন কেদারনাথ মন্দিরের চূড়ার এক টুকরো ছবি।   

মনে আছে, ‘গোরস্থানে সাবধানে’ উপন্যাসের চিত্রমালা? মনে করে দেখবেন, গোরস্থানের যতগুলো ছবি সেখানে আছে, তার সব কটিতেই আছে গোরস্থানের নানা রকম রেফারেন্স। প্রতিটি ছবিতেই কোনো না কোনো প্রান্তে দেখা যাবেই যাবে গোরস্থানের স্তম্ভগুলির একটা না একটা দৃশ্যগত টুকরো।

আরও পড়ুন
অল্প রেখার গল্প

শেষে চোখ রাখা যাক ফেলুদার প্রচ্ছদের ছবিগুলোতে। ‘সোনার কেল্লা’র এখনকার প্রচ্ছদে তো সরাসরি সোনার কেল্লার সিনেমা থেকে বসানো ছবিই আছে। কিন্তু তার আগের প্রচ্ছদেও ছিল কেল্লার ছবি। ঠিক সেইভাবেই ‘ছিন্নমস্তার অভিশাপ’, ‘যত কাণ্ড কাঠমাণ্ডুতে’ আর ‘কৈলাসে কেলেঙ্কারি’-র তিনটি কভারেরও একেবারে পিছনে দেখা যাচ্ছে ছিন্নমস্তা মন্দির, কাঠমাণ্ডুর প্যাগোডা আর ইলোরার কৈলাস মন্দিরের রেখাচিত্র। ‘গোরস্থানে সাবধান’-এর প্রচ্ছদ তো গোরস্থানের পটভূমিতেই আঁকা আর ‘বাদশাহী আংটি’র অসামান্য প্রচ্ছদে দেখা যায় অনেক দূরে লখনউয়ের রুমি দরওয়াজা।

সত্যজিতের ফেলুদার বইয়ের প্রচ্ছদ ও অলংকরণ অঙ্কনের এটাই আসলে একটা ধরন। গল্পের পটভূমিকে কোনো না কোনো দৃষ্টিকোণে ব্যবহার করেন। নিজেই স্থির করেন প্রতিটি ভূখণ্ডের এক-একটি ল্যান্ডমার্ক আর সেই ভূমি-চিহ্নকে নিপুণভাবে বুনে রাখেন কখনো প্রচ্ছদে আবার কখনো অলংকরণে। নিজেই আবার কখনো স্থির করেন এক-একটি কাহিনির এক-একটি মেজাজ-মর্জি আর তারপরে সেই মেজাজেই রচনা করেন ছবির শিল্প আঙ্গিক। সাধারণভাবে একটি গোয়েন্দা-গল্পের ছবি মূলত ঘটনাপ্রধান। ঘটনার প্রাধান্য আর মুখ্যত ঘটনার নানা অ্যাকশনই সাধারণত চিত্রিত হয় অলংকরণশিল্পীর কলমকারিতে। কিন্তু যে-অলংকরণের কলমকারি সত্যজিতের হাতে, সেখানে তো ছবির ঘটনার ঘনঘটার সঙ্গেই জুড়ে থাকবে গল্পের ভূগোল ইতিহাসের মনমর্জি।

আরও পড়ুন
জটায়ুর দাদারা

Powered by Froala Editor